মনে ও মানে বাংলা ভাষা
মানুষ কথা বলতে শেখার পর ভাষার জন্ম হয়েছে প্রায় আট হাজার। তার মধ্যে একুশ শতকে এসে বেঁচে আছে প্রায় পাঁচ হাজার।
অধিকাংশ মানুষ কথা বলে মাত্র ১৪টি প্রধান ভাষায়।
জীবিত সাড়ে চার হাজার ভাষার প্রতিটিতে কথা বলে এক লক্ষেরও কম মানুষ।
পঞ্চাশটির বেশি ভাষায় কথা বলতে পারে মাত্র এক জন করে৷ সবচেয়ে বেশি ভাষা পাপুয়া নিউগিনি নামের ছোট একটি দ্বীপে, ৮৩২টি৷
এশিয়ায় মোট ভাষা প্রায় আড়াই হাজার৷ সংক্ষিপ্ত এই ভাষা পরিসংখ্যানে ‘বাংলা’ ভাষা পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ ভাষা৷
১৭ নভেম্বর ১৯৯৯, ইউনেস্কো ঘোষণা দেয় ২১ ফেব্রুয়ারি International Mother Language Day৷ সবাই তা জানি৷ সাথে বলা হয়েছিল- বাংলা ভাষা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহৎ ভাষা।
চাইনিজ ম্যান্ডারিন প্রথম, স্প্যানি শদ্বিতীয়, ইংলিশ তৃতীয় এবং হিন্দি চতুর্থ৷অন্যদিকে ২০০৪-এ ইউনস্কোর আরেক হিসাবে বাংলা’কে চতুর্থ স্থান দেয়৷ যদিও এখনো পর্যন্ত অন্য অনেক পরিসংখ্যানে ‘বাংলা’ ষষ্ট কিংবা সপ্তম ধরে৷
২০০৪ এর হিসেবটায় ভারতীয় অনেকেই একমত নন যদিও৷ হিসেবটা ছিল এমন — বাংলাদেশে ১৫ কোটি, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় এবং ত্রিপুরায় ৯ কোটি, সারা পৃথিবীতে ইমিগ্রান্ট হয়েছে কিন্তু ঘরে বাংলা প্রথম ভাষা- এমন প্রায় এক কোটি । সবমিলে ২৫ কোটি৷
১৯৯৯ সালের ঘোষণায় হিন্দি ভাষীর সংখ্যা ধরা হয়েছিল ৩০ কোটি, যাদের প্রথম ভাষা হিন্দি।
ভারতের বাকি ৭০ কোটির উপর লোক বাদবাকি ১৯টি প্রধান ভাষায় কথা বলে৷
হিন্দিভাষীদের মধ্যে একটু শুভঙ্করের ফাঁকি ছিল এবং ভারতে ইংলিশ অনেকের প্রথম ভাষা হয়ে দাঁড়ানোর কারণে হিন্দিভাষীদের সংখ্যা কমতির দিকে ছিল গত চার দশক ধরে৷ হিসাবে ফাঁকিটা ছিল এইযে- হিন্দি এবং উর্দু- দু’ ভাষাতেই ঘরে কথা বলে এমন সংখ্যা ছয় কোটির উপরে ছিল বলে দেখা যায়। তাই, শুধু হিন্দি একমাত্র ঘরের ভাষা, এই হিসাবে গিয়ে দাঁড়ালো ২৪ কোটি মাত্র !
২৫ কোটি বাংলাভাষীদের পঞ্চম থেকে চতুর্থ বলা হল৷
এবার একটু অন্য হিসাবে যাই ।
একশ বছর আগেও বাংলা ভাষা কিভাবে বৃহৎ ভারত শাসন করতো, তার ছোট নমুনা দেবো, যা আজকে হিন্দি এবং ইংরাজি দখল করেছে৷
উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরনো ভাষা ‘কোল’ — যা এখনো সাঁওতাল, মুন্ডাদের মাঝে মুমূর্ষার মত বেঁচে আছে৷তারপরের পুরনো দ্রাবিড়ভাষা- যা থেকে তামিল ভাষার উৎপত্তি । এরপরে এলো আর্য্যভাষা, যেটা থেকে পরে হিন্দি, বাংলা, গুজরাটি ভাষা এলো৷
১৯০১ সালের বৃহৎ ভারতে মোট জনসংখ্যা ছিল ২৮ কোটি, বাংলায় কথা বলত ৪ কোটি ৭০ লক্ষ, মোট জনসংখ্যার এক-ষষ্ঠাংশ।শুধু হিন্দি জানতো-বলতো লোকের সংখ্যাছিল ১৩ কোটি। হিন্দি প্রথম ভাষা- এমন লোক ছিল ৪ কোটি ১০ লক্ষ৷বাংলা ভাষা ছিল তখন সমগ্র উপমহাদেশের সবচেয়ে বৃহত্তম একক ভাষা।
ওই ১০০ বছর আগেও ব্রিটিশ ভারতবর্ষে বাঙালিরা সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত, সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, সবচেয়ে উঁচুমানের সাহিত্যের সৃষ্টি এবং যথেষ্ট ধনবানও ছিল৷সময়ের ব্যবধানে মাত্র একশ বছরে বাংলাদেশে বাংলাভাষার মর্যাদা ৫২’
এর ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেলেও, পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিশাল অঞ্চলজুড়ে হিন্দির রাজত্ব।
এইদিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালিরা নিজের বাসভূমেই ভাষায় পরাধীন, সামনে হয়ত ভাষায় ভিটাহারাও হবেন !
বাংলাভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত তিনটি গান তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত।বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কা।
রবি ঠাকুরের একটি গানের কথা ও সুর ১৯৪০ সালে George Wilfred Samarakoon যিনি আনন্দ সামারাকন নামে পরিচিত, বাংলা থেকে সিনহালা ভাষায় অনুবাদ করেন।
পরবর্তীতে নালাথাম্বি ও তামিল ভাষায় অনুবাদ করেন এবং ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ঠিক করা হয়।
এবার আসি – ‘বাংলা’ পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম ভাষা প্রসঙ্গে।
২০১০ সালে ইউনেস্কো একটি ঘোষণা দেন বলে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে।যদিও পরবর্তীতে দেখা গেছে যে, ইউনেস্কো আসলে চারমাসব্যাপী একটি অনলাইন সার্ভে করেছিল, যার বরাত দিয়ে টাইমস অফ ইন্ডিয়া একটি খবর ছাপে। তখন খবরটিতে UN এর বরাত দিয়ে বলা হয়, ভারতের জাতীয় সঙ্গীত পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রুতিমধুর জাতীয় সঙ্গীত এবং বাংলা পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম ভাষা। দ্বিতীয় স্থানে ধরা হয় স্প্যানিশ, এবং তৃতীয় হয় ডাচভাষা। ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ এবং বাংলা, ধ্বনি বিজ্ঞানের আলোকে আগে থেকেই মধুর ভাষা বলা হত।
যদিও সবার মাতৃভাষা তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা, পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম ভাষা।
এক সময়ে আনঅফিসিয়ালি সবচেয়ে sweetest ধরা হত ফ্রেঞ্চ ভাষা।কিন্তু, ভাষার গবেষণায় দেখা গেল- বাংলাভাষা কথোপকথনে সবচেয়ে মিষ্ট, শ্রুতিমধুর, এবং উচ্চারণে ব্যঞ্জনাময়। কারণ হল, বাংলাশব্দগুলো সঠিক ধ্বনির উপায় – যাকে আমরা প্রমিত বাংলা বলে থাকি, অনুসরণ করলে, প্রতিটি শব্দ পৃথকভাবে উচ্চারিত হয়।
সেই সাথে প্রতিটি উচ্চারণ পরবর্তী শব্দের পৃথক উচ্চারণের সাথে মিলে একটা বৈচিত্র্যময় সিম্ফনির সৃষ্টি করে, যা পৃথিবীর অনেক ভাষাতেই বিরল। বাংলাভাষার শব্দগুল উচ্চারণে মিউজিক্যাল, ধ্বনির মধ্যে একধরনের সফট-রাউন্ড-স্কেল আছে। যেকারণে, বাংলাভাষা গানের ভাষা, কবিতার ভাষা, গান ও কবিতা সৃষ্টির ভাষা।
ভাষা দিবসে আর কিছু না পারি, অন্তত ভুলে যাবেন না, পৃথিবীর প্রধান একটি ভাষায় কথা বলি আমরা, যে ভাষা সংখ্যায় শুধু বিশাল নয়, মানের দিক থেকেও একটি উন্নত ভাষা।