somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অতিপ্রাকৃত গল্পঃ দেবতাখুমের অপদেবতা

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




মোহনা দুইপাশের ভেজা পাথরের দেওয়ালের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । বাঁশর বইঠাটা এক পাশে সরিয়ে রাখলো কিছু সময়ের জন্য । এমন একটা চমৎকার স্থানে সে চলে আসবে ভাবতেও পারে নি । বাঁশের ভেলার দুইপাশে পা দিয়ে বসে আছে সামনের দিকে । ভেলার পেছনে ওর বড় বোন শোভনা বসে আছে ।

ভেলা বাঁওয়া বন্ধ করতেই পেছনে থেকে শোভনা বলল, কি ব্যাপার বন্ধ করলি কেন ?
মোহনা বলল, আরে আপু দাড়াও না ! দেখো না চারিদিকে কি চমৎকার একটা ভিউ ! এমন ভিউ আর দেখতে পাবো কোন দিন ?

সত্যিই চোখের সামনের এই দৃশ্য আর দেখা যাবে কি না সন্দেহ । এই দেশে এমন কিছু আছে মোহনার ধারনার বাইরে ছিল । মুভিতে কিংবা ডিসকভারি চ্যানেলে এইরম দৃশ্য দেখে এসেছে । দুই পাশে পাহাড়ের দেওয়াল । তার মাঝখান দিয়ে আঁকা বাঁকা পানির ট্রেইল বয়ে গেছে । সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ছোট নৌকা কিংবা ভেলা ছাড়া আর কোন পথ নেই । পাহাড়ের উপরে গাছহাছালি দিয়ে ভর্তি । তার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো আসছে । মোহনা কেবল অবাক হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে আছে ।

দেবতাখুমে আসার সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল বলেই এখন ওর মনে হচ্ছে । একটা ট্যুর গ্রুপের সাথে এখানে এসে হাজির হয়ে দুইবোন । সকালে বান্দরবান এসে হাজির হয়েছে ওরা । শহর থেকে জিপ গাড়িতে করে রোয়াংছড়ি এবং পরে সেখান থেকে সকল ঝামেলা শেষ করে ঘন্টা খানেকের ট্রেকিং করে এই দেবতাখুনের হাজির হয়েছে । পাহাড়ে হাটার সময় বারবার মনে হচ্ছিলো এখানে আসা হয়তো ঠিক হয় নি । আজকে সূর্যটা একেবারে মাথার উপরে ছিল সব সময় । তীক্ষ ভাবে আলো দিচ্ছিলো । হাটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো । কিন্তু এখানে আসার সব সকল কষ্ট একেবারে ধুয়ে মুছে চলে গেছে ।

এই পানি দিয়েই ওরা দেবতাখুমের যতদুর যাওয়া যায় ততদুর গিয়েছিলো । সেখানে পাথড়ের উপর বসে বেশ কিছু সময় ছিল । গোসল করেছ ঝাপাঝাপি করেছে আর অনেক ছবি তুলেছে । এরপর আবার ফেরার পথ ধরেছে । একে একে সবাইকে ভেলাতে তুলে দিয়েছে ওদের গাইড ।

যাওয়ার সময় যেমন করে চারিদিকট মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল ঠিক ফেরার পথেও একই ভাবে চারিদিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছিলো । শোভনা পেছন থেকে আবারও বলে উঠলো, এই কি হল ? সামনে যাবা না আর ?
মোহনা পেছনে একটু তাকিয়ে বলল, আহ আপু থাকি না একটু ! আমাদের পেছনে আরও লোক আসবে তো !

শোভনা পেছনে তাকিয়ে দেখলো ওরা পাথরের দেওয়ালের বাকে চলে এসেছে । কাউকে দেখা যাচ্ছে না । তারপর সামনে তাকিয়ে দেখলো ওদের আগে যে দুজন রওয়ানা দিয়েছিলো ওরাও চলে গেছে । হঠাৎই আবিস্কার করলো যে এই পুরো এলাকাতে কেবল ওরা দুইবোন ! আর কেউ নেই । শোভনার মনে তখনই একটা সুক্ষ ভয় ঢুকে গেল । ওরা কেউই সাঁতার জানে না । যদিও শোভনার লাইফ জ্যাকেট পরা আছে তবে মোহনা জ্যাকেট পরে নি । ওটা ভেলার সাথে বাঁধা রয়েছে । এখন যদি ভেলা উল্টে যায় ?
ওদের দেখার কেউ থাকবে না !

শোভনা বলল, লাইফ জ্যাকেট টা পরে নাও !
-কেন ?
-যা বলছি কর ! দেখ চারিদিকটা কেমন নির্জন হয়ে গেছে । আমাদের সামনে যেতে হবে !

এইবার মোহনাও ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো । সত্যি চারিদিকটা কেমন যে শান্ত হয়ে গেছে । একটু যেন বেশিই নির্জন । বাঁশের বৈঠাটা হাতে নিয়ে আবারো ভেলা বাঁওয়া শুরু করলো ! কিন্তু অবাক হয়ে দেখলো ভেলা সামনে যাচ্ছে না । ওরা স্রোতের অনুকুলে এগিয়ে যাচ্ছে । সেখানে খুব বেশি পরিশ্রম হওয়ার কথা না । কিন্তু যাচ্ছে না !
-আপু কি হচ্ছে ? ভেলা যাচ্ছে না কেন ?
-বুঝতে পারছি না !
-যাওয়ার সময় তো স্রোতের বিপরীতে যাচ্ছিলাম তখন তো এমন হয় নি !
-মোহনা লাইফ জ্যাকেট টা পর !

মোহনা আর কথা বাড়ালো না । বৈঠাটা একপাশে সরিয়ে রেখে যেই না লাইফ জ্যাকেট টা হাতে নিতে যাবে ঠিক তখনই ভেলাটা নড়ে উঠলো । ওদের দুজনেরই মনে হল যেন পানির নিচ থেকে কেউ ভেলাটা ধাক্কা দিয়েছে । মুখ দিয়ে দুজনেরই একটা চিৎকার বের হয়ে এল ! মোহনা দ্রুত লাইফ জ্যাকেট পরতে যাবে তখনই দ্বিতীয় ধাক্কাটা এল । এবং সাথে সাথেই ভেলা উল্টে গেল ! দুইবোন পড়লো দুইদিকে !

শোভনার পরনে লাইফ জ্যাকেট থাকার কারনে সে পানিতে ভেসেই রইলো । গাইড ওদের বলে দিয়েছিল যদি ভেলা উল্টেও যায়, সাথে সাথে যেন ভেলাটা হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করে । তাহলে আর কোন সমস্যা নেই । শোভনা জলদিই ভেলাটা হাত দিয়ে ধরলো । কিন্তু ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল মোহনা ভেলা ধরতে পারে নি । ওর পরনে লাইফ জ্যাকেটও নেই । চোখের সামনে ছোটবোনকে ডুবে যেতে দেখলো সে !

মুখ দিয়ে কেবল চিৎকার বের হয়ে এল !


মুহর্তের ভেতরে যে এমন হয়ে যাবে মোহনা সেটা ভাবতেও পারে নি । পানিতে পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ওর কেবল মনে হল পানির নিচ থেকে কেউ যেন ওর ডান পাটা ধরে টান দিচ্ছে । একবার ভেলাটা ধরার চেষ্টা করলো । কিন্তু পারলো না । তারপরই পানির নিচে চলে গেল !

নাক মুখ দিয়ে সমানে পানি ঢুকতে শুরু করলো ওর । শেষ পর্যন্ত ডুবে মরতে চলেছে ও ! তারপরই সব শান্ত হয়ে গেল !

মোহনার মনে হল ও যেন অন্য কোন জগতে চলে এসেছে । বর্যাকালে দেবতাখুমের পানি একেবারে পরিস্কার থাকে না কিন্তু হঠাৎ ওর চোখের সামনে পানিটা একেবারে পরিস্কার হয়ে গেল । ও একেবারে স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলো পানির ভেতরে !
কি হচ্ছে ওর সাথে ?
ও কি ইতিমধ্যে মারা গেছে ?
এটা কি হেভেন ?

তারপরই ও কিছু একটা দেখতে পেল !
কি ওটা ?

পানির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে । আরও একটু এগিয়ে এল ওটা । নিজের চোখকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না ও !

প্রাণীটা দেখতে অনেকটা মানুষের মত তবে মানুষ নয় মোটেও । মানুষের থেকেও বেশ কিছুটা লম্বা । হাত দুটো মানুষের মতই । তবে কোন পা নেই । পায়ে বদলে মোটা লেজ রয়েছে । সেটা একটু যেন বেশিই লম্বা আর চ্যাপ্টা । মুখটা একটু চ্যাপ্টা ধরনের মাথার উপর দিয়ে দুটো শুড় জাতীয় কিছু বের হয়েছে । গায়ের রং পুরো সবুজ ! সেই সাথে সবুজ চোখ !
সব থেকে অবাক করে দেওয়ার ব্যাপার হচ্ছে প্রাণীটার বুকের ঠিক মাঝখানে একটা আলো দেখা যাচ্ছে । সেটা একটু একটু নড়ছে । মানুষ নিঃশ্বাস নিলে যেমন সেটা ওঠা নামা করে মোহনার মনে হল প্রাণীটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে !

প্রাণীটা একেবারে ওর সামনে এসে থেমেছে । ওর মতই পানির ভেতরে স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে । তাকিয়ে আছে ওর দিকে । মোহনার কাছে প্রাণীটার সবুজ চোখটা কেমন মায়াময় মনে হল । অদ্ভুদ চোখে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে ! অন্য সব কিছু অদ্ভুদ হলেও চোখ দুটো একেবারে মানুষের মতই । ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে একভাবে !

মোহনা নিজের চোখ সরাতে পারছে না । মনে হচ্ছে যেন অনন্তকাল ধরে প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ও ! আর সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে পানির নিচে নিঃশ্বাস নিতে ওর মোটেই মোটেই কষ্ট হচ্ছে না ।
প্রাণীটা আরও একটু এগিয়ে এল । মোহনার মনে হল যেন প্রাণীটা ওর দিকে তাকিয়ে হাসলছে । ওকে যেন বলছে কোন ভয় নেই । তোমার কিছু হবে না । চার আঙ্গুলের হাত দিয়ে মোহনার হাত স্পর্শ করলো । তারপর সাথে সাথেই মোহনা উপরের দিকে একটা টান অনুভব করলো । ও যেন আপনা আপনিই উপরে উঠে যাচ্ছে । নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রাণীটা সেই আগের স্থানেই স্থির হয়ে আছে । ও উঠে যাচ্ছে উপরে !

শোভনার জানে পানি ফিরে এল যখন সে মোহনাকে আবারও পানির উপর ভেসে উঠতে দেখলো । তারপর আস্তে করে সে ভেলার এক প্রান্ত ধরলো ।
-আপু ধরে থাকেন ! এই তো চলে আসছি !
শোভনা পেছনে তাকিয়ে দেখলো ওদের গাইড জেমস মারমা চলে আসছে নৌকা নিয়ে ! কাছে আসতে বলল, পড়লেন কিভাবে ?
-কি জানি কিভাবে ! মনে হল যেন কিছু একটা নিচ থেকে ধাক্কা দিয়েছে !

মোহনা নৌকাতে উঠতে উঠতে বলল, আমি ঐ প্রাণীটাকে দেখেছি !
গাইড সহ সবাই মোহনার দিকে ফিরে তাকালো ! বলল, কি বলছেন আপু ?
মোহনা বলল, হ্যা ! আমার থেকে ফুট খানেক দুরে ছিল ! আমার দিকে তাকিয়ে ছিল !
গাইড বলল, জলদি চলেন এখান থেকে !
আর কেউ কোন কথা বলল না । দ্রুত নৌকা চালিয়ে পাড়ের দিকে এগিয়ে চলল । মোহনা চুপ করে বসে রইলো কেবল । ওর চোখের সামনে এখনও সেই প্রাণীটার কথাই ভাবছে সে । কি অদ্ভুদ চোখে প্রাণীটা ওর দিকে তাকিয়ে ছিল !




বিকেলের পরপরই দেবতাখুমে মানুষ আসা একেবারে বন্ধ হয়ে যায় । এমন কি আদিবাসীরাও সন্ধ্যার পরে এদিকে আসে না । নির্জন এলাকাটা কেবল পানির কলকল এগিয়ে চলার আওয়াজ ছাড়া আর কোন আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় না । কিন্তু আজকে হঠাৎই পানির ভেতরে আন্দোলন শুরু হল । দুর থেকে দেখলে মনে হবে যেন নিচ থেকে খুব বড় কিছু উঠে আসছে উপরে ।
কিছু সময় পরেই সেই লম্বা মত প্রাণীটা পানির উপরে উঠে এল । খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে পানির উপর দিয়ে নিজের লম্বা লেজ নাড়াতে নাড়াতে এগিয়ে যেতে লাগলো পাড়ের দিকে । ধীরে তার শরীরের সবুজ রংটা পরিবর্তন হতে শুরু করলো । যখন সে পাড়ে এসে দাড়ালো সবুজ প্রাণী থেকে সে একেবারে মানুষ হয়ে দাড়িয়েছে । লেজটা পরিবর্তিত হয়ে দুটো পারে পরিনত হয়েছে । পাড়ে হাটতে গিয়ে যেন একটু চলে উঠলো । পায়ে হাটার অভ্যাস নেই । একটু সময় লাগবে স্বাভাবিক হতে !

তার সব কিছু মানুষের মত গিয়েছে কেবল তার চোখের কোন পরিবর্তন হয় নি । সেটা এখনও সবুজই রয়েছে ! সে সামনে এগিয়ে চলল । আজকে বহু বছর পরে তার কাঙ্খিত মানুষটার দেখা পেয়েছে সে ! সেই মানুষটার শরীরের গন্ধ সে এখান থেকেই পাচ্ছে । মানুষটার কাছে তাকে যেতেই হবে !


এক

মোহনার মন হল ও যেন অতল সমুদ্রের মাঝে ডুবে যাচ্ছে । হাত পা নাড়িয়েও কোন লাভ হচ্ছে না । একটুও উপড়ের দিকে উঠতে পারছে না । কেবলই নিচের দিকে নেমেই যাচ্ছে । তারপর একটা সময় যখন সে বুঝতে পারলো যে চেষ্টা করে আর লাভ নেই তখন সে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা একেবারে বন্ধ করে দিল । কেবল নিচের নিচের দিকে নামতে লাগলো । যখন চারিদিকে একেবারে অন্ধকার হয়ে এসেছে ঠিক সেই সময়ই মোহনা দুইটা সবুজ চোখ দেখতে পেল । সবুজ চোখ দুটো আস্তে আস্তে ওর দিকে এগিয়ে আসছে । একটা সময় মোহার চোখের সামনে পুরো অয়বয়টা ফুটে উঠলো । সাথে সাথে ওর পুরো শরীরটা যেন কেঁপে উঠলো । আবারও পালাতে শুরু করলো । এবার ঠিকই সামনে এগিয়ে যেতে পারলো ।
কিছু দুর যেতেই দেখতে পেল পানির ভেতরে তিনটা বড় বড় পাথর । একটা মাঝের বড় পাথরটা খানিকটা লালচে ধরনের । তিনট পাথর একটা স্থানকে ঘিরে রেখেছে । সেই স্থান দিয়ে আলো বেরিয়ে আসছে । মোহনা কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছে না । পেছনে তাকিয়ে দেখে সেই প্রাণীটা এগিয়ে চলে এসেছে ! আবারও পালাতে চাইলো ঐ প্রানীটার কাছ থেকে । হাত পা ছুড়তে শুরু করলো ...

তারপর বিছানায় উঠে বসলো ।

এতো সময় স্বপ্ন দেখছিলো ! ওর বিছানার ঠিক পাশেই একটা বড় ড্রেসিং টেবিল । সেটা দিয়ে পুরো বিছানাটা বেশ ভাল করেই দেখা যায় । আয়নার নিজের চেহারা দেখতে পেল পরিস্কার । কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখতে পাচ্ছে । ওর দিকের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো ভোর হয়ে গেছে । ভোরের আলো চলে এসেছে ঘরের ভেতরে ।

প্রতিদিন স্বাভাবিক নিয়মের ঘন্টাখানেক আগে আজকে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে আজকে । আবার ঘুমানো যায় তবে তখন অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাবে । মোবাইলের এলার্মটা বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাড়ালো । সামনের রাস্তারটা একেবারে ফাঁকা । কোন মানুষের কোন চিহ্ন নেই । মোহনা দুরে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু সময় ভাবতে লাগলো ।

মাত্র দুই মাসে ওর জীবনটা কিভাবে বদলে গেছে । আগে ইচ্ছে করলেই সকাল বেলা মাথা গুজে শুয়ে থাকতে পারতো যত সময় ইচ্ছে, চাইলেই ক্লাস কামাই দেওয়া যেত । কাউকে বলে দিলে ওরা সুযোগ মত ক্লাসে ওর হয়ে প্রক্সি দিয়ে দিতো । ক্লাসের মত অফিসেও যদি প্রক্সি দেওয়ার একটা সিস্টেম থাকতো তাহলে কতই না ভাল হত ।

দেবতাখুমের ঐ পানিতে পড়ে যাওয়ার ঘটনার পর থেকে ওর জীবনে একটা বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে । রান্দারবান থেকে যেদিন ফিরে এল ঐদিনই ওর অফিসে জয়েন করার কথা ছিল ইন্টার্নশীপের জন্য । কিন্তু সেখানে দিন পরে অফিস করার পরপরই ওর জীবনে একটা বড় রকমের ঘটনা ঘটলো । ওর অফিসের বস ওকে নিজের ডেকে পাঠিয়ে জানালো ড্রাগোন রিসার্চ ইন্টারন্যাশনাল একজন এপ্লোয়ী খুজছে যে কিনা ওর সাবজেক্টে পড়াশুনা করেছে । এবং ওর অফিসের বস ওর নাম রেকোমেন্ড করেছে । মোহনার প্রথমে মনে হল ও সম্ভব ভুল শুনছে । এমনটা আবার হয় নাকি । কিন্তু ঐদিনই বিকেল বেলাতেই ওর হাতে এপোয়েন্টমেন্ট লেটার চলে এল । তারপর পরদিন থেকেই জয়েনিং । সব কিছু কেমন যেন স্বপ্নের মত মনে হয় এখনও ।

কিন্তু একটা সমস্যাও শুরু হয়েছে সাথে সাথে । দেবতাখুমের পানিতে সে যে প্রাণীটা দেখেছিলো সেই প্রাণীটাকে সে নিয়মিত স্বপ্নে দেখতে শুরু করেছে । প্রায়ই দিনই দেখতে পায় যে সে পানিতে ডুবে যাচ্ছে তারপর একটা সময় সেই প্রাণীটা ওর কাছে চলে আসছে । সবুজ ঐ চোখ দেখলে ওর বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে ওঠে । এখন সবুজ রংয়ের উপর এমনই একটা ভয় সৃষ্টি হয়েছে রাস্তার সবুজ বাতিটা দেখলেও কেমন যেন কেঁপে ওঠে মনে মনে । এটার হাত থেকে কিভাবে মুক্তি পাবে সে বুঝতে পারছে না ।

বারান্দায় দাড়িয়েই এসব কথা ও ভাবছিলো তখনই ওর চোখ গেল ডান দিকের রাস্তার দিকে । সাথে সাথেই ওর বুকের ভেতরট কেঁপে উঠলো । একজন মানুষ দাড়িয়ে আছে সেখানে । ওর দিকে তাকিয়ে আছে । মানুষটাকে সে এর আগে কোন দিন দেখেছে বলে ওর মনপড়ে না । কিন্তু মানুষটার সবুজ চোখটা ও এতো দুর থেকেও পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে । এই চোখের দৃষ্টি সে কোন দিন ভুলতে পারবে না ।

একটুও দেরি করলো না সে । এক দৌড়ে ঘরের ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল । জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলো ।


#####
২৭ নাম্বারের বেঙ্গল বইতে আজকে মোহনা এসেছে ওর বড় বোন শোভানার সাথে । আজকে ছুটির দিন বলে এখানে একটু ভীড় বেশি । বেঙ্গল বইটা বুকশপ হলেও মানুষ এখানে বেশি আছে ছবি তোলার জন্য । এখানে আসা মানুষের চেহারা দেখলেই মোহনার বুঝতে কষ্ট না যে এরা কেমন বই পড়ে । তবে বইয়ের মাঝে আসতে মোহনার সব সময়ই ভাল লাগে । সারি সারি বইয়ের মাঝ দিয়ে হাটছে সে, একটা দুইটো বই হাতে নিয়ে পাতা খুলে দেখছে সেটা ভাবতেই অন্য রকম একটা অনুভূতি হয় ।
রাতের ঘুমের সমস্যাটা এখন যায় নি ওর । সেটা প্রতি নিয়ত ওর পেছনে লেগেই আছে । মোহনা ঠিক বুঝতে পারছে না কি করবে । কারো সাথে এই ব্যাপারটা নিয়ে কথাও বলতে পারছে না । ঐদিন ওদের গাইড খানিকটা অন্য রকম আচরন করছিলো । তার মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলো যে গাইড ভয় পেয়েছে ।
যেদিন চলে আসবে গাইড ওকে এক পাশে ডেকে বলেছিলো যে এই ব্যাপারটা যেন কাউকে না বলে । কারন জানতে চাইলে গাইড বলেছচিলো লোকজন শুনলে হয়তো ভয় পাবে তখন আর এদিকে আসবে না । কিন্তু মোহনার কারনটা সত্যি মনে হয় নি । তার কাছে মনে হয়েছে গাইড ওর কাছে কিছু লুকাচ্ছে । তবে সে কারো সাথে এই গল্প করেনি । করলে কেউ অবশ্য বিশ্বাসও করতো না ! এক জনের কাছে অবশ্য বলেছে ।
স্বপ্নের সমস্যা সমাধানের জন্য সে ডাক্তারের কাছেই গিয়েছিলো । সে কেবল কিছু ঘুমের ঔষধ দিয়েছে । আর বলেছে কোন চিন্তা না করতে । তার মতে সাতার না জানার কারনে যখন সে দেবতাখুমের পানিতে পড়ে গিয়েছিলো সে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলো । সেই ভয় থেকেই সে এই প্রাণী জাতীয় কিছু দেখেছে । আসলে ওটা ওর মনের কল্পনা ছাড়া কিছুই নয় । সেই ভয়টা এখনও ওর মনের ভেতরে বাসা বেঁধে আছে । সময়ের সাথে সাথে ওটা ঠিক হয়ে যাবে ।

কিন্তু ঠিক হয় নি । স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয় নি । এবং সেই সাথে সাথে মাঝে মধ্যেই সেই সবুজ চোখের মানুষটাকেও সে দেখতে পায় । দুর থেকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে এক ভাবে । কাছে আসে না তবে তাকিয়ে থাকে সেটা ! মোহনা যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে এসব ভাবতে ভাবতে !

মোহনা বড় বোনের দিকে তাকালো । দ্বিতিয় তলার ক্যাফেটরিয়াতে দুবোন বসে আছে । সামনে দুটো কফির কাপ । একটা বই নিয়ে বসে আছে মোহনা ।

শোভনার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই একজন মানুষ ওদের ঠিক সামনে এসে এসে দাড়ালো । কালো পোশাক শার্ট আর কালো জিন্সের প্যান্ট পরা । মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি । চোখে একটা কালো সানগ্লাস পরা । বয়স হবে ২৫/২৬ এর মত । মোহনা লক্ষ্য করলো ছেলেটার হাতে কয়েকটা বই রয়েছে । সব গুলোই ইংরেজি বই ।
ছেলেটাকে লক্ষ্য করে কিছু বলতে যাবে তার আগে ছেলেটা বলল, বসতে পারি এখানে একটু ?
শোভনা আর মোহনা দুজনেই একে অন্যের দিকে তাকালো । তাকিয়ে দেখলো ক্যাফেটরিয়ার সব টেবিলই ভর্তি !
শোভনা বলল, বসুন !

ছেলেটা ওদের মুখোমুখি বসলো । বইটা গুলো টেবিলের উপরে রেখে ছেলেটা এবার নিজের সান গ্লাসটা খুলে রাখলো টেবিলের উপর । মোহনার চোখের সাথে ছেলেটার চোখ মোহনা খানিকটা কেন কেঁপে উঠলো !
ছেলেটার চোখের কি তীব্র চাহনী ! এতো তীব্র আর আর তীক্ষ্ণ চোখের যে হতে পারে সেটা মোহনার জানা ছিল না । চোখের দিকে তাকালে মনে হয় যেন মনের ভেতরের সব কথা যেন জেনে যাচ্ছে ।
মোহনা নিজের চোখের দৃষ্টি নিতে গেল কিন্তু পারলো না । ছেলেটার চোখ যেন ওকে আটকে ফেলেছে ।



ছেলেটা কিছু সময় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে রইলো । তারপর মোহনার দিকে তাকিয়ে বলল, সবুজ চোখ কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না, তাই না?
তীব্র একটা বিস্ময় অনুভব করলো সে ! ছেলেটা কি বলল ?
কিভাবে বলল ?
মোহনা বলল, কে আপনি ?
ছেলেটা হাসলো ! তারপর বলল, আমার নাম খুব বেশি জরুরী না । আমাকে রাফায়েল নামে ডাকতে পারেন ! জরুরী হচ্ছে আমি যেই কথাটা আপনাকে বলতে এসেছি সেটা !
মোহনা কি বলবে খুজে পেল না । শোভনা বলল, আপনি কি আমাদের পিছু নিয়েছেন ? দেখুন আপনি এখান থেকে উঠে যাবে নাকি আমরা উঠে যাবো !

রাফায়েল চুপ করে বসে রইলো কিছু সময় । তারপর নিজের মোবাইলটা বের করে কিছু সময় কিছু যে খুজতে লাগলো । তারপর সেটা মোহনার দিকে বাড়িয়ে দিল ।
-এমন কিছু চিনেন ?
মোহনা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে । দেবতাখুমের সেই প্রাণী । বুকের ভেতরে হার্টবিট যেন আরও একটু দ্রুত হয়ে উঠলো !
রাফায়েল বলল, আপনারা না চাইলে আমি চলে যাই । যাবো ?
শোভনা কিছু বলতে যাবে তার আগে মোহনা বলল, আপনি বসুন ! এসব কিভাবে জানেন !
রাফায়েল বলল, কিভাবে জানি সেটা আসল কথা না । জানি এটাই হচ্ছে কথা । যাই হোক আসল কথায় আসি । আপনি যেটা মনের ভুল ভাবছেন সেটা ভুল না । দেবতাখুমের সেই সবুজ রাজকুমার এখন এই শহরেই আছে । আপনাকে খুজছে ।
মোহনার মনের ভেতরে একটা ঠান্ডা ভয়ের স্রোত বয়ে গেল । সে ঠিক বুঝতে পারছিলো না কি বলব ! কোন মতে বলল, আমাকে কেন খুজবে ? আমি কি করেছি ? আমার ক্ষতি করতে চায় কেন ?
রাফায়েল বলল, ক্ষতি ? না না সে ক্ষতি করতে চায় না । আপনি তার কাছে সব থেকে মূল্যবান বস্তু । সে আপনাকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে চায় !
-কেন ?
-অনেক লম্বা কাহিনী । আমার একটু কাজ আছে । আমার একটা পরামর্শ কেমন মনে রাখবেন পানির কাছ থেকে দুরে থাকবেন !
-পানির কাছ থেকে ?
-হ্যা । যেখানে অনেক পানি আছে এমন স্থান থেকে । যেমন গুলসান লেক ধানমন্ডি লেক জিয়া উদ্যানের লেক । তাহলে সে আপনাকে নিয়ে যেতে পারবে না । মনে থাকবে তো ?
মোহনা দ্বিধান্বিত হয়ে কেবল মাথা ঝাকালো ! রাফায়েল নামের মানুষটা আর বসলো না । উঠে দাড়ালো । তারপর চশমাটা চোখে পরে চলে গেল । মোহনা তখনও বসেই আছে চুপ করে । তার মানে ও যা যা দেখেছে সেটা মোটেই মিথ্যা নয় । কিন্তু এই রাফায়েল নামের মানুষটা কিভাবে জানলো এই সব ?
নিজের চিন্তা থেকে বাস্তবে ফিরে আসতই দেখতে পেল রাফায়েল তার বই ফেলে রেখে গেছে ! সেটা হাতে নিয়ে নিচে নেমে এল । কিন্তু রাফায়েলকে আর খুজে পেল না !



দুই

অফিসের আজকে কাজ শেষ করতে বেশ রাত হয়ে গেল । মোহনা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে দশটা পার হয়ে গেছে । আজকে ড্রাগন ইন্টারন্যাশনাল এর বিদেশী ডিরেক্টররা এসেছিলো । অফিসের কাজের শেষে একটা ছোট পার্টির মত আয়োজন করা হয়েছিলো । সব কাজ শেষ করতে করতে এতো রাত হয়ে গেলো । বাসায় আগে থেকেই বলা ছিল যে রাত হবে তবে এতো রাত যে হবে মোহনা ভাবতে পারে নি । যতই বলা থাকুক ওর মা আজকে ঠিকই ওকে বকাবকি করবে ।

এখন এই রাতের বেলা বাসায় কিভাবে যাবে সেই ভাবছে ! এতো রাতে একা একা সিএনজি নেওয়াটা একটু ঝুকিপূর্ণ হয়ে যাবে । উবার কিংবা পাঠাও বাইকে উঠতে পারলে সব থেকে বেশি ভাল হত । তবে মোহনার মা পাঠাও এর বাইকে ওঠা একদমই পছন্দ করে না ।

সিড়ি দিয়ে নামছে আর ভাবছে কোনটা ব্যবহার করবে তখনই পেছন থেকে ওর বস আবরার আহমেদের ডাক শুনতে পেল !
-মোহনা !
মোহনা দাড়িয়ে গেল । পেছনে তাকিয়ে দেখলো সে ফোনে কথা বলতে বলতে আসছে । ওর কাছে এসে ফোন থেকে মুখ তুলে বলল, এতো রাতে একা একা যেতে হবে না । আমি তোমাকে পৌছে দিচ্ছি !

মোহনা একবার বলতে গেল যে স্যার আপনাকে কষ্ট করতে হবে না কিন্তু বলল না । আবরার স্যারের গাড়িটা এখন সব থেকে বেশি নিরাপদ ওর যাওয়ার জন্য । আর তখন মোহনার মাও কিছু বলতে পারবে না ।

গাড়িতে যখন উঠে পড়লো তখনও আবরার আহমেদ এক মনেই ফোনে কথা বলেই যাচ্ছে । মোহনা গাড়িতে উঠে নিজের মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে গেল । স্যার যত সময় কথা বলছে ওর ফোন ছাড়া অন্য দিকে মনযোগ দেওয়ার কোন দরকার নেই । ড্রাইভার ওর বাসা চেনে । এর আগেও কয়েকবার স্যার ওকে বাসায় পৌছে দিয়েছে । তাই ওকে ঠিকই ওর বাসার সামনে নিয়ে যাবে । এখন আর কিছু ভাবার দরজার নেই ।

কিন্তু ওদের গাড়িটা যখন হাতিরঝিল এলাকাতে প্রবেশ করলো তখনই ওর মনে খানিকটা ভয় ঢুকে গেল । ফোনের ভেতরে ঢুকে ছিল বলে ড্রাইভার কোন দিক দিয়ে যাচ্ছে সেদিকে কোন লক্ষ্য ছিল না । কিন্তু এখন এই হাতিরঝিল এলাকাতে এসে ওর সেই রাফায়েলের কথা মনে পড়ে গেল ।
ছেলেটা বলেছিলো পানির কাছ থেকে দুরে থাকতে ।
বড় পানির উৎস থেকে ওকে অবশ্যই দুরে থাকতে হবে । ঢাকা শহরে বড় পানির উৎস বলতে এই হাতির ঝিলই আছে । সেদিনের পর থেকে মোহনা খানিকটা এড়িয়েই চলতো । কিন্তু আজকে এখানে চলে এসেছে !

গাড়ি অতি দ্রুত এগিয়ে চলছে । মোহনা হঠাৎ লক্ষ্য করলো হাতিরঝিল এলাকাটা একেবারে জন মানব শূন্য । রাস্তার পাশে একটা মানুষও দেখা যাচ্ছে না । এমন জনমানব শূন্য তো থাকে না । এমন কি ওদের সামনে পিছনে কোন গাড়িও দেখা যাচ্ছে না ।
কথাটা মুখ দিয়ে আপনা আপনি বের হয়েই গেল !
-এরকম ভুতুড়ে লাগছে কেন ? একদমই দেখি মানুষ নেই ।

ও কথাটা বলেছিলো ড্রাইভারকে উদ্দেশ্যে কিন্তু জবাব এল পেছন থেকে । আবরার আহমেদ বলল, কদিন থেকে রাত নয়টার পরে হাতিরঝিল এলাকতে মানুষ জনের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ।
মোহনা বলল, কেন ?
-কি জানি । ওরা বলছে রাতে নাকি কিছু একটা উঠে আসে এই পানি থেকে । মানুষজনকে হামলা করে । পানির ভেতরে নিয়ে যায় !

সাথে সাথেই মনে পড়লো ফেসবুকের খবরটা । দিন পনেরো আগের । একলোক ভিডিও করে বলছিলো ব্যাপার । সেদিন ব্যাপারটা টক অব দ্য টাউন ছিল । সাথে সাথেই আবারও সেই কথাটা মনে পড়ে গেল ।
পানি থেকে দুরে থাকতে বলেছিলো ছেলেটা !
আচ্ছা এমন কি হতে পারে যে ঐ প্রাণীটা এখন এখানে .....
যদি সত্যিই এমন কিছু হয়ে থাকে তাহলে ? ওর মনের ভয়টা আস্তে আস্তে বাড়তেই থাকলো । যদি সত্যিই সেই সবুজ চোখের প্রাণীটা চলে আসে তখন ?
ওর মনের কথা মনেই রয়ে গেল । সামনের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো ওদের গাড়ির ঠিক সামনে আর রাস্তা দেখা যাচ্ছে না । স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোতে সামনের রাস্তাটা পরিস্কার দেখতে পাওয়ার কথা কিন্তু সামনে কিছু দুর গিয়ে হঠাৎ করে কেমন যেন ঘোলা হয়ে আছে ।
কিছু দেখা যাচ্ছে না ।
অনেকটা মনে হচ্ছে সামনে যেন পানির দেওয়াল রয়েছে !
পানি !!
মোহনা চিৎকার করে উঠলো । গাড়ি থামাতে বলল ড্রাইভারকে । কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে । গাড়ি বেশ দ্রুত যাচ্ছিলো । সময় মত ব্রেক করতে পারলো না সে । গাড়িটা সোজা গিয়ে পানির সেই ঘোলা দেওয়ালে গিয়ে ধাক্কা মারলো ।

ধাক্কাটা যতটা প্রবল হবে ভেবেছিলো ততটা প্রবল হল না । একটা ফটবল যেমন পানিতে আঘাত করলে প্রথমে কিছু সময় নিচে দেবে যায় ঠিক সেই রকম অনুভব কল । মোহনার মনে হল ওদের গাড়িটা পানির দেওয়ালের ভেতরে ঢুকে গেল কিছুটা তারপর স্প্রিংয়ের মত বাইরে ফিরে এল ।

মোহনার হাত থেকে ফোনটা ছুটে গেল । মাথাটা ঠুকে গেল গাড়ির জানালার কাঁচের সাথে । মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটনাটা ঘটে গেল । ধাক্কাটা মোহনা বেশ ভাল ভাবেই অনুভব করতে পারলো ।
গাড়িটা শান্ত হয়ে যেতেই মোহনা নিজেকে ফিরে ফেল সাথে সাথেই । তার চিন্তা ভাবনা আবারও সুস্থির হয়ে দাড়ালো । ভাগ্য ভাল যে গাড়িতে বসার আগে সিটবেল্ট টা বেঁধে বসেছিলো নয়তো এই ধাক্কাতে ওর অবস্থা খারাপ হয়ে যেত । দ্রুত গাড়িতে থাকা অন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখলো । দুজনের অবস্থাই ওর মত । কারোই কোন ক্ষতি হয় নি । তবে প্রত্যেকেই খানিকটা চমকে গেছে । সেটা সামলে নিতে খুব একটা সময় লাগলো না ।
মোহনার তখনই ড্রাইভারের জানালা দিয়ে বাইরে চোখ গেল । সাথে সাথেই ওর পুরো শরীর জুড়ে একটা ঠান্ডা ভয়ের স্রোত বয়ে গেল । মোহনা দেখতে পেল হাতির ঝিলের পানির ভেতর থেকে একটা পানির স্রোত উঠে আসছে । মধ্যাকর্ষনের সুত্র ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে পানির স্রোতটা পাড় বেয়ে ঠিক রাস্তার উপরে উঠে আসছে । আর সেই স্রোতের ঠিক উপরে সেই প্রাণীটা রয়েছে ।
দেবতাখুমের সেই অবদেবতা !


ঐদিন রাফায়েল নামের মানুষটা চলে যাওয়ার পরপরই সে বাসায় এসে দেবতাখুমের এই অপদেবতা নিয়ে খোজ খবর করা শুরু করে । পুরো নেট ঘেটেও কিছু খুজে পায় না । পরে পুরানো বই পত্র ঘাটতে থাকে লাইব্রেরীতে গিয়ে । তেমন একটা বইতেই এই অপদেবতার ব্যাপারে খোজ পায় সে । খুব বেশি না পেলেও এটা জানতে পারে যে এই অপদেবতার নাম নাগা !
নাগা প্রিন্স ! হিসাবেই সে পরিচিত ! পানি হচ্ছে তার পোষা প্রাণীর মত । সেদিন রাফায়েল রাফায়েল ওকে পানির কাছ থেকে এই কারনেই দুরে থাকতে বলেছিলো !


মোহান কি করবে খুজে পেল না ।
এখন ওর কি করা উচিৎ ?
ওর কেবল মনে হল এই প্রাণীটার কাছে ধরা পরা যাবে না । নয়তো এটা ওকে পানির ভেতরে টেনে নিয়ে যাবে ! ওকে এখান থেকে পালাতে হবে ! অবশ্যই পালাতে হবে !

মোহনা নিজের সিটবেল্ট খুলে ফেলল দ্রুত । দরজা খুলে বের হয়ে এল দরজা দিয়ে । পেছন থেকে আবরার আহমেদ চিৎকার করে বলল, "মোহনা বের হয়েও না"
কিন্তু মোহনা সেই কথায় কান দিল না । ওর কাছে এখন কেবল মনে হচ্ছে ওকে এখান থেকে পালাতে হবেই ! অন্য কোন কিছু ওর মাথায় এলই না !

মোহনা বের হওয়ার সাথে সাথেই আবরার আহমেদ নিজের ড্রাইভারকে ইশারা করলো । সে নিজেকে সামলে নিয়েছে এতো সময়ে । সাথে সাথে ড্রাইভারও দরজা খুলে বের হয়ে গেল । তারপর নিজের পকেট থেকে পিস্তল বের প্রাণীটা লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করলো।
মোহনা দৌড় দিয়ে কিছু গিয়েই চমকে গেল । গুলির শব্দে । ড্রাইভের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে সেই প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে গুলি করেই যাচ্ছে ।


মোহনা আবার সামনের দিকে তাকালো ! হাতির ঝিলে এই স্থানটাতে আসলে যাওয়ার জায়গা নেই । এক পাশে একটা অফিসের বড় দেওয়াল, তার পাশেই একটা দোকান দেখা যাচ্ছে । এরপর পাবলিক টয়লেট । সবই এখন বন্ধ ! অন্য পাশে লেক । মাঝ দিয়ে রাস্তা । ওকে পালাতে হলে সামনের বেশ কিছুটা পথ দৌড়াতে হবে । এখন প্রশ্ন হচ্ছে সে এতোদুর দৌড়ে যেতে পারবে ?
পেছনে অল্প দুরে গেলেই একটা গলি আছে । এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছে ?
কোন দিকে যাবে সে ?

ড্রাইভার তখনও গুলি চালিয়ে যাচ্ছে !
কিন্তু বেশি সময় ধরে গুলি চালাতে পারলো না । প্রাণীটা নিজের হাত তুলে ড্রাইভারের দিকে ছুড়ে মারার মত ভঙ্গি করলো । সাথে সাথে একটা পানির হাত ড্রাইভারের দিকে ছুটে এল । ধাক্কা দিয়ে ওকে দুরে ফেলে দিল । এরপর প্রাণীটা ফিরে তাকালো আবরার আহমেদের দিকে । তার হাতেও একটা পিস্তল চলে এসেছে । সেও প্রাণীটা লক্ষ্য করে গুলি করা শুরু করেছে ।

ঠিক একই ভাবে প্রাণীটা আবরার আহমেদকে লক্ষ্য করে পানির একটা হাত পাঠিয়ে দিল । মোহনা ভেবেছিলো হয়তো এবার আবরার আহমেদও দুরে গিয়ে পড়বে সেই পানির আঘাতটা আবরার আহমেদ খুব নিপূনতার সাথে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে এল ।
মোহনার দিকে তাকিয়ে বলল, ঐদিকে যেও না ! এদিকে এসো ! গাড়ির ভেতরে ঢুকে বস !
মোহনা আবারও খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়ে গেল ! কি করবে ?
সে তখনও প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে আছে । রাফায়েল ঠিকই বলেছিলো । পানির কাছ থেকে দুরে থাকতে । পানির উপরে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রন রয়েছে । গত বছর আকুয়্যাম্যান মুভিটা দেখেছিলো ও । সেই মুভিতে রাজকুমারী মীরার ঠিক এই রকম ভাবে পানির উপর নিয়ন্ত্রন থাকে । পানিকে ব্যবহার করতে পারে নিজের ইচ্ছে মত !
আবরার আহমেদ আবারও চিৎকার করে বলল, গাড়ির ভেতরে এসো !
গাড়ির ভেতরে যাওয়া মনে একেবারে আটকা পরে যাও !
গাড়ির ভেতরে গিয়ে বসলে কত সময় সে প্রাণীটার কাছ থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে সেটার ব্যাপার ওর সন্দেহ আছে ! এভাবে বন্দী হয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না । কিন্তু পালিয়ে যাবে কোন দিকে । যা করার ওকে দ্রুত করতে হবে । দেরি করা যাবে না মোটেও !

আবরার আহমেদ আবারও প্রাণীটার আরেকটা আঘাত পাশ কাটিয়ে গেল । তবে তৃতীয় আঘাতটা সে এড়াতে পারলো না । পানির হাতটা আবরার আহমেদকে এবার গাড়ির সাথে চেপে ধরলো । ঠিক তার পরেই তাকে দুরে ছুড়ে ফেলে দিল । রাস্তার উপর গিয়ে পড়লো সে !

এবার নাগা প্রিন্স ফিরে তাকালো মোহনার দিকে । সবুজ চোখ দুটো এক ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে । বুকের কাছে সেই সবুজ আলোটাও পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে । আলোটা একটু একটু করে যেন বাড়ছে করছে যেন ! মানুষের নিঃশ্বাসের সময় যেমন বুকটা ওঠা নামা করে ঠিক তেমনি ভাবেই আলোকিত বুকটার আলোটা নড়ছে ।

মোহনা এবার দেখলো পানির এতো গুলো শুড় ওর দিকে ধেয়ে আসছে । মোহনা আর কিছু ভাবতে পারলো না । বুঝতে পারলো ও কোন ভাবেই পালাতে পারবে না । সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে ! অপেক্ষা করতে লাগলো আসন্ন বিপদের জন্য । এখনই হয়ত শুড় গুলো ওকে আঘাত করবে ! অথবা ওকে চেপে ধরে নিয়ে যাবে পানির ভেতরে !
মোহনার কাছে মনে হল যেন সব কিছু থেমে গেছে । সময় যেন আর যাচ্ছে না একদম !
তারপর মনে হল একটু যেন বেশিই সময় পার হয়ে গেছে । এতো সময় তো ওকে পানির শুড় গুলো স্পর্শ করে ফেলার কথা !
কিন্তু এখনও করছে না কেন ?

চোখ খুলতেই সেই কারন টা বুঝতে পারলো । ওর ঠিক সামনেই একজন এসে দাড়িয়েছে !
চেহারা না দেখা গেলেও মানুষটাকে সে চিনতে পারলো সাথে সাথেই !
রাফায়েল !

নাগা প্রিন্সের সব পানির শুড় গুলো এসে থেমে গেছে রাফায়েলের সামনেই । মোহনার মনে হল পানির শুড় গুলো যেন একটা অদৃশ্য দেওয়ালে এসে আঘাত করেছে । সেখানেই এসে থেমেছে । রাফায়েল নিজের দুইহাত ধরে যেই অদৃশ্য দেওয়াল যেন ধরে রেখেছে !
মোহনা কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ।
চোখের সামনে কি হচ্ছে সেটা সে কোন ভাবেই বুঝতে পারছে না । বিশ্বাস করতে পারছে না । বারবার মনে হচ্ছে যে ও এসব কিছুই বাস্তবে দেখছে না । সব কিছু স্বপ্নে দেখছে নয়তো এটা কোন মুভির দৃশ্য !
দ্য একুয়াম্যান টু !

বেশ কয়েকবার প্রাণীটা নিজের পানির শুড় দিয়ে মোহনার কাছে পৌছাতে চাইলো কিন্তু কোন লাভ হল না । প্রতিবারই আঘাত গুলো সেই অদৃশ্য দেওয়ালে এসে আটকে যাচ্ছে ।

তারপরই প্রাণীটা নিজের ডান হাতটা হাতিরঝিলের দিকে বাড়িয়ে দিল । যেন কাউকে ডাকছে । সাথে সাথেই মোহনা দেখতে পেল অন্তত ফুট দশেক উচু পানির স্রোত উপরে উঠতে শুরু করলো । রাফায়েল প্রতিক্রিয়া দেখালো সাথে সাথে । নিজে এক প্রকার লাফ দিয়েই ফুটপাথের কাছে পড়ে থাকা আবরার আহমেদের গাড়ির পেছনে চলে গেল । তারপর মোহনার দিকে তাকালো !

এই টুকু সময়ের ভেতরে মোহনার সাথে এতো কিছু ঘটেছে যে মোহনা অবাক হতে ভুলে গেছে । ওর বিশ্বাস করে নিয়েছে যে কোন কিছুই এখন হতে পারে ! কোন কিছুই অসম্ভব না ! কিন্তু রাফায়েল ওর দিকে তাকাতেই যে ঘটনাটা ঘটলো সেটার জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিল না । ও অনুভব করলো ওর শরীরটা কেউ যেন দুই পাশ থেকে চেপে ধরলো । তারপর ওকে শূন্য তুলে একেবারে রাফায়েলের পাশে এনে দাড় করিয়ে দিল !
কাজটা যে রাফায়েল করলো সেটা বুঝতে মোহনার মোটেই কষ্ট হল না ।
এই মানুষটা আসলে কে ?


এসব এসব ভাবার সময় নেই । অন্তত এই মানুষটা তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে এটাই হচ্ছে সব চেয়ে বড় কথা । রাফায়েল ওর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ঠিক পেছনেই থাকো !
মোহনা তাকিয়ে দেখলো অন্তত দশ ফুট উচু পানির স্রোতটা ওদের দিকে ধেয়ে আসছে ।
মোহনা ভেবেছিলো হয়তো ওদের এই পানি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কিন্তু নিয়ে গেল না ।
ধাক্কাটা সে রাফায়েলের পেছনে থেকেও অনুভব করতে পারলো । যেন শক্ত দুই টা বস্তু পরস্পরের সাথে ধাক্কা লাগলো ! এমন আওয়াজ শুনতে পেল সে । পানির স্রোত আবারও সেই অদৃশ্য দেওয়ালে আটকে গেল ।
স্রোতটা ফিরে যাওয়ার সাথে সাথেই রাফায়েল এই প্রথমবারের মত হামলা করলো । এতো সময়ে সে কেবল ঐ প্রাণীটার আঘাত ঠেকিয়ে এসেছে । নিজে কোন আঘাত করে নি । স্রোত নেমে যাওয়ার সাথে সাথে সে তার প্রথম আঘাত আনলো !

নিজের দুই হাত এক সাথে করে তারপর হাত দুটো গাড়ির উপর রাখলো । অনেকটা ধাক্কা দেওয়ার মত করে ভঙ্গি করলো । তারপর মুখ দিয়ে উচ্চারন করলো "অপ্রে ভিয়েস্তা"

গাড়িটা একেবারে উড়ে গিয়ে নাগা প্রিন্সের দিকে এগিয়ে গেল । এই আঘাতটার জন্য নাগা প্রিন্স মোটেই প্রস্তত ছিল না । সে পানির দেওয়ার সৃষ্টি করে গাড়িটাকে আটকানোর চেষ্টা করলো তবে আঘাত পরিপূর্ন ভাবে ঠেকাতে পারলো না । ধাক্কা লেগে সরাসরি গিয়ে পড়লো লেকের পানির ভেতরে ! তারপর পানির ভেতরে ডুবে গেল ।

মোহনা দেখতে পেল দুটো গাড়ি ওদের দিকে এগিয়ে আসছে । আবরার আহমেদ উঠে দাড়িয়েছে । মোহনার ভয় হচ্ছিলো বুঝি এখনই আবার প্রাণীটা উঠে আসবে কিন্তু পানি থেকে আর উঠলো না ।

রাফায়েল সেদিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । তারপর মোহনার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ঠিক আছে ?
কোন কথা মুখ দিয়ে বের হল না । কেবল মাথা নাড়লো । সে ঠিক আছে । শরীর ভিজে একাকার তবে আর কোন ক্ষতি হয় নি । আবরার আহমেদ কে আসতে দেখা গেল । আবরার আহমেদ কাছে আসতেই রাফায়েল তার দিকে ফিরে তাকালো ।

আবরার আহমেদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাফায়েল ঠান্ডা কন্ঠে বলল, আপনি জানতেন এরকম কিছু হতে পারে তবুও ওকে এই রাস্তায় নিয়ে এসেছেন ?
আবরার আহমেদ কিছু বলতে গেল তখনই রাফায়েল তার ডান হাতটা সামনে নিয়ে আঙ্গুলো একটু মোচড় দেওয়ার ভঙ্গি করলো । সাথে সাথেই আবরার আহমেদ রাস্তা থেকে ফুট খানেক উপরে উঠে গেল । যেন খুব শক্তশালী কেউ তার গলা চেপে ধরে শূন্যে তুলে ধরেছে । আবরার আহমেদ নিজের হাত দিয়ে সেই শূন্য হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিছু সময় । কিন্তু সক্ষম হল না ।
রাফায়েল আবারও বলল, ডোন্ট ইউ ইউ ডেয়ার ! আই নো হু ইউ আর !

পেছনের গাড়ি দুটো তখন ওদের ঠিক সামনে এসে থেকে । সেখান থেকে হুড়মুড় করে কম করে হলেও ১০ জন মানুষ নেমে এল । ওদের সবার হাতেই অটোমেটিক রাইফেল । সেটা ওরা সরাসরি তাক করে ধরলো রাফায়েলের দিকে । একজন রাফায়লেকে আবরার আহমেদকে ছেড়ে দিতে বলল । নয়তো তারা গুলি করবে !
মোহনা কিছুই বুঝতে পারছিলো না । কি হচ্ছে এসব !
আবরাহ আহমেদ জানতো ওর উপর হামলা হতে পারে !
এই স্বসস্ত্র লোক গুলো কিভাবে এল এখানে ?
মোহনা রাফায়েলর কাধে হাত রাখলো । তারপর বলল, প্লিজ স্যারকে ছেড়ে দিন । প্লিজ !
রাফায়েল মোহনার দিকে তাকাল । ওর চোখের ভাষা যেন বুঝতে চেষ্টা করলো । তারপর নিজের হাত নামিয়ে আনলো । সাথে সাথেই আবরার আহমেদ মাটিতে পড়ে গেল ।
রাফায়েল মোহনার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলল, তোমার এই স্যারের কাছ থেকে সাবধান ! তাকে যতখানি ভাল মানুষ মনে সে ততখানি ভাল মানুষ না !

রাফায়েল আর কিছু বলল না । ঘুরে পেছনের দিকে হাটতে শুরু করলো । মোহনা কেবল তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলো



তিন

আবরার আহমেদ আরেকবার বলল, প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড ! লেট মি এক্সপ্লেইন !

মোহনা শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার বসের দিকে । প্রায় তিন মাস ধরে সে এই অফিসে কাজ করছে । কিন্তু আজকে এসে জানতে পেরেছে তার এই চাকরি পাওয়া থেকে এই অফিসে আসা পর্যন্ত সব কিছুর পেছনে অন্য একটা উদ্দেশ্য আছে । সে কেবল সেই খেলার একটা গুটি মাত্র । সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ গুটি অবশ্য !

গতদিন রাতের ঘটনার পরে আবরার আহমেদ তাকে বাসায় পৌছে দেয় । ভেবেছিলো আজকে অফিসে সে আসবে না । কিন্তু পরদিন আবরার আহমেদ তাকে গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে । আবরার আহমেদের মুখোমুখি হওয়া পরে প্রথম যে প্রশ্নটা সে করে সেটা হচ্ছে গতরাতে যে ঐ প্রাণীটা তার উপর হামলা করতে পারে সেটা সে জানতো কি না !

মোহনা জানে যে আবরার আহমেদ জানে ব্যাপারটা । রাতে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে সে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে । রাফায়েলের কথাটা ঠিক । ড্রাইভার এবং তার গুলি করার ধরন দেখেই সেটা সে বুঝতে পেরেছে । সেই সাথে পেছনে গাড়িতে করে আসা ঐ মানুষ গুলো দেখে মোহনার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে সে যে জানতো । এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন ?

আবরার আহমেদ সত্যটা স্বীকার করে নিল । বলল, হ্যা আমি জানতাম যে নাগা প্রিন্স আসতে পারে !
মোহনা চোখ সরু চোখে তাকালো আবরার আহমেদের দিকে । তার বস এই প্রাণীটার সম্পর্কে সব কিছু জানে।
-আপনি জানতেন যে হামলা হতে পারে তার পরেও আমাকে নিয়ে গেছেন ওখানে !
-প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড ! লেট মি এক্সপ্লেইন !
মোহনা কিছু বলতে গিয়েও বলল না । ওর এখন এতো রাগ হচ্ছে । মনে মনে ঠিক করে নিল আর এখানে চাকরি করবে না । খ্যাতা পুরি এমন চাকরির !
আবরার আহমেদ বলল, কথা টা ! আমি চাইছিলাম যে নাগা প্রিন্স যেন আসে ! এই জন্য পেছনে এই লোক গুলোকে আমি ঠিক করে রেখেছিলাম । কিন্তু ইডিয়েট গুলো ঠিক সময়ে আসতে পারি নি ।
-কেন চাইতেন ?
-কারন আমি নাগা প্রিন্সকে ধরতে চেয়েছিলাম !
-মানে ?

আবরার আহমেদ বেশ কিছুটা সময় চুপ করে রইলো তারপর বলল, মনে আছে তুমি দেবতাখুমে বেড়াতে গিয়ে পানিতে পড়ে গিয়েছিলে ?তারপর পানির মধ্যে এই নাগা প্রিন্সকে দেখতে পেয়েছিলে !
মোহনা এবার অবাক হয়ে গেল । পানি পড়ে যাওয়ার ঘটনা খুব বেশি মানুষের জানার কথা না । এই কথা ও কখনই বাসায় উচ্চারন করে নি । কারন যদি ও মা এই ব্যাপারটা জানতে পারে তাহলে হয়তো আর কোন কোথায় যেতেই দিবে না । আর পানির ভেতরে ঐ প্রাণীটা দেখার ব্যাপার ওর বোন আর সেই সাইক্রায়াটিস ছাড়া আর কেউই জানে না বলতে গেলে । তাহলে এই খবর তার বস জানলো কিভাবে ?

আবরার আহমেদ বলল, দেবতাখুমের এই নাগা প্রিন্সের মিথ খুব কম মানুষ জানে । তার থেকেও কম মানুষ সেটা বিশ্বাস করে । কিন্তু সেটা যে সত্যিই তুমি সেটা দেখতেই পাচ্ছো । কথিত আছে যে প্রতি চারশ থেকে পাঁচশ বছরে নাগা প্রিন্স উপরে উঠে আসে তার ব্রাইডের জন্য । এটা নিয়তিই যে সেই মেয়েটি সেখানে যাবেই এবং নাগা প্রিন্স তাকে নিয়ে পানির নিচে চলে যাবে !

মোহনা বলল, আমি সেই ব্রাইড ?
-হ্যা তুমিই সেই ব্রাইড !
-তাহলে আমাকে সে কেন নিয়ে যায় নি পানির নিচে । সুযোগ তো পেয়েছিলো তাই না ? আমাকে চেনে নিয়ে গেলে আমার তো কিছুই করার ছিল না ।
আবরার আহমেদ একটু চুপ করলো । তারপর বলল, নিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল । কিন্তু যখন নিয়ে যায় নি তার পেছনে একটা কারন থাকতে পারে ।
-কি কারন ?
-সম্ভবত তখনই সেই ফুলটা তখনও ফোটে নি নি !
-আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না ।
-কাল যখন নাগা প্রিন্স আমাদের উপর হামলা করছিলো তখন নিশ্চয়ই খেয়াল করেছিলে যে ওর বুকের কাছটা একটু উজ্জ্বল ছিল । ওটা ওর জান বলতে পারো । আবার ওটাকে পাওয়ার কোরও বলতে পারো । ওটা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে শেষ হয়ে যায় । যেমন মোবাইলের ব্যাটারি থাকে সেটার পাওয়ারে পুরো মোবইল চলে ঠিক সেই রকম ! এই শেষ হয়ে যাওয়ার সময় দেবতাখুমের পানির ভেতরেই একটা ফুল ফুটে । সেটার থেকে এক ফল হয় । সেই ফলটা এই নাগা প্রিন্সকে খেতে হয় । তাহলে তার ঐ পাওয়ার কোর আবারও রিস্টোর করে ।

মোহনা বলল, এখানে আমার কি দরকার আমি বুঝতে পারছি না ।
-দরজার টা আছে । নাগা প্রিন্স এই ফুলের গাছটা খুজে পায় না । মিথ এই গাছ টা খুজে পাওয়া এবং সেই ফুল থেকে ফল সংগ্রহ করার কাজটা করতে হয় তার ব্রাইডকে ! তোমার হতের ভেতরেই কেবল সেই ফুল থেকে ফলে রূপান্তর হতে পারে । তোমাকেই এটা নিয়ে আসতে হবে !
-আমি যদি না নিয়ে আসি ?
-তাহলে সে মারা যাবে !
-সে মরলে তো আমার ঝামেলা শেষ হয়ে যায় । তাহলে আপনি আমাকে কেন বিপদের মধ্যে নিয়ে গেলেন ? কেন ?
-প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা কর ! খুব বড় সম্ভবনা রয়েছে এর ভেতরে । খুব বেশি । আমার বুদ্ধিটা একটা শোন !

মোহনা চুপ করে তাকিয়ে রইলো । এখনও ওর মাথার ভেতরে ঠিক মত কাজ করছে না । সামনে কি হবে কিংবা কি করা উচিট তার কিছুই সে বুঝতে পারছে না আপাতত । তবে আবরার আহমেদ কি বলতে চায় সেটা শুনতে ইচ্ছুক ।
আবরার আহমেদ বলল, কালকে তার আসল ক্ষমতা তো দেখেছো তাই । এটা তার শক্তির শেষ সময় । মানে হচ্ছে যে পাওয়ার কোরের কথা আমি বলছি, যেটা তার ভেতরে আছে সেটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে । তাতেই তার শক্তির নমুনাটা দেখেছো তুমি । এখন যদি পুরোটুকু পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে পারছো ?
মোহনা বুঝতে পারছে না । তবে সামনের মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা অনুমান করতে পারছে ।
মোহনা বলল, আপনি চান আমি সেই ফুলের গাছটা খুজে বের করি । এবং সেটা এই নাগা প্রিন্সের কাছে দেই ।
-রাইট !
মোহনা বলল, আপনি আমাকে বলেন যে তখন লাভটা কি হবে ? আপনি বলছেন ঐ প্রাণীটার শক্তির শেষ সময়ে চলে এসেছে তাতেই আপনি কালকে তাকে ধরতে পারেন নি । কিংবা তার সাথে পারেন নি । যখন পরিপূর্ন শক্তি পাবে তখন সে আপনার কথা কেন শুনবে?

মোহনার এই কথা শুনে আবরার আহমেদ হাসলো । তারপর বলল, এসো আমার সাথে ।

এই বলে মোহনাকে অফিসের ওয়াশরুমের দিকে নিয়ে গেল । মোহনা ঠিক বুঝতে পারলো না যে ওকে ওয়াশ রুমের দিকে কেন নিয়ে যাচ্ছে । তবে ভুলটা ভাঙ্গলো যখন ওয়াশের ঠিক পাশে রাখা একটা পেইন্টিং ভেতরে সামান্য একটা চাপ দিল । পাশেই একটা লিফটের দরজা খুলে গেল। আবরার আহমেদ ওকে নিয়ে সেই লিফটের ভেতরে প্রবেশ করলো৷ যখন নতুন একটা রুমে এসে লিফট এসে থামলো মোহনা দেখলো ওরা একটা ল্যাবে এসে থেমেছে। নানান মানুষ সেখানে কাজে ব্যস্ত।

মোহনাকে নিয়ে এসে আবরার আহমেদ একটা কাঁচের আলমারির সামনে থামলো৷ তারপর মোহনার দিকে তাকিয়ে বলল, এই যন্ত্রটা দেখতে পাচ্ছো না? এটাই হচ্ছে তোমার প্রশ্নের জবাব?
কৌতুহল নিয়ে যন্ত্রটার দিকে তাকালো সে৷ তবে কিছুই বুঝতে পারলো না।
আবরার আহমেদ বলল, এই যন্ত্রটা বসানো হবে নাগা প্রিন্সের বুকের ভেতরে। যার পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রন থাকবে আমাদের হাতে। আমরা যা বলবো সেটা করতে বাধ্য হবে সে। একবার চিন্তা কর এই শক্তি দিয়ে আমরা কত কিছু করতে পারবো। কেবল ভাবো একবার!
কিছু মসয় তাকিয়ে রইলো যন্ত্রটার দিকে । এটা দিয়ে নাগা প্রিন্সকে আটকানোর পরিকল্পনা করছে সে !

মোহনার হঠাৎ মনে হল প্রাণীটাকে যদি এই যন্ত্রটা পরানো হয় তাহলে সে আবরার আহমেদের হাতে বন্দী হয়ে যাবে । দাসে পরিনত হবে। কাজটা কি ঠিক হবে?
পেছন থেকে আবরার আহমেদ আবার বলল, মাই ডিয়ার মোহনা, অন্য কিছু ভেবো না ৷সামনের সম্ভবনার কথা ভাবো। আমি তোমার খারাপ লাগছে, এই কথা শুনে কিন্তু নিজের কথাটা ভাব একবার ৷ওটা তোমার পিছু কিছুতেই ছাড়বে না। যদি তুমি ওকে না ধরতে চাও, তবে ওটা তোমার কাছে আসবে, বেঁচে থাকার জন্য ওর ঐ ফলটা দরকার আর ফলের জন্য তোমাকে দরকার। যে কোন ভাবেই সেটা সে করবেই। হয়তো পালিয়ে থাকতে পারবে কিন্তু যদি না পারো তখন? তোমাকে না পেয়ে তোমার ফ্যামিলির পিছুও নিতে পারে। তখন তোমার কি হবে ?

মোহনা কিছু ভাবতে পারছে না। প্রাণীটা ওর পিছু ছাড়বে না এটা রাফায়েলও ওকে বলেছিল। সত্যিই যদি ও নিজে হয় একমাত্র উপায় তাহলে প্রাণী টা মরিয়া হয়ে উঠবেই। নিজের প্রাণ বাঁচাতে সবাই মরিয়া হতে পারে।
আবরার আহমেদ বলল, এটা ছাড়াও মিথ বলে যে নাগা প্রিন্স যেখানে থাকে সেখানে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ পড়ে থাকে । যদি আমাদের পক্ষে এই পাওয়ার কোরটা নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব নাও হয় আমরা একটা সমঝোতায় আসতে পারি এই নাগা প্রিন্সের সাথে !
-কি রকম ?
-তাকে আমরা বলল যে আমাদেরকে এই সম্পদকে এনেদিক আমরা ওকে ছেড়ে দিবো ! সোজা হিসাব । দেখো তখন তাকে আর নিয়ন্ত্রনও করা লাগবে না !

মোহনাকে তখনও খানিকটা দ্বিধান্বিত মনে হল । তারপর জোড়ে করে একটা দম নিল সে। তারপর বলল, কি করতে হবে আমাকে? কি ভাবে এই প্রিন্সকে ধরতে পারি আমরা?

আবরার আহমেদের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার মুখে একটা হাসি ফুটেছে।

চার

মোহনা ঠিক জানে না কিভাবে নাগা প্রিন্সকে ধরা হবে। কেবল এই টুকু বলা হয়েছে তাকে কিছুই করতে হবে না। সে শুরু বসে থাকবে।
আগে বাঘ শিকার করার জন্য যেমন টোপ ব্যবহার করা হত মোহনার নিজেকে তেমনই মনে হচ্ছে। তবে এখানে পার্থক্য হচ্ছে মোহনার জীবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা আবরার আহমেদ হোক আর সেই নাগা প্রিন্সের কাছেই হোক। কারন সেই ফুলটা কেবল মোহনাই খুজে বের করতে পারবে। আর মোহনার হাতের ভেতরেই সেটা ফুল থেকে ফলে পরনত হবে ! তাই মোহনার কোন ক্ষতি কেউ করবে না। অন্তত এটা ওর নিজের বিশ্বাস !

মোহনা এই বেড়িবাঁধ এলাকায় আগেও এসেছে। যখন ক্যাম্পাস থেকে বাসায় আসতো মাঝেমধ্যেই এই রাস্তা দিয়ে ফিরতো। কিন্তু এই স্থানে সে আগে আসে নি। বেড়িবাঁধ থেকে একটু ভেতরে৷ এখানে একটা বড় খোলা জায়গা রয়েছে৷ তার পাশেই একটা পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরি। তার কাছেই ও দাড়িয়ে রয়েছে। ও জানে আসে পাশে আরও অনেক মানুষ আছে। সবাই লুকিয়ে আছে।
মোহনা চারিদিক টা দেখতে লাগলো । কিভাবে নাগা প্রিন্সকে ধরা হবে সেটা সে জানে না ! আবরার আহমেদ পাশে এসে দাড়িয়েছে ।
মোহনা প্রশ্ন করলো, আমি এখানে আছি সেটা নাগা প্রিন্স কিভাবে জানবে?
আবরার আহমেদ বলল, সে জানতে পারবে ।
এই বলে তাকে ঠিক বেড়িবাঁধের একেবারে কাছে নিয়ে গেল । তারপর মোহনাকে বলল, তুমি এখন এই পানিতে হাত ডুবাও ।
মোহনা বলল, এতে কাজ হবে ?
-হ্যা হবে । বিলিভ কর হবে ! কিভাবে হবে সেটা আমি জানি না তবে হবে । নাগা প্রিন্স জগতের প্রাচীন প্রাণীদের একজন ! আদিবাসিরা একে অপদেবতা বলে । এদের প্রধান শক্তি হচ্ছে এই মাদার আর্থ, তার কোর এলিমেন্ট ! পানি বায়ু মাটি এসব । নাগার সাথে এই পানির সম্পর্ক সব থেকে গভীর ! সো আমি নিশ্চিত এতেই যে জেনে যাবে ।

মোহনা খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়ে নিজের হাতটা পানিতে ডোবালো । কিছু সময়ে কিছুই হল না । তারপর কি মনে হল সে নিজের চোখটা বন্ধ করলো । সাথে সাথে চোখের সামনে সেই সবুজ চোখ ভেসে উঠলো । ওর কেবলই মনে হল সবুজ চোখ ওর দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে ।
সাথে সাথে পানি থেকে হাত বের করে ফেলল ।
-কি হল ?
মোহনা কোন কথা বলল না । দ্রুত পানির কাছ থেকে উপরে উঠে এল । সে নিশ্চিত জানে নাগা প্রিন্স জেনে গেছে সে কোথায় আছে ! সে আবারও আগের স্থানে ফিরে গেল । এটা পানি থেকে একটু দুরে । নাগা প্রিন্স যখন আসবে তখন পানি থেকে যতদুরে পারা যায় ততই ভাল ! যতপানির কাছে থাকবে তাকে কাবু করা ততই শক্ত হয়ে যাবে !


বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না। বেড়িবাঁধের খালের ভেতরে আন্দোলন শুরু হল। তার পরই তাকে উঠে আসতে দেখলো। মোহনা দাড়িয়ে রইলো সোজা হয়ে। বুকের ভেতরে একটা ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। যতই বলুক ওর কোন ক্ষতি কেউ করবে না কিন্তু যদি এইবারও এই নাগা প্রিন্সকে ধরতে ব্যর্থ হয়?
আর যদি নাগা প্রিন্স ওকে নিয়ে যায় সাথে করে? তখন?
ভাবনাটা আসতেই আবারও মনের ভেতরে একটা ভয়ের স্রোত বয়ে গেল। খুব ইচ্ছে হল পেছন ঘুরে দৌড় দেয়। নিজের ইচ্ছেটা খুব কষ্টে দমন করলো। ততক্ষণে নাগা প্রিন্স ওর কাছে চলে এসেছে।

সবুজ চোখ দুটো একেবারে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে৷ চোখ দুটো ওর উপরেই নিবদ্ধ৷ মোহনার ভেতরে হঠাৎ একটা পরিবর্তন এল৷ সবুজ চোখ দুটোর ভেতরে এক অদ্ভুত বিষাদ দেখতে পেল। ওকে কিছু যেন বলতে চাইছে ও। এতো দিন সে কেবল এই প্রাণীটাকে ভয় পেয়ে এসেছে । কোন দিন এই প্রাণীটার দিকে ভাল করে তাকায় নি ।
রাফায়েলের কথাটা আবার তার মনে পড়লো ! ও নাগা প্রিন্সের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ন !

নিজের ভেতরে এক তীব্র অনুশোচনা বোধ জেগে উঠলো। সামনে দাড়ানো এই মানুষের মত প্রাণী টা যা করছে তা কেবল বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু আবরার আহমেদ যা করতে যাচ্ছে তা নিছক স্বার্থ আর কিছু নয়। নিজের স্বার্থের জন্য কারো এই অধিকার নেই যে সে অন্য কাউকে নিজের দাসে পরিনত করবে!
নাহ । মোহনা হতে দিবে না এটা!

মোহনা চিৎকার করে উঠলো। হাত নেড়ে নাগা প্রিন্সকে চলে যেতে ইশারা করতে শুরু করলো ! কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। একটা ডার্ট এসে বিধেছে নাগা প্রিন্সের শরীরে। তার আরও কয়েকটা। মোহনা দৌড়ে গেল সেদিকে। নাগা প্রিন্সের শরীরে তীব্র চেতনা নাশক ঔষধওয়ালা ডার্ক বিধেছে ৷সে নিজের হাত তুলে পানির দিকে ইশারা করতে চাইলো ।
কিন্তু সেটা পারলো না । একটা গুলি এসে বিধলো সেই হাতে !
একটা চিৎকার বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে !
মোহনা একেবারে কাছে এলে এসেছে । আর কোন গুলি লাগতে দিবে না সবুজ চোখের প্রাণীর শরীরে ! কিন্তু ততক্ষণে আসলেই অনে দেরি হয়ে গেছে । প্রাণীটা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে । মোহনা তার কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে বসলো ! ওর চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এল আপনা আপনি !
অজানা এই প্রাণীট জন্য ! মানুষের মন কি অদ্ভুত ! একটু আগেও এই প্রাণীটা থেকে সে পালিয়ে বেড়াতে যাচ্ছিলো আর এখন এর জন্য কান্না করছে !
মোহনা দেখতে পেল তার সবুজ চোখটা বুঝে আসছে। সেই চোখে তীব্র বিস্ময় আর কষ্টের ছাপ।



পাঁচ


-খবরটা একবার দেখ

মোহনা নিজের ঘরেই ছিল । ঐদিনের ঘটনার পর থেকে মোহনার আসলে কিছুই ভাল লাগছে না । বারবার সেই সবুজ চোখদুটো চোখের সামনে ভেসে উঠছে । মোহনা যখন ইচ্ছে করে পানিতে হাত দিয়ে তাকে খুজতে শুরু করলো তখন সে নিশ্চয়ই ভেবেছিলো যে মোহনা তাকে ডাকছে । আর যখন সেই তাকে ধরিয়ে দিল তখন সে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল মোহনার দিকে । সেই চোখে কোন রাগ ছিল না, ছিল কেবল বিস্ময় । এই বিস্মিত দৃষ্টি সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না । কোন ভাবেই না ।
বিছানা শোয়া অবস্থায় সে তার বড় বোনের দিকে তাকালো । শোভনার হাতে ওর মোবাইল ।
মোহনা বলল, কি হয়েছে ? এখন কিছু দেখতে ভাল লাগছে না ।
-আরে দেখ না ! আমরা দেবতাখুমে গিয়েছিলাম মনে আছে ?
দেবতাখুমের নাম শুনেই মোহনার কান সজাগ হঠে উঠলো । সে বলল, হ্যা ।
-জায়গাটা নাকি মারা যাচ্ছে ?
-জায়গা মারা যা্চ্ছে মানে ?
-এই দেখ ? আজকে কিরন ভাই ঐখানে গিয়েছিলো ট্যুরে । সেখানে গিয়ে দেখে এই অবস্থা !

মোহনা শোভনার হাত থেকে মোবাইলটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিল । তারপর ছবি গুলো একে একে দেখতে শুরু করলো ।

সত্যি জায়গাটা কেমন মারা যাচ্ছে ! প্রধানত ঝিড়ি পথ একেবারে শুকিয়ে গেছে । কোন পানি নেই । কেবল যে স্থানে ওরা ভেলাতে করে গিয়েছিলো সেখানে একটু পানি দেখা যাচ্ছে । আর কোন পানি নেই ।
আর চারিদিকের গাছ গাছি গুলোও কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে !

মোহনা নিজের চোখকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না । কদিন আগেও সে কিরন ভাইয়ের ফেসবুক প্রোফাইলে এই ছবি গুলো দেখেছে । তখন একেবারে সজিব ছিল । মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে এই সব কিভাবে হয়ে গেল !

তখনই ওর মাথায় সেই চিন্তাটা বাড়ি মারলো !
আচ্ছা এমন কি হতে পারে ?
না না হতে পারে না !
ও মাথা থেকে চিন্তাটা দুর করার চেষ্টা করলো !
বারবার বলল এটা কোন ভাবেই হতে পারে না । নিজের মাথার ভেতর থেকে চিন্তাটা দুর করার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না !

ও সাথে সাথে বিছানা থেকে উঠে বসলো । এখনই তাকে আবরার আহমেদের কাছে যেতে হবে ! শোভনা বলল,
-কোথায় যাচ্ছিস?
-অফিস যাবো আপু ! জরুরী কাজ মনে পরে গেছে !


##
-স্যার তাকে ছেড়ে দিতেই হবে !

আবরার আহমেদ যেন এমন একটা হাসির কথা কোন দিন শোনেই নি । সে বলল, তুমি কি পাগল হয়েছো ? তাকে ছেড়ে দিবো মানে কি? আমাদের প্রজেক্ট কতখানি এগিয়ে গেছে জানো তুমি ? তাকে কাবু করে ফেলেছি প্রায় । তার শরীরে ভেস্ট বসানো হয়ে গেছে প্রায় ! সেটা হয়ে গেলে তোমাকে নিয়ে দেবতাখুমে যাবো ! লাইফ ট্রি থেকে ফলটা দরকার আমাদের ।
-আপনি বুঝতে পারছেন না । আমি নিশ্চিত যে দেবতাখুম মরে যাওয়ার পেছনে এই নাগা প্রিন্স এখানে পরে থাকা টা দায়ী । আপনারা ওকে পুরো পুরো আইসোলেটেড করে রেখেছে । পানি মাটির কাছ থেকে একেবারে আলাদা !
-আমাদের এই এতো বড় প্রজেক্টের কাছে সামান্য দেবতাখুমের কোন দাম নেই । আমার সাথে আমাদের হেড অফিসে কথা হয়েছে । তারা খুবই প্লিজড ! বুঝতে পারছো ? এখন এসব চিন্তা করার সময় নেই।

মোহনা চুপ করে কিছু সময় আবরার আহমেদের দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, আপনি যদি তাকে না ছাড়েন তাহলে আমার কাছ থেকে কোন প্রকার সাহায্য পাওয়ার আশা ভুলে যান । আমি কোন দিন আপনাদের সাহায্য করবো না !
আবরার আহমেদের চোখ যেন মহুর্তের ভেতরে জ্বলে উঠলো । তবে সেটা সে সামলে নিল সাথে সাথেই । মোহনার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি স্বরে হেসে বলল, মাই ডিয়ার মোহনা, তুমি ভেবো না যে আমি সব কিছু এতো হালকা ভবে কাজ নিচ্ছি । তোমাকে কিভাবে রাজি করাতে হয় সেটা আমার জানা আছে !
-আপনি কোন দিন পারবেন না । আর আমি সবাইকে বলে দিবো আপনি আসলে কি করছেন এখানে !
-মাই ডিয়ার মোহনা ! তোমার সাথে আমি জোর জবরদস্তি করতে চাইছিলাম না । যাক কি আর করা ! কিন্তু তুমি অন্য কোন পথ খোলা রাখো নি !
এই বলেই সে একট বেল চাপ দিল । সাথে সাথেই দুজন মানুষ রুমের ভেতরে ঢুকে পড়লো । তাদের দিকে তাকিয়ে আবরার আহমেদ বলল, একে আমার ফার্ম হাউজে নিয়ে যাও । দেখো যেন পালাতে না পারে । আমরা পরশুদিন দেবতাখুমের দিকে রওয়ানা দিবো !
মোহনা কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটা হাত ওকে হাত টা শক্ত করে ধরলো ।
আবরার আহমেদ আবার বলল, যাওয়ার পথে যদি তুমি কোন প্রকার ঝামেলা করার চেষ্টা কর মনে রাখবে এটা তোমার পরিবারের উপরে বিপদ ডেকে আনবে !

শেষ কথাটা শুনতেই মোহনার শিরদাড় বেঁয়ে একটা ঠান্ডা অনুভূতি বয়ে গেল । আর কোন কিছু যেন ভাবতেই পারলো না । আবরার আহমেদ নিশ্চিত স্বরেই তখন বলেছিলো যে কিভাবে রাজি করাতে হয় সেটা সে জানে !
একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল সে । চারিদিকের অন্য কোন কিছু তার মনে আসছিলো না । কিছু করতে সাহস পাচ্ছিলো না । আবরার আহমেদ যে একজন ক্ষমতাবান মানুষ সেটা সে খুব ভাল করেই জানে । সে কিছু করতে গেলে যদি তার পরিবারের ক্ষতি হয় !
কি করবে এখন ?

গাড়ি যখন শহর ছেড়ে শান্ত পথে এগিয়ে চলছে তখনও কেবল নিজের পরিবারের কথা ভাবছে । বাইরের দিকে কোন লক্ষ্য নেই । বারবার কেবল মা বাবা আর শোভনার চেহারা ভেসে উঠছে । ওর কারনে যদি তাদের ক্ষতি হয় তাহলে নিজেকে কোন দিন ক্ষমা করতে পারবে না । কোন দিন না !

যখন একেবারে নির্জন রাস্তায় গাড়ি চলে গেল তখনই গাড়ির ডান দিক থেকে কিছু একে গাড়িতে আঘাত করলো । সাথে সাথে গাড়িটাকে রাস্তা থেকে এক পাশে সরিয়ে দিল । মোহনা চমকে তাকালো গাড়ির ডান দিকে । ও গাড়ির বাঁ দিকে ছিল বিধায় আঘাতটা ওর শরীরে খুব একটা লাগে নি । তাকিয়ে দেখলো একটা গাড়ি ওদের গাড়িকে ধাক্কা মেরেছে ।
মোহনা সামনের গাড়ির দিকে চোখ যেতেই দেখতে পেল গাড়ির সামনের সিটে ওর বড়বোন শোভনা বসে আছে । আর ঠিক তার পাশেই বসে আছে সেই মানুষটা !
রাফায়েল !
শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে !
এই মানুসটা সব স্থানে কিভাবে সঠিক সময়ে পৌছে যায় ?

মোহনা তাকিয়ে দেখলো গাড়ির ড্রাইভারের পাশের জন ধাক্কা খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে । ধাক্কাটা সরাসরি ওখার কাছেই গেলেছে । ড্রাইভারের খুব একট ক্ষতি হয় নি । সে সামলে নিবে একটু পরেই । তবে ওর পাশে থাকা গার্ডটা দ্রুত সামলে নিল নিজেকে । গাড়ির দরজা খুলে বের হতে দাড়ালো । হাতে পিস্তলটা তাক করলো সামনের গাড়ির দিকে । মোহনার মনে কি হল সেটা সে কোন ভাবেই বলতে পারবে না । গাড়ির দরজাটা তখনও বন্ধ হয় নি । লোকটা পিস্তল হাতে ঠিক দরজার সামনেই দাড়িয়ে আছে । মোহনা এবার খুব দ্রুত নিজের দুই পা দিয়ে সর্ব শক্তি দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল ।

লোকটা একেবারে দরজার কাছেই দাড়িয়েছে । দরজাটা সোজা গিয়ে আঘাত করলো লোকটার পেছন দিকে গিয়ে লাগলো । সে নিজের ব্যালেন্স ধরে রাখতে পারলো না । সামনের দিকে ছিটকে পড়ল খানিকটা । তারপর আবার উঠে পড়তে চেষ্টা করলো অবশ্য তবে ততক্ষণে রাফায়েল বের হয়ে এছে গাড়ি থেকে ।
লোকটা নিজের পিস্তল রাফায়েলের দিকে বাড়িয়ে ধরতে যাবে তখন নিজেকে শূন্যের উপর আবিস্কার করলো । রাফায়েল শান্ত চোখে লোকটার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো কেবল । তারপর মানুষ যেমন একটা হালকা পাথর এক দিকে ছুড়ে ফেলে দেয় তেমনি ভাবে লোকটাকেও এক পাশে ছুড়ে ফেলে দিলো কেবল । ড্রাইভার লোকটা সেটা দেখে আর সাহসই করলো না সামানে আসার। সে দরজা খুলে সোজা দৌড় দিল ।

মোহনা এবার গাড়ি থেকে বাইরে বের হয়ে গেল । শোভনাও ততক্ষণে গাড়ি থেকে বাইরে বের হয়ে এসেছে । মোহনা বলল, আপু আব্বু আম্মু কেমন আছে ?
উত্তরটা রাফায়েল দিলো, বলল, সমস্যা নেই । আবরার আহমদে যেন তোমার বাবা মা কিংবা পরিবারের কোন ক্ষতি না করতে পারে সেই ব্যাপারটা আমি দেখবো । আমার কিছু পরিচিত মানুষ আছে । তারা সামলে নেবে !
মোহনা যেন একটু শান্তি পেল মনে মনে । কিন্তু সাথে সাথেই আবার সে সবুজ চোখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে । সে মরতে বসেছে ! সেই সাথে পুরো দেবতাখুম ! ওর কারনে !

গাড়িতে উঠতে উঠতে মোহনা বলল, আমাদের দেবতাখুমে যেতে হবে !
শোভনা বলল, কি বলছিস ? কেন যেতে হবে ?
-আপু তুই বুঝতেছিস না । সেই প্রাণীটা আমার পেছন পেছন এই ঢাকাতে চলে এসেছে । আর আমি ওটাকে ধরতে সাহায্য করেছি আবরার আহমেদ কে । এখন এটার কারনে দেবতাখুম নষ্ট হতে চলেছে । এটার জন্য আমি দায়ী ।

রাফায়েল ততক্ষণে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছে । গাড়ি চলতে শুরু করলে রাফায়েল বলল, তোমার কোন দোষ নেই । দেবতাখুম এমনিতেও মারা যেত । ওদের দেবতার আয়ু শেষ হয়ে আসছে । সে যদি সেখান থেকে বের না হয়ে আসতো তাহলে হয়তো আরও কিছু দিন টিকে থাকতো। এখন তার সময় শেষ হয়ে আসছে ।
-আমাদের ঐ লাইফ ট্রি খুজে বের করতে হবে । ওটা লাগা প্রিন্সকে দিলেই সব আগের মত হয়ে যাবে ।
শোভনা এসবের কিছুই বুঝতে পারছিলো না । সে বলল, কিসের লাইফ ট্রি ?
রাফায়েল বলল, সেদিন আমাদের যখন দেখা হল বেঙ্গল বইতে মনে আছে আমি বলেছিলাম যে মোহনার পেছনে একটা অপশক্তি পরেছে?
শোভনা মাথা ঝাকালো ।
রাফায়েল বলল, ওয়েল এই অপশক্তিটার নাম নাগা প্রিন্স । যদিও সে ঠিক অপশক্তি না। অন্য নামে ডাকলে সে হচ্ছে এই দেবতাখুমের দেবতা । তার সাথেই পুরো দেবতাখুমের প্রাণ যুক্ত । সে যদি মারা যায় তাহলে দেবতাখুম মারা যাবে । ওখানকার প্রাণী, ঝর্ণা গাছগাছি সব মারা যাবে । মানুষের যেমন বয়স বাড়ে বুড়ে হয় তার পর মারা যায় ঠিক তেমনি এই পৃথিবীর সব কিছুর বয়স বাড়ে এক সময় মারা যায় সে । এই নাগা প্রিন্সও এক সময়ে মারা যায় । কিন্তু তার মারা যাওয়ার সাথে সাথে যেহেতু পুরো দেবতাখুমটা জড়িতো তাই তাকে আবারও পুনোরায় জীবিত হতে হয় । দেবতাখুমের পানির গভীরে একটা লাইফট্রি আছে। প্রতি ৪০০/৫০০ পরপর ঐ লাইফ ট্রিতে একটা করে ফুল জন্মে । সেটা থেকে ফল হয়। সেটাই নাগা প্রিন্সকে আবার নতুন জীবন দেয় । অনেক অনেকটা বলতে পারো ঐ ফল টা হচ্ছে একটা ব্যাটারি । মোবাইলে যেমন নতুন ব্যাটারি সংযোগ করলে ওটা বেশ কিছু সময় জীবিত থাকে ঠিক তেমনি এই ফল নাগা প্রিন্সকে লম্বা সময় ধরে জীবিত রাখে ।
শোভনা বলল, এর ভেতরে মোহনা এল কোথা থেকে ?
-সব কিছুর ভেতরে কিছু না কিছু দূর্বলতা থাকে যাতে সে কোন ভাবেই নিজেকে সর্বশক্তিমান না ভাবে। এই নাগা প্রিন্সের দূর্বলতা হচ্ছে সে কোন ভাবেই এই লাইফট্রি খুজে পাবে না । কোন ভাবেই সেই ফুল থেকে ফল তৈরি করতে পারবে না। এর জন্য তার একজন মানবীর উপর নির্ভর করত হবে । এখন কে সে মানবী হবে সেটা কেউ বলতে পারে না । লাভ এট ফার্স্ট সাইটের মত ! বলা যায় মোহনার জন্মই হয়েছে এই কারনে ।
মোহনা বলল, তাহলে চলুন । আমরা নিয়ে আসি সেই ফল । দেবতাখুম যদি ধ্বংশ হয়ে যায় তাহলে পুরো ইকোলজির উপরে কি পরিমান প্রভাব ফেলবে ভেবে দেখেছেন একবার?
রাফায়েল কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, ব্যাপারটা সলে এতো সহজ না যতটা তুমি ভাবছো ?
-মানে সহজ কেন হবে না ? এর ভেতরে প্যাঁচ কোথায় ?
রাফায়েল বলল, তুমি যখন লাইফ ট্রির ফুলটা হাতে নিবে তখন সেটার সাথে তোমার নিজের জীবন যুক্ত হয়ে যাবে । তোমার হাতের ভেতরেই সেই ফুলটা থেকে ফল হবে । তারপর যখন তুমি এই ফল টা নাগাপ্রিন্সের কাছে দিবে তখন তোমার নিজের জীবনটাও সেটার সাথে চলে যাবে । সোজা বাংলায় বললে তুমি মারা যাবে ।
গাড়ির ভেতরে হঠাৎ করেই নিরবতা নেমে এল । সবাই যেন কথা বলা ভুলে গেছে কিছু সময়ের জন্য ।

তারপর হঠাৎ মোহনা বলল, আমি তবুও যেতে চাই ওখানে । ও লাইফ ট্রির কাছে যেতে চাই ।
শোভনা কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই মোহনা তাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিল । বলল, আপু বাঁধা দিস না প্লিজ । তুই বুঝতে পারছিস এটার উপর কত কিছু নির্ভর করছে ! পুরো এলাকাটা ধ্বংশ হয়ে যাবে । সব কিছু নষ্ট হয়ে যাবে ।
-কিন্তু তাই বলে তুই তো নিজেকে এভাবে নিজেকে মেরে ফেলতে পারিস না । একবার আমাদের কথা ভাববি না? আম্মু আব্বুর কথা ভাববি না ?

মোহনা কিছু বলতে গিয়েও বলল না । তার মনে হল যে কোন ভাবেই শোভনাকে বোঝাতে পারবে না । কাউকেই বোঝাতে পারবে না এর থেকে বোঝানোর কোন দরকার নেই । রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন ওখানে ? না পারলে আমি একাই যাবো ।
রাফায়েল কোন কথা না বলে সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে থাকলো । তারপর এক সময় হঠাৎ বলল, আমি এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম যে যে তুমি ঠিক ঠিক এই পাগলামিটা করতে চাইবে ।
-আপনার কি মনে হচ্ছে না এটা দরকারি ?
-হ্যা দরকারি । কিন্তু এভাবে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া মোটেই ভাল কোন কাজ নয় ।
-কিন্তু আমি এর পেছনে দায়ী ! এই মানুষটাকে আমি নিজে ধরতে সাহায্য করেছি । নয়তো আরও কিছুদিন হয়তো দেবতাখুম টিকে থাকতো ! যা হয় হবে আমি যাবোই ।


ছয়



পরের দিন সকাল বেলা ওরা তিনজন বান্দরবান শহরে এসে থামলো । মোহনার বাসায় ফোন করে জানালো যে অফিসের একটা জরুরী কাজ তাকে ঢাকার বাইরে যেতে হচ্ছে । সাথে করে শোভনাকে নিয়ে যাচ্ছে । প্রথমে মোহনার মা একটু রাগ করলেও শোভনা সাথে আছে বলে আর কোন কথা বলল না । বলল যে কাজ শেষ করে জলদিই বাসায় ফিরে আসে ।

মোহনা যদিও যাচ্ছে সেই লাইফ ট্রির কাছে যেটা ওর প্রাণ কেড়ে নিবে । তবে সেটা এখনই হবে না । ওটা যখন নাগা প্রিন্সকে দিবে তখনই কেবল ও মারা যাবে । তার মানে ওটা ধরলেও কিছু হবে না । ওর প্লানটা খুব সহজ । আগে ও সেই ফলটা সংগ্রহ করবে । তারপর ঢাকায় ফিরে নাগা প্রিন্সকে মুক্ত করবে আবরার আহমেদের হাত থেকে । তারপর নাগা প্রিন্সকে দিবে সেই ফলটা । এখনই সে মারা যাচ্ছে না সো এসব এখন ভেবে লাভ নেই ।

সকালবেলাতে নাস্তা সেরে ওরা তিনজন রওয়ানা দিল রোয়াংছড়ির দিকে । খুব বেশি সময় লাগডলো না সেখানে পৌছাতে । আগের বার থানা আর কচ্ছপতলি আর্মি ক্যাম্প থেকে ওরা অনুমুতি নিয়েছিলো । তবে এবার আর সে সবের ধার দিয়ে গেল না । কদিন থেকে এই এলাকাতে টুরিস্ট আসা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে । তাই এখন আর অনুমূতির ব্যাপারটা বন্ধ হয়ে গেছে ।

মোহনা লক্ষ্য করলো ট্রেকিং শুরুর আগে ওদের সাথে দুজন আদিবাসি ছেলে এসে হাজির হয়েছে । ওর দুজনের কাধে দুটো অক্সিজেন সিলিন্ডার তুলে দেওয়া হল । পানিতে নামতেই অক্সিজেন সিলিন্ডার দরকার হবে । সাথে ডুবুরীর পোশাকও নিয়ে আসা হয়েছে । পানির নিচে নামতে হবে । পানির নিচেই সেই লাইফ ট্রি রয়েছ ।

ওরা যতই দেবতাখুমের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলো ততই অবাক হতে লাগলো । ওদের কেবল মনে হতে লাগলো একট মৃত জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । মাত্র চার মাস আগেও এই স্থানে ওরা ঘুরে গেছে । তখন কি সবুজ এলাকা ছিল এটা আর এখন মনে হচ্ছে এখান থেকে সব প্রাণ আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে যে ঝিরিপথ দিয়ে ওরা গিয়েছিলো দেখলো সেটা একেবারে শুকিয়ে গেছে । কোন পানি নেই সেখানে ।

দেবতখুমে পৌছাতে ওদের আরও ঘন্টা দুয়েজ সময় লাগলো । ওদের ঘড়িতে সময় তখন এগারোটা । দেবতাখুমের যাওয়ার আগে একটা খালের মত পড়তো । সেটা নৌকা করে পার হত ওরা । সেখানে এখন এক ফোটা পানিও নেই । সেটা হেটেই পার হল ওরা । যেখান থেকে ভেলাতে উঠেছিলো সেই খানে এখনও পানি দেখা যাচ্ছে । তবে সেখানের বেশ কিছুটা স্থান শুকিয়ে গেছে । ওরা আরও কিছুদুর হেটে গেল । তারপরই পানি শুরু হয়েছে । মোহনার জায়গাটা চিনতে মোটেও কষ্ট হল না । এই স্থানেই ও পানিতে পড়ে গিয়েছিলো । দু পাশে বড় পাথড়ের দেওয়ালের মাঝে সেই পানির যাওয়ার পথ ।

মোহনা খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে । কখনও ভাবে নি এতো জলদি আবারও সে ফিরে আসবে এখানে ।

এর আগে মোহনা আরও একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে পানিতে নেমেছিলো উখিয়াতে । সেবার ক্যাম্পাস থেকে একটা প্রজেক্টের কাছে উখিয়াতে আসতে হয়েছিলো । সেখানে তাদের ডিরেক্টর তাদের এই অক্সিজেন ট্যাংক নিয়ে পানিতে নামার ট্রেনিং দিলেন দুইদিন ধরে । সামনের কোথায় নাকি সমুদ্রের নিচে নামতে হবে । যদিও শেষ পর্যন্ত তাদের আর নামতে হয় নি । তারপরেও ট্রেনিংটা নেওয়া হয়েছিলো । সেই জ্ঞানটা এখন কাজে গেলে গেলো ।

শোভনাকে আদিবাসি ছেলে দুটোর সাথে রেখে রাফায়েল আর মোহনা পানিতে নেমে গেল । আস্তে আস্তে কিছু দুর হেটে গেল । তারপর পানিতে ডুব দেওয়ার আগে নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো । শোভনা চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে । একটু হাসার চেষ্টা করলো ও । হাত নাড়লো বোনের দিকে । তারপর ডুব দিল ।



পানিতে ডুব দেওয়ার সাথে সাথেই মোহনার মনে হল যেন সে অন্য এক জগতে প্রবেশ করেছে । নিচটা একেবারে অন্য রকম লাগলো । ট্রেনিংয়ের সময় ওরা একটা সুইমিং পুলে ছিল কিন্তু এটা একেবারে অকৃত্রিম একটা স্থানে । প্রথমে কিছু সময় চোখে ঠিকঠাক মত কিছু না দেখলেও আস্তে আস্তেই সব কিছু সয়ে এল । ওর ঠিক সামনেই রাফায়েলকে দেখা যাচ্ছে । হাতে একটা টর্চ নিয়ে এগিয়ে চলছে সামনের দিকে । মোহনা ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে । খুব যে বেশি কাজ হচ্ছে সেটা বলবে না ও । তবে একেবারে এগোতে পারছে না সেটাও না ।

প্রথমে কিছু সময় কেবল এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করলো ওরা । চোখের সামনে কিছুই দেখতে পেল না । একটা সময়ে মোহনার মনে হতে লাগলো যে ওরা হয়তো সেই গাছের কাছে যেতেই পারবে না । রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে হাতের ইশারাতে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে সে কিছুই খুজে পাচ্ছে না । ঠিক একই ভাবে সেও হাতের ইশারা দিয়ে দেখালো যে সেই কিছু বুঝতে পারছে না । আরও বেশ কিছু সময়ে ওরা এদিক ওদিক কেবল ঘুরেই বেড়ালো তবে কিছুই খুজে পেল না ।তবে একটা ব্যাপার মোহনা এখনও ভেবে পেল না যে এখনও ওরা দেবতাখুমের তল খুজে পায় নি । কত সময় ধরে ওরা নিচে এসেছে অথচ এখন মাটি স্পর্শ করতে পারে নি । দেবতাখুম আসলে কত গভীর !!

তখনই ওর অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে সংকেত ভেসে এল । অক্সিজেনের পরিমান শেষ হয়ে আসছে । খুব বেশি সময়ে আর থাকা যাবে না । উপরের দিকে এখনই উঠা দরকার । কি করবে ও ! ও রাফায়েলকে ডাকার চেষ্টা করলো হাতের ইশারাতে । কিন্তু কাজ হল না । সে কিছুই শুনতে কিংবা বুঝতে পারলো না । দেখতে পেল সে ওর থেকে আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ! একটু দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলো আসলে ও একদমই এগোতে পারছে না । যতই চেষ্টা করুক না কেন কিছুতেই এগুতে পারছে না ।

তারপরই আসল ঘটনাটা ঘটলো । ও নিচের দিকে প্রচন্ড এক টান অনুভব করলো । মুখ দিয়ে আপনা আপনি একটা চিৎকার বের হয়ে এল । তবে সেই চিৎকার আসলে বাইরে বের হল না । তার বদলে এক গুচ্ছ বাতাস বেরিয়ে এল । পানিতে সেটা কেবল বুদবুদের সৃষ্টি করলো কেবল ! মোহনার কেবল মনে সে এক টানে নিচের দিকে চলে যাচ্ছে । কোন কিছুতেই আর তাকে আটকে রাখতে পারছে না । একটা সময়ে ওর হাত থেকে সব কিছু ছুটে যেতে লাগলো । হাতের টর্চটা ছুটে গেল । একটা সময়ে ওর পেছনের অক্সিজেন ট্যাংকটাও আলাদা হয়ে গেল শরীর থেকে । । তারপর মোহনার আর কিছু মনে নেই !

কতটা সময় পরে মোহনার চেতনা ফিরে এল সেটা মোহনা বলতে পারবে না । তবে নিজেকে সে জায়গাতে স্থির ভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো । চোখ মেলে চারিদিকে দেখতেই জায়গাটা ওর বেশ পরিচিত মনে হতে লাগলো । কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছিলো না কোথায় এই স্থানটা দেখছেন । ঠিক বড় তিনটা পাথরের মাঝে সে পানির ভেতরে ভেসে আছে । বড় পাথরটার রং একটু লালচে ধরনের ! তার পাশের রং সবুজ । আরে বা পাশের রং কালো ! তিনটে পাথরই ডিম্বাকৃতির !

সাথে সাথেই মনে পরে গেল ওর । ওর স্বপ্নে এই স্থানে অনেক বার এসেছে । আরেকবার এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো । স্বপ্নে এই স্থানে পৌছানোর পরপরই সেই সবুজ প্রাণীটা এসে পৌছায় । তারপরই ওর ঘুম ভেঙ্গে যেত ।

মোহনা তিন পাথরের সামনে ভেসে রইলো বেশ কিছু সময়ে । তারপরই অবাক করা জিনিসটা ওর মাথায় এল । ওর সাথে কোন অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই । তারপরও মোহনার পানির ভেতরে থাকতে মোটেও কষ্ট হচ্ছে না । একটুও অসুবিধা হচ্ছে না ! পানি ওর নাকেমুখ দিয়ে ভেতরে যাচ্ছে ঠিকই তবে তাতে ওর কোন সমস্যা হচ্ছে না !
আশ্চর্য্য হয়ে গেল সে ! এটা কিভাবে সম্ভব হচ্ছে ?

স্বপ্নেও ঠিক একই ভাবে সে পানির ভেতরে থাকতে পারছিলো । কিন্তু এটা তো বাস্তব !
মোহনা এসব চিন্তা বাদ দেওয়ার চেষ্টা করলো । আগে তাকে সেই লাইফ ট্রি টা খুজে পেতে হবে ! কিন্তু কোন দিকে যাবে সে । এই তিন পাথর ছাড়া তো আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ও ! এভাবে কত সময় এখানে দাড়িয়ে থাকবে !

মাথা ঠান্ডা করে কিছু সময় ভাবতে শুরু করলো ও । তারপরই রাফায়েলের কথাটা মনে পড়লো । ওর জন্মই হয়েছে এই গাছটা খুজে পাওয়ার জন্য । ওর সাথে যা হয়েছে সব কিছু আপনাআপনিই হয়েছে । ওকে নিজ থেকে কিছু করতে হয় নি ।

মোহনা নিজের চোখ বন্ধ করলো । নিজের সব চিন্তা দিয়ে কেবল ভাবতে লাগলো এই দেবতাখুমের কথা, নাগা প্রিন্স আর সেই লাইফ ট্রির কথা ! অন্য সব চিন্তা মাথা থেকে বের করে দিল । সব কিছু শূন্য করে দিয়ে তার চিন্তা কেবল এক দিকে ফোকাশ করতে শুরু করলো । তখনই তার স্বপ্নের কথাটা আরও ভাল করে মনে করলো । প্রতিবারই সবুজ চোখের সেই নাগা প্রিন্স ওকে সব সময় এই তিন পাথরের কাছে নিয়ে যেতে চাইতো । সেখানে নিয়ে যাওয়ার আগেই ওর ঘুম ভেঙ্গে যেত । চোখ খুলে ওর মনে হল এই তিন দিক থেকে ঘেরা তিন পাথরে কাছেই ওকে যেতে হবে !

চিন্তাটা আসতেই ধীরে ধীরে সে এগিয়ে গেল পাথর তিনটার দিকে । বড় পাথরের উপরে এসে দাড়ালো । তিন দিক থেকে তিনটা পাথর জায়গাটাকে ঘিরে রেখেছে । পাথরের উপরে দাড়ালেই কেবল মাঝের অংশটা দেখা যায় ভাল করে । সেখানে তাকাতেই মোহনা গাছটা দেখতে পেল । খানিকটা বাদামী রংয়ের পাতাওয়ালা ফুট দুয়েক লম্বা একটা গাছ । ঠিক তার মাঝে এক উজ্জ্বল ফুল ফুটে আছে !
জীবনের ফুল !
এটার জন্যই এতো কিছু !

রাফায়েল বলেছিলো এই ফুলটা যখন সে স্পর্শ করবে তখনই এই ফুলের সাথে নিজের জীবনটা সংযুক্ত হয়ে যাবে । ওর হাতের উপরেই ফুলটা ফলে পরিনত হবে ।

মোহনা আবারো লম্বা করে আরেকটা দম নিল । কঠিন একটা কাজ করতে যাচ্ছে ।
এখনও ওর হাতে সময় আছে । এখনও যদি ও ফিরে যায় তাহলে কোন সমস্যা হবে না ওর । কিছুদিন খানিকটা লুকিয়ে থাকলেই চলবে । সে যদি এসব ঝামেলা থেকে বাঁচতে চায় তাহলে নিশ্চয়ই সেটার ব্যবস্থা করা যাবে । রাফায়েল নামের মানুষটা ওকে ঠিকই সাহায্য করবে ! কিন্তু এই দেবতাখুম কি রক্ষা পাবে ?
সব কিছু ধ্বংশ হয়ে যাবে !
তখন সারা জীবন ওর মনে হবে চাইলেই ও সব কিছু রক্ষা করতে পারতো !
কিন্তু করে নি !

মোহনা আর চিন্তা করলো না । হাত দিয়ে ফুলটা ছিড়ে নিয়ে এল । হাতের উপর ধরে থাকলো !

প্রথমে কিছু হল না তারপর ধীরে ধীরেই ওর হাতের ভেতরে ফুলটা থেকে আলো ছড়াতে শুরু করলো । মোহনা মনে মনে ঠিক করেছিলো যে কোন কিছুতেই সে অবাক হবে না । ওর সাথে কদিন থেকে যা কিছু হতে চলেছে তাতে ওর অবাক হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু সে কেবল অবাক হয়েই তাকিয়ে রইলো । প্রথমে ওর হাতের ভেতরেই ফুলটা একেবারে আলোতে পরিনত হল । সেটা ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে । তারপর আস্তে আস্তে সেই আলো ফিরে এসে জড় হতে লাগলো ওর হাতের ভেতরে ! ধীরে ধীরে সেই আলোতে সংকুচিত হতে হতে একেবারে একটা গোল বলে পরিনত হল । সেই বলটা এই বরইয়ের সমান ফলে পরিনত হয়ে ওর হাতের উপরে পড়লো । ফলটা ও খানিকটা নেড়ে চেড়ে দেখলো । এখনও ওটা থেকে আলো বের হচ্ছে ।
কি অদ্ভুদ চমৎকার লাগছে দেখতে !

সময় হয়ে হয়েছে । আবারও ওকে ফিরে যেতে হবে !
এই কথাটা কেবল মনে হতেই মোহনা পানির স্রোতের ভেতরে টান অনুভব করলো । পানি যেন ওকে টেনে নিয়ে চলল । এতো দ্রুত যে ওর পক্ষে চোখ চোখা রাখাই সম্ভব হচ্ছিলো না । তারপর একটা সময়ে এসে একেবারে থেমে গেল হঠাৎ করে । চোখ মেললে দেখতে পেল ওর থেকে ঠিক সামনেই রাফায়েল রয়েছে । ওর দিকে ছুটে আসছে । সামনে আসতেই মোহনা রাফায়লের দিকে তাকালো । ওয়াটার গোগলসের ভেতরে সেই তীক্ষ্ম চোখে বিস্ময়টা দেখতে পেল । মোহনার মুখে কোন অক্সিজেন মাস্ক নেই তবুও মোহনা চমৎকার নিঃশ্বাস নিচ্ছে দেখে যে কেউ অবাক হবে !
তারপরই মোহনা নিজের হাত তালুকে মেলে ধরলো ।
রাফায়েল ফলটার দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুটা সময় !



সাত

মোহনা হাতে এখন অনেক শক্তিশালি একটা জিনিস রয়েছে । এটার উপর এই পুরো এলাকাটার টিকে থাকা নির্ভর করছে । মোহনা পানির উপরে যেতে যেতে কেবল এই কথাই ভাবতে লাগলো যে এখন কেবল একটা কাজই বাকি আছে । এই ফলটাকে নাগা প্রিন্সের কাছে পৌছানো ।

কিন্তু মানুষ যা ভাবে তা কখনই হয় না । মোহনা যখন পানির উপর থেকে মাথা তুলে তাকালো তখন তার জন্য অন্য কিছু অপেক্ষা করছিলো । মাথা তুলেই সে দেখতে পেলো পুরো এলাকাটাতে কম করেই জোনা বিশেক মানুষ দাড়িয়েছে । সবার আগে আবরার আহমেদের চেহারাটাই ওর চোখ পড়লো । ওর জন্য অপেক্ষা করছে । ওকে দেখতে পেয়েই মুখে হাসি ফুটলো । আবরার আহমেদকে ছাপিয়ে ওর চোখ আরও একটু পেছনে গেল । দেখতে পেলো তিন মানুষ শোভনার দিকে পিস্তল তাক করে আছে ।

ঠিক তার পেছনেই সেই মানুষটাকে দেখতে পেল । সবুজ চোখের নাগা প্রিন্স ! ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে । ওর শরীরের উপরের অংশটা উন্মুক্ত ! ঠিক বুকের স্থানটা যেখান থেকে আলোটা ঠিকড়ে বের হচ্ছে সেখানে জুড়ে একটা স্টিলের ভেস্ট পরানো রয়েছে । ঠিক একই ভাবে গলাতে একটা স্টিকের কলার পরানো হয়েছে । হাতেও হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকানো । তাকে ঘিরেও তিনজন মানুষ পিস্তল তাক করে আছে !

রাফায়েল ঠিক ওর পেছনেই রয়েছে । ওকে ছাপিয়ে একেবারে সামনে চলে এল । দুজনেই পানি থেকে উঠে পাড়ে এসে দাড়ালো । মোহনা পানির একেবারে কাছেই দাড়িয়ে পড়লো ! ওরা পানি থেকে উঠতেই আবরার আহমেদ বলল, নো মিস্টার রাফায়েল ! কোন চালাকি করবেন না ! আমি আপনার শক্তি সম্পর্কে খুব ভাল করেই জানি তবে আপনার একটা দূর্বলতার কথাও আমি জানি ! ইউ কেয়ার টু মাচ । এটা খুবই খারাপ একটা দিক । আপনি যদি কিছু করার চেষ্টা করেন কি হবে সেটা আমি আপনাকে বলি ! এই যেন তিন তিন ছয়জন মানুষকে দেখছেন ?

আবরার আহমেদ হাত দিয়ে পেছনে দেখালো । তারপর বলল, তাদের বলা আছে যে যদি তারা কোন প্রকার অস্বাভাবিকতা অনুভব করে তাহলে কোন কিছু না ভেবেই ট্রিগার চেপে দেয় । আমার কিছু বলার থাকবে না ! এখন হ্যা আপনি ঠিকই আমাদের কাবু করে ফেলতে পারেন হয়তো কিন্তু আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি একজন মরবেই ! এবং সেটা হবে আপনার কারনে ! সো ....
মোহনা এবার রাফায়েলের পেশিটা এবার শান্ত হতে আসতে দেখলো !
সাথে সাথে আরও চারজন মানুষ রাফায়ের কাছে চলে এল । তার দিকে চারটা অটোমেটিক অস্ত্র তাক করে ধরলো !

আবরার আহমেদ এবার মোহনার দিকে তাকালো । তারপর বলল, মাই ডিয়ার মোহনা ! এবার ওটা আমাকে দিয়ে দাও !
মোহনা নিজের জায়গা থেকে এক কদমও নড়লো না ।
আবরার আহমেদ বলল, আমরা এখনই ওটা এই নাগা প্রিন্সকে দেবো না । এখনও ঠিক তার শক্তিকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছি না । এই পাওয়ারকোর টা যদি তার ভেতরে বসাই তাহলে সেটা সম্ভব হবে না । সো রিস্ক নিবো না । আরও কিছুদিন সময় নেব ভাবছি ।
মোহনা বলল, আপনি কোন দিনই পারবেন না । প্রকৃতির এই শক্তি নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা কারো নেই ।
-সেটা আমি দেখবো । এখন ওটা আমার কাছে দাও !

মোহনা নাগা প্রিন্সের দিকে তাকালো । সে ঠিক বুঝতে পারছে না নাগা প্রিন্স কেন কিছু করছে না । তার পাশেই তো পানি রয়েছে ।
মোহনার মনের কথাই যেন আবরার আহমেদ বুঝতে পারলো । সে বলল, ভাবছো নাগা সাহেব কিছু করছে না কেন ? হা হা হা । সে কিছু করতে পারবে না আপাতত । তার শরীরে খুব কড়া চেতনাবিরোধী ঔষধ পুশ করা হয়েছে । সে খুব ভাল ভাবে চিন্তা করতে পারছে না । তার উপরে তার বুকের ঐ ভেস্ট টার কারনে সব কিছুর উপর তার নিয়ন্ত্রন নেই ! গলাতে দেখতে না কলার পরানো, উল্টাপাল্টা কিছু করতে গেলে সেটা ওকে শক দিবে ! তাকে এখন আমি যা বলবো সেটা শুনতে সে বাধ্য ! বুঝেছো ?

মোহনা রাফায়েলের দিকে তাকালো । তার চোখ কি বলছে সেটা সে পড়তে পারলো না । কি করবে সে !
যা ভেবে এসেছিলো সেসবের কিছুই তো হচ্ছে না । নাগা প্রিন্স ওর থেকে অনেকটা দুরে দাড়িয়ে । ফলটা তার দিকে ছুড়ে দিলে কি কাজ হবে ?
সে কি ধরতে পারবে ?
কিন্তু এটা কোন ভাবেই আবরার আহমেদের হাতে সে পড়তে দিবে না । নিজের জীবন টা এই ভাবে নষ্ট করতেই পারে না সে !

মোহনা হঠাৎ একটা পাগলামি করে ফেলল ! আবরার আহমেদকে বলল, এটা চাই আপনার ? এই নিন !
এই বলে ফলটা হাতে নিজে সোজা নিজের মুখে ভেতরে চালান দিয়ে দিল । তারপর দাঁত দিয়ে একটা কামড় বসিয়ে দিল ।

মিষ্টি একটা স্বাধ অনুভব করলো সে !
তারপর আবরার আহমেদের চিৎকার কানে ভেসে এল !



মোহনা যে এমন একটা কাজ করবে সেটা শোভনা ভাবতেও পারে নি । ফলটা আবরার আহমেদের দিকে ফলটা বাড়িয়ে দিতে গিয়ে সোজা নিজের মুখে ভেতরে চালান করে দিল । শোভনা দেখতে পেল মোহনার মুখের ভেতরেই আলোর বিস্ফোরন ঘটলো ! সাথে সাথেই মোহনা নিজের মাথা চেপে ধরলো । কেন মাথার ভেতরে কিছু হচ্ছে । মুখ দিয়ে একটা তীব্র চিৎকার বের হয়ে এল । তারপরই ওর সেই মুখের আলোটা নিভে এল !

শোভনা দেখতে পেল মোহনার চোখ দুটো বুঝে এল । ও একেবারে পানির কিনারেই দড়িয়ে ছিল । ওর দেহটা পানিতে পড়ে গেল সে । সাথে সাথে ডুবে গেল পানিতে ! মোহনা পানিতে পড়ে যেতেই আরেকবার আলোর ঝলকানী দেখা গেল ! তারপর সব শান্ত !

আবরার আহমেদ পাগলের মত পানিতে ঝাপ দিয়ে দিল । কিছু সময় সে ঝাপাঝাি করলো বটে কিন্তু কিছুই খুজে পেল না ।

পানি থেকে উঠে এসে রাফায়েলের সামনে এসে দাড়ালো ! তীব্র কন্ঠে বলল, সে কোথায় গেছে ? এই ফল একজন সাধারণ মানুষ খেলে কি হবে ?
রাফায়েল তখনও পানির দিকে তাকিয়ে আছে । সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনার আর কোন আশা নেই । আপনি যা করতে চেয়েছিলেন তা আর হবে না । একজন সাধারন মানুষের পক্ষে এই শক্তি হোল্ড করার ক্ষমতা নেই । এটা মোহনার ধারন ক্ষমতার বাইরে । হয়তো ওখানেই মারা যাবে সে ! সম্ভবত মারা গেছে !

শোভনার চোখ বেঁয়ে আপনা আপনি পানি বেরিয়ে এল ! বা্চ্চা মেয়েটা কি পাগলামী করে ফেলল !
মোহনা ওর পিঠাপিঠির বোন । বয়স কাছাকাছি হওয়ার কারনে কোন দিন ঠিক ছোট বোনের মত দেখে নি ওকে । সব থেকে আপন বন্ধুর আচরন করে এসেছে । যখন প্রথমবার ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আলাদা হয়ে গেল ওর থেকে সেদিন ও ভাল ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলো তার এই বোনটাকে কত ভালবাসে !
আর এখন ?

আবরার আহমেদ যেন পাগল হয়ে গেল । তার সকল পরিশ্রম এখন ব্যর্থ হয়ে গেছে । এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না । সে চিৎকার করে বলল, সব কটাকে মেরে ফেলো । সবাইকে !

কথাটা বলার সাথে সাথেই পুরো দেবতাখুম কেঁপে উঠলো । শোভনার মনে হল যেন কিছু একটা ভেঙ্গে চুড়ে এগিয়ে আসছে ! সেই আওয়াজে কেঁপে উঠছে সব !
পরক্ষণেই বুঝতে পারলো কি এগিয়ে আসছে ।
পানি !
ওর আশে পাশেই সবাই বুঝতে পেরেছে পানি এগিয়ে আসছে । সেদিকেই তাকিয়ে রইলো ও ! নড়তে ভুলে গেছে যেন ।
যে আওয়াজ আসছে তাতে মনে হচ্ছে তীব্র এক পানির স্রোত এগিয়ে আসছে । ঝরনা কি আবারো চালু হয়ে গেছে তাহলে ?
কিভাবে হল ?

মোহনা সেই ভয়ংকর পানির ধারা দেখতে পেল কিছু সময় পরেই । অন্তত ফট দশে উচু পানির স্রোত এগিয়ে আসছে ওদের দিকে । সবাই এতোটাই অবাক হয়েছে যে নড়তে ভুলে গেছে । অবশ্য খুব একটা লাভও হবে না । কোন ভাবেই এই পানির সাথে প্রতিযোগিতায় ওদের কেউ পারবে না। দুইদিকে পাথরের দেওয়াল সামনে অনেক টা পথ ঠিক ভাবে এগিয়ে গেল তারপর এই গিরিখাত থেকে উঠতে পারবে না । এর পানির সামনে ওরা কোন ভাবেই টিকতে পারবে না !

শোভনার চোখ হঠাৎ সবুজ চোখের মানুষটার দিকে গেল । সে অবাক চোখ তাকিয়ে আছে । ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছে না । তবে সেটা আনন্দের বিস্ময় !

পানি যখন ওদের থেকে আর মাত্র ২০ গজের মত দুরে তখনই শোভনা ওর জীবনের সব থেকে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটতে দেখলো । ছুটে আসা পানির স্রোতের ঠিক মাঝ দিয়ে দিয়ে মোহনাকে দেখা যাচ্ছে । শোভনার মনে হল যেন পানির সাথে ওর শরীরটা লেগে আছে । পানি এগিয়ে আসার সাথে সাথে সাথে ও নিজেও এগিয়ে আসছে। ওর চোখ দিয়ে আলো ঠিকরে বের হচ্ছে । ঠিক বুকের কাছ দিয়ে আলোর একটা বিচ্ছুরন হচ্ছে ! সেটা উঠছে আবার নামছে । নিঃশ্বাসের সাথে !

স্রোত এসে থামলো ঠিক ওদের সামনেই । দেওয়ালের মত করে স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলো । মোহনা ধীরে পানির দেওয়াল থেকে নিজেকে মুক্ত করে ওদের সামনে নেমে এল ! শোভনা কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে । কিছুই বলতে পারছে না । বিশ্বাস করতে পারছে না ।

শোভনা দেখতে পেল ওর দিকে যে পিস্তল তাক করা মানুষ গুলো এবার মোহনার দিকে পিস্তল তাক করলো । সব গুলো পিস্তল মোহনার দিকে । মোহনা যেন এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলো । ও নিজের হাত দুটো উপরে করে কিছু একটা ইশারা করলো । ব্যস সেই স্থির হয়ে পানির ভেতরে থেকে পানির শুড় বের হয়ে এল । গাছের লতা যেভাবে বের হয় ঠিক সেই ভাবে সাপের মত শত শত পানির শুড় বের হয়ে এল নানান দিক থেকে ।
শোভনার পাশ দিয়ে চলে গেল তীব্র গতিতে । ওর পাশের মানুষ গুলোকে যেন একেবারে উড়িয়ে নিয়ে গেল । ঘটনা এতোই দ্রুত ঘটলো যে কেউ কোন কিছু করার সুযোগই পেল না । শোভনা যখন আবার তাকালো দেখতে পেল আবরার আহমেদের সব লোকজন এদিক ওদিক পড়ে আছে । কেউ কেউ দৌড়ে পালাচ্ছে । তারা মানুষের সাথে লড়তে প্রশিক্ষন নিয়েছে কিন্তু এই অতিপ্রাকৃত শক্তির সাথে তারা লড়তে পারবে না ।

আবরার আহমেদ অবাক হয়ে কেবল তাকিয়ে রইলো । তার যেন কিছুই করার নেই পরাজিত সৈন্যের মত কেবল মোহনার দিকে তাকিয়ে রইলো । মাত্র কয়েক মুহুর্তের ভেতরে এসব হয়ে যাবে সেটা সে ভাবতেও পারে নি । তার সব সৈন্যরা পালিয়ে গেছে । নয়তো এদিক সেদিক পরে আছে !
সে মোহনার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল । ওর পেছন পেছন ওর পানির শুড় গুলো কিলবিল করে এগিয়ে আসতে লাগলো । সব গুলো এখন আবরার আহমেদের দিকে ।
আবরার আহমেদ বলল, মাই ডিয়ার মোহনা ! কি করেছো তুমি ? তুমি কি করলে ?
মোহনা কোন কথা বলে কেবল তাকিয়ে রইলো । আবরার আহমেদ বলল, আমরা কত কিছু করতে পারতাম ! কিন্তু তুমি সব নষ্ট করে দিলে । আমার সব কিছু শেষ করে দিলে ! আমিও তোমাকে শেষ করে দিবো !

নিজের পকেট থেকে পিস্তল করে মোহনাকে গুলি করতে গেল । সাথে সাথে অন্তত গোটা পঞ্চাশেক পানি শুড় আবরার আহমেদকে আঘাত করলো । তাকে ছিটকে ফেলে দিলো হাত বিশেক দুরে । তিনি সোজাসুজি একটা পাথরের উপরে গিয়ে পড়লেন ! আর উঠলেন না !

শোভনা দৌড় এগিয়ে গেল মোহনার দিকে ! বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো । ধীরে ধীরে মোহনা শান্ত হয়ে এল । ওর চোখের আলো শান্ত হয়ে এল !


আট


দেবতাখুমে আবারও পানির স্রোত ফিরে এসেছে । মাত্র কিছু সময়ের ভেতরে যেন সব কিছু প্রাণ ফিরে পেয়েছে । মোহনা চুপ করে বসে আছে পাথরের উপরে । চলতে থাকা পানির দিকে তাকিয়ে আছে । কি যেন ভাবছে ।

নাগা প্রিন্সকে মুক্ত করা হয়েছে । সে পানিতে নেমে সাতার কাটছে । এই কদিন সে পানি থেকে দুরে ছিল । শোভনা দুরে বসে আছে চুপচাপ । সে নাগা প্রিন্সের লাফালাফি দেখছে !

রাফায়েল এসে বসলো মোহনার পাশে ।
মোহনাকে বলল, এখন কেমন লাগছে ?
-জানি না । কেবল যেন মনে হচ্ছে । আমি এই পানির স্রোতকে অনুভব করতে পারছি । মনে হচ্ছে ওদের কথা শুনতে পাচ্ছি । পানির প্রতিটা বিন্দু যেন আমার সাথে কথা বলছে ! এই দেখুন !
বলেই মোহনা পানির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করলো । সাথে সাথেই পানির একটা লাইন উপরে উঠে গেল । এদিক ওদিক নাঁচতে শুরু করলো ।
রাফায়েল বলল, লাইফ ট্রির ফলের ভেতরেই আসলে সব কিছু নিহিত । সব শক্তি যুক্ত । ওটা সাধারন কোন মানুষের পক্ষে ধারন করা সম্ভব না । কিন্তু তুমি কিভাবে সেটাকে ধারন করতে পারলে বুঝতে পারছি না । অথবা বলা যায় তুমি এই পৃথিবীতে এসেছোই এর জন্য ! আমার কাছে এসব কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না !
-কিন্তু আমি তো এসব চাই না !
তারপরই মোহনার কি হল সে উঠে দাড়ালো ।
রাফায়েল পেছন থেকে ডাক দিল তবে মোহনা সেটা শুনলো না !

পাড়ে দাড়িয়ে কি রকম একটা শব্দ করলো । সাথে সাথেই নাগা প্রিন্স মাথা তুলল পানি থেকে । তারপর ওর দিকে এগিয়ে এল । মোহনা নিজে একটু পানির ভেতরে নেমে এল । নাগা প্রিন্সের ঠিক সামনে এসে দাড়ালো। । মোহনা নিজের দুই হাত দিয়ে নাগা প্রিন্সের হাত ধরলো । নাগা প্রিন্সের সবুজ চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । চোখের দিয়েই যেন কিছু বলতে চাইলো ।

তারপর নিজে চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করলো । পানির একটা সুক্ষ ধারা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো । সেটা ওর মুখের ভেতরে আসতে আস্তে প্রবেশ করলো ।


মোহনার মনে হতে লাগলো ওর ভেতরকার সব নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসতে । একটা সময়ে সেটা বের হয়ে এল । পানির ধারাটা যখন আবারও ওর মুখ দিয়ে বের হল তখন সেখানে সেই ফলটাকে দেখা গেল । নাগা প্রিন্স নিজের চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে মোহনার দিকে । এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না যে মোহনা এই কাজটা করতে যাচ্ছে । ফলটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিল । নাগা প্রিন্স সেটা হাতে নিয়েই মুখে ভেতরে দিল । তারপর ঠিক মোহনার সাথে যেমনটা হয়েছিলো নাগা প্রিন্সের সাথেও এমনটাই হল । সে প্রথমে পানির ভেতররে পরে রইলো কিছু সময়ের জন্য । একটু একটু নড়ে উঠছিলো যেন । তারপর তার শরীর দিয়েও সেই একই ভাবেই আলো ঠিকরে বের হতে শুরু করলো । যখন যে আবারও উঠে দাড়ালো মোহনা দেখতে পেল যে তার বুকের ঠিক মাঝ বরাবর সেই আলোটা উঠছে নামছে । নাগা প্রিন্সের শক্তি আবারও ফিরে এসেছে !

রাফায়েল এগিয়ে এসে বলল, কি করলে তুমি ?
-আপনাকে বললাম না আমার সাথে এই পানির প্রতিটা বিন্দু কথা বলছে । আমি কেবল ওদের নিজের শরীরের ভেতরে ঢুকিয়ে ঐ শক্তিটা বের করে নিয়ে আসতে বললাম । ওরা তাই করলো । সবটুকু নিয়ে আসতে পারে নি । কিছুটা এখনও রয়ে গেছে অবশ্য !
রাফায়েল বলল, এটা সম্ভব ?
মোহনা বলল, কেন সম্ভব না ? আপনি কি বলেছিলো ? যে এই ফলটা অনেকটা পাওয়ার সোর্সের মত । ব্যাটারি । আমি সেই পাওয়ারটা যে কোন ভাবেই নিজের ভেতরে ধারন করতে পেরেছি । মানে ব্যাটারিটা আমার নিজের ভেতরে ছিল । এখন আমি সেটা থেকে নাগাকে ট্রান্সফার করে দিলাম ! পাওয়ারব্যাংক থেকে যেভাবে দেওয়া হয় !
রাফায়েলের বিস্ময় তখনও কাটে নি। সে বলল, আর আমি ভাবতাম আমি এসব ব্যাপারে সব কিছু জানি !
মোহনা হাসলো । তারপর বলল, সব কিছু যখন বদলাচ্ছে এসবও বদলাবে না কেন !

তারপর শোভনার দিকে তাকিয়ে বলল, চল আপু আজ তোমাকে একেবারে দেবতাখুমের শেষ মাথা পর্যন্ত নিয়ে যাই । এসেছি যখন আরেকবার দেখেই যাই !


পরিশিষ্টঃ

আজকের মত দেবতাখুমের সব টুরিস্ট চলে গেছে । সন্ধ্যা হতে আর খুব বেশি বাকি নেই । মোহনা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ঝিরিটার সামনে । সেখানে একটা নৌকা দাড় করানো আছে । সেখানে উঠে বসলো । এক পাশে বসতে পানিতে ইশারা করতেই সেটা আপনা আপনি চলতে শুরু করলো । দেবতাখুমের কাছে এসে নেমে পড়লো সে । বড় পাথরটার উপর পা দিতেই পানি থেকে একটা মাথা উপরে উঠে আসলো । সবুজ চোখ দিয়ে তাকিয়ে রইলো মোহনার দিকে । তার চোখে মোহনা ষ্পষ্ট অভিমান দেখতে পেল ।
মোহনা মিষ্টি করে হাসলো । পানিতে না নেমে বলল, আরে বাবা রাগ করার কি আছে ! আমার কি অফিস নেই ? প্রতি সপ্তাহে আসা যায় নাকি ?
সবুজ চোখের রাজকুমার তবুও নিজের জায়গা থেকে নড়লো না ।
মোহনা বলল, দেখ তুমি ছোট বাচ্চা না ! ছেলে মানুষী করবা না ! উঠে এসো ! আজকে আমি নিচে নামবো না ! আসো সন্ধ্যাটা এক সাথে দেখি !
সবুজ চোখের রাজকুমার আরও কিছু সময় নিজের অভিমান ধরে রাখার চেষ্টা করলো কিন্তু মোহনা পানিতে নামছে না দেখে শেষ আর সেটা ধরে রাখতে পারলো না । ধীরে ধীরে পানির উপরে উঠে আসতে শুরু করলো !





পদাটিকাঃ নাগা প্রিন্স ওর দেবতাখুম সম্পর্কিত সকল কিছু পুরো টুকুই কাল্পনিক ।





রাফায়েল সিরিজের ১৫তম গল্প
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৩৪
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটা গাছ কাঠ হলো, কার কী তাতে আসে গেলো!

লিখেছেন নয়ন বড়ুয়া, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:০৬



ছবিঃ একটি ফেসবুক পেইজ থেকে

একটা গাছ আমাকে যতটা আগলে রাখতে চাই, ভালো রাখতে চাই, আমি ততটা সেই গাছের জন্য কিছুই করতে পারিনা...
তাকে কেউ হত্যা করতে চাইলে বাঁধাও দিতে পারিনা...
অথচ... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×