গোপন ক্যামেরাটা ঠিকঠাক বসানো হয়েছে কি না আগে দেখে আসলো রিনা।
আজ আমাদের ছেলে রাজীব এর আঠারো-তম জন্মদিন। এখনকার দুনিয়ায় আদর্শ ছেলে বলতে কিছু নেই, তবে রাজীব যাকে বলে বেশ ভালো ছেলে। ভালো ছেলে না হলে কি আর আজকের দিনে বন্ধুবান্ধব ছেঁড়ে আমাদের কথায় রাতের খাবারের জন্যে এত দ্রুত বাসায় চলে আসে। ওর বন্ধুদের খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল দুপুরে, তখনই বলে দিয়েছিল রিনা যে রাতের খাবারটা আমরা তিনজন একসাথেই খাবো। রাজীবও সাড়ে সাতটার মধ্যে বাসায় চলে এসেছে। রিনাকে বলে গিয়েছিলাম, আজ রাজীবের প্রিয় খাবারগুলো রাঁধতে। খিচুড়ি, চিকেন ফ্রাই, গরুর কালো ভুনা, জালী কাবাব। আর অনেকখানি সালাদ, আমার জন্যে। এই বয়সে এসে এত ভারী খাবার রাতের বেলা পেটে সয় না।
গত কয়েক দিন ধরেই আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধিটা খেলা করছিল। রিনাকে বুঝিয়ে বলতেই ও হাসতে হাসতে রাজী হয়ে গিয়েছিল। না হওয়ার কিছু নেই। ভার্সিটিতে আমি আর রিনা মিলে যেসব দস্যিপনা করেছি সেগুলো এখনও আমাদের ক্লাসমেটরা দেখা হলে বলে। রাজীবের খুব শখ একটা মোটরবাইকের। আমাকে না বলে কয়েক মাস আগে চালানো শিখে এসে মা-কে বলেওছিল। আমাকেও আভাস দিয়েছে যে আঠারো হলেই ও লাইসেন্সটা করবে আর তারপর একটা বাইক ওর চাইই চাই। রিনার হালকা আপত্তি থাকলেও, আমার খুব একটা না নেই। সেটা আজকে ওকে জানাবো তবে তার আগে ওকে একেবারে সেই একটা চমক দিতে হবে।
বেশি কিছু না। আমি আর রিনা মিলে একটা নাটক সাজিয়েছি। আমার আইডিয়াই মেইন, রিনা একটু ঘষামাজা করে দিয়েছে। সেটা আজকে ওকে বলে, গোপন ক্যামেরা দিয়ে ওর ঐ মুহূর্তের এক্সপ্রেশন আমরা ক্যাপচার করে ফ্যামিলি গ্রুপ আর ইউটিউবে আপ দিব। আজকের পর আর কি এমন কখনো করা যাবে নাকি? যত যাই হোক, ছেলে বড় হয়ে গিয়েছে। কাজেই এটা একটা স্মৃতি হয়ে থাকবে। রিনা আমাকে থাম্বস আপ দেখিয়ে বুঝালো সব ঠিক আছে।
"রাজীব, খেতে আয়।" ডাক দিলাম আমি।
"আসছি বাবা।" বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে রাজীবের গলার অস্পষ্ট স্বর শোনা গেল। মিনিট পাঁচেক পর দরজা খুলে ডাইনিং রুমে এসে ঢুকল রাজীব। "এতক্ষণ লাগে রুম থেকে আসতে?" রিনা রাগত গলায় বলল।
"আরে মা, রাশেদের সাথে কথা বলছিলাম। সেই ইউকে থেকে ফোন করেছে উইশ করতে। ওভাবে হঠাৎ করে কি উঠে আসা যায়? তার আগে দেখি, আজকে কি রান্না করলে আমার জন্য?"
"খাওয়া পরে হবে।" আমি গম্ভীর গলায় রাজীবের কথার মাঝখানে বাধা দিলাম। "তোর সাথে আমাদের জরুরী কথা আছে।"
"কি কথা?" রাজীবের গলায় নিখাদ বিস্ময়। এরকম গলায় ওর সাথে সহসা কথা বলি না আমি। শেষ যে বার বলেছিলাম, তখন ও ক্লাস টেনে পড়ে। কোচিং ফাঁকি দিয়ে এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছিল।
"এখন আমি যেসব কথা বলবো তোর হয়তো বিশ্বাস হবে না কিন্তু সত্য অনেক নিষ্ঠুর, আর বাস্তবতা জিনিসটা কিন্তু আমাদের কল্পনার চাইতেও অনেক গভীর।"
"কি আশ্চর্য, এভাবে নাটকের মতন কথা বলছ কেন? কি হয়েছে কিছুই তো বুঝতে পারছি না।"
রিনা এবার বলে উঠল, "দেখ বাবাই। তোর আব্বু তোকে বলার সাহস করে উঠতে পারছে না। আমি সরাসরিই বলি। তুই আসলে আমাদের ছেলে না।"
"কি বলছ এসব!?" চেয়ার ঠেকে উঠে দাঁড়াল রাজীব। ধাক্কাটা একটু জোড়েই হয়ে গিয়েছিল চেয়ারটা ঠক করে গিয়ে ধাক্কা খেল পেছনের কাবার্ডে। "কি বলছ এসব মামণি?"
"ঠিকই বলছে তোর মা। আমরা তোর আসল বাবা মা নই। আমাদের উপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তোকে বড় করার। সবার চোখের আড়ালে। সাবধানে। এই পৃথিবীতে।" মনে মনে খুব হাসছি আমি। নিশ্চয়ই ভিডিওটা দারুণ হচ্ছে। শেষমেশ যখন রাজীবকে বোকা বানিয়ে হেসে উঠবো আমরা, দেখার মতন হবে ওর চেহারা। এখনই যা লাগছে!
"আব্বু, আস্তে। তোমরা ঠিক আছো তো? এসব কি বলছ তোমরা? তোমরা বুঝতে পারছ কি বলছ?" রাজীব রীতিমত হাঁপাচ্ছে।
"শোন বাবাই। আগে বস, চেয়ারে বস।" রিনা চেয়ারটা টেনে দিল। "আমরা তোকে বলছি। মন দিয়ে সব শুনবি। তোর উপর তোর গ্রহের অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব। তোকে এখন এরকম অস্থির হলে চলবে না।"
"দাঁড়াও, আমাকে বলতে দাও। বাবা, তুই আসলে আমাদের ছেলে না। এই পৃথিবীর কেউ তুই নোস। এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিরও বাইরে থেকে তোর আগমন। এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির কারুস নামের একটা গ্রহের হারিয়ে যাওয়া রাজপরিবারের শেষ সন্তান তুই..."
রাজীব আমার কথার মাঝখানেই চিৎকার করে উঠলো। "থামো। তোমরা দুজন আমার সাথে মজা করছ তাই না? আমার প্রিয় সুপারহিরো সুপারম্যানের মত করে কাহিনী বানাচ্ছ..."
"চুপ করে আগে আমাদের কথা শোন তুমি।" ধমক দিয়ে বলে উঠলো রিনা। সহজে রাজীবকে তুমি করে বলে না ও। কাজেই রাজীব অবাক হয়ে তাকাল ওর মা-র দিকে। সেই ফাঁকে আমি কাহিনী বলে যেতে থাকলাম।
"...তোর চাচা নিজের হাতে তোর বাবা-মা আর তোর ছোট বোনকে হত্যা করে। তোর একান্ত বিশ্বস্ত বডিগার্ড আর তার স্ত্রী, আমি আর রিনা, তোকে সাথে করে পালিয়ে আসি পৃথিবীতে। সেটা যখন তোর বয়স পৃথিবীর হিসেব মতে পাঁচ। কারুসের উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে নিজেদের চেহারা বদলে নেই পৃথিবীর মানুষের আদলে আর সেই সাথে তোর মস্তিষ্ক থেকে সব স্মৃতি মুছে দেই। তোর আঠারো বছর বয়স হয়েছে তাই গতরাতেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোকে সব জানানোর..." - রাজীবের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। এখনো ওর চেহারায় অবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু, তাও চুপচাপ শুনছে আমার কথা।
"নিয়মিত আমাদের ট্রান্সমিটার দিয়ে কারুসের সাথে যোগাযোগ রাখি আমরা। তোর চাচার বয়স হয়েছে। আর রাজপরিবারের বিশ্বস্ত বিপ্লবীরা গোপনে গোপনে এখন অনেক সংগঠিত। তারা সকলেই চায় রাজপুত্রের পুনরাগমন। তোর চাচাকে পরাজিত করে তোকে আবার সিংহাসনে বসাতে চায়।" মোটামুটি আমার কাহিনী শেষ। এখন রিনার পালা। হাজার হোক, ছেলে মা-র ন্যাওটা। শেষ পেরেকটা রিনাই ঠুকবে।
"বাবাই, আমি জানি এই কথাগুলো তোর মোটেও বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু এগুলাই সত্যি।" রাজীবের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল রিনা, ওর চেয়ারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। "আর তুই যে বিশ্বাস করবি না তা আমরা জানতাম, আর তাই তোর বাবা আর আমি মিলে ঠিক করেছি আজকে তোকে সেই বাক্য শিখিয়ে দিব যা বললে তোর সব স্মৃতি মনে পড়ে যাবে। সেই সাথে তুই যখন ইচ্ছে তখন নিজের দেহ কারুসবাসীদের মতন পালটে ফেলতে পারবি।" এই অংশটা শাজাম থেকে নিয়েছি। এসব কমিকস সব আমিই তো কিনে দিতাম রাজীবকে। আর ওর আগে আমিই পড়তাম অবশ্যই।
"মামনি, তুমি কি বলছ এগুলো। আমি এখনো কিছু বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমি, বাবা, এই সব কিছু। ওহ গড। নাহ, অসম্ভব।" কান্না কান্না গলায় বলল রাজীব।
নাহ, আর বেশিক্ষণ এই নাটক চালানো যাবে না। একবার চোখ দিয়ে পানি বের হলে পরে রিনা বিগরে যাবে। পরে ঝড় যাবে আমার উপর দিয়ে। আমি চোখের ঈশারা দিলাম রিনাকে। তাড়াতাড়ি শেষ করতে ব্যাপারটা।
"বাবাই, এখনই তুই সব মনে করতে পারবি। একটু ধৈর্য ধর বাবা।" রিনা নিজেকে সামলে বলল। "শুন, আমি যা যা বলছি ঠিক তাই তাই কর। উঠ, উঠে দাড়া বলছি।" রাজীবকে হাত ধরে দাঁড় করলো রিনা।
"হ্যাঁ, এবার নিজের দুই হাত আড়াআড়ি বুকের উপর রাখ।" ঠিক ব্ল্যাক প্যান্থারের মতন, তবে রাজীবের এখন সেসব মাথায় আসার কথা না। সে এখন রিনার কথা শুনছে। "হ্যাঁ, এবার আমি যা যা বলি ঠিক সেটা বলতে থাক। আর হ্যাঁ, কারুসবাসীদের দৈহিক গড়ন অনেক বীভৎস। প্রথমবারে ভয় পেতে পারিস। ভয়ের কিছু নেই। আমি আর তোর বাবা এখানেই আছি। তোর সাথে। এখন বল, লেছেকা বোটাক এমিয়া লেসয়া..."
অবিশ্বাস চোখে মুখে নিয়ে রাজীব রিনার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে বলল, "লেছেকা বোটাক এমিয়া লেসয়া..."
চমক, হ্যাঁ, চমকই তো।
চোখের সামনে রাজীবের সাড়ে পাঁচ ফুট শরীর বাড়তে বাড়তে ছাদ ছুঁয়ে ফেললো প্রায়। সারা শরীর ঢেকে গেল কচ্ছপের খোলের মতন শক্ত চামড়ায়। ঘাড় নেই, শরীরে উপর বসানো গোল ফুটবলের মতন মাথাটায় গুণে গুণে দশটা চোখ। কানগুলো নেই, সেখানে ফুলকোর মতন কান আর নাক একসাথে। নাকের জায়গায় একটা শুঁড়। আরও এক জোড়া হাত পা গজিয়েছে, একটা প্লাটিপাসের মতন ল্যাজও।
চমক তো বটেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৩৯