ঐ তিতকুটে ধোঁয়ার মধ্যে কিসের আনন্দ?
তা জানি না এখনও। তবে হ্যাঁ, আগুনকে বৃত্তাকার ক্ষেত্রফলে বশ করার মধ্যে আলাদা একটা শান্তি আছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস পোড়ানো থেকে শুরু করে আফ্রিকান জঙ্গলের দাবানলে ধ্বংস করে দেয়া আসামীকে ঠোঁটের আগায় নিয়ে বাধ্য ছেলের মত শাসন করার কৃতিত্বকে তো আর ছোট করে দেখা যায় না।
ধারণা ছিল, থার্ড ইয়ারে ক্লাস না করার রেকর্ড ফাইনাল ইয়ারে ভাঙতে পারবো না। কিন্তু রেকর্ড ভাঙার দিকে এগোতে এগোতে নতুন আরেক রেকর্ড করে বসলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং থার্ড ইয়ার পর্যন্ত আমার ফুসফুসদ্বয়ের পোড়ানো সিগারেটের সংখ্যা ছিল সর্বসাকুল্যে চার কি পাঁচ। আর সেই সংখ্যাটা পার হওয়া এখন আমার দুইদিনের মামলা।
এই বস্তুটা খুব আস্তে আস্তে পুড়িয়ে মারে, ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর চোখের মেয়েটার মত অনেকটা।
আর বাতাসটা বুক পর্যন্ত একবার গেলেই হল, সে ভারী মিশুক। তাই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিকোটিন সাহেবশুদ্ধ ব্রেইনে গিয়ে হাজির হয় সে। আর ওখানে গিয়েই শুরু হয় নিউরোট্রান্সমিটারের আসল খেলা।
তবে যাইহোক, একবিংশ শতাব্দীর চুম্বন, আগ্রহী সঙ্গী কিংবা সঙ্গিনীর ঠোঁটের জন্য ক্ষতিকর না হলেও, কাগজে মোড়ানো তামাকটুকুর জন্য কেয়ামতের ফুৎকারের মতই। আমার প্রতিটা সহজ-সরল নিঃশ্বাস ক্রমাগত তার আয়ু কেড়ে নিতে থাকে। আর সেলুলোজের ফিল্টার, ঠোঁট-মুখ আর শ্বাসনালী পার হয়ে অসহায় সেই সিগারেটের প্রতিটা দীর্ঘশ্বাস আমি আবার নিজের ভিতরে ফিরিয়ে নেই প্রতি মুহূর্তে।
আর আমার দীর্ঘশ্বাসগুলো কোথায় যায় জানেন?
আমি বিশ্বাস করি ওগুলো ছাই হয়ে পড়ে যায় নিচে। নাহলে শার্টের গায়ে এক কণা রাস্তার ধুলা কিংবা খুশকির মিশে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকে।
তবে আমার অন্য সব বিশ্বাসের মত এটাও অনেকটা ছেলেমানুষীই বলা যায়।
সেদিন চোখে অন্ধকার দেখলাম হঠাৎ করে।
ধূমায়িত আড্ডায় অন্য সব প্রফেশনাল স্মোকার বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হাতে সিলিন্ডারাকৃতির সেই ‘মহার্ঘ্য’ বস্তুটা। কি মনে করে একবার আমার অপরিপক্ক নাদান-ফুসফুসে টেনে নিলাম পুরো বাতাসটা। আর যায় কোথায়!! নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়ার সমবেগে ছুটলো চোখের পানি। তারপর কাশি আটকে রাখতে গিয়েই বেগ পেতে হলো খানিকক্ষণ। তা-ও দাঁড়িয়ে থাকলাম পা শক্ত করে, হাসিমুখে। আমার নাটকের বিরাট স্ক্রিপ্টে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকার অংশটুকু পার হয়ে গেলাম সুন্দর করেই।
সত্যি বলতে কি, সবকিছু পুড়তে পুড়তে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছি দেড়বছর ধরে, হাসিমুখেই ছিলাম বেশিরভাগ সময়, এখনও আছি। তাই এইটুকুতে আর কি হবে।
তবে একটা ব্যাপার হলো, আমি জানি যে নিকোটিনের তৃষ্ণা আমাকে কখনও কাতর করবে না। আমার ধমনীর অ্যাড্রেনালিন আমার কথায় চলে না এটা যেমন সত্যি, তেমনি পাঁচ-দশ টাকার তামাক-দণ্ডের আদেশে চলে না, এটা তারচেয়েও বড় সত্যি।
বরং আমার জীবনে অনেক সুন্দর একটা নেশা আছে।
একজনের চোখ আমাকে আফিমের চেয়ে মাতাল করে। বেসূরো কয়েকটা গানের এলোমেলো লাইন আমাকে অপূর্ব ইউফোরিয়ায় আচ্ছন্ন করে রাখে। রিকশার সিটে কোনও একজনের সাথে দূরত্বের মাইনাস ব্যবধান এখনও আমার জন্য অজস্র এলএসডির হেলুসিনেশন।
কিভাবে সেই মেয়েটাকে আমি অপমান করবো এসব সস্তা নেশায়??
আচ্ছা, মানুষের স্বপ্নকে কি বায়বীয় বলা যায়? আমি আমার স্বপ্নগুলোকে বায়বীয় প্রশ্বাসে উড়িয়ে দিতাম তাহলে। তারপর বাস্তব ফিজিক্সের সূত্রেই একটা মেঘ বানিয়ে ফেলতাম আমার স্বপ্ন দিয়ে একসময়!!
কয় প্যাকেট মার্লবোরো কিংবা বেনসন লাগবে একটা মেঘের জন্য? দশ-বিশ-তিরিশ? নাকি আরো বেশি?? কতটুকু বায়বীয়-স্বপ্ন জমাট বাঁধলে সেই মেঘ বৃষ্টি নামাতে পারবে?
ক্যালকুলেটরে হিসাব করে আমার স্বপ্নের বর্ষার জন্য বসে থাকতাম তাহলে। মেয়েটা হয়তো ভিজবে আরেকজনের সাথে, তা ভিজুক। আমার বায়বীয়-স্বপ্নের বর্ষার জন্য ঐটুকু হলেই চলবে।