somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিউলি-কাব্যের বাংলো

০৯ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১২:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্কয়ার-ফিট আর মাপা আর্কিটেকচারে বন্দী ঢাকা শহরে আমাদের বাসাটা আসলেই অন্যরকম সুন্দর।
এখানে প্রথম বেড়াতে আসি দশ-বারো বছর আগে। আম্মার খুবই পছন্দ হলো বাসাটা, যাওয়ার সময় আস্তে করে আব্বাকে বললো, তুমি পারবা না এখানে উঠতে??

অনেক অনেক উপরে কেউ একজন নোট করে রাখলো বোধ হয় চাওয়াটা তখনই।
তারপর আমি যখন নটরডেমের সেকেন্ড ইয়ারে, আব্বার প্রোমোশনের পর এই বাসায় উঠি আমরা।
বিশাল বড় দোতলা বাংলো। আর আমরা মাত্র তিনজন। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা কিংবা এ-ঘর ও-ঘর করতেই ক্লান্ত হয়ে যেতাম প্রথমদিকে।

অদ্ভুত খোলামেলা আমাদের এই বাসা। পেছনের দিকে বড় একটা অংশ গাছপালায় ভর্তি। আম-কাঁঠালের সময় বাসার নিচতলা রীতিমত গোডাউন হয়ে থাকে। জাম, জামরুল, বড়ই, পেঁপে এসব খেয়েও কখনই শেষ করতে পারি না। গাছ থেকে মোচাভর্তি কলা পেড়ে খাওয়ার অভিজ্ঞতাও আমাদের এই বাসাতেই প্রথম হয়।
তবে কামরাঙ্গাগুলো আমাদের কপালে জোটে না প্রায় কখনই। কয়েকটা টিয়া এসে খেয়ে যায় নিয়মিত। তবে নিমন্ত্রণটা অবশ্য আমরাই বজায় রেখেছি এখনও। ঐ কামরাঙ্গা গাছ তাই ওদের জন্যই বরাদ্দ।

মন খারাপ থাকলে আমি রাত এগারোটা-বারোটার দিকে বের হয়ে যাই বাসার সামনে। বেজিগুলার লাফঝাঁপ দেখি কিংবা আমাদের ছাগল-পরিবারকে ডাকাডাকি, গুতাগুতি করি। পিঙ্কু, গুপি, বাঘা, সাহেব, গিলটি, হনুমান; এদের নিয়ে আমাদের ছাগল পরিবার।

শিউলি আর হাস্নাহেনা ফুলের কম্বিনেশনে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গন্ধটা এই বাসাতেই প্রথম পাওয়া শুরু করি আমি। আর এতদিনের আড়াল থেকে চাঁদটাও ফিরে আসলো আমাদের লম্বা বারান্দায়, কিংবা বাসার সামনের খোলা অংশে।

গভীর রাতে বৃষ্টি হলে আমি, আব্বা আর আম্মা; তিনজন বারান্দায় বর্ষাবিলাস করি। আর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুরা আসলে নিচতলায় অসম্ভব সুন্দর আড্ডা কিংবা মুভি নাইটের আসর তো ছিলোই।

এই বাসা ছেড়ে দিতে হবে এবার।
সন্ধ্যায় মন খারাপ করে বাসা দেখতে বের হই আমরা, সবগুলো বাসাকে পাখির খোপের মত মনে হয়। আর নাহলে বিরাট অঙ্কের একেকটা অর্থনৈতিক সংখ্যা অর্থপূর্ণ কটাক্ষ করে ফিরিয়ে দেয় আমাদের।।

আমার গোপন শিউলি-বিলাস কিংবা বার্বিকিউ-পার্টিগুলো অনেক মিস করবো। বিরাট বারান্দায় পায়চারি করতে করতে মাথার উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা গুলো নতুন যান্ত্রিক বাসায় আর আসবে কিনা সেটাই বা কে জানে।

তবে যেখানেই যাই, এই বাসাটা মনে থাকবে সারাজীবন। ঢাকার মধ্যে রাতদিন এত আয়েশ করে সবুজ দেখার আনন্দটা মনে থাকবে সবসময়। সেই সাথে আমার জীবনের অনেকগুলো খারাপ সময়ও এখানেই কাটানো। গাছগুলো আমার কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমৃদ্ধ গভীর নিঃশ্বাসগুলো নিজেদের শরীরে টেনে এখনও আমাকে শান্ত করে প্রতিদিন। মোবাইল কানে নিয়ে বাসার সামনে এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হাঁটি। হাসি-কান্না কিংবা গোপন কথাগুলো ভাগ করি ফোনের ঐপাশের রহস্যময় কিংবা অবুঝ কারো সাথে।


শিউলি ফুলের কাহিনী বলে শেষ করি লেখাটা।
বাসার সামনে একটা শিউলি ফুলের গাছ আছে আমাদের। এই ফুলটা শরৎকালের একান্ত নিজের। সারাদিনের আকাশ-বাতাস থেকে প্রাণশক্তি নিয়ে, সন্ধ্যার পর থেকেই প্রতিটা ফুল নিজের কোমল শরীর নিয়ে ফুটে ওঠে। তারপর রাতের অন্ধকারের সাথে খুনসুটি সেরে ভোরের আলো ফুটতে ফুটতেই ঝরে পড়ে।

নজরুলের শিউলিমালা গল্পে বিদায়বেলায় চৌধুরী সাহেবের মেয়ে শিউলি আজহারকে বলে, সে যেন প্রতিবছর আশ্বিনের প্রথম দিনটায় তার কথা ভেবে শিউলি ফুলের মালা জলে ভাসিয়ে দেয়। রাজী হয় ছেলেটা। প্রতিবার আশ্বিনের প্রথম দিনে নদীতে তার ভালো লাগার এই আবেগটুকু সমর্পণ করে।

যে মেয়েটার সাইকোলজিকাল কলাকৌশল, গত তিনবছর ধরেই আমার কার্ডিওলজিকাল বৈকল্যের কারণ, সে অবশ্য এত চমৎকার অনুরোধ করে আমাকে সপ্ত-আসমানে চড়ানোর মেয়ে না। বরং আমার সেন্টিমেন্ট অকপটে বিলিয়ে আমি নিজেই ভেসে যাই, আর সে নিরাপদ উচ্চতায় উড়তে থাকে সবসময়।

যাইহোক, তবুও বলি, আমার ইচ্ছাটা খুব ছোট্ট ছিলো। শরতের কোনও এক সকালে ওকে দাঁড় করাবো আমাদের শিউলি গাছটার সামনে। কারণ কনক্রিটের উপর সেই সময় হেলে পড়া শিউলি গাছ তার ছোট ছোট অসংখ্য ফুলে সাদা-কমলার অপূর্ব একটা নকশা তৈরি করে। ঐ নকশা করা স্নিগ্ধ কার্পেটের উপর দাঁড় করাবো ওকে আমি।
আমি খুব ভালো বক্তা না, এই মেয়েটার সামনে আমার অনেক সহজ কথাই এলোমেলো হয়ে যায়। কিন্তু তবুও, দরকার হলে প্র্যাকটিস-রিহার্সেল করে হলেও ঐ জায়গায় দাঁড়িয়ে কয়েকটা সহজ কথা বলবো।
আর তারপর... গাছটা ধরে একবার ঝাঁকুনি দেব। গাছে আটকে থাকা আরো অনেকগুলো ফুল যখন আমাদের শরীরে পড়বে, ওখান থেকেই দুয়েকটা ওর হাতে গুঁজে দেবো। ব্যাস।।

কতক্ষণ লাগবে এটা শেষ করতে? হিসাব করে দেখেছি, কোনওভাবেই এক-দেড় মিনিটের বেশি লাগার কথা না।

এই বাংলোতে আমাদের শেষ শরৎকালটা পার করে ফেলেছি। এরপর হুট করে শীত এসে আবার চলেও গেলো। আর অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন ঠিকানা ধরতে হবে আমাদেরকে। তাই শিউলি ফুলের এক-মিনিটব্যাপী আমার ‘সুদীর্ঘ’ পরিকল্পনাটাও চলে গেলো আমার অজস্র অপূরণীয় বাকির খাতায়।

তবে সে বাকির খাতাই হোক, আর আমার মনের গোপন-অবাধ্য অ্যাডভেঞ্চারই হোক, অর্ণবের গানের মধ্যে হারিয়ে না যাওয়ার যেই কষ্টটা ছিলো ঐটা আমি এখন পুরোটা বুঝতে পেরেছি।

“স্বপ্নে আমার শরীরে কেউ ছড়ায় না শিউলি ফুল-
আলোর আকাশ নুয়ে এসে ছোঁয় না কপাল।।”


সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১২:১৮
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×