চায়ের মগ হাতে বারান্দায় এসে বসলো নীলা। নতুন বাসাটা তার ভারি পছন্দ হয়েছে। পুরনো দিনের সরকারি কোয়ার্টার। সামনে ও পেছনে অনেক খোলা জায়গা আর প্রচুর গাছপালা। নীলার বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় ৯ মাস। আর এই শহরে এসেছে প্রায় ২ মাস। স্বামীর বদলির চাকরীর সুবাদে এই শহরে আসা। মফস্বল হলেও শহরটা ভালো লেগেছে নীলার। নিরিবিলি আর পরিচ্ছন্ন। শহরের গা ঘেঁষে বয়ে গেছে ছোট্ট একটি নদী। সমস্যা শুধু একটাই। কথা বলার মানুষের অভাব। পুরো বাড়ীতে ওরা মানুষ মাত্র ৪ জন। নীলা, ওর স্বামী ইমরান, একটা ছুটা বুয়া যার ডিউটি সকাল ৮ টা থেকে রাত ৮ টা, আর একজন ড্রাইভার কাম মালি। ড্রাইভার ও চলে যায় রাত ৮ টার পর। স্বামী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলে সবাই ওকে সমিহ করে চলে। তাই মন খুলে কথা বলার কেউ নেই। ইমরান মানুষ হিসেবে অসাধারণ, কিন্তু কথা বলে খুব মেপে। নীলার মাঝে মাঝে খুব অস্থির লাগে।
****
হঠাৎ ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো। এই ভর দুপুরে কে আবার ফোন করলো! ভ্রু কুচকে ভাবে নীলা। ইমরান একটু আগেই দুপুরের খাবার খেয়ে আবার অফিসে গেলো। এতো জলদি তো ফোন করার কথা না! ভাবতে ভাবতে রিসিভারটা তুলে নিলো
-হ্যালো স্লামালাইকুম কে বলছেন?
ওপাশে কোন সারা শব্দ নেই।
-হ্যালো কে?
এবার বেশ মিষ্টি কণ্ঠে ছোট্ট একটা মেয়ে বলল
-হ্যালো আম্মু!
নীলা বুঝল এটা রং নাম্বার।
-হ্যালো তুমি ভুল নাম্বার এ ফোন করেছো। এখানে তোমার আম্মু নেই।
বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলো। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন বেজে উঠলো।
রিসিভ করতেই সেই একই কণ্ঠ
-আম্মু কথা বল।
-হ্যালো। বাবু শোনো এটা তোমার আম্মুর নাম্বার না। তুমি বোধহয় নাম্বার ভুল করেছো।
-না এটাই আমার আম্মুর নাম্বার।
নীলা মনে মনে ভাবলো নিশ্চয়ই বাসায় কেউ নেই আর এই সুযোগে মেয়েটা টেলিফোন নিয়ে দুষ্টুমি করছে। নীলা বেশ মজা পেয়ে বলল
-ওরে দুষ্টু, বাসায় কেউ নেই দেখে দুষ্টুমি হচ্ছে তাই না? আম্মু জানতে পারলে দেবে পিট্টি।
-না পিট্টি দিবে না। আম্মু অনেক ভালো।
-তাই বুঝি? তা তোমার আম্মু বাসায় নেই? নাকি ঘুমুচ্ছে?
-না ঘুমুচ্ছে না। আম্মু আমার সাথে কথা বলছে।
-মানে?
-মানে তুমিই তো আমার আম্মু।
নীলা হাল ছেড়ে দিয়ে হেসে ফেললো।
-তোমার নাম কি মামনি? কোথায় থাকো? এই নাম্বার পেলে কোথায়?
-আমার নাম রূপকথা।
নীলা চমকে উঠলো। এই নামটি ওর খুব পছন্দ। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল ওর মেয়ে হলে নাম রাখবে রূপকথা।
কলিং বেল বেজে উঠলো। ইমরান ফিরেছে।
-শোন রূপকথা, আমি এখন রাখব। কলিং বেল বাজছে দরজা খুলতে হবে। ভালো থেকো কেমন?
ঘরে ঢুকেই ইমরান বলল
-কি ব্যাপার ঘুমাচ্ছিলে নাকি? দরজা খুলতে দেরি হোল যে?
-একটা ফোন এসেছিল। এই জানো একটা দুষ্টু কিন্তু ভারি মিষ্টি মেয়ে ফোন করেছিল। কে জানে কোথা থেকে নাম্বার পেয়েছে! আশ্চর্যের বিষয় হোল মেয়েটির নাম রূপকথা। তোমাকে বলেছিলাম না আমাদের কখনো মেয়ে হোলে নাম রাখবো রূপকথা।
-হম। হয়তো কোথাও পেয়েছে নাম্বার।
****
পরদিন একই সময় আবার এলো ফোনটা। মেয়েটা সম্পর্কে কিছুই জানেনা অথচ কথা বলতে বেশ ভালো লাগে নীলার। কত রকম কথা হয় ওদের যার কোন আগা মাথা নেই। প্রতিদিন রূপকথার ফোন আসতে লাগলো। মাঝে মাঝে রূপকথা বায়না ধরে গান শোনাতে। নীলাও গেয়ে শোনায়। রূপকথা এখনো নীলা কে আম্মু ডাকে। প্রথম প্রথম আপত্তি করলেও এখন আর বাধা দেয়না নীলা। আম্মু ডাকটা ওর ভালই লাগে। নীলাও রূপকথা কে আদর করে রুপু বলে ডাকে।
****
সাপ্তাহিক ছুটির দিন তাই ইমরান আজ বাসায়। দুপুরে খেয়ে একটা বই হাতে নিয়ে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে নীলাকে দেখছে। নীলা অস্থির হয়ে ল্যান্ড ফোনটার পাশে পায়চারি করছে। আজ এখনো রূপকথার ফোন এলো না। কি হোল মেয়েটার! অসুখ করেনি তো? নীলার উদ্বেগ আরও বেড়ে গেলো। ইমরানের ডাক শুনে সম্বিৎ ফিরে এলো। নীলা ইমরান এর পাশে এসে বসলো। ইমরান কিছুক্ষণ নীলার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি হয়েছে তোমার?
-কিছু হয়নি তো! রুপু টা আজ এখনো ফোন করলোনা। টেনশন হচ্ছে মেয়েটার কিছু হয়নি তো?
ইমরান নীলার হাতটা নিজের মুঠোয় নিল।
-নীলা কিছুদিন থেকেই একটা কথা তোমাকে বলব ভাবছি।
নীলা চুপ করে ইমরান এর দিকে তাকিয়ে থাকল। ইমরান আবারো বলতে শুরু করলো।
-আমি বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি তুমি এই ফোনটা নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করছ। সারাক্ষন তোমার মুখে শুধু রুপু রুপু। তাই বিরক্ত হয়ে গত ছুটির দিনে তুমি যখন রুপুর সাথে কথা বলছিলে তখন আমি ড্রইং রুমের প্যারালাল সেট থেকে তোমাদের কথা শুনেছি।
এটুকু বলে ইমরান থামল। নীলা এখনো চেয়ে আছে ইমরান এর দিকে।
-নীলা আমি হতভম্ব হয়ে দেখলাম যে তুমি একাই কথা বলে যাচ্ছ। ওই দিক থেকে কারো কণ্ঠ আমি শুনতে পাইনি।
নীলা বিরক্ত হয়ে বলল
-তুমি কি বলতে চাও? আমি একাই কথা বলি? তারমানে রূপকথা আমাকে ফোন দেয়না? দীর্ঘ ১ মাস তবে আমি কার সাথে কথা বললাম?
-নীলা এটা তোমার কল্পনা। সারাদিন একা থাকো তো। আমি বলি কি তুমি ঢাকায় মার বাড়ীতে কিছুদিন থেকে আসো। তোমার ভালো লাগবে।
-আমি কোথাও যাবনা। ইমরান তোমার কি ধারনা আমি মিথ্যে বলছি?
-না তুমি মিথ্যে বলছনা। কিন্তু এটা তোমার কল্পনা মাত্র।
নীলা আর কিছু না বলে উঠে চলে গেলো। ইমরান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
****
কিছুদিন থেকেই নীলার শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না। ইমরান ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। কিছু টেস্ট করে ডাক্তার জানালেন নীলা মা হতে যাচ্ছে। ইমরান খুশিতে ক্লিনিকেই নীলাকে জড়িয়ে ধরল। আর নীলা তো লজ্জায় বেগুনী। পরদিন দুপুরে রূপকথার ফোন এলো। নীলা ফোনে রুপুকে অনেক আদর দিয়ে বলল
-জানিস আমার একটা বেবি হবে। ঠিক তোর মতো দুষ্টু হবে।
-আমি জানি আম্মু।
-কি জানিস?
-ওই যে দুষ্টু হবে সেটা জানি।
দুজনই হিহি করে হাসতে লাগলো।
****
অপারেশন থিয়েটারে শুয়ে আছে নীলা। প্রায় অচেতন। হঠাত তীব্র কান্নার আওয়াজে চেতনা ফিরে এল। তবু চোখ মেলে তাকাতে পারছেনা। নার্স ওর কপালে হাত রাখল। একটু করে চোখ মেললো নীলা। নার্স হেসে বলল আপনার একটা পরীর মত মেয়ে হয়েছে। মেয়ের মুখ দেখবেন না? ধবধবে সাদা একটা তোয়ালে পেচানো ছোট্ট পুতুলটাকে যখন নীলার সামনে নিয়ে এলো, ও আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। কাঁপা কাঁপা হাতে ঘুমন্ত মেয়ের নরম গোলাপী গালটা একটু ছুঁয়ে দিলো। বিরবির করে বলল -আমার রূপকথা। আমার শোনামনি।
****
ক্লিনিক থেকে বাড়ী ফিরেছে বেশ অনেকদিন হোল। রূপকথা কে নিয়ে এত ব্যস্ত, গোসল করানো খাওয়ানো সবকিছুই নিজের হাতে করা চাই নীলার। এতদিন রুপুর কথা ভাবার সুযোগই হয়নি। এক মাসের উপর হল রুপুর সাথে কথা হয়নি। নীলা ঠিক করল এবার রুপুকে আসতে বলবে ওদের বাসায়। আমার রূপকথা কে দেখবেনা রুপু তাই কি হয়? বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলো কিন্তু রুপুর ফোন এলোনা। পরদিন ও এলোনা, তার পরদিনও না। নীলা বুয়া কে ডাকলো।
-বুয়া আমি যখন ক্লিনিকে ছিলাম তখন তুমি তো সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসায় ছিলে। বা গত এক মাসে আমার কাছে রুপু নামের কোন ছোট্ট মেয়ের ফোন এসেছিল?
-না তো আফা। আমিতো হারাদিন ঘরেই আছিলাম। কুনো ফোন আহেনাই তো!
নীলার কাছে রুপুর টেলিফোন আর কোনদিনও আসেনি।
(কাল্পনীক কাহিনী )
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:৫২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


