ভয়টা আগে থেকেই ছিল, ইদানীং আরও বেশী পাই। আমার দ্বিতীয় ছেলে জন্মের পর থেকে স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা রূপের চাইতে আমার অর্ধাঙ্গিনীর মাতৃরূপই প্রবল হয়ে উঠেছে। এটাই স্বাভাবিক, তা আমি জানি। কিন্তু তাও খুব বিরক্ত হয়ে উঠছি মাঝে মাঝে। সতেরো বছর অনেক লম্বা একটা সময়, এই সময়ে একজন মানুষ জীবনের অনেক চড়াই উৎরাই পার করে ও জীবিত থাকলে সেই বিখ্যাত উক্তির যথার্থতা প্রমাণ করে প্রতিনিয়ত পালটে যায়। আমিও বদলে গিয়েছি নিঃসন্দেহে। আর এটাও জানি যে আমি যেমন তার পরিবর্তন মন থেকে মানতে পারছি না; সেও আমার এই পাল্টানোকে খুব একটা মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে না। কখনোই না। আমরা ঝগড়া করি খুব, আর তাই সেটা চোখে পড়ে যায়, কিন্তু হিসেবের বিচারে তার পরিমান খুবই নগণ্য না-দেখানো প্রেমের কাছে। কাজেই, হ্যাপী ভ্যালেন্টাইনস ডে - "ডিয়ার ডিকটেটর অফ মাই লাইফ।"
হাতেগোনা কিছু গান আছে যা বারবার শুনি। আর বার বার শুনতে চাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংখ্যা আরো কম। সেখান থেকে দুইটার কথা বলে যাই। আশ্চর্য ব্যাপার, এই বুড়োকে কখনোই ভালো লাগে না; কিন্তু কিছু কিছু গান মাঝে মাঝে আমার এই ধারনাকে এমন ঝাঁকি দেয় যা বলার মত নয়। তখন নতুন একটা চাকরিতে ঢুকেছি। ফ্যাক্টরি পোস্টিং, আটঘন্টা ডিউটি-তিন রোস্টারে, থাকা-খাওয়া সব ফ্যাক্টরিতে। ডাল নামক পানি দিয়ে ভাত খেয়ে ছাড়পোকার সাথে সুখ-দুঃখের গল্প করতে করতে ঘুমানোর চেষ্টা করি, আর চেষ্টা করি ওভারটাইমের- তাতে যদি হাস্যকর বেতনটার গায়ের মাংস-চর্বি একটু বাড়ানো যায়। একদিন ইউটিউবে গান শুনতে শুনতে এসে থামলাম সুমন-এর "ভালোবেসে সখী"-তে। হঠাৎ করেই দুটো লাইন মাথার মধ্যে আটকে গেলো।
"মনে ক'রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী-- তোমার
কনককঙ্কণে॥"
আমার মাথা চক্কর দিতে লাগলো। কি অদ্ভুত কথা। আমার হাতের রাখী, সেটা কেনো বাঁধা লাগবে? আবার বাঁধতে হবে তো কোথায় - তোমার কনককঙ্কণে। কনককঙ্কণ মানে জানতাম না। একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলাম। তারপর একটা স্যালুট দিলাম। এই অমানুষিক লাইন আর কারো পক্ষে হয়তো লেখা সম্ভবই হতো না। এক কথায় বলা হচ্ছে আমার হাতের রাখী আর তোমার কনককঙ্কণ একসাথে বেঁধে রাখো। আমার হাত ধরো - এই কথাটার এর চাইতে শৈল্পিক রূপ আর কি হতে পারে? এই ধরনের একটা লিরিক্সই পারে একটা ছেলেকে হঠাৎ ছুটি নিয়ে চার ঘন্টার বাস জার্নি শেষে তার প্রেমিকার সামনে পৌঁছে দিতে।
আরেকটা গান - যা আমি জানি আমার তারও খুব প্রিয় গান। শুধু এই কথাটাই গানটার মর্ম বুঝাতে যথেষ্ট। কারন তার বাংলা গান শোনা হয় খুব কম আর রবীন্দ্রসঙ্গীত(!) তো বলাই বাহুল্য - কাজেই যে সেই গান এটা না। "মাঝে মাঝে তব দেখা পাই" - এই গানটা অর্ণবের কন্ঠ ছাড়া আর কারো কন্ঠেই মানায় না। অন্তত আমার কানেই (পড়ুন - মনেই) পৌঁছে না। গানটা ভক্তিমূলক হলেও, আমার কাছে অসম্ভব রোমান্টিক একটা গান বলেই মনে হয়। এই গানে এসে বুড়ো আবার লিখে ফেললো কিছু স্বর্গীয় লাইন -
"ওহে, তুমি যদি বলো এখনি করিব
বিষয়-বাসনা বিসর্জন।
দিব শ্রীচরণে বিষয় -
দিব অকাতরে বিষয় -
দিব তোমার লাগি
বিষয়-বাসনা বিসর্জন।"
আমি যতবারই শুনি, এই লাইনে এসে খেই হাড়িয়ে ফেলি। তাইতো, বিষয়-বাসনার চাইতে বড় আকাঙ্খা, তীব্র নেশা, এর চাইতে বড় সাধনার বস্তু কি মরণশীল মানুষের কাছে আর কিছু আছে। সেই বিষয়-বাসনা, অর্থ-যশ-লোভ; যার-তার চরণে কি বিসর্জন দেয়া যায়? এও কি সম্ভব? জানি না। তবে এই গান প্রথম যখন আমার সঙ্গিনীকে শুনিয়েছিলাম সে অবাক হয়ে দেখেছিলো যে আপাতদৃষ্টিতে আবেগ-বিবর্জিত একটা মানুষ একটা গান শুনে হাস্যকরভাবে কতটা আবেগাক্রান্ত হতে পারে।
কাজেই প্রিয় সহধর্মিনী, আমার হাতের রাখী নিজের কনককঙ্কণে বেঁধে রাখতে ভুল করো না আর হ্যাঁ, তুমি যদি বলো তবে অনায়াসে বিষয়-বাসনা বিসর্জন দিতে পারি - আজকের দিনে এছাড়া আর বলার কিছুই নেই। ভালো কথা, এই জন্ম ও মৃত্যুর পরেও, মহাকালের প্রতি পাতায় লেখা প্রতি গল্পে, তুমি শুধুই আমার।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১:০৮