বছর চার-পাঁচেক আগের কথা। পায়ের অপারেশনের পর বার দুয়েক UTI হল। শেষমেষ এমন অবস্থা হল যে Multidrug resistance UTI ধরা পড়ল। ফরহাত মহল ম্যাডামের চিকিৎসাধীন ছিলাম। ম্যাডাম Urine C/S করতে দিলেন। রিপোর্ট দেখাতে গিয়ে ম্যাডামকে পেলামনা। শুনলাম আউটডোরে ম্যাডামের পরিবর্তে আরেকজন বসছেন। হতাশমনে অগত্যা তার কাছেই গেলাম। সেইদিন প্রথম চিনলাম ও জানলাম পারভীন ম্যাডামকে। সুন্দর ও হাসিমুখের মানুষটি তার কথা দিয়েই আমাকে মুগ্ধ করলেন। আমাকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেন, “বাবা,তোমার তো সব ইঞ্জেক্টেবল অ্যান্টিবায়োটিক Sensitive আসছে। এগুলো নিতে হলে তোমাকে ভর্তি হতে হবে বা অনেক কষ্ট হবে। তুমি বরং টেস্টটা রিপিট করাও।” তার কথাতেই আবার Urine C/S করতে দিলাম, চিকিৎসা করালাম এবং আজ অবধি আর কোনদিন ঐ অসুখে পড়িনি। তার কয়েক বছর ম্যাডামকে কাছে থেকে দেখলাম যখন গাইনী ওয়ার্ড করতে গেলাম। কিন্তু এ কী পরিবর্তন? জানতে পারলাম ম্যাডামের স্তন ক্যান্সার হয়েছে কিছুদিন আগে। ভয়াবহ কেমো সৌন্দর্যের অনেকখানি কেড়ে নিলেও কেড়ে নিতে পারেনি মুখের হাসিটুকু আর সুন্দর করে কথা বলার ক্ষমতা। হায়! নির্দয় বিধাতা বুঝি এমন করেই ভাল মানুষগুলোকে পরীক্ষা করেন! ম্যাডামের সংস্পর্শে দিনদিন আমাদের মুগ্ধতা বেড়েই চলল। এক সময় এমন হল আমার পরিচিত যার গাইনীর কোন সমস্যার কথা আমাকে বলত তাকেই রেফার করা শুরু করলাম পারভীন ম্যাডামের কাছে। আমার প্রচন্ড খুতখুতে ছোটখালা ম্যাডামের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। চেম্বারের বাইরে মাসী আমাকে ভেতরে পাঠাতে একটু দেরি করলে ম্যাডাম উথে বলতেন, “তোমাকে না বললাম আমার মেয়েটাকে আগে পাঠাতে!” আমার যে বান্ধবীর Chronic cervicitis দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় ভাল হচ্ছিলনা তাকেও পাঠালাম ম্যাডামের কাছে। তাকে শুধু সুস্থ করেই ম্যাডাম ক্ষান্ত হলেন না, দিয়ে দিলেন জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ভ্যাকসিন সাথে নিয়মিত ফলোআপ। নিজের ব্যক্তিগত নাম্বারটা পর্যন্ত তাকে দিলেন কোন সমস্যা হলে যোগাযোগ করতে। শুধু ভাল চিকিৎসা দিয়ে রোগীদের মন ভরেনা তা ডাক্তার হবার অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি। আর তার বাস্তব প্রতিফলন দেখলাম পারভীন ম্যাডামকে দিয়ে। একসময় আমার বান্ধবীরা বলত একইভাবে হিজাব করার কারণে আমাকে নাকি অনেকটা পারভীন ম্যাডামের মত লাগে, কথা বলার ঢংয়ের মধ্যেও নাকি অনেকটা মিল। উনি নাকি আমার বড়বোন হন কোন এককালের। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে খুব খুশি হতাম। কে না খুশি হবে এমন বড়বোন পেলে!
গতকাল শুনতে পেলাম ম্যাডামের নাকি ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে পুরো শরীরে এমনকি লিভারেও। একটু সময়ের জন্যে পুরো চিন্তা-ভাবনা থমকে গেল। আরও শুনলাম গাইনীতে যারা ইন্টার্ন ডাক্তার আছে তারা সবাই ভাবছে ম্যাডামের পাশে দাঁড়ানোর কথা। নিজের ভেতর থেকেই প্রচন্ড রকমের তাগিদ অনুভব করলাম আমার বড়বোন সুলভ শিক্ষকের পাশে দাঁড়ানোর। আজ মাসের ৬ তারিখ, কিছুদিন পরেই ইন্টার্নীর ২য় মাসের টাকা আমাদের সবার হাতে আসবে। কেন আমরা তার মধ্যে থেকে কিছু টাকা এই সুন্দর, হাসিখুশি মানুষটার জন্যে তুলে দিতে পারবনা? আমি জানি আমার ৫০০, ১০০০ কিংবা পুরো বেতনের ১০,০০০ টাকা ক্যান্সারের বিশাল চিকিৎসার কাছে কিছুই না। তবুতো এতটুকু তৃপ্তি একজন মানুষ হিসেবে, একজন ছাত্রী হিসেবে আমি পাব যে আমি দাঁড়িয়েছি একজন সত্যিকার ভাল ডাক্তার, শিক্ষক সর্বোপরি একজন সত্যিকার ভাল মানুষের পাশে!
একান্তই ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে আজ আমার লিখতে বসা। তবে এটুকু নিশ্চিত আমার এ অনুভূতি আর সবার মধ্যেও ভিন্ন নয়। যদি নর্থ ইস্টের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী, ইন্টার্ন ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে নার্স, ওয়ার্ড বয়, আয়া পর্যন্ত সবার হাতে একটি চিরকুট আর কলম তুলে দেয়া হয় এবং বলা হয় পারভীন ম্যাডাম সম্পর্কে সামান্য কিছু লিখতে এর থেকে ভিন্ন কেউ লিখবেনা। হয়তোবা কারও চিরকুটও খুব ছোট হয়ে যাবে তাকে নিয়ে লিখতে গেলে। কারণ আমি বিশ্বাস করি যে ভাল সে সবার কাছেই ভাল। কারো কাছে উত্তম, কারো কাছে অধিকতর, কারো কাছে সর্বোত্তম। জীবনে বহু দক্ষ ডাক্তার দেখেছি কিন্তু খুব আন্তরিক ও অমায়িক ডাক্তার দেখেছি হাতে গোণা। সেই দিক থেকে পারভীন ম্যাডাম আমার চোখে সর্বোত্তম। আমার এই লেখা আমার সেইসব সহকর্মীদের প্রতি যারা আমার মতই ম্যাডামের এক সময়ের ছাত্র-ছাত্রী, আমরা সবাই মিলে কি পারিনা আমাদের অতি প্রিয় এই মানুষটার পাশে একটু দাঁড়াতে? আমি নিশ্চিত এতে আমাদের কারও ঈদের আনন্দ বিন্দুমাত্র কমবেনা, পরবর্তী মাস খুব কষ্টে কাটবেনা। শুনেছি বাবা-মা ও শিক্ষকের ঋণ কখনও শোধ হবার নয়। তবু কি আমরা একটু চেষ্টা করতে পারবনা? যে মানুষটা আজ এতদিন ধরে এই ঘাতক ব্যধির সাথে সাহসের সাথে লড়াই করে আসছেন তার পাশে দাঁড়ানো তো মানবতার প্রতি সম্মান, শিক্ষকের দাবিতো বলাবাহুল্য। আর আমার লেখার সেইসব অগণিত পাঠকের প্রতি আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ আপনারা একটু দোয়া করবেন শুধুমাত্র একজন নিবেদিতপ্রাণ ডাক্তারের জন্যেই নয় বরং একটি হাসিমুখের প্রত্যাবর্তনের জন্যে। ইট-কাঠ-পাথরের এই যান্ত্রিক জীবনে যে বড়ই প্রয়োজন একটি হাসিমুখের, কিছু সুন্দর কথার...