আমার স্কুল জীবনের জব্বার স্যার একটা কথা প্রায়ই বলতেন । দুই হাত তুলে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলতেন, ''ওরে শোন শোন, এই পৃথিবীতে একমাত্র বলদই সব থেকে বেশি জানে । তারা সব কিছুই জানে ।'' স্যারের কথাটা তখন পুরোপুরি আর ভাল করে না বুঝতে পারলেও এখন খুব ভাল করে বুঝতে পারি যে স্যার কি বলতে চেয়েছিলেন ! একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে আসলে সব কিছু জানা সম্ভব না । এমন কি প্রখর বুদ্ধিসম্পর্ন মানুষটিও সারা জীবন সাধনা করে অল্প কয়েকটি বিষয়ে হয়তো জ্ঞান অর্জন করতে পারে কিন্তু একজন বলদ শুরু থেকেই সব বিষয়ে সব কিছুই উপর সকল জ্ঞান অর্জন করে বসে থাকে । সে সব কিছু জানে এবং সব কিছুর ব্যাপারে তার জ্ঞান অপরিসীম ! এটা যে একধরনের মানসিক রোগ সেটা নিয়েই আজকের পোস্ট !
সায়েন্স বী নামে একটা চমৎকার বাংলা ওয়েবসাইট আছে ! বাংলাতে বিজ্ঞানের নানান বিষয় সংবাদ আবিস্কার এই সব নিয়মিত প্রকাশ হয় সেখানে । আমি নিয়মিত সেখানে ঢু মারি ! আপনারাও ঢু মারতে পারেন । এই ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট নামের মাসিক রোগটার ব্যাপারে প্রথমে এই সাইটেই পড়েছি । এই ব্যাপারে আমাকে আগ্রহী করে তোলার পেছনে কারণ হচ্ছে এই ব্যাপারটা যেভাবে আবিস্কার হয়েছে সেই মজার ঘটনাটা । মূলত ঘটনা পড়েই ডানিং গ্রুগার ইফেক্ট নিয়ে একটু পড়াশুনা করেছিলাম কিছুদিন আগে । মজার ঘটনাটা আগে বলি !
ঘটনা ১৯৯৫ সালের । আমেরিকার পিটসবার্গের একজন বাসিন্দার ম্যাক আর্থার হুইলার । ভদ্রলোকের বয়স ৪৪। জীবনের এই পর্যায়ে এসে সে জানতে পারলো যে লেবুর রসের ভেতরে এক আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে । এই লেবুর রস অদৃশ্য কালী হিসাবে ব্যবহৃত হয় । অর্থ্যাৎ লেবুর রস দিয়ে কিছু লিখলে সেটা দেখা যায় না । পরবর্তিতে আগুনের নিচে ধরলে সেই লেখা ফুটে ওঠে । অতীতে গুপ্তচরেরা এই ভাবে চিঠি আদান প্রদান করতো । তো এই তথ্য জানতে পেরে তার মনে একটা ধারণা জন্মালো যে কাগজের মত করে যদি লেবুর রস যে কোন কিছুর উপরে মাখা হয় তাহলে সেটা অদৃশ্য হবে । ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যই সে নিজের শরীরে লেবুর রস মাখলো এবং একটা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলল নিজের ।
কিন্তু ক্যামেরার ত্রুটির কারণেই হোক কিংবা অন্য যে কারণেই হোক, সেই ছবি উঠলো না। হুইলার সাহেবের মনে তখন দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো যে লেবুর রস যদি কোন কিছুর উপরে মাখা হয় তাহলে সেটা অদৃশ্য হয়ে যায় । এবং এই থিউরির উপরে তার অঘাত বিশ্বাস জন্মালো । বিশ্বাস আর আস্থা এতোই তীব্র হল যে সেটার থেকে তার ব্যাংক ডাকাতির করার ইচ্ছে জাগলো । যেহেতু সে অদৃশ্য হবে লেবুর রস মেখে তাই কেউ তাকে ধরতে পারবে না । হুইলার সাহেব তারপর একই দিনে দুইটা ব্যাংক ডাকাতি করলো । যেহেতু তার নিজের এবং নিজের উদ্ভাবিত থিউরির উপরে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাই সে ব্যাংক ডাকাতি করার সময়ে কোন মুখোশ পরলো না । এমন কি সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসিও দিল । সে জানে অদৃশ্য । লেবুর রস মেখে সে অদৃশ্য হয়ে আছে । তাকে দেখা যাচ্ছে না ।
কিন্তু পুলিশ তাকে রাতের ভেতরেই ধরে ফেলল । হুইলার মিয়া তো অবাক । তার তো ধরা পড়ার কথা না । সে তখন পুলিশকে জিজ্ঞেস করলো তাকে তারা কিভাবে খুজে পেল । পুলিশ জানালো যে তাকে সিসি টিভিতে দেখা গেছে । এই কথা মার্ক হুইলার কোন ভাবেই বিশ্বাস করলো না । কারণ নিজের উদ্ভাবিত থিউরি মতে তাকে কোন ভাবেই দেখা সম্ভব না । এমন কি তাকে সেই ফুটেজ দেখানোর পরেও সে বিশ্বাস করে নি । সব জুড়ি পুলিশ জজ মিলেও তার সেই বিশ্বাস থেকে টলাতে পারে নি ।
তাইলে বুঝেন বলদের কন্ফিডেন্স লেভেল কতবড় ! এই বলদের বলদামীর পরিমান এবং তার কন্ফিডেন্স লেভেল, মূলত এই দুইটার সাথে সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে ডানিং-ক্রুগার ইফেক্টে । হুইলার মিয়ার এই মজার ঘটনা জানতে পারলেন কর্নেল উইনিভার্সিটির ডেভিড ডানিং এবং জাস্টিন ক্রগার । তারা ব্যাংক ডাকাত হুইলার সাহেবের এতো কনফিডেন্স লেভেল দেখে এটা নিয়ে একটা গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং কিছু সাধারণ মানুষের উপরে গবেষণা চালালেন । তারা দেখতে পেলেন যে যে সব মানুষ অল্প জানে সেই অল্প জানার উপরে তাদের কনফিডেন্স অনেক বেশি থাকে । তারা তাদের পুরো পরীক্ষাটার একটা গ্রাফে রূপান্তর করলেন ! গ্রাফটা নিচের দেওয়া হল !
এই গ্রাফ খেয়াল করলে দেখা যাবে যেই মানুষের মাঝে জ্ঞান একদম নেই তার আত্মবিশ্বাসও একেবারে শূন্যের কোঠায় । অন্য দিকে যেই না একটু জ্ঞান এসে হাজির হল তখনই একদম আত্মবিশ্বাস গিয়ে ঠেকলো চুড়ায় । চিত্রের এ স্থানের মত । তারা এই এ স্থানের নাম দিলেন মাউন্ট স্টুপিড । বাংলায় এটার নাম দেওয়া যাক বলদ পাহাড় । আমাদের আশে পাশে এই স্থানে বসবাস করা মানুষের অভাব নেই । আমাদের ব্লগেই এই বলদ পাহাড়ে বেশ কয়েকজন উঠে বসে আছে । কষ্ট করে খুজে বের করতে হবে না তাদের । যাদের আসলে জানার কিংবা জ্ঞানের পরিধি কম তারা নিজেদের কে অন্য সবার থেকে বেশি যোগ্য মনে করে । এরপর গ্রাফের দিকে যদি তাই তাহলে দেখা যাবে যতই মানুষ জ্ঞানের দিকে ধাবিত হচ্ছে তাদের আত্মবিশ্বাসের পরিমান ততই কমছে । একটা পর্যায়ে গিয়ে সে বি স্থানে পৌছায় । তারপর আবারও যখন সে জ্ঞান অর্জন শুরু করে তখন তার ভেতরে আস্তে আস্তে একটা আত্মবিশ্বাস এসে বাসা বাঁধতে শুরু করে । ভেবে বসে যে হ্যা আমি ব্যাপারটাা সম্পর্কে কছুটা হলেও জানি । তারপর এক সময় সে এগিয়ে যায় একেবারে সি স্থানে । প্রকৃত পক্ষেই তারা আসলে জ্ঞানের শিখরে পৌছান । তখন আবারও তাদের আত্মবিশ্বাসের পরিমানটা বৃদ্ধি পায় !
ভারতের রিয়ালিটি শো ইন্ডিয়ান আইডল অনেকেই দেখে থাকবেন । মূল পর্ব শুরু আগে সেখানে অডিশন পর্বের বেশ কিছু পর্ব থাকে । সেখানে দেখে থাকবেন যে সেখানে ভাল শিল্পীর সাথে সাথে অনেক আনাড়ি শিল্পীও এসে থাকে । যখন সেই আনাড়া শিল্পী অডিশন দেয় এবং জাজরা তাদেরকে রিজেক্ট করে দেয় তাদের মুখ দেখলে মনে হয় যেন তারা খুব হতাশ হয়েছে । এই কাজটা জাজদের মোটেই করা ঠিক হয় নি । এটা উদাহরন ডানিং ক্রুগার ইফেক্টের ।
আমি আসলে সব জানি, আমি ভুল হতেই পারি না - মূলত এমন মনভাব থেকে বের হয়ে আসতে হবে যদি এই ডানিং ক্রুগার ইফেক্ট থেকে আমরা মুক্ত পেতে চাই । আপনি নিজে এই রোগে আক্রান্ত কিনা সেটা নিজে নিজেই পরীক্ষা করতে পারেন । যদি আপনার মনে হয় যে আপনি সব সময়ই ঠিক, অন্য সবাই ভুল করছে, আপনি ভুল করতেই পারেন না, তাহলে খুব সম্ভবত আপনি এই রোগে ভুগছেন ।
আশে পাশের মানুষের কথা শুনুন । তাদের কাছে আপনার আচনর সম্পর্ক ফিডব্যাক নিন । তবে তোষামুদে কারো কারো কাছে না যাওয়াই ভাল ।
স্যারের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, স্যারের কথা দিয়ে শেষ করি । জব্বার ছিলেন বড় মজার মানুষ । খুব চমৎকার গান করতেন । সেই সাথে তার ইংরেজির জ্ঞান অসাধারণ । একদিন স্যারকে আমরা কয়েকজন মিলে ডিকশনারী থেকে ইংরেজি শব্দার্থ ধরে পরীক্ষা করেছিলাম । স্যারের সাথে সম্পর্ক খুব ভাল ছিল তাই স্যারও হেসে রাজি হয়ে গেলেন । আমরা ৫/৬ জন মিলে স্যারকে অন্তত ২৫/৩০তা ডিকশনারী ঘেটে তাকে শব্দার্থ ধরলাম । একটাতেও তাকে আটকাতে পারলাম না । কিন্তু স্যারকে কোন দিন তার জ্ঞান নিয়ে বড়াই করতে দেখি নি । সব সময় বিনয়ী আর হাসি মুখ নিয়ে কথা বলতেন । আমরা কোন কিছু ভুল করলে হাসি মুখেই সেসব ঠিক করে দিতেন বুঝিয়ে দিতেন ! স্কুল জীবনের পরেও স্যারের সাথে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত । জ্ঞান মানুষকে বিনয়ী করে তোলে ! আর অমানুষকে করে তোলা অহংকারী ! আর সামান্য জ্ঞান বলদকে করে মহা অহংকারী !
এই পোস্টটি লিখেছিলাম নিজের ব্লগে গত এপ্রিল মাসে । সামুতে প্রকাশ করা হয় নি। আজকে করলাম !
পোস্ট তৈরি করতে যে কয়টি পোস্ট পড়েছি, তাদের লিস্টঃ
উইকিপিডিয়া
ডানিং ক্রুগার ইফেক্ট
ডানিং ক্রুগার ইফেক্ট
ডানিং ক্রুগার ইফেক্ট - আমি সব জানি
ইউটিউব ভিডিও
pic source
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০২২ দুপুর ১২:১০