উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া কয়েকজন ছাত্র। সুমন, জামান, আরিফুল, সিরাজ, মনির প্রভৃতি তাদের নাম। তাদের মধ্যে একমাত্র জামান ও সুমন ভাল ছাত্র, নিয়মিত পরীক্ষায় ভাল ফল করে। বাকীরা প্রত্যেক পরীক্ষায়ই কয়েক বিষয়ে বাধ্যতামূলকভাবে ফেল করে। কিন্তু তারা ভাল বন্ধু। জামান ভাল ছাত্র হলেও পুংটার একশেষ। নানা ধরনের আকাম কুকামে তার বিবিধ উৎসাহ দেখা যায়। অন্যদিকে সুমন এই পুংটা ছেলেগুলোর সাথে মিশলেও খুবই ভদ্র ছেলে। বন্ধুত্ব বিষয়টা আসলেই জটিল। কে যে কি কারণে কার বন্ধু হয় তা বলা মুশকিল। এক্ষেত্রে আমরা পারস্পরিক সম্পর্কের রসায়নের উপর দিয়ে বিষয়টা চালিয়ে দিতে পারি।
সুমন আর জামান বাদে বাকি সবাই হার্ডকোর বিড়িখোড়। সুমন বিড়ি একেবারেই খায় না। জামান মাঝে মাঝে খায় তবে অন্যদের মত কতক্ষণ পর পর বিড়ি না খেলে তার বমি আসার লক্ষণ দেখা যায় না। একবার রুবেল ও জামান এক কাজে কোন এক দূরবর্তী এলাকায় গিয়েছিল। ভুল করে রুবেল বিড়ি সাথে নেয় নাই। সেইদিন রুবেল বিড়ির নেশায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে বমি করেছিল।
শবে বরাত হলেই এই ছেলেগুলো একটা সুযোগ পেয়ে যায় বাইরে রাত কাটানোর। এমনিতে যত ফাজলামিই করুক না কেন রাতে তাদের বাড়ীর বিছানাতেই ঘুমুতে হয়, বাড়ীতেই থাকতে হয়। কিন্তু এই রাতে তারা একটা ভাল অযুহাত পেয়ে যায় বাড়ীর বাইরে থাকার। অযুহাতটা হল রাত জেগে ইবাদত বন্দেগী করার অযুহাত। এই রাতে সব মুসুল্লীরা মসজিদে রাত জেগে নামাজ পড়ে, ইবাদত বন্দেগী করে। ফজরের নামাজ শেষে সবাই বাসায় ফেরে। এই ছেলেগুলো সারারাত নামাজ পড়ার অযুহাত দেখিয়ে বাড়ির বাইরে থাকে। নামাজ তারা পড়ে ঠিকই কিন্তু সারা রাত নয় এবং ফজরের নামাজটাও তারা পড়ে না। মসজিদে এশার নামাজের পরে যে জিকির ও মিলাদ হয় তাতে অংশগ্রহণ করে, দোয়ায় শামিল হয়ে, একপ্রস্থ জিলাপি হাতে নিয়ে তারা মসজিদ হতে বের হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় তাদের আসল নৈশ যাপন।
এই ছেলেগুলো কোন খুব ধনী শ্রেণীর সন্তান নয়। বাবা মা সচ্ছল, সংসারে অভাব নেই। এদের মধ্যে জামান বাদে বাকী সবাই বাবার কাছ থেকে হাত খরচ পায়, তবে সেটা তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অংক নয়। এই দশ বিশ টাকার মত সপ্তাহে। তবে সিরাজ প্রায় প্রতিদিনই পাঁচ দশ টাকার মত হাতখরচ পায়। তাই শবে বরাত উপলক্ষে তারা কোন জটিল ধরনের মদ্যপান জাতীয় পার্টির আয়োজন করতে পারে না। তারা যা আয়োজন করে তা হল, ঢাকার উত্তরা থেকে পাঁচটার মত গুদাম গারাম সিগারেট আর পাঁচটার মত মোর সিগারেট কিনে আনে। মোর সিগারেটগুলো হয় লেডিস অর্থাৎ মহিলারা যে চিকন ধরনের সিগারেট খায় সেটা। সাথে কয়েকটা পাতার বিড়ি। সাথে এক প্যাকেট বেনসন। এই হচ্ছে তাদের সারা রাত্রের রসদ। তারা মসজিদে দোয়া শেষ করেই কোন এক ইট ভাটায় চলে যায়। সেখানে নির্জনে একটা মোর সিগারেট ধরিয়ে সকলে মিলে টানতে থাকে। তারা নিতান্তই সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। তাই রাস্তায় সকলের সামনে বুক ফুলিয়ে সিগারেট খেতেও পারে না। আর তাছাড়া পরিচিত মানুষের সামনে পড়ে গেলে সমস্যা। তাই কোন নির্জন জায়গা তারা খুজে নেয়। হতে পারে সেটা ইটভাটা অথবা কোন নির্মীয়মান বাড়ীর ছাঁদ, যেখানে কেউ এত রাত্রে আসবে না।
সবগুলো ছেলে সিগারেট খেলেও সুমন সিগারেট খায় না। সে খুবই ভদ্র। সবাই মিলে জোরাজুরি করে, অনুরোধ করে তাকে একটা টান দেওয়ার জন্য। কিন্তু সে টান দেয় না। মনির হয়তো মোর সিগারেটে একটা টান দিয়ে সুখানুভুতিতে বলে ওঠে, "আহা কইলজাডা ঠান্ডা হইয়া গেল"। কিন্তু এসব সুখানুভুতি আশিকের মন টলাতে পারে না। আরিফুল হয়তো কিছুক্ষণ সিগারেট খেয়ে তারা রাস্তায় ঘুরতে বের হয়। আরিফুল হয়তো অতি সাহসের বশে রাস্তাতেই একটা সিগারেট ধরিয়ে বসে। সিগারেটটা সে সুনিপন কৌশলে হাতের তালুতে লুকিয়ে রাখে যাতে কেউ দেখতে না পায়। ফাক ফোকরে সে দুই একটা টান দেয় সিগারেটে। মনিরও আরিফুলের মত সাহসী। সে আরিফুলের সাথে জ্বলন্ত সিগারেটের হাত বদল করে। একদল ক্লাস সেভেনের ছেলে রাস্তায় ঘুরছে আর তাদের মধ্যে দুইজন হাতের তালুতে লুকিয়ে সিগারেট টানছে। এই হচ্ছে তাদের শবে বরাতের ইবাদত বন্দেগী।
এর মধ্যে তারা একটা রিক্সা ভাড়া করে ফেলে। বয়স কম হলেও তাদের তেজ কম নয়। কথা বার্তায় এক এক জন এলাকার মাতবর এই জাতীয় ভাব। রিক্সাওয়ালা তাদের ভাই ভাই করে আপনি আপনি করে বলে আর ওরা রিক্সাওয়ালাকে তুমি তুমি করে বলে। বাংলাদেশের সব এলাকায় যেমন স্থানীয় লোকদের প্রভাব দেখা যায় এখানেও তাই মঞ্চস্থ হতে থাকে, ব্যাতিক্রম কিছু নয়। ভাবের ঠেলায় এখানে ঠেলাগাড়ী চলে।
রিক্সায় করে ওরা মেইন রোডে উঠে যায়। চলন্ত রিক্সায় সিগারেট খাওয়ার মজা আলাদা, তাছাড়া কেউ দেখে ফেলার ঝুকি কম। কারন রাতের সময় চলন্ত জিনিস চোখে পড়াটা একটু কঠিন বটে! ওরা রিক্সায় বসে এলাকার কোন মাতবর কি করেছে সেইসব আলোচনা করে। ওদের মধ্যে এখনই মাতবর মাতবর একটা ভাব আছে যা ওরা প্রায়ই সুযোগ পেলে খাটায়। খাটিয়ে ওরা মজা পায়। কম বয়সের তাচ্ছিল্যের প্রতিশোধ ওরা এভাবেই নেয়।
মসজিদে মসজিদে নামাজ পড়ে মুসুল্লীরা, জিকির করে মুসুল্লীরা আর কয়েকজন বালক সেইফাকে কোন এক ফাকা মাঠে শুয়ে শুয়ে সিগারেটে দম দেয় আর গল্প করে। ওদের গল্প করার অনেক বিষয় আছে। বেশীরভাগ সময় ওরা স্কুলের স্যারদের পচায়, তাদের নিয়ে কৌতুক করে। ওরা স্কুলের স্যারদের বিভিন্ন ব্যাঙ্গাত্বক নাম দেয় আর সেই নাম ধরে কোন একটা কাল্পনিক কথা বলে আর হেসে ওঠে। কোন স্যারের কোন বিষয়ে দুর্বলতা থাকলে সেই দুর্বলতা নিয়ে বিভিন্নভাবে ব্যাঙ্গ করে। স্যারদের ব্যাঙ্গ করে ওরা আনন্দ পায়, এক ধরণের প্রতিশোধ্মূলক সুখ অনুভব করে। মাঝে মাঝে ক্লাসের কোন ছাত্র যে খুব ভাব ধরে, যেমন কোন একজন ছাত্র পড়াশোনায় ভাল, অথচ কেউ তার কাছে সাহায্যের জন্য গেলে সাহায্য করে না অথবা পরীক্ষার হলে খুব স্বার্থপর তাদের ওরা ব্যাঙ্গকরে, তাদের নিয়ে হাস্যরস করে, নানা রকমের কৌতুক রচনা করে তাদের নিয়ে এবং কৌতুকে তারা তাদের এমন দুরবস্থায় ফেলে যাতে বিষয়টা মজাদার হয়ে ওঠে এবং একধরণের প্রতিশোধমূলক সুখ পাওয়া যায়।
আরো নানা বিষয়ে তারা গল্প করে। কখনো কখনো হয়তো তারা কোন একটা সাম্প্রতিক টেলিভিষনে প্রচারিত বাংলা সিনেমা অথবা নাটক নিয়ে গল্প করে। কোন চরিত্র খুব ভাল কাজ করছে আর কোন চরিত্র খুব খারাপ কাজ করেছে তা নিয়ে আলোচনা করে। মাঝে মাঝে নিজেদের কথা বলে। কেউ হয়তো কোন জায়গায় গিয়ে কোন বাহাদুরি মুলক কাজ করে এসেছে, অন্য এলাকায় গিয়ে সেই এলাকার ছেলেপেলেদের ঝাড়ি মেরে এসেছে সেই আলোচনা করে ওরা। ওরা ওদের পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, মতামত দেয়। ওরা মনে করে এতে ওদের জ্ঞান বৃদ্ধি হচ্ছে। ওরা নিজেদের অন্য ছেলেদের থেকে বেশী জ্ঞানী ভাবে, কারণ অন্য ছেলেদের তাদের মত সাহস নাই। ওরা মনে করে ওদের এই বন্ধুদের দলটাই তাদের স্কুলের সবচেয়ে জ্ঞানী ছেলেদের দল। পারলে তারা মাষ্টারদের হটিয়ে ক্লাস নিত কিন্তু যেহেতু সেটা সম্ভব না তাই তারা সেটা করতে পারছে না। মাষ্টারদের বৈষম্যমূলক আচরণ ও দূর্বল শিক্ষাদানের ওরা যারপরনাই বিরক্ত। ওরা মনে করে ওদের মস্তিষ্ক খুব উন্নত শুধু ভাল কয়েকজন শিক্ষক পেলেই ওরা খুব ভাল হয়ে উঠত।
নানা কথায় রাত পেরিয়ে যায়। গুদাম গারামের কারণে জামানেরর পকেটে তেজপাতার গন্ধ দেখা দেয়। জামান বার বার পকেট ঝাড়ে। একসময় ফজরের আজান দেয়। ওরা সকলে বাড়ীর দিকে রওয়ানা দেয়। সকলের বাড়ীতেই অনেক রাত পর্যন্ত হালুয়া রুটি বানানো হয়। সবার মায়েরা রাত জেগে হালুয়া রুটি বানায়। তাই বাড়ীর দরজা খোলাই থাকে। সকলেই বাড়ী ফেরার পথে চুইংগাম চাবায় ও লজেন্স চোষে। উদ্দেশ্য মুখের গন্ধ দুর করা। বাড়ী পৌছেই ওরা আগে বাথরুমে ঢুকে এবং বার বার কুলি করে। ওরা খুব সতর্ক থাকে যেন ওদের জামা কাপড়েও সিগারেটের গন্ধ না পাওয়া যায়। ওদের মধ্যে যাদের কাপড়চোপড় ওদের মায়েরা ধোয় তারা তৎক্ষনাৎ কাপড় ভিজিয়ে ফেলে। কারণ কাপড় থেকে সিগারেটের গন্ধ পেলে সমস্যা। প্যান্ট ভেজানোর দরকার নাই, শার্ট ভেজালেই যথেষ্ট। একসময় ওরা হালুয়া রুটি খেয়ে ঘুম দেয় আর পরদিন বেলা বারোটার সময় ঘুম থেকে উঠে। শুরু হয় তাদের নিত্যদিনের ফালতু জীবন যাপন।
সতর্কবাণীঃ
এই লেখা পড়ে কোন ব্লগার তার কম বয়সী ছেলেদের প্রতি অতিরিক্ত নজরদারী করবেন না। ছেলেদেরকে তাদের মত বড় হতে দিন। আপনি যেটুকু নজরদারী এই লেখা পড়ার আগে করতেন এই লেখা পড়ার পরেও ততটুকুই করবেন, অতিরিক্ত, আমি আবার বলছি আতিরিক্ত কিছু করবেন না। কারণ যে ছেলে বিড়ি খায় সে এমনিতেই খাবে, হাজার চেষ্টা করলেও আপনি তাকে ঠেকাতে পারবেন না, আপনার চৌদ্দ গুষ্টি মিলেও কিছু করতে পারবেন না। সর্বত্রং জয়ং পুত্রাৎ শিষ্যাৎ পরাজয়ং। বিড়ি না খেলে আপনার ছেল এমনিতেই খাবে না। সুমন এত খারাপ অবস্থায় থেকেও, যেখানে সে একদল বিড়িখোরের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে, সারারাত তাদের সাথে থেকেছে, কিন্তু বিড়ি খায়নি। বিড়ি যার খাবার সে এমনিতেই খাবে আর যে না খাবার সে কিছুতেই খাবে না, তার চৌদ্দগুষ্টি সাধলেও খাবে না। আপনি ছেলেপেলেদের উপর নজরদারী বন্ধ করে তাদের নৈতিক শিক্ষা দিন। একজন বালক যখন দেখে তার বাবা তাকে নৈতিক শিক্ষা দিচ্ছে অথচ অন্য বাবাদের মত অহেতুক খবরদারী করছে না, তাকে স্বাধীনতা দিচ্ছে তখন সে এই অনাকংখিত স্বাধীনতার জন্য তার বাবার প্রতি এক ধরণের ঋণবোধ করে। এই ঋণের প্রতিদান সে দেয় নষ্ট না হয়ে। নৈতিক শিক্ষা ছাড়া স্বাধীনতা দেওয়া ভাল না আর নৈতিক শিক্ষা দিয়ে খবরদারী করাও ভাল না। খবরদারী একধরণের বিদ্রোহী মনোভাব ও অভিমানের জন্ম দেয় বালকদের মনে, যে অভিমানের বশে তারা খারাপ কাজ করে বাবাদের উপর প্রতিশোধ নেয়। অনেকতা এরকম, " দেখ চৌধুরী সাহেব তুমি আমার উপর কি খবরদারীটাই না করলে আর আজ তোমার ছেলে খারাপ সংসর্গে খারাপ কাজ করছে"। এখানে ছেলেটার দুইমুখী সত্ত্বা কাজ করে। এইসব কোন সাইকোলজীর বই পড়ে বলছি না, জীবন থেকে দেখে বলছি। এখন আপনার সিদ্ধান্ত আপনার। ছেলে জন্ম দিয়েছেন আপনি, অতএব ছেলের মালিকানা আপনার। আপনি বেছে নিন আপনি কি করবেন।
আর বিড়ি খেলেই যে মানুষ নষ্ট হয়ে যায় এটা একটা আবালীয় ধারনা। দুনিয়ার তাবৎ বড় বড় বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, আইনবিদ বিড়িখোর, চুরুটখোর, পাইপখোর। তারা যদি বিড়ি খেয়ে এত কিছু হতে পারে তাহলে আপনার সন্তানও পারবে।
খুদাপেজ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৩:৫৫