সকালের ঘুমটা চমকে ভেংগে গেল ফাতেমার। এমন না ফাতেমা দুঃস্বপ্ন দেখছিলো। স্বপ্নে কে যেন ফোন করেছিল, ত্রপা অথবা সাজিদ ভাই। ঠিক মনে করতে পারছে না। মনে হয় ত্রপা। এরপর অন্য কাকে যেন ফোনটা ধরিয়ে দিল, স্বপ্নের এর পরের অংশ একদম বাস্তব মনে হচ্ছে। যে ফোন ধরেছিল সে বলছে ভারতের মধ্য প্রদেশে একটা সম্মেলন হবে, ফাতেমাকে সেখানে আমন্ত্রন করছে। স্বপ্নের মাঝেই ফাতেমা মনে মনে কি কি গুছাতে হবে ভেবে নিচ্ছিল আর ফোনে হ্যা হু করছিল। এত বাস্তব ছিল যে কবে রিপোর্টিং, কত দিনের ট্যুর জাতীয় প্রশ্ন করতেও ভুল হল না, আর তখনই বাস্তবতাটা ভোরের আলো ফোটার মত আরো একটু আলোকিত হল আর ফাতেমা ঘুমের মধ্যেই টের পেয়ে গেল যে সে স্বপ্ন দেখছে, রিসেন্টলি এমন কোন এ্যাসাইনমেন্টের জন্য সে এ্যাপ্লাই করে নাই, তার কাছে এমন কোন প্রস্তাব আসে নাই এত ডেফিনিট কোন আমন্ত্রন আসবে না, কথা বার্তা আসবে প্রতিযোগিতা হবে, নিজের যোগ্যতা প্রমান করতে হবে। মহিলা অধিদপ্তরের অসীমা রায় কঠিন চিজ তাকে সন্তুষ্ট করে তবেই এমন ফোন পাওয়া যাবে। কাজেই এটা একটা স্বপ্ন। এখন চাইলে স্বপ্নটা শেষ করে আরো কিছুক্ষন ঘুমানো যাবে অথবা উঠে পড়লেও সমস্যা নাই তাই স্বপ্নের ফোনালাপ আচ্ছা আপনাকে আমি পরে জানাচ্ছি বলে শেষ করে দিল। এত স্পষ্ট যুক্তি দিয়ে স্বপ্ন কিভাবে শেষ করে ফেলল সেই চিন্তায় ফাতেমা চমকে ঘুম থেকে পুরাপুরি জেগে গেল।
ঘুম থেকে উঠে দেখল বাসার সবাই জেগে গেছে, এটা সাধারনত হয় না। ফাতেমা বরবর সকালে উঠে, সবার আগে। আজ অবশ্য কোন কাজের তারা নাই, তবে ফোনটা যদি স্বপ্নে না এসে সত্যি আসত তাহলে প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসাবে কিছু ফোন কল করতে হবে জাতীয় তারা থাকত। স্বপ্নের কথা ভেবে মনে মনে হাসি আসলো। ২২/২৩ বছর বয়সে এমন স্বপ্ন দেখত ঠিক স্বপ্ন না সেই অর্থে। ভাবত, একদিন দেশ বিদেশে যাবে, অমুক কনফারেন্সে বক্তৃতা দিবে তমুক যায়গায় মতবাদ প্রতিষ্ঠা করবে। গত ৮ বছরে ফাতেমা ঈর্ষনীয় সাফল্য দেখিয়েছে, এখন উলটা বাড়িতে থাকাই তার জন্য একটা স্বপ্নের মত। দিনের অনেকটা সময় বাইরেই চলে যায়, নিজের বিছানা নিজের বালিশ তখন পৃথিবীর সবচেয়ে দূর্লভ জিনিশ মনে। কাজ শেষে যখন বাড়ি ফিরে আসে তখন কি যে শান্তি লাগে!! কিন্তু ঐ ঘুমের সময়টুকুই শুধু এর পর আবার ছুটে চলা। দেশের প্রতিটি প্রান্তরে কখনও কখনও বিদেশে। পথ চলা ফাতেমার বরাবরের প্রিয় কাজ চলন্ত গাড়িতে ভীষন বেগে চলা বাতাস সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে যায়। প্রতিবার যখন যে কোন সফর শেষে মাটিতে পা দেয় মনে হয় বৃষ্টিতে ছুটে চলা শৈশবের আনন্দ পাচ্ছে। ছুটে চলা ফাতেমার বড্ড প্রিয় কাজ।
আপনারা হয়তো ভাবছেন ব্যাক্তি ফাতেমাকে জানা হল না। যদিও ফাতেমা মনে করে ব্যাক্তি ফাতেমাকে জানার মত সব এই কয়েক লাইনে বলা হয়ে গেছে। তবু সামাজিক জীব আমরা, ফাতেমা তো আর সমাজের বাইরে না। উলটা সে নাকি সমাজের বুদ্ধিজীবিদের একজন। নারী নীতির খসড়া তৈরি করে নারী উন্নয়ন নিয়ে কথা বলে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে যার বিচরণ সে তো আর সামাজিক জীব হিসাবে তার একার বিবরন দিলে হবে না, সমাজে সে কার কার সথে সম্পর্কিত জানা লাগে। ২২ অথবা ২৩ এর সথে ৮ যোগ করলে ৩০ অথবা ৩১ বছর হয়। ৩০/৩১ বছর বয়সের একটা মেয়েলোক সে সধবা না কুমারী না বিধবা এসব জানা লাগে। সর্বপরি সে কার সাথে থাকে এটা জানা লাগবে। এই জাতীয় মেয়েরা একটু পুরুষ বিদ্বেষী হয়। নিজেদের খুব পন্ডিত মনে করে, এদের কেউ কেউ আবার একাই থাকে বাপ মার সাথেও থাকে না, কিছু আবার সমাজের সব বিধিটিধি কে বুইড়া আঙ্গুল দেখিয়ে একটা বাচ্চাও দত্তক নিয়ে বসে। দুই চারজন যে বিয়ে করে না তা না, এর পরও বেহায়ার মত সম্মেলন টম্মেলন করে উচ্চ শিক্ষার নাম করে দেশ বিদেশে ঘুড়ে। স্বামীর শশুর বাড়ির সেবা তো দূরে থাক তাদের প্রাপ্ত সম্মানটাও দেয় না, দিলেও স্বামীরে দিয়ে ঘরের থালা বাসন ধোয়ায়, কাপড় কাচায়, সংসারের সুখের জন্য বেচারা স্বামী মুখ বুজে সব সয়ে যায়। এদের আবার কিছু বলাও যায় না আইন-টাইন দেখায় একেবারে হুলুস্তুল পাকায় ফেলে। কাজেই এই সব মেয়েলোকের সামাজিক পরিচয় জানা অতীব জরুরী ব্যাপার।
চায়ের কাপ হাতে ফাতেমা তার আব্বার সাথে পেপার নিয়ে টানা টানি করে, ৫/৬টা দেশী বিদেশি পেপার সে রাতেই ইন্টারনেটে পড়ে নিয়েছে তবু সকালে চায়ের কাপ হাতে পেপার টানাটানি করে পড়াটা আসলে ছুটির দিন উৎযাপনের উপলক্ষ্য। আব্বার সাথে টুকটাক কাজের, রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলাপ হয়। আম্মাকে একটু রান্নায় সাহায্য সহযোগিতাও করা হয়। ফাতেমা বাবা মার একমাত্র সন্তান। বাবা তার সাধ্যের খনিকটা বাইরে এসেই ফাতেমাকে বড় করেছেন। মেয়ের বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে কষ্টও হয়েছে কিন্তু কোন কষ্টই আসলে চির জীবন স্থায়ী হয় না। এখন বরং মেয়ের বেরে উঠা দেখে ভাল লাগে। মনে মনে শতশহস্রবার আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন। তার ঘরে বরাবর চাঁদের হাট।
বিয়ে বা জীবন সঙ্গী নিয়ে ফাতেমার কোন স্বপ্ন, কষ্ট কিছুই অবশিষ্ট নেই। কম বয়সে একটা ছেলের সাথে খুব ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। ব্যাপারটা পরিবার পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ ফাতেমা লক্ষ্য করে যাকে মনে মনে জীবন সঙ্গী নির্ধারন করে রেখেছে সে ফাতেমার পরিবারের প্রতি কটাক্ষ করছে। মুখে না বললেও আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছে সামাজিক মর্যাদায় ফাতেমার পরিবার তাদের থেকে খানিকটা ছোট। একদিন সেটা মুখ দিয়ে ছেলের পরিবার বলেও দিল সে কথা। সেদিনই ফাতেমা নিজে হাতে সুতা কেটে দিয়েছিল। একবারও মুখের উপর বলে নাই সামাজিক মর্যাদার ব্যাপারটা সুক্ষ্ম তুলাদন্ডে মেপে ঘাটতিটুকু বের করতে হয়েছে তোমাদের অথচ তোমাদের বাড়ির মেয়েদের তুলনায় আমার সামাজিক মর্যাদা কত বড় সেট দিন আর রাতের মত প্রকট ভাবে খালি চোখে দেখা যায়, দোহাই দেয় নি কোন ভালবাসার, কোন প্রতিজ্ঞার, কোন আশ্বাসের।
সুতা যখন খুব বেশি টান টান হয়ে যায় তখন সেটা এক সময় না এক সময় ছিড়েই যায়, যদিও বা ফিরে আসে তবুও স্থিতিকালের ক্লান্তি থেকে যায়, পূর্বের অবস্থায় কখনই ফিরে আসে না। তার চেয়ে সেটা কেটে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
এরপর বাবা একটা ছেলেকে পছন্দ করেছিলেন, চমৎকার ঝরঝরে পরিছন্ন মানসিকতার একটা ছেলে। কিছুদিন কথা বার্তা চলা ফেরার পর খুব ভদ্রভাবে বলেছিল ফাতেমা তুমি অনেক লম্বা রেসের ঘোড়া তোমাকে বেঁধে রাখাও আমার পক্ষে সম্ভব না, আবার তোমার সাথে দৌড়ে পাল্লা দেবার ক্ষমতাও আমার নাই।
ফাতেমা এই থেকে টের পেয়ে গেল যে সে আসলে একটা পরিপূর্ন মানুষ। একজন পূর্ন মানুষের আরেকজনের সাথে কো-রিলেশন হয় না। অভিজাত মৌলরা যেমন কারও সাথে বন্ধনে জড়ায় না কারণ তাদের কোন অপূর্নতা নাই ঠিক একই কারনে তার সাথে কারও বাঁধন হচ্ছে না। ভিতরের ঘরে ফাতেমার ফোন বেজে উঠে। সাজিদ ভাই। "হ্যালো ফাতেমা মহিলা বিষয়কে মন্ত্রনালয় থেকে অসীমা দি ফোন করেছিলেন। তুমি কি সামনের মাসে একটু ভারতের মধ্য প্রদেশে যেতে পারবে? উনি তোমাকে টীম লিডার হিসাবে সাজেস্ট করছেন.........." হু হা করতে করতে ফাতেমা প্রয়োজনীয় বিষয় টুকে নেবার জন্য সেল ফোনের পাশ থেকে টান দিয়ে স্টাইলাসটা বের করে নেয়....