somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ আমার ভীনদেশী তারা

১৫ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৯:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

-আপনি আমাকে ফলো করছেন?

আমি যদিও বুঝতে পারছি লাইনটা বলা ঠিক হল না । অন্তত আমাদের সমাজের পরিপেক্ষিতে আমার বলা লাইনটা মোটেও খাটে না । সামনে দাড়ানো মেয়েটা আমাকে ফলো করতে পারে এটা আমি মোটেও বিশ্বাস করি না। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে মেয়েটাকে আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি প্রায়ই । বিশেষ করে অনামিকার সাথে ব্রেকআপের পর মেয়েটার সাথে ঘন ঘন দেখা হচ্ছে । একবার দুবার দেখা হতে পারে । এমন কি আমি যে অফিসে কাজ করি মেয়েটা সম্ভবত সেই অফিসেরই কোন বিল্ডিং চাকরি করে । সুতরাং প্রতিদিন দেখা হয়ে যাওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক না । কিন্তু এই সেইন্ট মার্টিন আইল্যান্ডেও মেয়েটার সাথে আমার দেখা হবে যাবে কিভাবে ?

মেয়েটি আমার অভিযোগ শুনে মোটেও বিচলিত হল না । বরং একটু হাসলো । মিষ্টি হাসি । আমার হাসি দেখে মনে হল এই হাসিটা যেন আমার পরিচিত । কোথায় যেন আমি দেখেছি । যদিও মেয়েটাকে আমি মাস খানেক আগেই সম্ভবত প্রথম দেখেছি ।
মেয়েটি বলল, খাওয়া শেষ ?
-হ্যা ।
-হোটেলে যাবে এখন ?

মেয়েটা আমাকে একেবারে তুমি করে বলছে । এতো পরিচিত ভঙ্গিতে কথা বলছে আমার সাথে । কারন টা কি ? মেয়েটা কি আমাকে চেনে ?
আমি বললাম, হ্যা রুমেই যাবো ।
-আগে খানিকটা হাটা হাটি করা যায় ।

আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । রাত হয়েছে একটু । সেন্ট মার্টিনে রাত এগারোটার পরে জেনারেটর বন্ধ হয়ে যায় । কাজ কর্ম সব এর ভেতরেই শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই । অবশ্য যারা টুরিস্ট তারা অনেকে রাতে হাটাহাটি করে । আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় এগারোটা বেজে গেছে । এই মেয়েটার সাথে সমুদ্র তীরে যাবো কি না আমি বুঝতে পারছি না । বিশেষ করে যাওয়া ঠিক হবে কি না সেইটা ভাবছি ।
মেয়েটা আবার বলল, ভয় নেই । আমি খুবই নিরীহ একটা মেয়ে । তোমার সম্ভ্রমের উপর হামলা করবো না । চল ....

এই কথার পরে আর কিছু বলা যায় না । না গেলে নিজের মান সম্মান থাকে না । আমি বললাম, না মানে আমি একটু জলদি জলদি ঘুমাই ।
-আরে চল তো । একদিন নিয়মের একটু ব্যতিক্রম হলে সমস্যা হবে না ।

বেশ কিছু সময় মেয়েটার পাশাপাশি হাটলাম সমুদ্রের পাড়ে । মেয়েটা পানির ভেতর দিয়েই হাটছে । হাতে স্যান্ডেল নিয়েছে । জ্যোৎস্নার আলোতে এই অপরিচিত মেয়েটার সাথে হাটতে মন্দ লাগছে না । কিছু সময় হাটার পরে মেয়েটি বলল, আমার নাম জানতে চাইলে না ?
আমি বললাম, এক সময় তো বলবেই ।
-তা ঠিক । আমিম কিন্তু তোমার নাম জানি । তুমিও জানো আমার নাম । এখানে না হলেও অন্য কোথাও । যাই হোক । আামর নাম নিশি !
-নিশি !
-পরিচিত না খুব ?
-আচ্ছা তুমি কি সত্যিই আমাকে চেনো? তখন বললে আমাকে ফলো করছো ? তার মানে আমার ব্যাপারে সব জানো তুমি । আমার যে নিশি নামের প্রতি একটা আলাদা ভাললাগা আছে সেটাই কাজে লাগাচ্ছো । তাই না ?

মেয়েটা জোরে হেসে ফেলল । তারপর বলল, আমার নাম সত্যিই নিশি । এনআইডি দেখাতে পারি যদি বল ! দেখাবো ?
আমি আর কিছু জানতে চাইলাম না । নিশির নামটার উপর আমার ছোট বেলা থেকেই একটা আলাদা আকর্ষন আছে । কেন আছে সেটা আমি নিজেও জানি না । কেবল আছে, এটা জানি । এটার কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে ছিল না । ছোট বেলা থেকেই এই আকর্ষন আমার ছিল । একদিন কেবল মনে হয়েছে যে আমি এই নামটাকে পছন্দ করি । নিশি নাম ব্যবহার করে আমি অনেক গুলো গল্প লিখেছি । এটা থেকে আমার পাঠকদের একটা ধারণা হয়েছে যে আমার প্রেমিকার নাম বুঝি নিশি । কিন্তু সত্য কথা হচ্ছে আমার জীবনে আমি নিশি নামের কোন মেয়ের দেখা পাই নি । এমন কোন মেয়ের সাথে আমার বাস্তবে পরিচয় হয় নি । আজকে এই প্রথম একটা মেয়ের সাথে আমি পরিচিত হলাম যার নাম নিশি !

নিশিকে বললাম, তুমি আমাকে ফলো কেন করছিলে?
-তোমার সাথে কথা বলার জন্য !
-আমার সাথে কথা ! কি কথা ?
নিশি থেমে গেল । তারপর আমার চোখের দিকে তাকালো । চারিদিকে চাঁদের আলো থৈ থৈ করছে । সেই আলোতেই আমি নিশির চোখের দিকে তাকালাম । সাথে সাথেই আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো । এই চোখ জোড়া আমাকে কি বলতে চাচ্ছে ! এমন করে তাকিয়ে কেন আছে আমার দিকে ! আমি চোখ সরিয়ে নিলাম । নিশি কাতর কন্ঠে বলল, চোখ সরিয়ে নিলে কেন ? ইউ ক্যান ফিল ইট রাইট ?
-মানে ?

নিশি কিছু যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল । সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো । তারপর আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ক্লাস ফাইভে গাছ থেকে পড়ে তোমার হাত ভেঙ্গে গিয়েছিলো তাই না ?
আমি একটু অবাক হলাম !
-স্কুলে যখন এইটে পড় তখন তোমার সাথে একটা মেয়ের খুব ভাব হয় । মেয়েটাকে একটা চিঠি দিতে তুমি উঠেছিলো ওদের বাড়ির পাশের বড় একটা গাছে । কিন্তু সেই সময়েই মেয়েটির বাবা চলে আসে । তাড়াহুড়া করে করে নামতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে যায় !
আমি বললাম, তুমি কিভাবে জানো এসব?
-আরও অনেক কিছু জানি । অনেক কিছু । বলতে গেলে ২১ বছর পর্যন্ত তোমার সাথে যা হয়েছে সব কিচু আমার জানা !
-কেবল একুশ বছর পর্যন্ত ! এর পরে নয় কেন ?
-কারণ এর পরে আমি তোমাকে হারিরে ফেলেছি । আর কিছু জানতে পারি নি ।
-হারিয়ে ফেলেছি বলতে ! আমি ঠিক বুঝলাম না !

নিশি এবার ধীর পায়ে পানি থেকে উঠে এল । তারপর সমুদ্রের বালির উপর বসে পড়লো । আমিও ওর পাশে বসে পড়লাম । নিশি বলল,
-তোমার সমুদ্র পছন্দ অনেক । মন খারাপ হলেই তুমি এখানে চলে আসো । তাই না ?

কথা সত্যি । সমুদ্র আমার খুব প্রিয় । আমি ছুটি পেলেই সমুদ্রের কাছে চলে আসি । এরপর নিশি আস্তে আস্তে অনেক কিছু বলতে লাগলো । সেগুলো প্রায় সঠিক না হলেও একেবারে কাছাকাছি সঠিক । কখন আমি কোথায় ব্যাথা পেয়েছি, কি কিনেছি কাকে কি দিয়েছি প্রায় সব কিছু ও জানে ! এবার সত্যিই আমি খানিকটা নড়ে চড়ে বসলাম । এই মেয়ে এতো কিছু কিভাবে জানে ? এতো কিছু তো জানার কথা না । এই মেয়ে কিভাবে জানে ?

আমি এক সময় বললাম, তুমি এতো কিছু কিভাবে জানো ?
নিশি হাসলো । তারপর বলল, কারণ এগুলো তুমি আমাকে বলেছ।
-কি আবোল তাবল বলছো ? আমি তোমাকে কখন বললাম ?
-তুমি ঠিক না আবার তুমি ?
-হেয়ালি রাখো প্লিজ ! যা বলার পরিস্কার করে বল ।
নিশি কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, তোমাকে যদি আমি বলি যে আমি এই পৃথিবীর কেউ না তাহলে কি তুমি বিশ্বাস করবে?
আমি হেসে ফেললাম । বললাম, এই পৃথিবীর কেউ না বলতে? ভুত ? আত্মা ?
-না ! ভুত জ্বীণ না । রক্তে মাংসের মানুষ তবে তোমাদের পৃথিবীর কেউ না ।
-বুঝলাম না । মানুষ বলছো আবার আমাদের পৃথিবীর না । এটা ঠিক মাথায় ঢুকছে না ।
-প্যরালাল ইউনিভার্সের কথা শুনেছো নিশ্চয়ই ? সায়েন্স ফিকশনে পড়েছো অনেক । আমি জানি বেশ কয়েকটা লিখেছো নিজে নিজেও । মনে আছে?
আমি বললাম, তুমি বলতে চাও তুমি আমাদের মতই একটা পৃথিবীতে থেকে এসেছো যেখানে আমার মতই আরেকটা আমি আছে । রাইট ?

আমি যদি সেটা হেসে বললাম নিশি হাসলো না । তারপর বলল, তোমার কাছে হাসি আসলেও এটা কিন্তু সত্যি । আমি জানি তোমার কাছে বিশ্বাস হচ্ছে না । তবে আমার কাছে এমন কিছু আসে যা তোমার বিশ্বাস হবে ।
-কি আছে?
-তোমার কাছে তোমার দাদার একটা জিনিস আছে । তোমার খুব পছন্দের । যেটা তুমি কখনই হাতছাড়া কর না । রাইট ?

আমার হাত আপনা আপনি আমার বাঁ পকেটে চলে গেল ।
আছে ! ঘড়িটা এখনও পকেটেই আছে । সেটার অস্তিত্ব আমি এখনও অনুভব করতে পারছি । আমার দাদা মারা যাওয়ার সময় আমাকে পকেট ঘড়িটা দিয়ে গিয়েছিলো । পিতলের তৈরি । নিয়মিত চাবি দিতে হয় ।

আমাকে অবাক করে দিয়ে নিশি নিজের পকেট থেকে হুবাহু একই রকমের একটা ঘড়ি বের করে দিল । আমার চিরো পরিচিত ঘড়িটা । আমার সামনে তুলে ধরলো সেটা । আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে ঘড়িটার এক পাশে একটা দাগ রয়েছে । দাদা একবার বড় রকমের দূর্ঘটনাতে পড়েছিলেন । একজন তাকে ছুরি মেরেছিলো। তখন আঘাতটা গিয়েছিলো এই ঘড়িটার উপর দিকে । তখন থেকেই তিনি ঘড়িটা কাছে রাখতেন । এটাকে নিজের সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করতেন ।

আমি নিজের ঘড়িটা বের করলাম । তারপর দুটো ঘড়ি পাশা পাশি রাখতে গেলাম । নিশি সেটা সরিয়ে নিল । বলল, এই দুটো বস্তু এক সাাথে রাখা যাবে না । বুঝেছো । ওটা একটু দুরে রাখো তারপর দেখো ।

আমি তাই দেখতে লাগলাম । কোন সন্দেহ নেই যে এই দুটো ঘড়িই আমার দাদার । একই রকম হুবাহু !

নিশি বলল, আমার অপু মারা যাওয়ার আগে এটা আমাকে দিয়ে যায় !
-তোমার অপু মারা গেছে ?
-হ্যা । বললাম না যে ২১ বছর পর্যন্ত তোমার সব কিছু আমি জানি । সে ২১ বছর বয়সে মারা গেছে । বলা যায় নয় বছর আগে ।

আমি আসলে কি বলবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । কি বলা উচিৎ সেটা আমার মাথার ভেতরে এল না । এটা কি সম্ভব?
প্যারালাল ইউনিভার্স সম্পর্কে আমি অনেক কিছু শুনেছি । আমাদের মত আর কয়েকটা বিশ্ব পাশাপাশি আছে ।
নিশি বলল, ভেবো না যে কেবল একটা বিশ্বই আছে তোমার পাশে । এই রকম আরও অসংখ্য বিশ্ব রয়েছে ।
-তুমি কত গুলোতে গিয়েছো?
-গিয়েছি বেশ কিছু ।
-গিয়ে ?
-তোমাাকে খুজেছি ।
-সব খানেই আমি আছি?
-অবশ্যই আছো । কেন থাকবে না শুনি? কিন্তু এখানে যেমন ভাবে আছো একেবারে তেমন ভাবে নেই ।
-মানে ?
-মানে ধর তোমারটা যদি আর্থ ওয়ান ধর আর আমার টা যদি আর্থ টু ধরি আর্থ ওয়ানে তুমি বেঁচে আছো আর্থ টুতে তুমি ২১ বছর বয়সে মারা গেছো । আবার আর্থ থ্রিতে তুমি বিয়ে করে ফেলেছো । আমার আর্থ ফোরে আমি মারা গেছি ২০ বছর বয়সে । আর্থ ১২তে তোমার সাথে আমার দেখাই হয় নি । আর্থ ৩৪ আমাকে একদম দেখতেই পারো না তুমি !
আমি বললাম, আমার আর্থে তোমার জন্ম হয় নি ? মানে তুমি কোথায় আছো এখন ?
-এখানে? এখানে আমি নেই । আমি মারা গেছি খুব ছোট থাকতে। আমি এখানে এসেই আমার বাবা মায়ের বাসা গিয়েছিলাম । আমার আর্থে আমরা তিন ভাইবোন । এখানে এসে দেখি আমার বাবা মায়ের দুই ছেলে মেয়ে । খুব ছোট থাকতে তাদের এক মেয়ে মারা যায় । দুই দিন বয়সে । মানে হচ্ছে এখানে আমার অস্তিত্ব নেই ।

আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । কি বলা উচিৎ সেটাও আমি জানি না । একটা মেয়ে এসে আমাকে বলছে যে সে এসেছে অন্য একটা বিশ্ব থেকে । আমাদের মতই একটা প্যারালাল বিশ্ব থেকে । এটা কি বিশ্বাস যোগ্য কোন কথা ? কিন্তু মেয়েটা যা যা বলছে সেটা মিথ্যাও মনে হচ্ছে না । আমি বললাম, তুমি কেন এসেছো এখানে?
নিশি অনেক সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার জন্য ?
-আমার জন্য ?
-হ্যা । তুমি আমার সৌউলমেট ! তোমাকে ছাড়া আমি ভাল থাকতে পারবো না । ঠিক তেমনি আমাকে ছাড়াও তুমি সুখে থাকবে না । অপূর্ণতা থাকবে আজীবন । জীবনে তো প্রেম কম করো নি। তাই না ? মনের মত কাউকে কি খুজে পেয়েছো ? পাও নি । পাবেও না কোন দিন ।

নিশি যা বলছে সেটা সত্য কথা । আমি আসলেই মনের মত কাউকে খুজে পাই নি । কত মেয়ে এল আমার জীবনে কিন্তু আমি মনের মত কাউকে খুজে পেলাম না কোন দিন ।
নিশি বলল, আরও অনেক আর্থেই যাওয়া যেত কিন্তু সে সব আর্থে আমার অস্তিত্ব আছে কেবল এখানে আমি নেই একদম । এটাই সব থেকে ভাল ম্যাচ আমার জন্য ।

নিশি এই কথা বলে আমার হাতটা ধরলো । আমি সাথে সাথেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করলাম । সত্যিই আমার পুরো শরীর যেন কেঁপে উঠলো । এমনটা কেন হল ঠিক বুঝতে পারলাম না আমি । নিশি আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে । ওর চোখের ভাষা ওর চোখের তৃষ্ণা আমার মনকে কেবল আবেশ করে নিল । আমি অনুভব করলাম মেয়েটার মাঝে আমি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছি । নিশি আস্তে আস্তে এগিয়ে এল আমার দিকে । ওর চোখে আস্তে আস্তে বুঝে এসেছে ।

জীবনে এই প্রথম আমার মনে হল আমি পরিপূর্নতার সাথে কোন মেয়েকে চুমু খেলাম । এই মেয়েটার জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম এতোদিন !
আমার থাকার কথা ছিল তিন দিন, আমি থাকলাম মোট সাত দিন । এই সাত দিনে মনে হল আমি আমার জীবনের সব থেকে শ্রেষ্ঠ সময় কাটালাম । নিজেকে এতো পরিপূর্ন মনে হল সেটার কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই । আমার মনে হল যেন নিশিকে আমি চিনি জন্ম থেকে । নিশি আমার রুমেই উঠে এল । কোন রকম সংকোচ ছাড়াই সে আমার সাথেই থাকতে শুরু করেছিলো । আমার নিজেরও কেন জানি কোন প্রকার সংকোচ হচ্ছিলো না ।

ফিরে যাওয়ার দিন সকাল বেলা যখন ঘুম ভাঙ্গলো দেখলাম আমি নিশি আমার পাশে নেই । তার বদলে একটা কাগজে রেখে গেছে ও আমার জন্য । সেখানে লেখা

''আমার জন্য অপেক্ষা কর, আমি আবার আসবো।"

আমি জানি নিশি আবার আসবে । তাকে যে আসতেই হবে ।

ঢাকায় ফিরে এসে আবার কাজ কর্ম করতে শুরু করলাম । মনের ভেতরে নিশির চেহারাটা সব সময় লেগেই থাকল। ওকে কোন ভাবেই ভোলা সম্ভব না আমার পক্ষে। সব কিছু স্বাভাবিক ভাবেই কাটতে লাগলো । আরেকটা ঘটনা ঘটলো আরও কিছু দিন পরে । আমি অফিস থেকে বের হচ্ছি তখনই একজন কালো পোশাক পরা লোক আমার পথ রোধ করে দাড়ালো ।

-মিস্টার অপু হাসান ।
আমি মুখ তুলে তাকালাম । মুখে লম্বা দাড়িওয়ালা এক লোক আমার সামনে দাড়িয়ে রয়েছে । শান্ত দৃষ্টি । পোশাকটা আমার কাছে কেমন অদ্ভুত মনে হল । এমন পোশাকের মানুষ আমি আশে পাশে দেখেছি বলে মনে পড়ে না । কেমন একটা আল্লাখেল্লা টাইপ পোশাক । লোকটা স্বাভাবিক ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে আশে পাশে অন্য কেউ লোকটার দিকে তাকাচ্ছে না । এমন তো হওয়ার কথা না । লোকটার পোশাক পরিচ্ছদের ধরন এমন যে মানুষজন সেদিকে তাকাতে বাধ্য । তাহলে তাকাচ্ছে না কেন ?

লোকটা যেন আমার মনের কথাই বুঝতে পেরে বলল, তুমি ছাড়া অন্য কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছে না ।
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম কেন? কিভাবে?
-কিভাবে সেটা তোমার না জানলেও চলবে । কারণটা বলি । কারণটা হচ্ছে আমরা চাইনা তুমি ছাড়া অন্য কেউ আমাদের দেখুক ।
-কিন্তু কেন ?
-সেটাও তোমার না জানলে চলবে । এখন সে কাজে তোমার কাছে এসেছি সেটা বলি । তার আগে হেড বের করে কানে লাগাও যাতে লোকজন তোমাকে পাগল না ভাবে । তারপর পার্কিংয়ে তোমার গাড়ির গিয়ে দাড়াও ।

আমি আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম । কেউ আমাকে ঠিক লক্ষ্য করে নি এখনও । এখন সবার কানেই ব্লুটুথ এয়ার রাখে। তাই কে যে কার সাথে কখন কথা বলছে সেটা বোঝা মুশকিল । আমি কথা মত আামর গাড়ির পার্কিংয়ের কাছেই গিয়ে দাড়ালাম । লোকটা আমার পেছন পেছন এসে দাড়ালো। তারপর কিছু সময় এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, আমি তোমাকে সাবধান করতে এসেছি ।
-কিসের জন্য ?
-কদিন আগে তোমার কাছে এমন একজন এসেছিলো যার তোমার কাছে আসার কথা না ।
-মানে ? আমি ঠিক বুঝলাম না ।
লোকটা বলল, তুমি খুব ভাল করেই জানো আমি কার কথা বলছি । আর্থ ৪৪২২৯২০ এর নিশি অর্নান্ড থিও । মেয়েটা একজন অপরাধী।
বুঝলাম নিশির কথা বলছে লোকটা । আমি বললাম
-অপরাধী মানে ? আমি ঠিক বুঝলাম না ।
-শোন অপু । প্রতিটি বিশ্ব নিয়ন্ত্রনের কিছু নিয়ম আছে । চাইলেই এক বিশ্বের মানুষ অন্য বিশ্বে চলে যেতে পারে না । এটা নীতি বিরুদ্ধ । এতে ভারসাম্য নষ্ট নয় । কিন্তু নিশি এই কথাটা মানতে রাজি নয় । সে নিয়ম ভেঙ্গে একের পর এক প্যারালাল বিশ্বে পরিভ্রমন করেই চলেছে । এটা ভয়ংকর একটা কাজ হচ্ছে । তাই আমরা ওকে খুজে বেড়াচ্ছি ।
-আপনারা কারা ?
-আমরা কারা সেটা তোমার না জানলেও চলবে । কেবল তোমাকে এই টুকু বলি যে নিশি তোমার কাছে আসলেই আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে । যতদ্রুত সম্ভব । এটা তোমার জন্য মঙ্গল হবে ।

এই বলে লোকটা আমার হাতে একটা ছোট্ট এমপিথ্রির মত ডিভাইস দিল । তারপর একটা সুইচ দেখিয়ে বলল, নিশি আসলে এটা ওর দিকে বাড়িয়ে চেপে ধরবে । ব্যাস ও আর এ বিশ্ব থেকে পালাতে পারবে না । তারপর আমরা এসে ওকে ধরে নিয়ে যাবো । তুমি নিশ্চয়ই চাও না কেবল একজনের জন্য তোমার এই বিশ্বটা ঝুকির ভেতরে পড়ুক। চাও কি?
আমি খানিকটা সংকোচ নিয়ে বললাম, না চাই না ।
লোকটা বলল, শুনো তোমার ভাগ্য এই বিশ্বে লেখা রয়েছে । এখানকার মানুষের সাথে তোমার তোমার জীবন বাঁধা । অন্য কোথাও না । নিশির মাথা খারাপ হয়ে গেছে এই জন্য সে এই কাজ গুলো করছে । ওর বিশ্বের অপুকে হারিয়ে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে । যে কোন মূল্যেই সে অপুকে চায় ।

লোকটা কিছু সময় থামলো । আমি চুপ করে ভাবতে লাগলাম । তার মানে হচ্ছে নিশি যা বলেছে তার সবই সত্য । নিশি আসলেই প্যারালার বিশ্বের মানুষ । আমি লোকটাকে বলল, ওর মোট গুলো বিশ্বে ভ্রমন করেছে ?
-কম করে হলেও তিন হাজার !
-তিন হাজার !
-কত গুলো বিশ্ব আছে এমন !
-এখনও পর্যন্ত আমরা এগারো হাজার মিলিনের সন্ধান পেয়েছি । আরও পাবো ।
-তার মানে আমার মত অপু এগারো হাজার মিলিয়ন আছে ।
-হ্যা ।

আমি সত্যিই কি বলবো খুজে পেলাম না । লোকটা আবার বলল, শোন নিশি খুবই ভয়ংকর আর মেধাবী একজন মানুষ । এই যে সে ভ্রমন করছে এই পদ্ধতি সে নিজে আবিস্কার করেছে । নিজের মত করে । নিজেকে কিাবে লুকিয়ে রাখতে হয় সেটাও সে খুব ভাল করেই জানে । আগে এক সময়ে সে আমাদের সাথে কাজ করতো । ওর থেকে এতো মেধাবী মানুষ আমি দেখি নি । সুতরাং সাবধান। দেখা পাওয়া মাত্র সুইচ টিপে দিবে । তোমার প্রতি ওর আলাদা একটা দুর্বলতা আছে । এই জন্য তোমাকে সন্দেহ করবে না ।
আমি কেবল ঘার কাত করলাম ।

লোকটা আর বিশেষ কিছু না বলে চলে গেল । তবে আমাকে সাবধান করে গেল এই বলে যে যেহেতু আমি কিছুই জানতাম না তাই আমাকে তারা দোষী ভাবছে না । কিন্তু এখন তারা আমাকে জানিয়েছে । এরপরেও যদি আমি নিশির সাথে মিশি কিংবা ওর সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক তৈরি করি তাহলে আমাকেও শাস্তি ভোগ করতে হবে ।
এতো দেখতে বাংলা সিনেমা হয়ে গেছে । বড় লোক বাপের মেয়ের সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক তৈরি করা যাবে না আর এখানে কোন মহাজাগতিক স্বত্ত্বা এসে আমাকে নিষেধ করছে মেয়ের সাথে মিশতে । কি হাস্যকর লাগছে ব্যাপারটা !

কয়েকটা দিন কেটে গেল । ঠিক এক সপ্তাহ পরে নিশি এসে হাজির হল আবার । একেবারে আমার ঘরে । ও যে কিভাবে আমার ঘরে ঢুকলো বুঝতেই পারলাম না । সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেছি দেখি নিশি ধোয়া ওঠা চায়ের কাপ নিয়ে আমার সামনে এসে দাড়েছে । আমি চোখ মেলে চমকে উঠলাম । তবে সামলে নিলাম সাথে সাাথেই ।

নিশি হাসি মুখে বলল, উঠে পড় । আজকে তোমার পছন্দের নাস্তা রেডি ।
-পছন্দের ?
-বাসায় বানানো পরোটা আর গরুর মাংস ভূনা ! যদি গরুর ভূনানা আমি রান্না করে নিয়ে এসেছি ।
-কোথা থেকে ?

নিশি হাসলো । তারপর বলল, আজকে তোমাকে অন্য বিশ্বের খাবার খাওয়াবো । এক মাত্রই এমন একজন মানুষ যা প্যারালাম ইউনিভার্সের গরুর ভূনা খাবে ! উঠে পড় জলদি !

আমি চায়ে চুমুক দিয়ে আরও কিছু সময় বিছানাতেই বসে রইলাম । মনের ভেতরে অদ্ভুত চিন্তা আসতে লাগলো । এখন আমার কি করা উচিৎ । ঐ লোকটার কথা মত আমাকে কি এখন এই সুইচটা চিপ দেওয়া উচিৎ !
কিন্তু নিশিকে কোন ভাবেই ধরিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো না আমার । অন্তত ভূনা গরুর মাংশ দিয়ে পরোটা খাওয়ার আগে তো নয়ই !

নাস্তা মুখে দিয়ে মনে হল এমন চমৎকার খাবার খাই নি আমি অনেক দিন । নিশির রান্নার হাত চমৎকার । আমি নাস্তা খেতে খেতে নিশিকে সেদিনের লোকটার কথা বলে দিলাম । দেখলাম লোকটা কথা শুনতেই ওর মুখ খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সে কিন্তু ভুল কিছু বলে নি । সত্যিই কিন্তু আমি ভারসাম্য নষ্ট করছি । আমার এই পৃথিবীতে আসার কথা না । ফলে একটা ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে ।
আমি আরেকটা গরুর মাংস মুখে দিতে দিতে বলল, কি হতে পারে ফলে ?
-অনেক কিছু হতে পারে । লাইক, ধর এই পৃথিবীর যত মানুষ থাকার কথা সেই অনুপাতে এই পৃথিবীতে কোর এলিমেন্ট গুলো রাখা আছে ।
-কোর এলিমেন্ট বলতে ?
-এই যে মাটি পানি বাতাস এই সব । আমি এখানে আসা মানে হচ্ছে এখানে আমার জন্য কিছু নেই তার পরেও আমি সেগুলোতে ভাগ বসাচ্ছি । ফলে কোর এলিমেন্টগুলোর উপরে আলাদা চাপ পড়ছে । এর ফলে মারাত্বক কিছু হয়ে যেতে পারে ।
-সত্যিই নাকি ?
-হ্যা । আমি নিজেও জানি তবে আমি আসলে ......
-তুমি আসলে ....
-তোমাকে না দেখে থাকতে পারি না । তাই চলে আসি ।
-কতদিন ধরে আসছো ?
-প্রায় মাস দুয়েক ধরে তোমার পৃথিবীতে আসছি । তোমাকে দুর দেখি । তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে দেখেছো যে বেশ কিছুদিন তোমার পৃথিবীর আবহাওয়াতে একটু পরিবর্তন দেখা দিয়েছে । লাইক শীত কালে এই দেশে ঝড় হয় না খুব একটা কিন্তু সেদিন কি ভয়ংকর ঝড় হল ! আমি আসলে প্রথমে ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারি নি । যখন তোমাকে খোজার জন্য বিভিন্ন ইউনিভার্সে যাওয়া শুর করলাম তখনও ঠিক জানতাম না যে এর ফল কি হবে । একটা ইউনির্ভাস প্রায় আমার কারনে ধ্বংস হতে বসেছিলো ।
-তারপর ?
-আসলে আমি যত বেশি অন্য ইউনিভার্স থাকবো সেটা সেই বিশ্বের জন্য তত খারাপ হবে ।

আমরা কেউ কিছু সময় কোন কথা বললাম না । নিশির দিকে তাকিয়ে মনে হল ওর মন খারাপ হয়ে গেছে । নিশি হঠাৎ বলল, আমার এখানে আসা বন্ধ করতে হবে । এটা তোমার আর তোমার বিশ্বের জন্য ভাল নয় । আজকের পরে আর খুব একটা আসবো না । আজকে এসেছি তোমাকে একটা কথা বলতে ....
-কি কথা ?
নিশি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল । তারপর বলল, তোমার মনে আছে ঐ সেন্টমার্টিনের কথা । আমাদের মাঝে যা হয়েছিলো !
আমি হেসে ফেললাম । বললাম, সেটা না মনে থাকার কি কোন কারণ আছে ?
নিশিও হাসলো । তারপর বলল, কাজটা মোটেও ঠিক হয় নি । বুঝেছো?

নিশি আর কিছু বলল না । আমার খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো । নিশিকে দেখলাম ও আমার ঘর থেকে কয়েকটা জিনিস তুলে নিলো । আমার একটা ব্যাগ । আমার ফ্রিজ থেকে কাঁচা মাংস বের করলো । তারপর এক প্যাকেট ময়দাও নিয়ে নিল !
আমি বললাম, কি করছো তুমি ?
-এগুলো সাথে করে নিয়ে যেতে হবে । বলতে পারো ভারসাম্য রক্ষার জন্য !

এরপর নিশি আমার দিকে একটা ঘড়ি বাড়িয়ে দিল । বলল, এটা পর !
আমি ঘড়িটার দিকে তাকালাম । সাধারন স্মার্ট ঘড়ির মতই । নিশি বলল, তোমার যদি যখনও আমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হয় তাহলে এই ঘড়ির লাল সুইচটা টিপ দিবে । আমি বুঝতে পারবো । এটা তোমার অবস্থান সম্পর্কেও আমাকে বলবে । আমি সেখানে হাজির হয়ে যেতে পারবো । ঠিক আছে !
-আচ্ছা ।
-তবে না ডাকলেই বরং ভাল । আমি আসলেই জানো ভারসাম্য নষ্ট হবে !
আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম !
নিশি বলল, আমি চেষ্টা করবো না আসতে । তোমার কিছু আমার কাছে আছে । সেটা নিয়ে আমি থাকতে পারবো খুব ভাল করে ।
আমি নিশির হাতের ব্যাগটার দিকে তাকালাম । একটু আগে ওর ভেতরে যে জিনিস পত্র গুলো ভরে নিয়েছে । এগুলো নিয়ে থাকতে পারবে মানে কি ! আমি ঠিক বুঝলাম না !

নিশি চলে গেল । আমি নিজের ঘরে বসে বস ভাবতে লাগলাম কাজটা কি আমি ঠিক করলাম। ঐ লোকটাও বলেছিলো যে নিশির এই পৃথিবীতে আসাটা মোটেই নিরাপদ না । আজকে নিশিও সেটা অস্বীকার করলো না । যতই সে আমার সৌউলমেট হোক না সে আমার এই পৃথিবীর কেউ না । তাকে এই পৃথিবীতে আসতে দেওয়া মানেই এই পুরো পৃথিবীর একটা বিপদ ডেকে নিয়ে আসা ! আমি কেবল নিজের জন্য এই পুরো পৃথিবীর বিপদ ডেকে আনবো?
অবশ্য নিশি তো বলেই দিলো যে আর আসবে না । তাহলে আর সম্ভবত সমস্যা হবার কথা না । কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হল আরও কিছুদিন পরে । শীতকাল শেষ হওয়ার পথে অথচ শীত কমার নাম নেই । মাঝে একটু শীত কমে গিয়েছিলো তবে ফেব্রুয়ারি মাসে শীত কমে যায় অনেকটাই কিন্তু শীত যেন আরও বেশি করে পড়ছে। ঠিক পহেলা ফাল্গুনের দিন তীব্র শীত শুরু হল । সেই সাথে পঞ্চগড়ে প্রথমবারের মত বরফ পড়া শুরু হল ।

আমি এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম । নিশির কারণেই এটা হয়েছে সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । নিশির কারণেই ভারসাম্যটা বেশি করে নষ্ট হচ্ছে । বাংলাদেশে বরফ পড়ার ঠিক পরদিনই সেই লোকটা এসে হাজির হল । আমি তাকে দেখে ভয় পেয়ে গেলাম । লোকটা বলল, তোমাকে আমি বলেছিলাম যে নিশি আসলে ওকে আটকাতে !
আমি কোন মতে বলার চেষ্টা করলাম যে আমি কিছু করি নি কিন্তু কোন কাজ হল না । লোকটা আমার কাছে এসে শক্ত ভাবে আমার হাত ধরলো । আমি আর কিছু বলার আগেই অনুভব করলাম যে আমার চারিদিকটা কেমন যেন নড়ে উঠেছে । চোখের সামনে থেকে পরিচিত পৃথিবীটা গায়েব হয়ে গেল মূহুর্তের ভেতরে । পরক্ষণেই আমি একটা অপরিচিত স্থানে এসে হাজির হলাম । চারিদিকে যতদুর চোখ যায় দেখতে পেলাম দুর দূরান্তে কেবল বিস্তর প্রান্তর । মাঝে সাজে কিছু গাছ গাছালি দেখা যাচ্ছে তা ছাড়া আর কিছু নেই ।

লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমাকে কোথায় নিয়ে এলেন ?
-এটা হচ্ছে মহাজাগতিক জেলখানা । এটাও একটা পৃথিবী । তবে এখানে হাতে গোনা কত গুলো মানুষ থাকে । তোমার মত কিছু অপরাধী যারা নিয়ম ভাঙ্গে । তাদের জন্য এই স্থান । আজ থেকে এখানেই থাকবে তুমি ।
-না আপনি এই কাজটা করতে পারেন না ।
-আমি চাইলেই সব কিছু পারি । তুমি যে যঘন্য কাজ করেছো!
-কেবল নিশির সাথে দেখা করে আমি জঘন্য কাজ করেছি? আমি চাইলে তো ওকে আটকাতে পারি না । আর ও আমার কথা শুনবে কেন ? আমার সাথে দেখা করুক না করুক সে এখানে আসলেই তো এই ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে । তাহলে আমার দোষ কোথায় ?
লোকটা বলল, তুমি কি ভাবছো আমি কিছু জানি না? নিশির শরীরে তোমার ভ্রুন রয়েছে ! কি ভয়ংকর একটা কাজ হয়েছে এটা বুঝতে পারছো তুমি ? সেই সন্তান যখন পৃথিবীতে আসবে তখন কি ভয়ংকর একটা কাজ হবে !
কথাটা আমার মাথার ভেতরে ঢুকতে একটু সময় লাগলো । সাথে সাথেই আমি সেদিন নিশির কথার মানে বুঝতে পারলাম না । ও বলেছিলো আমার কিছু নিয়ে যাচ্ছে ও !

লোকটা আবার বলল, এখনও তোমার সামনে আরও একটা সুযোগ আছে ।
-কি সুযোগ ?
তোমাকে বাঁচাতে নিশি একখানে চলে আসতে পারে । যদি চলে আসে তাহলে যে যন্ত্রটা আমি তোমাকে দিয়েছি সেটা দিয়ে তাকে আটকে দিবে । ব্যাস । সে এখানে আটকা পড়লে তোমার মুক্তি । নয়তো এখানে আটকে থাকবে সারা জীবন । আমি নিশিকে চাইলেই তুমি ডেকে আনতে পারো । ঐযে হাতের ঐ ব্যান্ডটা আছে । ওটা দিয়ে ওকে ডাক দাও এখানে । ও আসুক ।
একবার মনে হল আমি এটা করবো না । কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল নয়তো আমি এখানে সারা জীবনের জন্য আটকে থাকবো । এটা হতে পারে না । আমি সুইচে টিপ দিলাম । তারপর অপেক্ষা করতে শুরু করলাম । লোকটা আমার থেকে একটু দুরেই অপেক্ষা করছিলো । আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে ছিল ।

নিশি এসে হাজির হল পনের মিনিটের মধ্যেই । এসেই খানিকটা অবাক চোখে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো ! তারপর সামনের লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, রোজারিও আবারও তুমি ?
লোকটা বলল, আমাকে তো আসতেই হবে ।
-আমি তোমাকে বলেছি যে আমার পেছনে লাগা বন্ধ করো । আমি আর যাবো না ।
-সেটা তো বললে হবে না । তোমার উপর তো আমি ভরশা করতে পারছি না ।

এই বলে রোজারিত আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এবার তোমার পালা ।
নিশি যেন বুঝতে পারলো না । আমি পকেট থেকে সেই ডিভাইসটা বের করলাম । তারপর সেটা নিশির দিকে বাড়িতে ধরলাম । রোজারিও বলল, কাজ টা কর তাহলে তোমাকে তোমার পৃথিবীতে রেখে আসবো । ব্যাস ঝামেলা শেষ । তুমি মুক্ত !

আমি নিশির দিকে তাকিয়ে রইলাম । ওর চোখটা খানিকটা বিস্মিত । ঠিক যেন বুঝতে পারছে না আমি এমন একটা কাজ করতে যাচ্ছি । আমি নিশির চোখের দিকে তাকালাম । ওর চোখে বিস্ময়ের সাথে একটা দুঃখবোধ দেখতে পেলাম ।

নিশির সাথে আমার পরিচয় অল্প দিনের হতে পারে কিন্তু একটা কথা আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি যে মেয়েটা সত্যিই আমার সৌল মেইট ! ও আসার আগে আমার ভেতরে যে ডিপ্রেশন ছিল সেটা এখন আর নেই । আগে যেমন আমি নিজেকে অসম্পূর্ন মনে করতাম এখন আর আমি সেটা মনে করি না ।

আমি ডিভাইসটা হঠাৎ ঘুরিয়ে রোজারিও দিকে নিয়ে গেলাম । তারপর সুইচটা টিপে দিলাম। আমি কেন এই কাজ করলাম আমি নিজেও জানি না । আমার কেবল মনে হল এই লোকটার হাতে আমি নিশিকে কোন ভাবেই পড়তে দিবো না । কোন ভাবেই না । সুইচ টেপার সাথে সাথে কিছুই হল না । আমি কেবল দেখলাম যে লোকটা কেমন যেন স্থির হয়ে গেছে । কোন প্রকার নড়াচড়া করছে না । একেবারে থেমে গেছে যেন ।
নিশি আমার কাধে হাত রাখতেই ওর দিকে ফিরে তাকালাম । তারপর বললাম, ও কি মরে গেছে?
নিশি সেদিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক মরে নি তবে ঠিক বেঁচেও নেই ।
-মানে ?
-মানে হচ্ছে আগামী বেশ কিছু দিন ও এভারেই পড়ে থাকবে এবং ওর কাছে যা ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি আছে সব নষ্ট হয়ে গেছে । এটা থেকে একটা অদৃষ্ট সামোনিট্রগ্রাফিক রে বের হয় যা মানুষের শরীরের প্রবেশ করলে সেটা অন্তত তিনদিন একেবারে প্যারালাইড থাকবে এবং যে যন্ত্রের দিকে লক্ষ্য করে এটা ছোড়া হবে সেটা একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে ।
আমি বললাম, তুমি এতো কিছু কিভাবে জানো?
নিশি বলল, কারণ এটা আমি বানিয়েছি ।
-তাই নাকি?
-হ্যা । এটা এতোই ভয়ংকর যে এটার ব্যবহার খুবই সীমিত । রোজারিও এটা তোমার হাতে দিলো কিভাবে বুঝতে পারলাম না । এই যন্ত্র খুব একটা নেই ও ।

আমরা দুজনেই বেশ কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম রোজারিও দিকে । তারপর নিশির দিকে তাকিয়ে বললাম, চল এখান থেকে যাওয়া যাক ।
-আর একে কি করবো?
-এ এখানেই থাকুক ।
-এখানেই থাকবে ?
-হ্যা । বেটা আমাকে এখানে রেখে যেতে চেয়েছিল । বেটা থাকুক এখানে ।
নিশি কিছু সময় কি যেন ভাবলো । তারপর বলল চল ।

পরিশিষ্ট
এখন মোটামুটি পুরো সময় নিশির সাথে আমি আছি । আমার পৃথিবীতে নেই । এমন কি আমরা নিশির পৃথিবীতেও নেই । নিশি বলেছে এই পৃথিবীর নাম আর্থ এক্স বি টু ২৯। এইখানে বেশ কিছু মানুষ থাকে । এবং এটা অন্য সব পৃথিবী থেকে আলাদা । কি আলাদা এইটা আমি ওকে জিজ্ঞেস করি নি । এতো কিছু আমি বুঝিও না ।
তবে এখানে আমরা নিরাপদ । এখানে রোজারিওদের কেউ আসতে পারবে না । আর আমিও এই সময়ে নিশিকে একা রেখে কোন ভাবেই থাকতে ইচ্ছুক নই । আমাদের বাচ্চাটা আর কদিন পরেই এই পৃথিবীর মুখ দেখবে । সে যখন আসবে হয়তো কিছু সমস্যা সৃষ্টি হবে । আমি বলেছি যে হলে হোক, আমরা দুইজন মিলে সেটা সামলে নিব ।
নিশি আর আমাদের অনাগত সন্তানের জন্য আমি আমার পরিচিত পৃথিবী ছেড়ে দিয়েছি । অবশ্য এই আমি মোটেই আফসোস করি না । আমার পৃথিবী এখন এই দুইজনকে কেন্দ্র করেই ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ১২:৩১
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×