প্রথমেই বলে নেয় যে আমি কোনো বইয়ের ভালো-মন্দ নিয়ে লিখতেছি না,সেই ক্ষমতা আমার নাই। আমি যা বলবো তা কারো ভালো লাগতে পারে,কারো খারাপ লাগতে পারে কিন্তু সবই আমার নিজের মনের কথা। তাই এই লেখাটি পড়ে কেউ ভাববেন না যে আমি কোনো "বুক রিভিউ" করতেছি বা কোনো লেখক ভালো না খারাপ সেটা যাচাই করতেছি।
হুমায়ুন আহমেদ নিঃশন্দেহে এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। প্রতিবার একুশের বইমেলায় তার লেখা বই কেনার ভীড় দেখেই সে কথা বোঝা যায়(আমি নিজেও বহু কষ্ট করে ভীড়ের মদ্ধে প্রতি বছর তার বই কিনি
হুমায়ুন আহমেদ অসম্ভব প্রতিভাবান একজন মানুষ এইটা নিয়ে মনে হয় তার কোনো গোড়া নিন্দুকেরও আপত্তি থাকার কথা না। তার জ্ঞান এবং মেধা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই,থাকার কথাও না। কিন্তু হুমায়ুন আহমেদের সেই মেধার কতোটুকু আমরা আসলে তার লেখায় প্রতিফলিত হতে দেখি?? তিনি বছরের পর বছর পাঠকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সেরা লেখক কিন্তু তার লেখা অনেকটা একই ছকে বাধা। ছকে বাধা লেখা খারাপ না,সব লেখকই তাদের নিজেদের মতো করে লেখেন এবং লেখক যেভাবে লেখেন সেটিই তার নিজের ছক হয়ে যায়। একজন লেখকের ৩/৪টা বই পর পর পড়লে বোঝা যায় যে সেই লেখকের লেখার কমন ফরমেট কেমন। আমার এই উপলব্ধি হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কয়েকটি বই পর পর পড়ে। পরে আমি সমরেশ মজুমদার এবং অন্যান্য কিছু লেখকের বই পড়েও একই অভিজ্ঞতার সম্মুক্ষীন হয়েছি।
হুমায়ুন আহমেদও এর ব্যতিক্রম না। কিন্তু আমার কথা হলো হুমায়ুন বছরের পর বছর যে প্রেমের উপন্যাসগুলো লিখছেন তারে আসলে তেমন কোনো বৈচিত্র নেই। সেই একই কথা ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে লেখেন তিনি। তার গল্পের চরিত্রের নামগুলোও একই-মুহিব,আসমানী,মৃন্ময়ী,শাহেদ,ছদরুল ইত্যাদি। কেউ যদি হুমায়ুন আহমেদের ৩/৪টি উপন্যাস একবারে পড়েন তাহলে একটি হলেও নাম কমন পরে যাওয়ার সম্ভাবনা ১০০%
কিন্তু "জোছনা ও জননীর গল্প"(একুশে বইমেলা ২০০৪ এ প্রকাশিত) উপন্যাস দিয়ে হুমায়ুন আহমেদ আবারো আমার দুঃখটাকে বড়ো করে দিলেন। যদিও ২০০৪সালের উপন্যাস কিন্তু আমি এটি পড়েছি ২ দিন আগে,অনেক দিন ধরে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও পড়া হয়ে ওঠেনি কিন্তু এইবার সেই সুযোগ হয়েছে আর এর ফলে আমার সেই আগের কথাটায় আবার নতূন করে মনে হয়েছে যে, "আহারে,প্রতিভার কি অপচয়ই না করেছেন এই মানুষটি"
"জোছনা ও জননীর গল্প" দিয়ে হুমায়ুন আরো একবার দেখিয়েছেন তিনি কোন শ্রেণীর লেখক। সাথে সাথে এই কথাটাও প্রমাণ করে দিয়েছেন যে তিনি যদি তার মেধার সামান্য অংশও বাংলা সাহিত্যকে দিতেন তাহলে বাংলা সাহিত্য আরো অনেক বেশি সমৃদ্ধ হতো।
হুমায়ুনের অন্যান্য গতানুগতিক উপন্যাসগুলোর চেয়ে "জোছনা ও জননীর গল্প" একেবারেই অন্যরকম তা নয়। "জোছনা ও জননীর গল্প" মূলত মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে উপন্যাস হলেও এতে প্রেম,ভালোবাসা সবই আছে। হুমায়ুন তার স্বভাবসুলভ গল্প বলার ভঙ্গিতে ৭১'এর সেই ভয়াল ৯ মাসের কথা বলেছেন পাঠকদের।
উপন্যাসের শুরু হয়েছে নীলগঞ্জ স্কুলের আরবি শিক্ষক মাওলানা ইরতাজুদ্দীন কাশেমপূরীকে দিয়ে যিনি ঢাকায় তার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে আসেন। এইখান থেকেই আমরা নানা ঘটনার মাধ্যমে আস্তে আস্তে পরিচিত হয় শাহেদ,আসমানী,নাইমুল,মরিয়মসহ উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রের সাথে। এই চরিত্রগুলোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্প নিয়েই মূলত এই উপন্যাস কিন্তু লেখক এই গল্পগুলোর মধ্য দিয়েই ফুটিয়ে তুলেছেন ৭১'এর সেই ৯মাসের ভয়াবহতা।
লেখকের বর্ণনায় উঠে এসেছে ২৫মার্চের সেই কালরাত্রির কথা। খুব সংক্ষেপে তিনি বর্ণনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং হলের ছাত্রদের উপর চালানো বর্বরতার কথা। যদিও খুব বেশি বিষদ বিবরণ নেই কোনো ঘটনার কিন্তু তাতে যুদ্ধের ভয়াবহতার কোনো কমতি ছিলো না। খুব সহজ ভাষায় হানাদারদের ৯ মাসের বিভৎষতার বর্ণনা দিয়েছেন সাথে সাথে "বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র" থেকে অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনাও তুলে ধরেছেন। সাথে সাথে কিছু কিছু জায়গায় রয়েছে লেখকের নিজের স্মৃতির বর্ণনা।
গল্প বলতে বলতেই বর্ণনা করেছেন যুদ্ধের ভয়াল দিনগুলোতে দেশের লাখ লাখ মা বোনের প্রতীক হয়ে ওঠা মরিয়ম,আসমানী,কংকনদের কথা। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শাহেদ-আসমানীর পুনঃমিলন যেমন পাঠকের চোখে পানি আনে তেমনি যুদ্ধের ২৫/৩০ বছর পর লেখকের সাথে দেখা হওয়া কংকনের কান্না শুনে লেখের যখন মনে হয়েছিল যে কংকন কাদছে না,কাদছে তার বাংলাদেশ তখনো পাঠক সমানভাবেই আপ্লুত হয়। নাইমুলের হাসতে হাসতে হানাদার ও তার দোসরদের হত্যার কাহিনী;কাদের সিদ্দিকী,হেমায়েতউল্লাহর সাহসিকতার কাহিনী পড়তে পড়তে যেমন শরীরের রক্ত গরম হয় তেমনি প্রথমে শান্তিবাহিনীর প্রধান হউয়ার পর বোধোদয় হওয়া অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ মাওলানা ইরতাজুদ্দীন কাশেমপূরীর মৃত্যু গভীরভাবে নাড়া দেয় পাঠককে। শেখ মুজিব সম্পর্কে ইয়াহিয়া খানকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বলা "আপনার হাতে মৃত্যুর চেয়ে সে অনেক বড় মাপের মানুষ" কথাটা যেমন পাক বাহিনীর মুজিব ও তার জনগণের প্রতি ভয়কে (এইটা আসলে একধরনের শ্রদ্ধাও,মুজিব যেটি পাওয়ার যোগ্য ছিলেন) প্রকাশ করে তেমনি নিয়াজী যখন কাদের সিদ্দিকীকের করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দেবার পর কাদের সিদ্দিকী বলেন যে তিনি নারী ও শিশু হত্যাকারীদের সাথে হাত মেলান না তখন পাকিস্তানিদের প্রতি সমগ্র বাঙ্গালির ঘৃণাও চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধের অনেক উপন্যাস/লেখাই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না(ছোট মুখে বড় কথা বলতে বাধ্য হলাম
উপন্যাসের প্রতিটি কথারই সত্যতা আছে তার প্রমাণ হুমায়ুন দিয়েছেন বিভিন্ন রেফারেন্স ব্যবহার করে। এটি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এর একটি অনন্য দলিলস্বরূপ তা বলতে দ্বিধা নেই। হুমায়ুন আহমেদ প্রমাণ করেছেন যে আসলেই তিনি কতো বড় লেখক। অবশ্য গত কয়েক বছরে তিনি "মধ্যাহ্ন ১","মধ্যাহ্ন ২","মাতাল হাওয়া" লিখেও তার লেখনী সক্তির প্রমাণ দিয়েছেন।
সবশেষে বইটি পড়ে একটা কথায় মনে হয়েছে বার বার যে আসলেই বাঙ্গালী যে সাহস নিয়ে কোনো ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই অসীম শক্তিধর পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল,সেই সাহস আমাদের মধ্যে নেই। সেই সাহসে সামান্যতম কিছু থাক্লেও আমার মনে হয় আজ আমরা এতো বেশি দূর্নীতিপরায়ণ জাতি হিসাবে পরিচিত হতাম না।
স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ সকল বীরদের প্রতি রইলো অসীম শ্রদ্ধা।
মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কতো প্রাণ হলো বলিদান
লেখা আছে অশ্রুজলে।
কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা,
বন্দিশালার ঐ শিকলভাঙা
তার কি ফিরিবে আর সুপ্রভাতে?
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে।।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১০ রাত ১২:১২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




