সুপ্তি মেসেঞ্জারের আসা মেসেজটার দিকে তাকিয়ে খানিকটা হাসলো । এতোদিন ধরে সে অনলাইনে আছে, মানুষ জনের কাজ কর্মের ধরন সম্পর্কে সে বেশ ভাল রকমেই অবগত আছে । ছেলেরা মেয়েদের সাথে কথা বলার জন্য, একটা নতুন কোন সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কত কিছুই না করে!
আয়ান নামের এই ছেলেটার কথাই ধরা যাক । ছেলেটা ওকে প্রথমে মেসেজ পাঠিয়েছিল । সেখানে লেখা ছিল, আগের আইডি তার নষ্ট হয়ে গেছে । এটা নতুন আইডি। দুদিন পরে আবার ছেলেটা আবার মেসেজ পাঠালো যে, সে সরি, সানজিদা নামে ওর এক পরিচিত কে মেসেজ পাঠাতে গিয়ে ওকে পাঠিয়ে ফেলেছে । ওর প্রোফাইলে ছবি দেওয়া নেই দেখে এই ভুল করেছে । এই জন্য সে সরি। সানজিদা হচ্ছে সুপ্তির ফরমাল নাম । ফেসবুক সহ সব স্থানেই এই নাম দেওয়া । সবাই আসলে ওকে এই নামেই চেনে ।
সুপ্তি জানে এরপর ছেলেটা ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করবে । নানান রকম প্যাঁচাল দিয়ে শুরু করবে । কিন্তু ব্যাপারটা একটু অন্য রকম হল যখন ছেলেটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা ক্যান্সেল করে দিল । মেসেজ পাঠানোর সাথে সাথে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও পাঠিয়েছিল । একটু খটকা লাগলো সুপ্তির, যা ভেবে তা হল না দেখে ! আবার মনে করলো যে হয়তো এটা নতুন কোন চাল । কিন্তু যখন ছেলেটা ওকে আর কোন মেসেজই করলো না, কোন প্রকার যোগাযোগই করলো না তখন সুপ্তির সত্যিই অবাক লাগলো। সত্যি বলতে কি ওর সাথে এমন ঘটনা এই প্রথম ঘটলো । এমন তো হওয়ার কথা না ।
শেষে আর থাকতে না পেরে সুপ্তি মাস ছয়েক পরে নিজেই নক দিল ছেলেটাকে । ছেলেটার নাম আয়ান আহমেদ । প্রোফাইল দেখে ডিসেন্টই মনে হল । অল্প কিছু ছবি পাব্লিক করে দেওয়া । দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘোরার ছবি । বেশির ভাগই পাহাড়ের ছবি । এই ছাড়া ছেলেটার ব্যাপারে আর কোন তথ্য দেওয়া নেই।
-হ্যালো ।
ভেবেছিল সাথে সাথেই বুঝি উত্তর আসবে । এল না । উত্তর এল প্রায় আট ঘন্টা পরে । রাত তখন এগারোটা বাজে । ম্যাসেজের টুং করে আওয়াজে সুপ্তি মোবাইল টা হাতে নিল । আয়ানই ফিরতি ম্যাসেজ দিয়েছে ।
-হ্যালো ।
সুপ্তি লিখলো, আপনার সেই সানজিদাকে খুজে পেয়েছেন ?
আয়ান প্রথমে হাসির ইমো দিল । তারপর বলল, আমার সানজিদা ! হাহাহা ! না না সে আমার সানজিদা নয় । আমার পরিচিত সানজিদা । হ্যা তাকে খুজে পেয়েছি ।
সুপ্তি এরপর কী বলবে খুজে পেল না । কথা যে হারিয়ে গেছে । ঠিক বুঝতে পারছে না ওর এখন কী বলা উচিৎ । আসলে এমন ভাবে সে কোন দিক আগে থেকে কথা শুরু করে নি । তাই ঠিক কথা বলতেও পারছে না । সুপ্তি বলল, তা আপনি কী করেন ?
-তেমন কিছু না । বেকার বলতে পারেন । একি টুকটাক কাজ করি । আর নিজের জন্য বাঁচি ।
-সবাই তো নিজের জন্যই বাঁচে ! তাই না ?
-নাহ । আমাদের বেশির ভাগ মানুষই বাঁচে অন্যের জন্য ।
-যেমন ?
-এই ধরেন আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন একটা মেয়েকে আমার খুব বেশি মনে ধরলো । প্রেম হল । তারপর মেয়েটা বলল যে তার ডাক্তার ছেলে খুব পছন্দ । বেশ আমি তার জন্য প্রবল ভাবে পড়াশুনা করলাম। ডাক্তার হলাম কিন্তু ডাক্তারী পড়ার শেষে এসে দেখি সে চলে গেছে । এই আমি এই এতো কষ্ট করে জীবনের ৬/৭ বছর পড়াশুনা করলাম এটা কিন্তু আমার জন্য না, ঐ মেয়েটার জন্য । ফলাফল হল শূন্য । যদি আমি নিজের জন্য এই সময়টা ব্যয় করতাম তাহলে অন্তত ডাক্তার হতাম না ।
-এখন তাহলে নিজের জন্য কী করেন শুনি?
-যা নিজের ভাল লাগে তাই করি । যা ভালো লাগে না তা করি না । এই যেমন ধরেন, ডাক্তারদের এই এতো পরিশ্রমের জীবন আমার ভাল লাগে না । এইজন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি ।
-তার মানে প্রাক্টিস করেন না?
-প্রক্টিস না করলে খাবো কি বলেন ? এটাই হচ্ছে জীবনের ট্রাজেডি ! আমি আসলে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা পরিশ্রম করি না । দুই তিনটা হাসপাতালের সাথে চুক্তি আছে । যখন ওদের ওখানে কোন ডাক্তার ছুটিতে যায় আমি সেখানে কামলা দিতে যাই । কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই । কিছু এনজিও থেকে মাঝে মাঝে ডাক আসে ।
-এতে চলে যায়?
-যাচ্ছে তো !
এইভাবে কথা চলতে থাকে । একটা সময়ে সুপ্তি খেয়াল করে যে ছেলেটার সাথে ওর কথা বলতে বেশ ভাল লাগছে । কথার পরে কথা উঠেই আসছে ।
সুপ্তিই তারপর আয়ানকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো । দেখতে পেল ভেতরে অনেক ছবি । কোথায় কোথায় যাচ্ছে কী করছে । তবে কিছু ছবি বেশ কমন । আয়ান বলেছিল যে সে এনজিওর সাথে কাজ করে । নানান রকম ক্যাম্পেইন করে মানুষকে সেবা দিয়ে বেড়ায় । এটা জেনেও সুপ্তির বেশ ভাল লাগলো ।
একদিন সত্যি সত্যি দেখা হয়ে গেল । সেদিন সুপ্তি ওর মাকে নিয়ে গিয়েছিলো ঢাকার একটা প্রাইভেট হাসপাতালে । কদিন আগেই সে জানতে পেরেছিলো যে আয়ানের এই হাসপাতালের সাথে চুক্তি আছে । মাঝে মাঝে এখানে সে কামলা দিতে এখানে আসে । ডাক্তারের সিরিয়ালে বসে থাকার সময় সুপ্তির কী মনে হল সে পায়ে পায়ে চলে গেল ইমার্জেন্সীর দিকে । সেখানে ঢুকে একজন নার্সকে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল যে আয়ান আহমেদ সত্যিই বর্তমানে ডিউটিতে আছে । এবং সুপ্তিকে অবাক করে দিয়ে মিনিট দুয়েকের ভেতরেই আয়ান ওর সামনে এসে দাড়ালো ।
সুপ্তি যখন নিজের পরিচয় দিল তখন আয়ান চিনতে পারলো সাথে সাথে । এখানে কেন এসে জানতে চাইলো । সুপ্তি ওকে আসল কারণ বলে দিলো । এবং অবাক হয়ে দেখলো এরপরে সব কিছু কেমন সহজ হয়ে গেল । আয়ান নিজে গিয়ে সেই অধ্যাপক ডাক্তারের সাথে কথা বলল । সুপ্তির মায়ের সিরিয়াল এগিয়ে এল এবং ডাক্তার দেখে সুপ্তির কাছ থেকে টাকা পর্যন্ত নিলো না । আয়ান ওকে নিজের বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছে ।
এরপর থেকে আয়ানের সাথে সুপ্তির নিয়মিত দেখা সাক্ষাত হতে লাগলো । আগে তো কেবল ফেসবুকের মেসেঞ্জারে কথা হত এখন ফোননেও কথা হতে শুরু করলো । সুপ্তি আস্তে আস্তে অনুভব করছিলো যে ছেলেটাকে তার অসম্ভব ভাল লাগতে শুরু করেছে । ছেলেটা হাসে, মানুষকে হাসায়, গল্প করে বই পড়ে, পাহাড়ে ঘুরতে যায় । এতো কিছু করে । নিজের মত করেই বাঁচে ! এতো চমৎকার ছেলেটাকে প্রথমে কিই না ভেবেছিলো । এটা ভাবতে এখনও সুপ্টির খানিকটা লজ্জার মত অনুভূত হয় । একদিন বলেও ফেলেছিলো সে আয়ানকে কথাটা । কথাটা শুনে আয়ানের সে কি হাসি ! হাসি যেন আর থামেই না ! আয়ানের এই হাসি দেখেই সুপ্তির মনে আরও একটু কাছে জায়গা করে নিলো ছেলেটা !
আরও সপ্তাহ দুয়েক পরের কথা । সুপ্তি ক্লাস শেষ করে বাসার দিকে যাচ্ছে তখনই আয়ানের ফোন এসে হাজির হল ।
-হ্যালো !
-তুমি না যেতে চেয়েছিলে আমাদের ক্যাম্পেইনে !
সুপ্তি অনেক আগেই বলে রেখেছিলো যে আবার যদি আয়ানটা মেডিক্যাল ক্যাম্পেইন করতে যায় তাহলে যেন ওকে জানায় । গ্রামে মেডিক্যাল ক্যাম্পেইন করতে গেলে ডাক্তার ছাড়াও আরও নানান ধরনের ভলান্টিয়ার লাগে ।
সুপ্তি বলল, হ্যা । কবে যাবে?
-দল যাবে কাল সকালে । ঢাকা থেকে এই ধর ঘন্টা তিনেকের পথ । তুমি ওদের সাথে যুক্ত হয়ে যাও ।
সুপ্তি বলল, তুমি যাবে না?
-হ্যা আমিও যাবো । তবে আমি যাবো আজকে রাতে । আসলে ওটা আমার দাদা বাড়ির পাশের গ্রাম । আমি আজকে যাবো । আমাদের ওখানে একটা বাড়ি আছে । বাড়ির পাশে নদী । সেই নদীর পাশে বসে জ্যোৎনা দেখবো আজকে ।
সুপ্তি কি যেন ভাবলো । আসলে ক্যাম্পেইনে যাওয়া তো সুপ্তির প্রধান উদ্দেশ্য না । প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আয়ানের সঙ্গ । আর নদীর পাড়ে বসে আয়ানের সাথে জ্যোৎনা দেখার কথাটা শুনতেই সুপ্তির মনের ভেতরে কেমন করে উঠলো ! খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বলল, তোমাদের দাদাবাড়িতে কে কে আছে?
আয়ান বলল, কেউ নেই । ওখানে কেউ থাকে না । একজন কেয়ারটেকার আছে । তার কাজ হচ্ছে দিনের বেলা গিয়ে ঘর বাড়ি পরিস্কার করা । আর কিছু না । রাতে তালা দেওয়া থাকে ।
-আচ্ছা । আমি যদি তোমার সাথে যাই আপত্তি আছে?
আয়ান কিছু সময় ভাবলো কী যেন । তারপর বলল, ওকে কোন সমস্যা নেই । তুমি এই ধর দশটার দিকে তৈরি হয়ে থেকো । আমি তোমার বাসা থেকে তোমাকে পিক করে নিবো !
সুপ্তি বলল, না না । বাসার সামনে এসো না । আমি বরং তোমার বাসার সামনে আসবো নে । আশে পাশের কেউ তোমার সাথে বাইকে উঠতে দেখলে বাসায় খবর চলে যাবে!
-আচ্ছা তাহলে লুকিয়ে যাবে !
-লুকিয়ে না । বাসায় বলবো যে রত্নার বাসায় থাকবো । আমাদের কয়েক বিল্ডিং পরেই ওদের বাসা !
-আচ্ছা । তুমি তাহলে চলে এস ! তবে একটু কিন্তু খাওয়া দাওয়ার কষ্ট হবে । কেয়ারটেকারের রান্না একদম ভাল না !
-আচ্ছা সমস্যা নেই ।
ফোন রাখার পরে সুপ্তি দ্রুত এগিয়ে যেতে শুরু করলো বাসার দিকে । যদিও বাসায় কিছু বলা যাবে না তারপরও একটু গুছিয়ে নিতে হবে । কী কী বলে বাসা থেকে বের হবে সেটা আগে থেকেই ভেবে রাখলো সে ! রত্নাকেও বলতে হবে যাতে হঠাৎ করে ওর মা ফোন দিয়ে ফেলে তাহলে যেন সামলে নেয় !
সুপ্তির মনের ভেতরে ভাল লাগার একটা অনুভূতি কাজ করতে শুরু করেছে । বারবার সামনে আসা সময়টার কথা সে কল্পনা করার চেষ্টা করছে । জ্যোঁছনা রাত, নদীর ধার পাশে আয়ান বসে ! ব্যাপরটা কল্পনা করতেই মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠছে আপনা আপনিই !
দুই
সুপ্তি চোখ মেলে তাকালো । প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলো না ঠিক কোথায় আছে ! চোখের সামনে একদম অন্ধকার ঠেকলো সব কিছু ! তবে কিছু সময় যাওয়ার পরেই চোখে অন্ধকার সয়ে এল । তখনই টের পেল যে ও একদম নড়তে পারছে না । ওর হাত পা পা বাঁধা শক্ত করে ! তীব্র একটা আতংঙ্ক এসে জড় হল ওর মনে । চিৎকার দিতে যাবে কিন্তু সেটাও পারলো না । মুখের ভেতরে কিছু দেওয়া রয়েছে । তার উপরে টেপ পেঁচানো শক্ত করে ! কোন আওয়াজই বের হল না !
আরও কয়েকবার চেষ্টা করলো ও । কিন্তু কোন কাজ হল না । আতংঙ্কটা বাড়তেই থাকলো । বারবার চিন্তা করতে লাগলো ও এখানে কিভাবে এল ?
রাতের বেলা সে আয়ানের সাথে এসেছিলো আয়ানের দাদা বাড়ি । বাড়িটা খুব নির্জন ছিল । এমনই থাকবে সেটা জানা ছিল । আয়ানের সাথেই বাড়িতে ঢুকেছিলো । একটা ঘরে তালা খুজে প্রবেশ করলো ওরা । আলো জ্বাললো । ঘরটা বেশ গোছানো ছিল । দেখেই বুঝতে পেরেছিলো যে এখানে মানুষজনের যাতাযাত হয় !
ঘরের এক পাশে একটা ফ্রিজও দেখতে পেয়েছিলো সুপ্তি। আয়ান সেখান থেকে পানি বের করে খেল । তারপর ওদের দুইজনের জন্য একটা শরবত বানালো । সুপ্তির দিকে গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে আয়ান বলেছিলো, জার্নি করে ক্লান্ত হয়ে আছো । এটা খাও । তারপরই আমরা জ্যোঁছনা দেখতে যাবো !
সুপ্তি কোন প্রশ্ন না করেই সেটা খেয়ে ফেলল । একটু অদ্ভুত স্বাদ হলেও খেতে খারাপ লাগলো না ।
খাওয়ার পরে কী হল ?
সুপ্তি মনে করার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না । তাহলে কী ঐ....।
সুপ্তি আর কিছু ভাবতে পারছে না !
ঠিক এমন সময়ে ঘরের আলো জ্বলে উঠলো । সুপ্তি চমকে গিয়ে সামনের দিকে তাকালো । আয়ানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তীব্র একটা বিস্ময় নিয়ে তাকালো । আয়ানের মুখ হাসি হাসি । সে সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বলল, ঘুম ভাঙ্গেছে ?
সুপ্তি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা রকলো আবার । কিন্তু কোন লাভ হল না । তীব্র একটা ভয় জেগে উঠলো ওর মনে !
-ভাবছো এখানে কিভাবে এলাম, তাই তো ? বোকা সুপ্তি ! এভাবে মানুষকে বিশ্বাস করতে আছে ? আমাকে তুমি কতই বা চিনো আর বল!
সুপ্তি কেবল অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে আয়ানের দিকে । এখনও ঠিক সে বিশ্বাস করতে পারছে না । আয়ান বলল, তোমরা মেয়েরা খুব বোকা হও । খুব সহজেই ফাঁদে পা দাও । যাই হোক তুমিই তো প্রথম না ! এই চেহারা দেখে অনেকেই ফাঁদে পা দিয়েছে । সবার অবস্থাই তোমার মত হয়েছে । আজকে তোমারও হবে !
সুপ্তি এবার সত্যিই ভয় পেল । তীব্র এক ভয় ! এমন ভয় সে আর কোন দিন পায় নি । আয়ান আস্তে আস্তে এগিয়ে এল । পাশেই একটা টেবিল থেকে বড় একটা ছুরি তুলে নিল । সেটা দেখে সুপ্তি চিৎকার দিয়ে উঠলো । কিন্তু মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হল না । চোখ দিয়ে কেবল কান্না বের হয়ে এল । সাথে সাথে ওর মায়ের মুখটা মনে পড়লো । ওর মা এখন কী করছে ?
এখন নিশ্চয়ই সে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে । কাল সকালে যখন ওর কথা মনে পড়বে তখন সে আর এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকবে না । ওকে কী আজকেই মেরে ফেলবে নাকি কষ্ট দিয়ে মারবে ?
বাঁচার একটা তীব্র আকাঙ্খা জেগে উঠলো সুপ্তির মনে । নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো । কিন্তু কোন কাজ হল না । খুবই শক্ত দড়িয়ে দিয়ে ওকে বাঁধা হয়েছে ।
আয়ানকে এগিয়ে আসছে দেখলো । ওর একদম কাছে এগিয়ে এল সে । তারপর হাতের ছুরিটা সে সুপ্তির গলা বরাবর ধরলো । একটু হাসলো সে । কুটিল হাসি । সুপ্তি বুঝতে পারলো ওর সময় এখনই শেষ । এখনই ওকে জবাই করা হবে !
ছুরিটা আয়ান এবার উপরে ধরলো । সুপ্তি কেবল দেখতে পেল সেটা নেমে আসছে ওর গলা বরাবর !
তিন
সুপ্তি এখন কিছুটা শান্ত । ঘরের ভেতরে সে চুপ করে বসে আছে । ওর হাত আর পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে । এখনও সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না সে বেঁচে আছে ! তীব্র একটা রাগ হচ্ছে আয়ানের উপর । সেই সাথে আবার বেঁচে থাকার আনন্দ হচ্ছে । এই মিশ্র একটা অনুভূতি !
আয়ানকে ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেখলো সে । একটু আগে সে এই পাতাল ঘরে ছিল । এই বাড়ির নিচে একটা পাতাল ঘর আছে । মুলত সেটা কয়েদ খানা । আয়ানদের পূর্বপুরুষ এই এলাকার জমিদার ছিল । তারা প্রজাদের শাস্তি দেওয়ার জন্যই নিচের কয়েদখানাটা বানিয়েছিলো !
আয়ানের হাতে একটা প্লেটে নানান পদের খাবার । সেই হাতে হাতে সফট ড্রিংস । সেটা বাড়িয়ে দিল সুপ্তির দিকে । সুপ্তি হাতটা বাড়িয়ে দিল না । আয়ান বলল, এতে কিছু নেই । এই দেখো ...
বলে সে নিজেই একটা চুমুক দিল । তারপর সেটা আাবারও সুপ্তির দিকে বাড়িয়ে দিল ! সুপ্তি এবার হাতে নিল । আয়ান ওর পাশে বসতে বসতে বলল, আমি জানি যে কাজটা তোমার সাথে করেছি সেটা মোটেই ঠিক হয় নি । আমি আসলে একটা এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম । তুমি যেখানে ছিলে সেটার দেওয়ালে চারিদিকে ক্যামেরা সেট করা । তোমার পুরো এক্সপ্রেশনটা ভিডিও করা হয়েছে । ওটা একেবারে র ! পিওর ! কোন ভ্যাজাল নেই ।
সুপ্তি আসলেই কিছুই বুঝতে পারছিলো না । ওর কাছে কেমন যেন সব এলোমেলো লাগছিলো । সত্যিই ভয় পেয়েছিলো ও । খুব বেশি ভয় ! যখন ছুরিটা নেমে আসছিলো নিচে । একেবারে ওর গলার কাছে ওর মনে হয়েছিলো যে ওর প্রাণ বায়ু বুঝি এবারই বের হয়ে যাবে । কিন্তু একেবারে শেষ মুহুর্তে থেমে গেল সেটা । সুপ্তি অনুভব করছিলো ওর বুকটা কিভাবে লাফাচ্ছিলো ।
তারপর আয়ান আস্তে আস্তে পা খুলে দিলো, হাত খুলে দিল ছাড়া পেতেই প্রথমে আয়ানের উপরে ঝাপিয়ে পড়লো সে । আঘাত করতে শুরু করলো । আয়ান কেবল নিজেকে রক্ষা করতে ঠেকাতে লাগলো ওর আঘাত গুলো । এক সময় সুপ্তি থামলে আয়ান ওকে খানিকটা জড়িয়ে ধরেই বলল যে এসব সাজানো ছিল । কেবল ওর রিএকশন কেমন হয় সেটা দেখার জন্য । ওর পড়াশোনার একটা ব্যাপার হচ্ছে হিউম্যান মাইন্ড ভয় পেলে কি করে । বাস্তব অভিজ্ঞতা চাইছিল । সেটাই দেখার জন্য ।
তারপর ব্যাগ থেকে বের করে কিছু জার্নালও দেখালো । তারপর সুপ্তি একটু শান্ত হল । তবুও আয়ানের উপর থেকে রাগটা কোন ভাবেই যাচ্ছিলো না ।
পরিশিষ্টঃ
সুপ্তি নদীর পাড়ে বসে আছে অনেকটা সময় । আয়ান ওর পাশেই বসে আছে । কেউ কোন কথা বলছে না । কেবল তাকিয়ে আছে সামনে ! চমৎকার বাতাস দিচ্ছে । সুপ্তির কাছে সব কিছু যেন আরও সুন্দর মনে হচ্ছে । বেঁচে থাকার আনন্দ । একটু আগে সে সত্যিই যে তীব্র একটা ভয় পেয়েছিল । মৃত্যুকে দেখেছিলো একদম কাছ থেকে । মনে হয়েছিলো আর যদি কিছু সময় পাওয়া যেত তাহলে কত কিছুই না করা যেত । এখন সেই সময় সে পেয়েছে ! এখন মনে হচ্ছে জীবনে আসলে অন্য সব কিছু গৌণ । কেবল নিজের জন্য বেঁচে থাকাটাই মূখ্য একটা ব্যাপার ।
আয়ানের মত করে ! আয়ান যেভাবে বাঁচে এখন নিজের জন্য ! আমরা সব সময় অন্যকে খুশি করতে বাঁচি । নিজের কথা ভুলেই যাই । তারপর শেষ সময়ে যখন এসে হাজির হয় তখন আফসোস হয় । তখন আমরা আসলে বুঝতে পারি যে অন্য সবার থেকে আপন সত্ত্বাকে গুরুত্ব দেওয়ার দরজার ছিল সব থেকে বেশি । সুপ্তিও ঠিক করলো যে আজ থেকে সেও তাই করবে ।
সুপ্তি আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, যাও তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম । তবে আর কোন দিন এসব করবে না !
আয়ান হাসলো । তারপর বলল, আমি আর চাইলেও করতে পারবো না । কারণ আর ভয় পাবেও না তুমি !
-সত্যি জীবনে এতো ভয় পেয়েছিলাম ।
-তবে এটা কিন্তু তোমার বোকামির ফলই । কারণ এভাবে কোন ভাবেই কারো সাথে চলে আসা ঠিক না । আমি সত্য সত্যি এমন কেউ হতাম তখন ?
সুপ্তি বলল, জানি না । কেবল তোমার চোখ দেখে মনে হয় নি যে তুমি খারাপ কিছু করতে পারো !
-এই সব ভুল তত্ত্ব । গল্পের বইতে লেখা তত্ত্ব । চোখ দেখে ভাল মানুষ বের করা । মোটেই তেমন কিছু না ! এবার থেকে অবশ্যই সাবধান হবে । যাকে ভাল করে চেনো না, জানো না এমন কারো সাথে একা কোথাও যাবে না ।
সুপ্তির অবশ্য এখন ওসব চিন্তায় আসছে না । জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো সে । সত্য বলতে জীবনে এভাবে সে মৃত্যুর ভয় পায় নি । আজকে যেভাবে সে মৃত্য ভয় পেয়েছে তাতে করে অনেক কিছু বদলে গেছে যেন । যখন ছুরিটা আস্তে আস্তে নেমে আসছিল তখন সুপ্তি যেন ওর জীবনের সব কিছু চোখের সামনে দেখতে পেল । তখন বারবার মনে হচ্ছিলো যে জীবনে এখনও কত কিছু করার বাকি !কত কিছু করতে চেয়েছিলো সে জীবনে ! তার তো কিছুই করা হয় নি আর !
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সুপ্ত । এখন থেকে কেবল নিজের জন্য বাঁচবে । একদিন না একদিন মরতে তো হবেই । আবার যখন মরণ আসবে তখন যেন এবারের মত আফসোস না আসে !
গল্পটি আগে নিজেস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ।
ছবিটি মিডজার্নি এআই দিয়ে আঁকা