অনেক দিন হল লেখিই না বলা চলে।ডিপার্টমেন্টের ফেস্টিভ্যালের স্যুভেনিয়ার এর জন্য লিখব লিখব করে শেষ পর্যন্ত লিখেই ফেল্লাম।বুঝতেছি না কেমন হইছে
লিড এর শীষটা শেষ বারের মত লিড পেনসিলের মধ্যে ঢুকাতে চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল রুদ্র।জানালা গুলো প্রচুর শব্দ করছে বাতাসে।জানালার কাছে দাড়াতেই এক ঝাঁক ধুলো এসে চোখে ঢুকে গেল।বাইরে ঝড়ের পুর্বলক্ষণ।ইদানীং সময় অসময়ে ঝড় আসছে।জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ঝড় দেখতে খুব ভালো লাগে। আজ বাইরে বের হওয়া লাগেনি।কিছুদিন হল নতুন একটা পার্টটাইম জব করা শুরু করেছে সে।
আজ ১৪দিন হল একটা গল্প লেখার চেষ্টা করছে।কখনো বানান ভূল,শব্দ ভূল ,বাক্য ভূল।তারপরেও প্রতিদিন লিখছে আর লীড এর শীষ ভেঙ্গে যাওয়ার পরিমান বেড়েই যাচ্ছে।গল্প যেন নিজেরই এক আত্বপ্রতিকৃতি,দূরপরদেশে কিংবা প্রিয়জনের খুব কাছে থেকেও সবকিছু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নতুন এক অজানায় নিজেকে সপে দেয়া।
আগে সে এইকাজটা খুব ভালই পারত।কলম হাতে বসলেই যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার নেশা তা হোক না ক্লাস লেকচারের খাতা,ডায়রী,বইয়ের পিছনে এমনকি সিগারেটের মোড়কের অপর পার্শ্বে।ধীরে ধীরে যেন নিজের বোধটা হারিয়ে যেতে শুরু করে।কবে যে শুরু হল ,সেইযে শুরু হল আর থামানো গেল না।সারাদিন যে বই হাতে থাকত বই আর ছুয়ে দেখতেও ইচ্ছা করে না।কোথাও গেল রবীন্দ্রনাথ,কোথায় শীর্ষেন্দু ,জীবনানন্দ,কোথায় প্রিয় শক্তি, মাঝে মাঝে কিছু রহস্য উপন্যাস,মনের মধ্যে রক্ততৃষনা ,শরীরে আদিম উল্লসতা যেন সেইসব গল্পের ভিলেন আমি ,বারে বারে মানবহত্যা করি ,কখনো আমি ট্রান্সিলভানিয়ার কাউন্ট ড্রাকুলা,কখনো আমি মেক্সিক্যান মাফিয়া-হত্যাই যেন আমার বেচে থাকার কারন কখনো আমার পাশের ফ্ল্যাটের রফিক সাহেব ভুলিয়ে ভালিয়ে মেয়েদের মুগ্ধ করে তাদের হত্যা করি।তারপর খুব ভালো মানুষের মত ডিনার করতে বসি।রক্তের ঔল্লাসিকতায় অখাদ্য গুলোকেও মনে হয় অমৃত।এভাবেই জীবন যাচ্ছিল কেটে।এই স্মার্টফোন আর যান্ত্রিকতাময় জীবনে এরচেয়ে মনে হয় আর ভালোভাবে বাঁচা যায় না।
জবে যাওয়ার সময় কাউকে একটু বেয়াদবি করতে দেখলেই মনে হয় তাকে মারতে থাকি যতক্ষণ পর্যন্ত না তার তার শরীরের শেষ রক্ত বিন্দুটিও সরি বলে।রক্ত টগবগ করা প্রতিটি মুহুর্ত।মনের মধ্যের ইমোশন গুলো যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে কিংবা ঠিক হারিয়ে যাওয়া নয় যেন কোন বুলেটপ্রুফ শীল্ড দিয়ে ঘেরা,কোন কিছুতেই তাকে স্পর্শ করা যায় না।নেই জীবনের কোন বর্তমান,ভবিষ্যত।এই একাকি জীবনে সত্যিকার সঙ্গী শুধু এক টুকরো জ্বলন্ত সিগারেট।
সেইদিন ও অনেক বাতাস,কিছুক্ষণ পরপর ধুলো এসে রুমের মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে।আজ হটাৎ করেই গ্রে কালারের পাঞ্জাবিটা পরতে ইচ্ছে হল। রুম থেকে বের হয়েই মন যেদিকে চায় হাটা শুরু করলাম।খুব একঘেয়ে ভাবে সিগারেট মুখে নিয়ে ফেসবুকের বিরক্তিকর স্ট্যাটাসের দিকে তাকিয়ে এইসব বোরিং লাইফস্ট্যাইল এর প্রতি আরেকবার ঘৃনা নতুন করে জেগে উঠলো।হটাত করে মনে হল কে যেন পিছন থেকে আমার পাঞ্জাবি ধরে টানছে।মাথায় যেন কে আগুনটাকে উস্কিয়ে দিলো,খুব রাগ হয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি একটা ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে কিসের দিকে যেন আমার দৃষ্টি আকর্ষন করার ট্রাই করছে।এত সুন্দর মায়াবী চেহারার দিকে তাকিয়ে আর রাগ করা গেল না,কিছুটা বিরক্ত হয়েই আবার চলতে শুরু করলাম।আবার দেখি মেয়েটা দৌড়ে এসে আবার আমার পাঞ্জাবি ধরে টানাটানি শুরু করলো।কি চায় এই মেয়ে?মনের বিরক্তিটা চরমে উঠলো।নিশ্চয়ই কোন খেলনা টেলনা হারিয়েছে,বা মোবাইলও হতে পারে।এখঙ্কার বাবা-মারাও স্মার্ট।বাচ্চারা ভালোভাবে কথা বলা শিখার আগেই তার হাতে তুলে দেয় স্মার্টফোন।ফলাফল আরকি,এরাও হয়ে উঠবে কিছু ইমোশনলেস যান্ত্রিক মনের মানুষ।শেষে বাবুটার ইচ্ছের কাছে হার মানতেই হল।কাছে যেয়েই দেখি বই এর মত কিছু একটা রাস্তার পাশের খোলা ম্যানহোলে কোন্মতে আটকে আছে।বাবুটার পক্ষে অইটা উদ্ধার করা অসম্ভব।মনে মনে একটু আশ্চর্য হলাম বৈকি।এতটুকুন মেয়ে,বইয়ের প্রতি এত প্যাশনেট!বইটা তুলে আরো আশ্চর্য হলাম –শীর্ষেন্দুর ‘মনোজদের অদভুত বাড়ি’ ।এই সময়ে এই বই এখনো পাওয়া যায়?এখনতো বই আর ছাপানো হয় না বললেই চলে,।এখনকার মানুষ কিন্ডলে পড়তেই বেশি ভালবাসে।এই জেনারেশনতো নতুন বইয়ের মুগ্ধকর ঘ্রাণ,বইয়ের সামনে পিছনে একটু যায়গা পেলেই কবিতা লিখে ফেলা,সারারাত ধরে বালিশের নিচে লুকিয়ে গল্পেরবই পড়া এসব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা পায়নি।
মেয়েটিকে খুব অবাক করা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,এটাকে কি বলে তুমি জানো?মিষ্টি করে উত্তর এল-হু,বই।
এরপর আরো অবাক করার পালা-সে বলল রবীন্দ্র,শরৎ,নজরুল এর মোটামুটি নাকি অনেক কিছুই পড়ে ফেলছে।তার বাসায় নাকি এসব বইয়ে ভর্তি।এবং তার বই পড়তেই নাকি খুব ভালো লাগে।আমাকে বল্ল,তোমার ভালো লাগে না?
আমি বল্লাম,খুব লাগে।
ঃতুমি গল্প লিখতে পাও?
ঃআগে পেতাম।এখন আর পাই না।
ঃএখন আর পাওনা কেন?
ঃলেখার মনটা মরে গেছে যে তাই।
ঃলেখার কি মন থাকে?
ঃহুম,তা থাকে।
ঃতুমি আমার জন্য লিখবে?
বলে কি এই মেয়ে,চিনি না জানিনা,হুট করে দেখা।বেশ ধমকের সুরেই বললাম
আমি তোমার জন্য লিখব কেন?
গুটিগুটী করে তাকিয়ে বল্ল,তুমি লিখলে তোমার গল্পকে বই বানাবো।তারপর আমি পড়বো!
আমি তার এই কল্পনায় হতবাক হয়ে চুপ করে তাকিয়ে থাকলাম।আমার চুপ করে থাকা দেখে তার সুন্দর মুখে ঝড়ের আভাস দেখা দিলো।টপ sসটপ করে চোখ গড়িয়ে বৃষ্টির ফোটা ঝড়তে লাগলো।আমি পুরা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।শেষে বাধ্য হলাম বলতে,ঠিক আছে,আমি লিখবো।হাত দিয়ে তার মুছে দিলাম চোখ।বল্লাম,চল তোমাকে বাসায় রেখে আসি।ওহ,হ্যা,তোমার বাসা কই?
অই সামনে।
ওকে বাসায় পৌছায় দিয়ে আমার নিজের বাসায় ফিরে এলাম।ভিতরে ভিতরে তোলপাড় হতে লাগলো,সিগারেট জ্বালানোই যেন ভুলে গেলাম।অনেকদিন পর লীড আর হোয়াইট পেপার নিয়ে বসলাম।আর কোন সফট কপি নয় ।মনের মধ্যে ছোট্ট মেয়েটির মুখখানি ভাসতে লাগলো।মনে হল আমার পরের প্রজন্মের জন্য আমি কি করেছি?আমি দোষ দেই যান্ত্রিকতার,তাদেরকে ইমোশনলেস যান্ত্রিক বলে ঘৃনা করি।কিন্তু এর দায়ভারতো আমাকেই গ্রহন করতে হবে।আমিইতো এনেছি এই সভ্যতা।আমিতো চেষ্টা করিনি তাদের মাঝে মানুষের মনের মাঝের দুঃখ,কষ্ট,ঘৃনা,সুখ,ভালোবাসা এগুলো পৌছে দিতে!নিজের প্রতি আজ প্রচুর ঘৃণা হল।মনের মধ্যে উথাল-পাতাল আবেগ।লীড পেন্সিলটা হাতে লিখতে শুরু করলাম।ভুলে গেছি লেখার ধরন,ভুলে গেছি শুদ্ধ উচ্চারণ।তবুও আমি লিখতে চাই আমার ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য।তাদের ঘৃণা ভরা চোখ দেখে যেন আমাকে কখনো শিউরে উঠতে না হয়।
বাইরে ঝড়ের পূর্বাভাস,জোরে জোরে বাতাস বইছে।হোক না ঝড় বিধ্বংসী,নতুন তো আসবেই তার সাথে।হয়ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হয়েই একদিন ঢেউ হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১২:২৯