এখন আপনারা সবাই সিট পাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়া দেন। দেখেন একটা টিকিট পান কি না। লাইনে দাঁড়াইয়া টিকিট নেন। কোনো হুড়াহুড়ি, পাড়াপাড়ি করবেন না। শৃঙ্খলা রেখে আস্তে আস্তে আসবেন।’ গতকাল ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের টিকিটপ্রত্যাশীদের উদ্দেশে বলছিলেন রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
তবে যাত্রীরা কোনোভাবে ট্রেনে পা রাখার একটা টিকিট পেলেই যেন খুশি। কারণ, ঈদের আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বাড়ি ফেরা আর ঢাকা ছাড়ার আনন্দ। সেই আনন্দের রেশ ছিল অনেকের চোখে-মুখে।
এদিকে যাঁরা আগেই গতকালের টিকিট কিনেছেন বাড়ি ফেরার জন্য, তাঁরা রেলস্টেশনে ঢুকেছেন অনেকটা হুল্লোড় তুলে। কাঁধে বাক্স-পেটোরা নিয়ে আপনজনের হাত ধরে ছুটেছেন নির্ধারিত প্লাটফরমের দিকে। ট্রেন ছাড়ার দেরির সময় কেটে গেছে গল্পে-স্বল্পে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বরের সব টিকিট আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। তার পরও সারাদিন টিকিটের জন্য প্রচুর লোক লাইনে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের অনেকেই আসনবিহীন (দাঁড়িয়ে যাওয়ার) টিকিট কিনেছেন। রেলওয়েতে মোট আসনের ২০ শতাংশ আসনবিহীন টিকিট বিক্রির নিয়ম আছে। তবে ঈদে আসনের সমপরিমাণ আসনবিহীন যাত্রী ভ্রমণ করে থাকে।
কমলাপুরের স্টেশন মাস্টার আবদুল্লাহ আল মাসুম বলেন, ‘টিকিট শেষ হলেও ঘরমুখো মানুষের কথা চিন্তা করে স্ট্যান্ডিং টিকেট চালু করা হয়েছে। এ টিকিট নিয়ে যাত্রীরা যেতে পারবেন। তবে একটু কষ্ট সহ্য করে তাঁদের দাঁড়িয়ে যেতে হবে।’
গতকাল কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে প্রায় সব ট্রেনই দেরিতে ছেড়েছে। কোনো কোনোটি দুই থেকে তিন ঘণ্টা দেরিতেও ছেড়েছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গগামী সব ট্রেন ছেড়েছে দেরিতে। পুরোনো ইঞ্জিনসহ নানা কারণে এই দেরি।
অবশ্য কয়েকজন যাত্রী বলেন, প্রতিবছরই ঈদের সময় কমলাপুরে ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে। কিন্তু গতানুগতিক একটি করে কোচ সংযোজন করেই দায়িত্ব শেষ করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সময়মতো ট্রেন আসে না। আসন পাওয়া যায় না। আবার কোনো কোনো ট্রেনে দাঁড়ানোর অবস্থাও থাকে না। রেলওয়ের অব্যবস্থাপনার জন্যই যাত্রীদের ঈদের আনন্দভ্রমণে নানা ভোগান্তি যোগ হয়।
স্টেশনে বইসা ভাবি...: গতকাল আন্তনগর তূর্ণা নিশীথা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার কমলাপুরে আসার কথা ছিল সকাল ছয়টায়। কিন্তু এসেছে বেলা ১১টায়। চট্টগ্রাম থেকে মহানগর প্রভাতী দুপুর দুইটা ৫০ মিনিটে কমলাপুরে আসার কথা থাকলেও এসেছে পৌনে চারটার দিকে। একই অবস্থা ছিল সুবর্ণ এক্সপ্রেসসহ চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা অন্য সব কটি ট্রেনের।
ঢাকা থেকে প্রতিদিন সকাল সাড়ে নয়টায় দিনাজপুরের উদ্দেশে একতা এক্সপ্রেস ছেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এটি গতকাল নির্ধারিত সময়ের চেয়ে সাড়ে চার ঘণ্টা পর কমলাপুরে পৌঁছেছে। ঢাকা ছেড়ে গেছে দুপুর সাড়ে ১২টায়।
জানা গেছে, গত দুই-তিন দিন ধরে ঢাকা থেকে একটি ট্রেনও নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করতে পারছে না।
কমলাপুরের স্টেশন মাস্টার (প্লাটফরম) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সব কটি ট্রেন নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে এসে পৌঁছাচ্ছে। এ কারণেই ছেড়ে যেতেও দেরি হচ্ছে। পরের গন্তব্যেও এটি নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে পারছে না। ফলে আবার কমলাপুরে ফিরে আসতেও দেরি হচ্ছে।
গতকাল দুপুর দুইটায় সিলেটের উদ্দেশে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, দুপুর তিনটায় চট্টগ্রামের উদ্দেশে মহানগর গোধূলী, বিকেল চারটা ২০ মিনিটে চট্টগ্রামের উদ্দেশে সুবর্ণ এক্সপ্রেস, বিকেল চারটা ৪০ মিনিটে ময়মনসিংহের উদ্দেশে মহুয়া এক্সপ্রেস ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। তবে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এসব গন্তব্যের যাত্রীদের দীর্ঘ সময় কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
স্টেশন মাস্টার আবদুল্লাহ আল মাসুম বলেন, এত যাত্রীর চাপ রেলওয়েতে সব সময় হয় না। ইঞ্জিন অচল হয়ে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত ইঞ্জিন না থাকার ফলেও সংকট তৈরি হয়েছে।
যাত্রী বেশি, আসন কম: প্রত্যেকটি ট্রেনে ১৮ থেকে ২০টি বগি বা কোচ রয়েছে। একটি কোচের আসন সংখ্যা ৬০টি। এই হিসাবে একটি ট্রেনে সর্বোচ্চ ১২০০ থেকে ১৪০০ জন যাত্রী যেতে পারে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেট ছাড়া বাকি গন্তব্যে মাত্র দুটি করে ট্রেন আসা-যাওয়া করে। অথচ শুধু গতকালই কমলাপুরে বিভিন্ন গন্তব্যের জন্য টিকেট নেওয়া যাত্রীর সংখ্যাই ছিল ১০ হাজার ২৫৪ জন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অতিরিক্তি যাত্রীদের কেউই আসন পাবেন না, দাঁড়িয়ে যেতে হবে।
যাত্রীরা জানান, যাঁরা আসন পেয়েছেন, তাঁদেরও স্বস্তির কারণ নেই। প্রতিটি কোচে থাকছে আসনবিহীন অতিরিক্তি যাত্রী। এর মধ্যে তীব্র ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদেও চড়ে বসেছেন অনেকে।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছেন নুসরাতুন নবী। তিনি জানান, কমলাপুরের পর বিমানবন্দর স্টেশনে এসে ট্রেনটির যাত্রী দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। নড়াচড়াও করা যায় না। আর কমলাপুরে তো কয়েক ঘণ্টা বসেই থাকতে হলো।
বাড়ি ফেরার আনন্দ বনাম অপেক্ষার কষ্ট: সকালে রাজশাহী যাওয়ার জন্য কমলাপুরে আসা ধূমকেতু এক্সপ্রেসের যাত্রী শারমিন সুলতানা বলেন, ‘সেহির খেয়ে বাসা থেকে বের হয়েছি। আমার ট্রেন ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল ভোর ছয়টায়। সব সময়ই ধূমকেতু ভোর পাঁচটায় কমলাপুর স্টেশনে থাকে। কিন্তু এবার পৌনে সাতটার সময়ও ট্রেনের দেখা নেই।’
বিকেলে সুবর্ণ এক্সপ্রেসের জন্য অপেক্ষমাণ ছিলেন কয়েক হাজার যাত্রী। এদের একজন মোহাম্মদ তারেক বলেন, মোবাইল ফোনে ট্রেনের টিকেট করেছি। এই টিকেট নিতে এক ঘণ্টা আগে আসতে হয়। ট্রেনটি চারটা ২০ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার কথা, এখন ছাড়ছে সাড়ে চারটায়। তবে ১০ মিনিটের এই দেরিতে তেমন বিরক্ত নন যাত্রীরা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



