গতকালকে রাতে খেতে গেলাম নিচে । এলাকার অধিকাংশ দোকান-পাঠ বন্ধ । এমন কি যে হোটেলে আমি নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করি সেটাও বন্ধ । বাধ্য হয়ে দুরের একটা হোটেলে যেতে হল খাওয়ার জন্য । হাটতে হাটতে আমি আশে পাশের মানুষ জনকে দেখছিলাম ! দেখতে পাচ্ছিলাম যে কিছু কিছু গ্রুপে মানুষ ঘোরাফেরা করছে । তাদের মাথায় টুপি আর পরণে পাঞ্জাবি ! গতকাল শবেবরাত ছিল ! সবাই নামাজ পড়তে বের হয়েছে ! অনেক আগের কিছু ঘটনা মনে পড়ে গেল আমার নিজের । যখন স্কুলে পড়তাম ঠিক একই ভাবে আমিও নামাজ পড়তে বের হতাম বন্ধুদের সাথে । একই ভাবে নামাজের পর বের হতাম মসজিদ থেকে । দলবেধে ঘুরতাম !
আমাদের ধর্মীয় রীতি নীতির সাথে আমার জীবনের অংশগুলো জড়িয়ে আছে খুব ভাল ভাবে ! ছোট বেলা থেকেই আমি দেখে এসেছি যে রমজানের কিছুদিন আগে একটা দিন আসে তখন সারা দিন ধরে আমাদের বাসায় চালের আটার রুটি বানানো হয় ! আমার চালের আটার রুটি ঠিক পছন্দ না । তবে দেখতাম আমার আব্বা বড় ভাই সবাই এই চালের আটার রুটি খুব পছন্দ করে । এই রুটির সাথে আরও বানানো হতো হালুয়া । কয়েক ধরনের হালুয়া । একটা ছিল সুজির হালুয়া আর আরেকটা বানানো হত ছোলার হালুয়া । দেখতে খানিটা হলদেটে । এই ছোলার হালুয়া আমার সব সময় খুব পছন্দ ছিল । এখনও এটা খুবই পছন্দের একটা খাবার । একটা বড় সমান বড় প্লেটে রাখা হত হালুয়া গুলো । তারপর সামান্তরিকের আকৃতির কাটা হত । আমি সারা দিনে এদিক ওদিক হেটে বেড়াম আর সুযোগ পেলেই একটা একটা করে কাটা পিচ তুলে নিয়ে মুখে পুরতাম ! এভাবেই দিন কাটতো । দুপুরের অবশ্যই গরুর কিংবা মুরগির মাংস রান্না করা হত । রাতের জন্য হত হালুয়া আর রুটি !
সন্ধ্যা হলেই বাবা চলে যেতেন মসজিদে । মা বসতো নামাজের জায়নামাজে । আমি কোন সময় যেতাম বাবার সাথে, কোন সময়ে বড় ভাইয়ের সাথে । একবার আমার মনে আছে আমি নামাজ পড়তে গেছি বড় ভাইয়ের সাথে । তখন কিভাবে নামাজ পড়তে হয় সেটা আসলে জানিই না । সবাই যা করে আমিও তাই করি । নামাজ শেষ করে যখন বাইরে বের হলাম তখন দেখি বড় ভাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে । কারণ আমি নাকি অনেক বার সিজদা দিয়েছি এক রাকাতেই । খুব ছোট বেলার এই স্মৃতি টুকুই মনে আছে ।
এরপর একটু বড় হলে আর বড় ভাইয়ের সাথে নামাজে যেতাম না । তখন পরিবারের তিন পুরুষ সদস্য নামাজে যেত ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ! তখন শবে বরাত হত শীত কালে ! আমাদের এলাকাতে একটা ফতেয়া চালু ছিল যে সন্ধ্যা বেলা নামাজের আগে নামাজের জন্য যদি গোসল করা হয় তাহলে শরীর থেকে গোসলের যত ফোটা পানি পড়বে তত নেকি যোগ হবে ! তাই নামাজে যাওয়ার আগে শীতের ভেতরে গোসল করে নিতাম । কেউ কেউ বেশি নেকির আশায় পুকুর থেকে গোসল করতো ! পুকুর থেকে বাসায় আসতে অনেক কয়ফোটা পানি পড়তো নেকি হাসিল হত অনেক বেশি !
আমাদের মাঝে তখন বিভিন্ন মসজিদে নামাজ পড়ার রেওয়াজ ছিল । এমনিতে বাসায় সন্ধ্যার পরপরই ফিরে আসার নিয়ম থাকলেও শবে বরাতের দিন এমন কোন বিধি নিষেধ ছিল না । আমরা সারা রাত বাসার বাইরে থাকতাম । গ্রামের এবং আশে পাশের যত মসজিদ আছে সব মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তাম । একবারে ফিরে আসতাম ফজরের নামাজ পরে । মাঝে অবশ্য একবার বাসায় এসে রাতের খাবার খেয়ে যেতাম !
ক্লাস টেনে পড়ার সময় একটা স্মৃতি মনে আছে । তখন নতুন প্রেম করেছি । আমি তখন নিজের এলাকা থেকে প্রেমিকার এলাকাতেই বেশি থাকি । স্কুলের পাশেই ছিল বাসা তাদের । অবশ্য আমার সব বন্ধুদের বাসাও ছিল আশে পাশেই । তাই খুব একটা সমস্যা হত না । সেই শবে বরাতে সাইকেল নিয়ে হাজির হলাম বন্ধুর বাসায় । সাইকেলটা তাদের বাসায় রেখে এরপর মসজিদে নামাজ পরে আড্ডা চলল । আরও অনেকেই এসেছিলো সেবার । কয়েকজন মিলে ঠিক করলাম যে একবার প্রেমিকার সাথে দেখা করে আসি । আমি যাবো ওরা বাইরে দাড়াবে !
বুকে দুরু দুরু ভয় নিয়ে সত্যিই হাজির হলাম তার বাসার সামনে । গেটে নক দিলাম । এবং সেই দরজার এলো । ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা । স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম যে নামাজে ছিল সে ! আমাকে দেখে তীব্র বিস্ময় নিয়ে কিছু সময় তাকিয়ে ছিল । পরে জানতে চাইলো এতো রাতে কেন এসেছি । বললাম আমার একটা বই ছিল তোমার কাছে । সেটা নিতে এসেছি !
সে বুঝলো যা বোঝার । গেটে দাড়িয়েই আরও কয়েকটা কথা বলে বিদায় নিলাম । পরে অবশ্য বকা শুনতে হয়েছিলো অতো রাতে যাওয়ার জন্য ! তবে এটাও জানিয়েছিলো যে মোনাজাতে সে পুরোটা সময় আমাকেই চেয়েছিলো । একই কাজ আমিও করেছিলাম । তবে উপরওয়ালা আমার কিংবা তার, কারো দোয়াই শোনেন নি !
কলেজে ওঠার পরে আর এমন ভাবে সারা রাত ভর নামাজ পরা হয় নি ! তখন কেবল মাত্র এশার পরে ১০/১২ রাকাত নফল নামাজ পড়েই বাসায় চলে আসতাম । ঢাকায় আসার পরে সেটা কমে গেল আরও ।
ঢাকাতে আমি প্রায় ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে আছি । বলতে গেলে এই সময়ের সব শবে বরাতই ঢাকাতে একাই কাটিয়েছি. ঢাকা শহরে একা থাকতে আমার মোটেই খারাপ লাগে না । বরং এই একা থাকাটা আমি বেশি উপভোগ করি সব সময় । কিন্তু কিছু বিশেষ বিশেষ দিন, এই রকম দিন গুলোতে মনে হয় বাসায় থাকলে হয়তো ভাল হত । সময় ভাল যেত ! কিন্তু পেট বড় ভয়ানক জিনিস ! এরজন্য কত কিছু আমাদের ছেড়ে দিতে হয় ! রুজি রুটির জন্য কত কিছু আমাদের ত্যাগ করতে হয় !
আশা করি সবার শবে বরাত প্রিয় জন পরিবারের মানুষের সাথেই কেটেছে । উপরওয়ালা আপনার মনে আশা কবুল করুক ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০২২ দুপুর ১:৫২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




