ক্লান্তিতে বিথির শরীরটা ভেঙ্গে আসছে । নিজের কেবিনে একটু চোখ বন্ধ করেছিল তখনই জোবাইদা ঘরে ঢুকলো দ্রুত পায়ে ।
-আপা একটু আসবেন ?
বিথি কেবল করুন মুখে জোবাইদার দিকে তাকাল । এই জোবাইদা পাঁচ বার বিথিকে ডাকতে এসেছে । গত চারবারই চারজন মারা গেছে । বিথি কিছু করতে পারে নি । বিথির কিছু করার ছিল না । একজন ডাক্তারও যে মাঝে মাঝে কত অসহায় বোধ করতে পারে বিথি আজকে সেটা খুব ভাল করে উপলব্ধি করতে পারছে । একজন মৃত্যুপথ যাত্রী যখন খুব আশা নিয়ে তার দিকে তাকায় এই আশা নিয়ে যে নিশ্চয় ডাক্তার তাকে বাঁচিয়ে দিবে । তার হাত ধরে কোন মন্ত্রে ফু দিয়ে সব যন্ত্রণা লাঘব করে দিবে । কিন্তু বাস্তবে এমন কিছুই হয় না । বিথিকে চেয়ে চেয়ে দেখেছে । আর যেন ওর কিছুই করার ছিল না ।
বিথি এই ফটিকছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জয়েন করেছে খুব বেশিদিন হয় নি । মোটামুটি শান্তির এলাকাই বলতে চলে । প্রতিদিন স্বাভাবিক ভাবেই রোগীরা আসতো যেত । বিথি আর ওর সাথের ডাক্তার সাজ্জাত মিলেই সামাল দিতো সব । বিথির উপরে ডাক্তার জামানকে খুব একটা প্রয়োজন পড়তো না । কিন্তু কাল সন্ধ্যা থেকে যেন এখানকার পরিবেশ একদম বদলে গেছে ।
ডিউটি সেরে সাজ্জাত কে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে বিথি বাসায় যাওয়ার প্রস্টুতি নিচ্ছিল তখনই বাইরে হট্টগোলের আওয়াজ পায় ! তারপরই পায় পুলিশের সাইেনের আওয়াজ ! মুহুর্তের ভিতরেই পুরো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একালা লোকে লোকারন্য হয়ে গেল !
পুলিশ ভ্যান, রিক্সা, আর ভ্যানে করে একের পর এক আসতেই লাগলো আহতরা ! কার হাতে ক্ষত ! কারো বা মাথায় ! কারো বা পুরো শরীর ভেষে গেছে রক্তে ! বিঠির কেবল মনে হচ্ছিল একদল হিংস্র কুকুর মানুষ গুলোকে কামড়ে কামড়ে খেয়েছে !
মানুষ জন পুলিশ আর আহতদের চিত্কার চেঁচামেচিতে পুরো পরিবেশটা কেমন যেন গুমট হয়ে গেছে ।
এখন প্রায় সকাল হতে চলল কিন্তু অবস্থার কোন প্রকার উন্নতি হয় নি । বরং আরো খারাপের দিকে গেছে ! এরই ভিতর মারা গেছে আরো চার জন ! পুলিশ যখন প্রথমে আহত দের নিয়ে আসে তাদের ভিতর থেকে এমনিতেই দুন মৃত ছিল ! তাও তো আহতদের খুব কম অংশই এখানে এসেছে ! বেশির ভাগই গেছে প্রধান শহরের দিকে !
বিথি এর আগে এক সাথে এতো মানুষ দেখে নি আহত অবস্থায় ! চারিদিকে এতো আহাজারি আর কান্নার শব্দ বিথির মনের ভিতর চাপ ফেলছে খুব বেশি !
বিথি জোবাইদার সাথে কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এল । জোবাইদাকে বলল
-সাজ্জাত কোথায় ?
-স্যার ও আছেন ওখানে !
-আর জামান স্যার ?
-উনি কেবিনে গেলেন ! সারাটা রাতই প্রায় উনি অপারেশন থিয়েটরে ছিলেন !
বিথি আর কোন কথা জানতে চাইলো না ! স্যারেরও আজ অনেক পরিশ্রম গেছে ! একটু বিশ্রাম নিক !
মেইন ওয়ার্ডটার দরজার কাছ বেশ ভিড় ! জোবাইদা কোন মতে ঠেলে ঠুলে বিথিকে ভিতরে ঢুকালো ! জোবাইদার পিছন পিছন পিছন হাটতে লাগলো ! জোবাইদা ওকে একেবারে কোনার বেড টার কাছে নিয়ে গেল ! বিথির এই ভয় টাই করছিল !
মাসুম !
বছর পনের কি ষোল হবে ! ডান হাতটা একেবারে থেতলে গেছে ! আর মাথার ডান দিকটাতে একটা বড় ক্ষত ! ছেলেটা কে যে আঘাত করেছে সে প্রথমে টার মাথা বরাবরই চালিয়েছিল মনে হয় ! ও হাত দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে পরে হাত ওকেজো হয়ে গেলে আবার আঘাত আসে মাথায় !
বিথির মন খারাপ হয় ! ছেলেটাকে ও চেনে ! ওর বাসা থেকে কয়েক বাড়ি দুরে থাকে ! মাঝে মাঝে দেখাও হত মাসুমের সাথে !
বিথির মনে আছে একবার মাসুম কোথা থেকে যেন আমলোকী নিয়ে যাচ্ছিল পঠে বিথির সাথে দেখা ! বিথির আমলোকী দেখে কেন জানি খেতে ইচ্ছা করল ! মাসুম কে বলল
-আমলোকী কি বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছ ?
-জে না ! আমার ছোড বইনের লাইগ্যা !
-ও !
বিথি একটু হতাশ হয় ! বিক্রির জন্য হলে কয়েকটা কেন যেত ! কিন্তু এখন তো চাওয়া টা কেমন হয়ে যায় !
মাসুম যেন বিথির মনের কথাই ধরে ফেলল
-আপনে খাইবেন ?
বিথি একটু লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিল ! ছেলেটা এভাবে ওর মনের কথা ধরে ফেলবে বুঝতে পারে নি !
-যদি তোমার কোন সমস্যা না হয় ! অল্প কয়েকটা হলেই চলবে !
সেদিন মাসুন ওকে প্রায় সব গুলো আমলোকীই দিয়েছিল !
আর আজকে ছেলেটা এখানে শুয়ে আছে ! আর খুব বেশিক্ষন মনে হয় না বাঁচবে ! বাইরে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা গেলেও মাথার আঘাতটা ছিল বেশ গুরুতর ! মানুষ কেমন করে একজন মানুষ কে এভাবে আঘাত করতে পারে বিথি ঠিক বুঝতে পারে না ! এমন একটা বাচ্চা ছেলে !
বিথি কেবল মাসুমের সামনে দাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষন ! বেডের ওপাশে মাসুমের মা কে দেখা যাচ্ছে ! এখন খানিকট শান্ত মন হচ্ছে ! কিন্তু চোখ দিয়ে পান পরছেই !
পরবেই তো ! মায়ের মন !
আর তার পাশেই দেখা যাচ্ছে একটা বাচ্চা মেয়েকে ! ওর ছোট বোন মনে হয় ! ! যার জন্য সেদিন আমলোকী নিয়ে যাচ্ছিল !
সাজ্জাত বলল
-এর অবস্থা খারাপ হচ্ছে দ্রুত !
-এখন !
-বড় শহরে নেওয়া জরুরী !
-কিন্তু এম্বুল্যান্সে হবে না ! এয়ার বাস লাগবে ! বড় শহরেও হবে না ! ঢাকায় হলে একটা আশা রয়েছে !
এমন সময় পেছন থেকে ডা. জামানের কন্ঠস্বর শোনা গেল !
-লাভ নেই !
বিথি আর সাজ্জাত দুজেই ঘুরে দাড়ালো ! কোন কথা না বললেও কেবল জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলো !
ডা. জামান বলল
-পেশেন্ট অলরেডি কোমায় চলে গেছে ! আমার মনে হয় না আর কিছু হবে ! এক পেশেন্টের পেছনে এতো সময় নষ্ট করে লাভ নাই ! আমাদের আরো কাজ রয়েছে । নয়তো লাশের মিছিল বাড়বে আরো ! এসো !
এই বলে ডা. জামান হাটা দেয় অন্য অন্য ঘরের দিকে ! সাজ্জাতও পিছু নেয় তার ।
বিথির কেন জানি ডা. জামানের কথা খুব কঠোর শোনায় ! কিন্তু বিথি জানে তিনি সঠিক কথাই বলতেছে ! কেবল একজনের দিকে তাকিয়ে থাকলেই হবে না ! নয়তো লাশের মিছিল বাড়বেই ! আরো কত রুগি রয়েছে !
বিথি মাসুমের মায়ের দিকে তাকলো ! মহিলা কেবল নিরব চোখে তাকিয়ে রয়েছে বিথির দিকে ! একটু আশা নিয়ে যেন বিথি তাকে আশার বানী শোনাবে ! বলবে যে ভয় নাই ! আপনার ছেলে ভাল হয়ে যাবে !
কিন্তু বিথি কিছু বলতে পারলো না ! কেবল একটু মুখ বিষন্ন করে মাসুমের নার্ভ চেক করলো !
খুব বেশি সময় নেই ! খুব দ্রুতই হয়তো সেও যোগ দেবে সেই লাশের মিছিলে !
বিথি মাসুম কে রেখে হাটা দেয় ! পিছনে তাকায় না আর একবারও ! তাকালেই হয়তো মাসুমের মায়ের চোখে ধরা পরে যাবে !
অন্য রুগী দেখলেও মনটা পরে থাকে মাসুমের দিকে ! কিছুক্ষনের ভিতরেই হয়তো জোবাইদা অথবা সাজ্জাত নার্ভ চেক করে বলবে মাসুম মারা গেছে ! ওর মা হয়তো কেঁদের উঠবে ! ঠিক যেমন আরো চার বার কান্নার আওয়াজ শুনেছে ও ! আপনজন কে হারানোর আহাজারি !
হঠাৎ কেন জানি বিথিট মাসুমের ছোট বোনটার কথা মনে পরে ! ছোট মেয়েটা কেবল তার ভাইাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখছে ! কিছু হয়তো বুঝতেও পারছে না ! হয়তো বুঝতে পারছে না তার ভাইটি আর এই বিছানা ছেড়ে উঠবে না !
আর তার জন্য আমলোকি নিয়ে আসবে না !

আলোচিত ব্লগ
শেয়াল ও মুরগি প্রসঙ্গে
নারীদের মুরগি আর পুরুষদের শেয়ালের সাথে তুলনা করা কোন সমাধান নয়। এটা সত্য যে, শিশু ও নারীরা কিছু ব্যক্তির কাছে সত্যি নিরাপদ নয়। এই যে , এত ধর্ষণ হয়, শিশুরা... ...বাকিটুকু পড়ুন
গদির উপর যদির মা
চাইছি আমি নাও বিদায় চাইছো তুমি থাকতে
আমারতো আর সাধ্য নেই তোমায় ধরে রাখতে।
চালগুলো সব খাওয়া হল চুলোটাই কেবল বাকি
তবুও তোমার টালবাহানা আর কিছুদিন থাকি।
ধারকর্যে চলতে গিয়ে খাচ্ছি হোঁচট... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিনয়াবনত চিত্ত আপনার জীবনকে উর্ধ্বমুখী করবে
বর্তমান প্রজন্মের একটা নিয়মিত অভ্যাস নিজেকে একটু ফোকাস করতে পারা। অথচ এ কাজটা করতে গিয়ে সে নিজেকে প্রতিনিয়ত কলুষিত করছে নিজের অজান্তেই। একটু ভেবে দেখুন। আজকালকার ছেলেদের “বডি ল্যাংগুয়েজ” একটু... ...বাকিটুকু পড়ুন
নিজে ভুক্তভোগী না হলে অন্যের দুঃখ অনুধাবন করা যায় না
রাজধানীর রামপুরায় একটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ফুড আউটলেটে কিছুদিন কাজ করতে হয়েছিল। ঝাড়পোছ থেকে শুরু করে পণ্য বিক্রি, যাকে বলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ- সব কাজই করতে হতো। যেহেতু অন্য কোনো... ...বাকিটুকু পড়ুন