গাইনী ওয়ার্ড প্রায় শেষ হবার পথে। শহরের অদূরে হাসপাতাল হলেও এই অঞ্চলের মানুষের মন-মানসিকতা খুব উন্নত না। অধিকাংশ গর্ভবতী মহিলা বাড়িতে টানা-হেঁচড়ার পর শেষ মূহুর্তে এসে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তার চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপারটা হল এরা শুধুমাত্র Ultrasonography করায়। আর কোন পরীক্ষা করানোর প্রয়োজনবোধ মনে হয় তারা করেনা। কারণ এই একটি পরীক্ষার মাধ্যমে সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে তা জানা যায়। আর তার উপর ভিত্তি করেই হয়তো তাদের সন্তান জন্মদানের বাজেটও নির্ধারণ হয়ে যায়। ছেলে বংশের প্রদীপ, তাকেতো হাসপাতালে ডেলিভারী করাতেই হবে, যত টাকা লাগুক! ভীষণ কষ্ট হয় যখন দেখি মেয়েসন্তান হয়েছে দেখে অনেক বাবা-মায়ের মুখ অন্ধকার হয়ে যায় আর আত্মীয়-স্বজনদের কথা নাহয় বাদই দিলাম। এ যেন মাছের মায়ের পুত্রশোক! মুসলিম হিসেবে আমরা এতটাই নিকৃষ্ট যে আমরা ভুলে যাই আল্লাহ একটা সুস্থ-স্বাভাবিক বাচ্চা দান করেছেন আর একটা সুস্থ-স্বাভাবিক বাচ্চা অনেক বড় নিয়ামত। আমরা শোকর গুজার করিনা। এতো গেল পুত্র-কন্যা কাহিনী। এ কাহিনীর সূত্রপাত সেই ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বা অন্ধকার যুগ থেকে এবং তা কেয়ামত পর্যন্ত চলবে। কারণ আমরা দিন দিন নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর হচ্ছি মানুষ হিসেবে, মুসলিম হিসেবে!
যে নারী কখনও মাতৃত্বের স্বাদ পায়নি সে হয়তো পৃথিবীর সবচে দুর্ভাগা নারী। তারপরও কত নারী শত সাধনার এই সন্তান গর্ভেই নষ্ট করে দেয় বা করে দিতে আসে। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি এরাই বুঝি মায়ের জাত! অঙ্কুরের মায়া বুঝি এত সহজেই ছেড়ে দেয়া যায়! ছোট্ট একটা মাংসপিন্ডের জন্যে আমাদের কতই না খারাপ লাগে আর তারাতো মা!
আমার জন্মের পর আমার এক দুঃসম্পর্কের চাচা, যিনি একজন স্কুল মাস্টার, আমার বাবাকে বলেছিলেন আরেকটা বিয়ে করতে ছেলে সন্তানের জন্যে। সেই চাচার সাথে আজও মন খুলে কথা বলতে বাঁধে আমার। আমার বিবেকবান পিতা আরেকটা বিয়ে করেননি। আমার প্রাণপ্রিয় বাবা-মা আমাকে অঙ্কুরেই নষ্ট করে দেননি। আর তাই বলেই আমি আজ একজন ডাক্তার। আল্লাহ তাআলার অশেষ দয়ায় আমি ত্রুটিমুক্ত সম্পূর্ণ একজন মানুষ। আমি মেয়ে, আমি ঘরের লক্ষ্মী, আমি শত সহস্র প্রাণের সেবাদাত্রী। আল্লাহর পর যদি কাউকে ইবাদাতের সুযোগ থাকত তবে আমি আমার বাবা-মাকেই করতাম। অঙ্কুরের মায়া তাদের মধ্যে দেখেছি বলেই আজ বৃক্ষ হয়েও তা টের পাই!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৫৭