somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি পাতিহাঁসের কিছু কথা

১৭ ই জুলাই, ২০১১ সকাল ৯:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দিনটি ছিল আমার শেষদিন। হ্যা আমার বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার ১৭ বছরের জীবনের শ্রেষ্ট ১২ বছরের মেয়াদ আজ শেষ হচ্ছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ ক্যাম্পাসে আমার শেষ দিন। সেদিন ছিল আমার কলেজের ফেয়ারওয়েল। এর পর আমার নারি কেটে দেয়া হবে আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হবে রূঢ় পৃথিবীর বুকে। আমি আর এই সুন্দর ক্যাম্পাসে আমার আকাশি নীল জামাটা পরতে পারব না, নরম ঘাসগুলোকে প্রচন্ড অত্যাচার করে আমি জুনিয়ার থেকে সিনিয়ারে ভোওওওওওও দৌড় দিতে পারব না। কোন সুভাষ স্যার আমার কানটা মলে বলবে না, "এই তুই এত লাফালাফি করছিস কেন? তোর ক্লাস নাই? ও আচ্ছা তুই চ্যাপ্টেন (ক্যাপ্টেন) নাকি?"

সেদিন আমার গায়ে সেদিন আকাশি জামাটা ছিল না। আমার মেয়াদ শেষ, আমি একটা আকাশি সাদা মিশেল শাড়ী পরেছিলাম। বন্ধুরা সবাই আমার মত আবেগে বিভ্রান্ত। কেউ হাসছে আবার কেউ অকারণের কাঁদছে। অডিটোরিয়ামের শব্দসীমা নির্ধারন করা আছে এর বেশি কথা বললে ফ্যান অফ করে শাস্তি দেয়া হয়, এই নিয়মের ধারও কেউ ধারছে না। অনুষ্ঠান শুরু হবার পরও মেয়েদের বকবক কান্নাকাটি চলছে, টিচাররা এর মাঝেই কথা শুরু করলেন। একজন টিচার উঠে খুব অদ্ভুত একটা কথা বললেন, "মেয়েরা তোমাদের বেশি কথা বলতে চাই না, শুধু দোয়া করি তোমরা যেন পাতিহাঁসের মত হও"
এমন অদ্ভুত আশির্বাদ পেয়ে নড়েচড়ে বসল প্রতিটা মেয়ে, অডিটোরিয়ামে নেমে এলো পিন পতন নিরবতা। সবাই জানতে চায়, এই আপা কেন আমাদের এমন অদ্ভুত দোয়া করছেন?

আপা কথা শুরু করলেন. আমরা বরং কথাগুলো আপার জবানীতে শুনি।
গত বছর আমি একটা ট্রেনিং এ গিয়েছিলাম। সেখানে আমার মত আরও অনেক টিচার দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছিলেন। এর মাধ্যে দেখলাম একটা লোক খুব গায়ে পরে কথা বলতে আসে। একটু পরপরই আপা আপা করে ছুটে আসে। খাতিরের অতিশয়তায় আমি একটু বিরক্ত। এর মাঝে সে আমাকে জানিয়ে গেল আপা আপনার কলেজের তো রেজাল্ট সবচে ভাল কিন্তু আমাদের কলেজের রেজাল্ট আপনাদের চেয়েও ভাল। এবার আমি একটু ভাল করে লক্ষ্য করলাম লোকটাকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল এবং জিজ্ঞেস করলাম, "কিভাবে?" তিনি জবাব দিলেন, "আপা গতবছর আমার কলেজে পাশের হার ১০০% আপনাদের কিন্তু ১০০% পাশ করে নাই। কথাটায় আমি খানিকটা দমে গেলাম, কারণ কথাটা আংশিক সত্য।"
গতবার একটা মেয়ে পরীক্ষা চলাকালে অসুস্থ হয়ে পরে তাই পরীক্ষা দিতে পারে নাই আরেকজনের সম্ভবত বাবা মারা গিয়েছিলেন বা এমন কিছু। অনেক মেয়ের মধ্যে প্রতিবারই কেউ না কেউ পরীক্ষা না দিতে পারার কারণে টোটাল রেজাল্টের শতকরা ১০০% হয় না। অনেক মেয়ের মধ্যে ব্যাপারটা হতেই পারে কিন্তু এই কথাটা ভদ্রলোককে বুঝানো বেশ দায়। তাই আমি সংক্ষেপে জবাব দিলাম, "আমার মেয়েরা পাতিহাঁসের মত।"
এর পর ভদ্রলোক বেশ পিছেই পরে গেলেন পাতিহাঁসের মত কথার মানে কি জানারা জন্য। বারবারই শুধু আমাকে জিজ্ঞেস করে আর আমি এড়িয়ে যাই। একদম শেষের দিন চলে আসব এমন সময় লোকটা বলল, "আপা বললেন না কিন্তু পাতিহাঁসের মত মানে কি!!"
আমি বললাম, "শুনুন, পাতিহাঁসত তো দেখেছেন, কি সুন্দর তা গড়ন, তার গায়ে আলো পরলে দ্যুতি ঠিকরে বের হয়, পাতিহাঁস পানিতে সামুক গুগলির মত নোংরা জিনিশ খায় তবু তার গায়ে কোনদিন ময়লা লেগে থাকে না। পানিতে তার চলন কেমন রানীর মত। পানিকে খুব না নাড়িয়ে কি সুন্দর সে পানি কেটে বের হয়?"
লোকটা খুব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল "হ্যা" আমি বলেই গেলাম, "আপনি তো জানেনই খাদ্য হিসাবেও পাতিহাঁস অনেক সুস্বাদু কিন্তু এটা কি জানেন পাতিহাঁস দুধে মুখ দেয়া মাত্র সেটা ছানা হয়ে যায় আর সে সেই ছানাটা খেয়ে সে চলে আসে? পানিটুকু পরে থাকে? আমার মেয়েরা হচ্ছে পাতিহাঁসের মত। তারা অনেক কিছুই পায় অনেক কিছুই পায় না কিন্তু তারা চালনে বলনে কাজে কর্মে অনেকের চেয়ে অনেক দক্ষ। তারা সবকিছু থেকে সারটুকু নিতে জানে আর সব কিছুর পরও তারা শ্রেষ্ট।"
সেদিন লোকটা আমার কথা মেনে নিয়েছিলেন আর বলেছিলেন যে, সবাই বলত আপনাদের মেয়েরা অনেক জানে এখন জানলাম তাদের মায়েরাও অনেক জানে। এই কথাটা আমাকে অনেক গর্বিত করেছিল।
মেয়েরা আমি তোমাদের দোয়া করছি তোমারা পাতিহাঁসের মত হও


এই শিক্ষিকার নাম মঞ্জুআরা আপা। উনি ক্লাস টেনে আমাদের ইতিহাস পরাতেন। সাইন্সের মেয়েদের জন্য ইতিহাস খুব বিরক্তিকর সাবজেক্ট কিন্তু আমার খুব ভাল লাগত আপার ইতিহাস শুনতে। আপা শুধু বইয়ে লেখা ইতিহাস বলতেন না। আমাদের বইয়ে ৬ দফা দাবীর কথা বলা ছিল বলা ছিল না আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিস্তারিত বিবরণ। নবাব সিরাজউদ্দৌলার কথা বলা ছিল বলা ছিল না আলীবর্দিখানের বাকি ২ কন্যার বিদ্রোহের কারণ। ভাষা আন্দোলনের কথা বলা ছিল বলা ছিল না বাঙ্গালীর আরও কিছু প্রাণের দাবীর কথা। বলা ছিল না বঙ্গোবন্ধুকে প্রতিটি পদে পদে কি পরিমান সংগ্রামের মুখোমুখী হতে হয়েছিল। বলা ছিল না বঙ্গোবন্ধু বাস্তবিক অর্থে একজন "মানুষ" ছিলেন তখনকার রাজনীতিবীদের মত তথাকথিত "এলিট" ছিলেন না। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের জন্য বহিস্কৃত হয়েছিলেন তবু কোনদিন তুচ্ছ কোন অন্যায়কে মেনে নেননি।

আপা আজকে আপনার দিন। ৩ মাসের জন্য সেই কন্টকের সিংহাসনে আজকে আপনাকে বসানো হয়েছে। আপা, বলুন আপনি পারবেন পাতিহাঁসদের মা হতে। আপনি আপনার গায়ে কোন কাদা লাগতে দিবেন না। আপনার দেহ থেকে দ্যুতি ঠিকরে পরবে, আপনার চলনও হবে রানীর মত। পরিসীম মিথ্যাচার সত্ত্বেও মানুষ আপনার মেয়েদের প্রশংসায় মুখর। বলুন আপা আপনি আমাদের মা এটি আপনি দেখিয়ে দিবেন।

আমরা আশায় বুক বেধেছি আপা। আবার আকাশি সাদা রঙের বলাকারা সাফল্যের তুঙ্গে অবস্থান নিবে আবার সবাই বলবে "হ্যা ওরা দেখিয়ে দিয়েছে ওরা শ্রেষ্ঠা" আমরাও আপনার গর্বিত সন্তান হতে চাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১১ সকাল ১১:৩৪
৩৫টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×