- হুম ।
-ওঠো না ! কথা বলব । ওঠো ।
সারাদিন খাটাখাটনির পর যদি একটু শান্তি মত ঘুমাতে না পারি তাহলে কি ভাল লাগে ? আমি চোখ না খুলেই বললাম
-আনুশেখা তুমি কিন্তু আমাকে বিরক্ত করছো ! আমাদের মধ্যে কি ডিল হয়েছিল মনে নেই ? ঘুমানোর সময় তুমি আমাকে বিরক্ত করতে পারবে না ।
-আমি বিরক্ত করলাম কই ? একটু তো কথা বলতে চাইছি !
-এখন কথা বলতে হবে না । আমাকে ঘুমাতে দাও ।
হঠাৎ আনুশেখার গলায় অভিমানের সুর টের পেলাম ।
-হ্যা , আমি তো কেবল তোমাকে বিরক্তই করি ! আমি তো বেশি কথা বলি ! সারাটা দিন আমার কিভাবে কাটে কেউ ভাবে না । নিজে তো সারা দিন মানুষের সাথে চিৎকার চেচামেচি করে অস্থির আমি একটু কথা বলতে গেলেই দোষ ! বেঁচে থাকতেও আমার কথা কেউ শুনতো মরে গেছি এখনও কেউ শুনে না ।
চোখ মেলতেই হল । না হলে পেত্নীর প্যান প্যানানী সারা রাতেও থামবে না । বিছানা ছেড়ে উঠে লাইট জ্বালাম । দেখি আনুশেখা দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । ওর শরীরটা অনেকটা আবছার হয়ে গেছে ।
এখনই গায়েব হয়ে যাবে ।
-শোন ।
জোরে ডাক দিলাম । কিন্তু আনুশেখা শুনলো না । অদৃশ্য হয়ে গেল । এই মেয়েটার এই এক দোষ !
মেয়ে !
নিজেয় কাছে হাসি পেল । ও তো মেয়ে না । না মানে মেয়ে ছিল । এখন হয়েছে মেয়ে ভূত । সোজা বাংলায় যাকে বলে পেত্নী ।
কিন্তু আনুশেখাকে কেন জানি পেত্নী বলতে ইচ্ছা করে না । আমি আবার ওর নাম ধরে ডাক লাম । ও সাড়া দিল না । অভিমান করলেই মেয়েটা এমন করে ।
মানুষ তো বলে মেয়েদের বোঝা জটিল ! শুধু মেয়ে মানুষ না মেয়ে ভূত দের বোঝাও জটিল কাজ । আমি আবার ডাক দিলাম ।
-প্লিজ আনু সামনে এসো । আমি তো ঘুমের ঘোরে বলেছি । সত্যি সত্যি তো বলি নি ।
-না তুমি সত্যি সত্যিই বলেছ ।
-বলি নি বাবা । আচ্ছা ঠিক আছে আই এম সরি । এই দেখো কান ধরছি । এবার সামনে আসো ।
-আসবো না । তোমার সাথে কথা নাই ।
-ঠিক আছে আর কি করা ? আমি একা একাই বারান্দায় বসে থাকি । বসে বসে হাওয়া খাই ।
আমি জানি এতে কাজ হবে । আনুশেখার বারান্দায় বসে গল্প করতে খুব ভাল লাগে । আমি দোতলার বারান্দার দিকে এগিয়ে যাই ।
শুনতে কি অবিশ্বাষ্য লাগছে যে একটা অশরীরি আত্মার সাথে গল্প করার জন্য আমি দোতলার বারান্দার দিকে যাচ্ছি । যেখানে এমন কথা শুনেই মানুষের ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসার কথা সেখানে আমার কাছে একা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা ।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি আনুশেখাকে দেখে আমার কখনই ভয় লাগে নি । এমন কি যখন আমি ওর সম্পর্কে সত্যিটা জানলাম তখনও না । অশরীরি ভুত অথবা পেত্নী বলতে আমি এতোদিন যেমনটা জেনে এসেছি আনুশেখা মোটেই তেমন নয় ।
কেমন আদুরে বাবার অভিমানী টিনএজ একটা মেয়ের মত ! ওকে দেখে আর যাই হোক মনের মধ্যে ভয়ের উদ্রেক ঘটায় না । আমার এখনও ঐ দিনকার কথা স্পষ্টই মনে আছে ।
নতুন চাকরী নিয়েই এই এলাকাতে এসেছি । বাড়ী খুজতে খুজতে এই দোতালা বাড়ীটা পেয়ে গেলাম । প্রথম দেখাতেই মনে ধরে গেল । আর বাড়ির ভাড়াটা ছিল নাম মাত্র । ভাড়ার পরিমান টা শুনে খানিকটা অবাকই হয়েছিলাম । যা হোক আমারই ভাল ।
ঠিক ঐ দিন রাতেই আনুশেখার উপস্থিতি টের পাই ।
সবে লাইট বন্ধ করে শুয়েছি মনে হল কেউ যেন ঘরে মধ্যে হাটছে । বিশেষ করে পায়েলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে ।
আমার প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিল ভাড়ার পরিমান টা শুনে । তারপর যে ছেলেটা আমার মালপত্র নামিয়ে সে যাবার সময় বলে গেল আমি যেন একটু সাবধানে থাকি ।
পায়েলের আওয়াজটা এখনও পাওয়া যাচ্ছে । মনে হয়ে আওয়াজটা ঐ দরজার দিক দিয়ে আসছে । আচ্ছা এখন যদি লাইট জ্বালি তাহলে কি হবে ? নিজের মনে মনে বললাম ।
আওয়াজ নিশ্চই বন্ধ হয়ে যাবে । আর দেখবো পুরো ঘর একদম খালি ।
ভুতের গল্পে সাধারনত এমনই হয় । আমি লাইট জ্বালালাম । এবং আমি যা ভেবেছিলাম তেমন কিছুই হল না । পায়েলের আওয়াজ বন্ধ হল ।
আওয়াজ লক্ষ্য করে তাকিয়ে তো আমি আরো অবাক হলাম । দেখলাম একটা আঠারো উনিশ বছর বয়সী একটা মেয়ে ঘরময় হেটে বেড়াচ্ছে । আর মেয়েটার পরনে কোন সাদা পোষাক নেই । এমনি নরমান মেয়েরা যেমন পোষাক পরে তেমনই রয়েছে ।
আমার দিকে চোখ পরতেই মেয়েটা হাসি মুখে বলে উঠল
-হাই ! আমি আনুশেখা । এখানে থাকি । বলতে পারো এই বাড়ির মালিক । ঠিক মালিক না , মালিকের মেয়ে । আমার বাবা এই বাড়িটা ...
প্রথম দেখা তেই আমার কেবল এই কথাটাই মনে হল কি বাচাল মেয়েরে বাবা !
এতো কথা বলে কেন ! আমার মনে তখন এই প্রশ্নটা আসেই নি যে মেয়ে কোন অশরীরি হতে পারে ।
কি স্বাভাবিক একটা মেয়ে ! কিন্তু আমার ভুল ভাঙ্গল কিছুক্ষন পরেই । আনুশেখা কথা বলতে বলতে আমার খাটের উপর এসে বসল । বলল
তোমার নাম কি ?
-অপু ।
-চাকরি কর তুমি ?
-হুম ।
-কোথায় ?
অফিসের নাম বললাম । ঠিক তখনই কোথায় যেন একটু আওয়াজ হল । মনেহল কোন জানলার কপাট বাড়ি খেল কিছুর সাথে ।
-উউহুম ।
-কি হল ?
আনুশেখা বলল
-উত্তরের জানালাটা বোধহয় আবার খুলে গেছে । তুমি একটু দাড়াও আমি এখনই আসছি ।
এই বলে আনুশেখা চোখের সামনে থেকে গায়েব হয়ে গেল । প্রথমে মনে মনে হল আমি কোন মুভি দেখছি । যেখানে চোখের সামনে থেকে মানুষ অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটা একদমই স্বাভাবিক বিষয় । আনুশেখা ফিরে এল কিছুক্ষনের মধ্যেই ।
এসেই কথা বলা শুরু
-আমি বুঝি না উত্তরের ঐ জানালাটার সমস্যা টা কি ! আমি প্রতিদিন জানালা টা লাগাই আর প্রতিদিন জানালা খুলে যায় । আমার মনে হয় কেউ ইচ্ছে করে জানালাটা খুলে দেয় । নিশ্চই কোন পাজি ভুত ! ছোকড়া ভুত হবে হয়তো ! জানো বেঁচে থাকতে যেমন ছোকড়ারা লাইন মারতো এখনও ছোকড়া টাইপের কিছু ভুত লাইন মারার চেষ্টা করে । বাড়ির বাড়ান্দায় গেলেই উকি ঝুকি মারে ।
আনুশেখা এই বলে জোরে জোরে হাসতে লাগল । আমার সেদিন কার কথা আর কিছু মনে নেই । স্নায়ু বোধহয় একটু বেশিই গরম হয়ে গেছিল । আর সহ্য হয় নি । ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । কিংবা অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম ।
সকালবেলা যখন ঘুম ভাঙ্গল প্রথমেই রাতের ঘটনা মনে হল । মনে হল হয়তো স্বপ্নে দেখেছি । অফিস গিয়ে খানিকটা খোজ খবর করলাম ঐ বাড়ির সম্পর্কে !
যা জানতে পারলাম তার সারমর্ম হল ঐ বাড়িতে এক অভিজাত পরিবার থাকতো । আর বাড়ির বড় মেয়ে সত্যি সত্যিই আত্মহত্যা করেছিল । তারপর থেকেই বাড়িটা হনটেড । কেউ থাকতে পারে না ।
আমি সিড়ি বেয়ে দুতলার বাড়ান্দাটার দিকে এগিয়ে গেলাম । বারান্দায় গিয়ে দেখি আনুশেখা আগে থেকেই বসে আসে অন্য দিকে মুখ করে । রাগ করেছে । এখন আমার রাগ ভাঙ্গাতে হবে ।
সত্যি বলতে কি অনেকে আমাকে ভয় পায় আমি এই ভূতের বাড়িতে থাকি বলে । ভাবে হয়তো আমি তান্ত্রিক টাইপের কিছু । কিন্তু আমার ঐ পেত্নীর টার সাথে গল্প করতে ভাল লাগে ।
-খবরদার পেত্নী বলবা না ।
আনুশেখা কিভাবে যেন আমার মনে কথা বুঝে ফেলে । আমি হাসলাম । ওর পাশে বসে বললাম
-বলব । কি করবা?
-পেত্নী বললে কিন্তু ঘার মটকে দিবো ।
আমি হাসতেই থাকি । একটু পর আনুশেখাও হাসে ।
এই ভাবেই আমাদের প্রতিটা রাত কাটে । গল্প করে । হাসাহাসি করে ।
কেবল সমস্যা হয় বাড়ির পাশ দিয়ে রাতের বেলা কোন লোক হেটে গেলে ।
সেই লোকটা এই হাসি শুনে ভয়টয় পায় । গ্রামে গিয়ে কতকিছু ছড়ায় ।
আমার অবশ্য মজাই লাগে....
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১২ রাত ১০:৫৭