ভাগ্যিস এটা আমাদের ক্লাস না, তাহলে আয়তকার আরো দুইটা কাচের টুকরা ভেদ করতে হতো আমাকে। সেই কাচ যত স্বচ্ছই হোক, ওর চোখের মত তো আর না!!
অনেকদিন পর আমার চোখের সমান্তরালে খুব প্রিয় দুইটা চোখ।
মনোযোগী ছাত্রের মত তাকিয়ে ছিলাম যতক্ষণ ও ছিলো আমার সামনে। অথচ আমাদের সলিড স্টেট কোর্সের ক্লাসে লেকচারার আমার এই মনোযোগের জন্য জীবন দিয়ে দিচ্ছেন কতদিন ধরে।
আর এদিকে আমার অ্যানালগ চোখ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বারবার দেখছিলাম মুখটা!!
আমার সামনে ডানদিকে, অর্থাৎ ওর বাম গালের ছোট্ট দুইটা তিলের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ আগে আমার মুখস্ত ছিলো। হাসলে যেখানটায় টোল পড়তো ওর, কান বরাবর সেদিকে মাত্র এক সেন্টিমিটার দূরেই।
একটা মানুষ কতটা ‘সসপ্রিয়’ হতে পারে ওকে না দেখলে জানতাম না কখনও। স্যান্ডউইচ, বার্গার থেকে শুরু করে ফ্রাইড রাইস পর্যন্ত সস দিয়ে খায় মেয়েটা। সেদিন পিজা অর্ডার করেছিলাম। তিনটা স্লাইস খেতে চার প্যাকেট সস লাগলো ওর। আর আমি সামনে বসে খাওয়া দেখলাম ওর।
এমন কোনও আহামরি দৃশ্য না হয়ত, কিন্তু এইখানেই তো পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রবিবর্জিত আপেক্ষিকতা, তাইতো আমার কাছে এইখানেই গ্রীক দেবী আফ্রোদিতি।
হিংসায় জ্বলে যাচ্ছিলাম।
কারণ চিলি কিংবা টমেটো কেচাপ, যেটাই হোক না কেন, ওর অসতর্ক ঠোঁটের ডানদিকে লেপটে যাচ্ছিলো বারবার। ওদিকে তখন আমি পরের জন্মে টমেটো কিংবা মরিচ হবার স্বপ্নে বিভোর। আচ্ছা, কে যেন বলেছিলো আজকাল টমেটো কেচাপের নামে মিষ্টি কুমড়া দেয়।।
উফহ, হলাম নাহয় ঐটাই! কি আসে যায়?
হিংসায় বার্বিকিউ হয়ে কয়েকবার ভাবলাম, এবার নাহয় আমিই মুছে দিবো। কিন্তু চোখ আর মাথা হয়ে সেই সিগনাল হাত পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই প্রতিবার অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আমার লক্ষ্য ধূলিস্যাৎ করে দিচ্ছিলো মেয়েটা।।
আগে যখন ওর সাথে ঘুরতাম, প্রচুর কথা বলতাম আমরা দুইজনই। কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগতো কখন জানেন? যখন আমি কথা বলতাম আর ও চুপ করে শুনতো।
আমি ওর চোখ দেখতাম মন-প্রাণ ভরে তখন। ওর সুন্দর বড় বড় চোখে আমি আমার শব্দের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেতাম। ঐটাই আমার জন্য অনেক ছিলো, অন্য কিছু খোঁজার কথা মাথায় আসতো ঠিকই, কিন্তু জোর করে দূরে সরিয়ে দিতাম তাও।
ঘুরাঘুরি আর বই-পড়ার বাতিক আমার অনেক ছোটবেলা থেকেই, আর সারাজীবন খোলামেলা একটা মানসিকতার মধ্যে থেকে আমার চিন্তাভাবনাও একটু অন্যরকম ছিল। তাই ওর জন্যই আমি আমার সারাজীবনের গল্পের স্টক বরাদ্দ করে ফেললাম ঐ সময়েই।
আমার গল্পের স্টক শেষ হয় নাই এখনও, কিন্তু ঐ দিনগুলো শেষ হয়ে গেছে।
সেদিন যখন ওর সাথে ছিলাম বেশ খানিকক্ষণ, কিন্তু আমার গল্পের স্টকের কথা মাথায় আসে নাই তেমন। বারবার শুধু মনে হচ্ছিলো, সময় চলে যাচ্ছে অনেক দ্রুত। আরেকটু বসি, আরেকটু থেকে যাই, আরেকটু দেখে যাই ওকে... তাহলে হয়তো আরো দুইটা লাইন বেশি লিখতে পারবো।
আমার জরুরি তাড়া ছিলো, আর ওর সাথে দেখা হওয়াটাও একদমই হুট করে। রোদের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ওকে ফোন দিয়ে ফেলি হঠাৎ। আর পারছিলাম না, একসময় বলেই ফেলি, দেখা করবি একটু? পাঁচ মিনিটের জন্য?
আমাদের পাঁচ মিনিট টাইম প্যারাডক্সে আটকে গিয়ে ঘণ্টা দেড়েকের মত স্থায়ী হলো। আগের মত নেই কোনও কিছু আর। তাই এলোমেলো বিষয় নিয়েও কথা হলো না, কথাগুলো কেমন বিষণ্ন হয়ে যাচ্ছিলো বারবার। আমাদের হাসিগুলোও ঠোঁট পার হয়ে কান পর্যন্ত এসে পৌঁছলো না বেশিরভাগ সময়ই।
যাওয়ার আগে ও বলল, হাসতে হাসতে আজকে তুই উঠবি, ঠিক আছে?
আমি হাসতে পারলাম না প্রথমে। ওর দিকে তাকালাম, ও খুব সুন্দর করে হাসছিলো। কিন্তু আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই বুঝতে পারলাম অভিনয়টুকু।
জুলিয়াস সীজার ক্লিওপেট্রার হাসি দেখেই বিশাল সাম্রাজ্য নিয়ে জুয়া খেলে গেছে একসময়, ইতিহাসের পরাক্রমশালী রাজা হতে পারলে আমিও ঐ মুহূর্তে মিরপুর ১১ নাম্বার নিয়ে বাজি ধরে ফেলতাম ওর জন্য।
আমার ভিতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু এবার আমিও হাসতে হাসতে বললাম, আবার কবে বের হতে পারবো তোর সাথে জানিনা। ভালো থাকিস।
আমরা তখন বের হয়ে গেছি, ও রিকশার জন্য দাঁড়ালো। আমার খুব ইচ্ছা করছিলো ওকে ধরে কিছু একটা বলি, কিন্তু দুইটা মানুষ খুব কাছে থেকেও যখন আলাদা হয়, ঐ দূরত্বটা তখন অনেক বড় হয়ে যায়। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম যাওয়ার আগে শুধু, অনেক অনেক কথা জমে ছিলো তখনও। কিন্তু মুখ দিয়ে শুধু বলতে পারলাম, হ্যান্ডশেক করতে পারিস, এতে আর আমাদের কিছু হবে না।
আমি হাত ধরে ঐ জায়গাটায় মূর্তির মত ওর চোখে তাকিয়ে ছিলাম অনেকগুলো মুহূর্ত। আমি ছেড়ে না দেয়া পর্যন্ত আমার শক্ত হাতটা ধরে ছিলো ও। ওর অদ্ভুত সুন্দর মুখের ভাষা আমি পড়তে পারলাম এবার।
কিন্তু তখন আর কিছু বলেছিলাম কিনা মনে নাই। একদমই নাই।
পুঁজিবাদী সমাজ থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর এই সুনয়নার ‘একনায়িকাতন্ত্র’ বারবার দন্ডিত করেছে আমাকে। কিন্তু হ্যান্ডশেক-পরবর্তী অতিরিক্ত কয়েকটা মুহূর্তের ইন্টিগ্রেশনে সব ভুলে গেলাম আমি।