কেউ যখন আপনার কাছে সাহায্য চায় আপনি তখন নিজের সাধ্যমত তাকে সাহায্য করেন । এই কাজটা অনেকেই করে থাকেন । মূলত অনেক কারণেই এই সাহায্যের কাজটা করে থাকেন । কিন্তু যখন আপনি জানতে পারলেন যে আপনার কাছে সাহায্য প্রার্থী একটা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আপনার কাছে সাহায্য চেয়েছে তখন আপনার কেমন মনে হয়? নিজেকে খানিকটা প্রতারিত মনে হয় না?
আপনার মনে হয় কিনা জানি না তবে আমার হয় ! এই রকম সাহায্য করে ঠকে যাওয়ার অনেক গল্প আছে জীবনে । তার ভেতরে কয়েকটা আজকে লিখি ।
এই গল্পটা অনেক আগের । যদিও এটা ঠিক আমার নিজের ঠকে যাওয়ার গল্প না । আমার মায়ের গল্প । আমি যেহেতু তখন তার কাছেই ছিলাম তাই এটা দিয়েই শুরু করি । তখন আমরা সবে মাত্র যশোর থেকে চুয়াডাঙ্গা এসেছি । একদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে দেখি আমাদের বাসার উঠনে একজন অপরিচিত মহিলা বসে মায়ের সাথে কথা বলছে । তাদের থেকে দুরে আমার থেকে খানিকটা ছোট বয়সী এক ফ্রক পরা মেয়ে কি নিয়ে যেন খেলা করছে । আমি ওদিকে গেলাম না আর । ঘরে চলে গেলাম । পরে জানতে পারলাম যে এই মহিলার বাসা ওমুক গ্রামে । গ্রামের নামটা এখন আর মনে নেই । এই মহিলা গেরস্তবাড়ির মেয়ে । আগে অনেক সুখের সুংসার ছিল কিন্তু স্বামী মরে যাওয়ার পরে মহিলা অনেক বিপদে পড়ে গেছে । আয় রোজগার করার লোক নেই । গ্রামে তাদের একটা সম্মান আছে তাই লজ্জায় সে কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারে না । তাই মেয়ের স্কুলের কথা বলে এখানে এসেছে সাহায্যের জন্য । মহিলার বিপদের কথা শুনে আমার মা তাকে টাকা পয়সা দিয়েছে । নিজের পরনের শাড়ি দিয়েছে এমন কি মেয়ের খেলার জন্য আমার খেলনা দেখলে কয়েকটা খেলনাও দিয়ে দিয়েছে । নিজের খেলনা হারানোর জন্য একটু মন খারাপ হল বটে তবে সেটা মেনেই নিয়েছিলাম ।
ঘটনা এখানেই শেষ হল না । প্রায় মাস খানেক পরে আমাদের এক পরিচিত মানুষের কাছে জানা গেল সে ঐ মহিলা ফ্রড । সে এমনই গল্প ফেঁদে নতুন যারা আসে তাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়ে যায় । আমার মায়ের চেহারা সেদিন কেমন যেন মলিন হয়ে গেল । এমন না যে অনেক অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার । কিন্তু এই একজন যে বিশ্বাস করে, তার কষ্টে সমব্যাথি হয়ে তাকে সাহায্য করলো কিন্তু দেখা গেল সে সব মিথ্যা !
এরপরের গল্পটা আমার ঢাকায় আসার পরে । তখন টিউশনীতে ঢুকেছি। কাটাবন নেমে পরিবাগ পর্যন্ত এই রাস্তাটুকু আমি হেটে পার হতাম । এই হাটা পথে একদিন সন্ধ্যা বেলা হঠাৎ একজন মহিলা আমাকে খুব করুন স্বরে ডাক দিল । তখন ঢাকাতে নতুন । এসব কিছুই বুঝি না । আমি দাড়িয়ে পড়লাম । সাথে সাথে দেখলাম বোরখা পরা দুজন মহিলা আমার দিকে এগিয়ে এল । নিচে দেখলাম এক ছোট বাচ্চা আছে । তাদের পেছনে রয়েছে এক বৃদ্ধ । মহিলা আমার কাছে এসে বলল যে তাদের বাসা নারায়নগঞ্জ । ঢাকায় এসেছিল ডাক্তার দেখাতে । এসে তাদের টাকার ব্যাগ হারিয়ে গেছে । এখন তারা কোন ভাবেই বাসায় যেতে পারছে না । যদি আমি তাদের কিছু সাহায্য করি । এমন ভাবে বলল আমার সত্যিই মনে হল । আমি পকেট থেকে টাকা দিয়ে সাহায্য করলাম তাদের । পুরো রাস্তায় আমার মনটা বেশ ভাল হয়ে রইলো ।
এই ঘটনার প্রায় মাস খানেক পরে গিয়েছি মহাখালি একটা কাজে । সন্ধ্যার সময় ফেরার সময়ও ঠিক একই ভাবে দুই বোরখা পরা মহিলা আমাকে ডেকে একই ভাবে একই গল্প শোনালো । নারায়নগঞ্জে বাড়ি, হাসপাতাল টাকার ব্যাগ হারানো । কিছু সময় আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । নিজেকে প্রতারিত মনে হল । খুব ইচ্ছে হল জোচ্চোর গুলো খুব কথা শোনাই, কিন্তু এমন একটা ঘৃণা জন্মালো যে কোন কথা না বলে সোজা সেখান থেকে হাটা দিলাম । পেছন থেকে তখনও করুণ স্বরে সেই মহিলা আমাকে ডেকেই চলেছে ।
ভার্সিটিতে বেশ কিছু সময় পার হয়েছে । যাওয়া আসা করি বাসে । একদিন সিটি কলেজের কাছে বাসে উঠলো শার্ট প্যান্ট পরা এক লোক। তারপর সাহা্য্য চাওয়া শুরু করলো । তার হাতে একটা মেডিক্যাল রিপোর্ট । তার মায়ের অপারেশ হবে । ৩০ হাজার টাকা লাগবে । এই লোকটা কে আলাদা ভাবে খেয়াল করার কারণ হল তার কথা বলার স্বরে কুষ্টিয়ার টান রয়েছে । যারা কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক স্বর চেনেন তারা জানবেন যে কেমন একটা আলাদা টান দিয়ে কথা বলে তারা । অনেকেই সাহা্য করলো । এরপর প্রায়ই দেখতাম ঐ সিটি কলেজের কাছেই সে উঠতো । প্রায় মাস দুয়েক তাকে দেখেছিলাম । তারপর বন্ধ হয়ে গেল । এই ঘটনার প্রায় বছর দুয়েক পরে তার সাথে আবারও আমার দেখা হল । এবার দেখা হল মিরপুর কালসি রুটে । লোকটাকে হয়তো আমি চিনতামও না । চিনতে পারলাম তার অদ্ভুত সেই কুষ্টিয়ার টানের কারণে । সেই একই গল্প । মায়ের অপারেশন, টাকা লাগবে ! অবশ্য ততদিনে ঢাকা শহরের ভাব সাব খুব করে বুঝে গিয়েছি ।
এই গল্পটা করোনার সময়ের । তখন কঠিন লকডাউন চলছে । বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই । কেবল বাজারের সময় বাইরে বের হই কিছু জিনিসপত্র কিনতে । একদিন বাজার করে ফিরছি । বাইরে তখন কোন লোকজন নেই । বাড়ির গেটের কাছে চলে এসেছি এমন সময় মনে হল পেছন থেকে কেউ যেন আমাকেই ডাকছে । এমনটা খুব একটা হয় না । ঢাকা শহরে আমাকে পেছন থেকে ডাকার মানুষ নেই বললেই চলে । তবুও পেছন ফিরে তাকালাম । দেখতে পেলাম একটা রিক্সাওয়ালা দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে আসছে । আমার সামনে থামলো । তারপর অনেকটা কান্নার মত করেই সে বলল যে তার মায়ের জন্য ঔষধ কিনতে হবে । ১২০০ টাকার মত লাগবে সে এই করোনার ভেতরে রিক্সা চালাতে পারছে না । টাকা আয় করতে পারছে না । তবুও সে সাতশ টাকার মত ম্যানেজ করেছে । বাকি টা যেন আমি তাকে দেই । উপরের গল্পেই বলেছি যে ঢাকা শহরে অনেক দিন থাকার কারণে এই সব আমার এখন আর মোটেই বিশ্বাস হয় না । কিন্তু এইবার কেন জানি বিশ্বাস হল । পকেট থেকে আমি একটা ১০০ টাকার নোট বের দিলাম । কিন্তু সে কোন ভাবেই নিবে না । তাকে বাকি টাকাই দিতে হবে । এমন ভাবে কান্না শুরু করলো আমি নিজের ভেতরেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম । মায়ের জন্য ছেলেটা এভাবে কান্না করছে আর করোনার সময় তখন হাহাকার চলছে । আয় রোজগার নেই কারো ! বাকিটা দিয়ে দিলাম ! ঐদিন রাতে প্রেমিকাকে কথা বলতেই আমাকে খুব বকলো। আমি যে কত বড়বোকা সেটার একটা লম্বা ফিরিস্তি দিল ।
যাই হোক আমি যে আসলেই বোকা সেটার প্রমান পেলাম মাস তিনেক আগে । সেই একই ভাবে সেই রিক্সাওয়ালা আবারও একই ভাবে একই গল্প । মায়ের চিকিৎসা টাকা লাগবে সে জোগার করতে পারি নি। এবার মেজাজ এমন খারাপ হল । ধরা চড় লাগানোর কথা বললাম । রিক্সাওয়ালা প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও পরে যখন তাকে বললাম আমার কাছে সে একই ভাবে টাকা চেয়েছিলো তখন দেখলাম তার মুখের ভাব একটু বদলে গেল । আবারও বলার চেষ্টা করলো যে তার মায়ের নতুন করে টাকা লাগবে ! বেটাকে একটা চড় মারার ইচ্ছেটা দমন করলাম কষ্ট করে । তারপর বললাম আবার যদি এখানে এভাবে টাকা চাইতে দেখি বাশ দিয়ে পেটাবো । দেখলাম দ্রুত রিক্সা ঘুরে চলে গেল সে । তাকে আর দেখি নি এলাকাতে !
এই রকম আরও অনেক গল্প আছে । বিশেষ সবই ঢাকাতে যখন প্রথম আসি তখন । ঢাকার আবহাওয়া মোটেই বুঝতে পারি না তখন তাই যে যা বলে সব বিশ্বাস করে নিই । এখন অবশ্য সেই ভাবটা আর নেই । রাস্তায় মানুষের এই ধরনের কথা বার্তা শুনলেই আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকি কিছু সময় । তারপরেই আমার মনে আসে বেটা বাটপার ! একে টাকা দেওয়ার কোন মানে নেই ।
এমন না যে আমি ঐ সমস্ত মানুষদের অনেক টাকা পয়সা দিয়ে একেবারে উল্টে ফেলেছি । সব সময় নিজের কাছে থাকা অতিরিক্তটাই তাদের দিয়েছি । মানে অর্থটা চলে গেলেও আমার কিছুই যায় আসে নি । কিন্তু এই যে তাদের গল্পে বিশ্বাস করে তাদের ব্যাথায় সমব্যাথি হয়ে তাদের সাহায্য করেছিলাম আর যখন জানতে পারি যে সেটা আসলে মিথ্যা ছিল নিকেজে বড় প্রতারিত মনে হল । মনের ভেতরে একটা গুমট ভাব এসে জমা হত । এই তিক্ত অনুভূতির ভাষায় বর্ণনা করার উপায় নেই ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০২২ দুপুর ১:৩১