somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ মায়া

২০ শে নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(সহ ব্লগার ভুয়া মফিজ তার ব্যক্তিগত দুইটা অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন ব্লগে । সেই দুইটা অভিজ্ঞতা এক সাথে করে এই গল্প লেখা হয়েছে ।)

অফিস থেকে আমাকে কাজের কারণে কোথাও পাঠাতে চাইলে আমি সাধারণত একা যাওয়ার জন্য শর্ত দিয়ে থাকি । এমন কি কাজটা দুই তিনজনের হলেও সেটা একাই সামলে নিই সব সময় । এই কারণে আমার এই শর্ত প্রায় সব সময়ই মেনে নেওয়া হয় । তবে এইবার তার ব্যাতিক্রম ঘটলো । আমাকে আরও একজনের সাথে স্কটল্যান্ডে আসতে হল । এবং সেই একজন টা হচ্ছে সারাহ । অফিসের এই মেয়েটাকে সবাই একটু এড়িয়ে চলে । সারাহ মানুষ হিসাবে ভাল তবে একটু বেশিই গুরুগম্ভীর । মানুষের সাথে ঠিক মিশতে পারে না কিংবা ইচ্ছে করেই মেশে না । দেখতে শুননে বেশ চমৎকার হলেও এই সবাইকে এড়িয়ে চলার জন্য অফিসে তাকে সবাই খুব একটা পছন্দও করে না । অবশ্য তাতে সারাহর খুব একটা যে কিছু যায় আসে, সেটাও না । এই মেয়ের সাথে বস কেন আমাকে স্কটল্যান্ড পাঠানোর বুদ্ধি করলো আমার জানা নেই ।
বসের কেবিনে গিয়ে নক দিতেই বস বলল যে কাজ দুইদিনের ভেতরে শেষ করতে হবে । স্কটল্যান্ডের দিকটা সারাহ একাই সব সময় সামলায় তবে এইবার ওর সাহায্য লাগবে । এই জন্য আমাকে যেতে হবে । আমি বলতেই যাচ্ছিলাম অন্য কাউকে পাঠান কিন্তু তার আগেই বস বলল কাজ শেষ করে দুইদিন ওখানেই থাকতে পারো । কোম্পানীর গেস হাউজেই তোমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে সুতরাং থাকা খাওয়ার খরচটা বেঁচে যাবে ।
বস আসলে ঠিক ঠিক জানে যে কাকে কিভাবে কোন কথা দিয়ে রাজি করাতে হয় । আমার দুর্বলতার কথা সে ভাল করে জানে । কাজের পরে একটু ঘোরাঘুরি না করলে আমার চলে না । আর সেটা যদি কোম্পানীর টাকায় হয় তাহলে তো আর কোন কথাই নেই । আমি আর কথা বাড়ালাম না ।

স্কটল্যান্ডে আমাদের কোম্পানীর গেস্ট হাউজটা বেশ চমৎকায় জায়গাতে । শহর ছেড়ে একটু দূরে আমাদের কোম্পানীর ফ্যাক্টারী সাথে অফিস । সেখানেই মূলত আমাদের কাজ । ফ্যাক্টারী থেকে আরো মাইল পাঁচেক ভেতরে এই গেসহাউজ । এই গেস্টহাউজটা সম্প্রতি কেনা হয়েছে । হেড অফিস থেকে প্রায়ই এখানে আসা হয় অডিটের কাজে । আমি নিজেও আগে এসেছি । তখন শহরের হোটেলেই উঠেছিলাম । তারপর কোম্পানী ঠিক করলো যে যেহেতু নিয়মিতই আসা যাওয়া লাগে, প্রতিবার হোটেল খরচ না দিয়ে একবারে একটা গেস্টহাউজ কিনে নেওয়া যাক । তাই করা হল । মাস ছয়েক আগে এই গেস্টহাউজ কেনা হয়েছে । দেখা শোনার জন্য একজন কেয়ারটেকার কাম রাধুনী রাখা হয়েছে ।

প্রথম দুটোদিন যে কিভাবে চলে গেল আমি আর সারাহ কেউ টের পেলাম না । বস আসলে ঠিকই বলেছিল । এই কাজ সারাহ কিংবা আমি যদি একা করতে যেতাম আমাদের দুইজনের খবর ঘোলা হয়ে যেত । আর সারাহকে আমি আসলে যেমন ভেবেছিলাম, এই অফিসের বাইরে এসে ওকে কেন জানি তেমন মোটেই মনে হচ্ছে না । বরং প্রানবন্ত, মিশুক আর হাসিখুশি মনে হচ্ছে । মেয়েটা যেন হঠাৎ করে নিজেকে মেলে ধরছে ।

কাজের চাপ একটু কমে এলে পরদিন সন্ধ্যায় গেস্ট হাউজের বারান্দায় দুজন বসে কফি খেতে খেতে গল্প করতে শুরু করলাম । এই দুইদিনে আমাদের দুইজনের অফিস আর ফ্যাক্টরি থেকে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যেত । শরীর থাকতো ক্লান্ত । কোন মতে খেয়েই বিছানাতে শুয়ে পড়তাম । গল্প গুজবের ইচ্ছে থাকতো না । কিন্তু আজকে একটু আগে আগেই ফিরেছি। ফ্রেশ হয়েছে বসলাম বারান্দায়। কেয়ারটেকার কফি নিয়ে এল । সেটাতে চুমুক দিতে দিতে গল্প করতে শুরু করলাম ।
আমরা দুজনেই বারান্দায় পেতে রাখা আরামদায়ক চেয়ারে বসেছি । বাইরে একটি ঠান্ডা পরেছে । তবে এই বারান্দায় বসে থাকতে আমাদের কারোরই খারাপ লাগছে না । অফিসের এই গেস্ট হাউজটা দুই তলা । আমরা দুইতলার বারান্দাতে বসে আছি । বারান্দাটা গেস্ট হাউজের পেছনের দিকে । মেইন বিল্ডিংয়ের পরেই একটু খোলা জায়গা । তারপর নিচু একটা দেওয়াল দিয়ে গেস্ট হাউজের সীমানা দেওয়া হয়েছে । দেওয়ালের ওপাশ থেকে গাছ পালা শুরু হয়েছে । সেটা ক্রমেই ঘন হয়েছে । তারপর ঘন বন। পেছনের দিকটা একেবারে আলোকিত হয়ে আছে । একটা ফ্লাডলাইটের মত উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে । তার কারণে পেছনের উঠান, দেওয়াল আর তারপরের জঙ্গল একেবারে আলোকিত হয়ে আছে । এতো আলো জ্বালিয়ে রাখার কারণ ঠিক আমি বুঝতে পারলাম না । দুইদিন ধরে আছি, এই আলো খেয়াল করেছি । আমি আলোর দিক থেকে মনযোগ সরিয়ে সারাহর দিকে মনযোগ দিলাম ।

সারাহর সাথে আমি কাজ করছি প্রায় দুই বছরের উপরে । কিন্তু অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে ওর সম্পর্কে আমি বলতে গেলে কিছুই জানি না । তবে তার থেকেও অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে সারাহকে দেখলাম আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই বলে দিতে । বিশেষ করে আমি কী পছন্দ করি না করি, কোথায় যাই না যাই এইসব । হঠাৎ করেই সারাহ বলল, টামিম তোমাকে এই ভিজিটে আমি পাঠাতে বসকে অনুরোধ করেছিলাম ।
সারাহ আমার তামীম নামটা ঠিক উচ্চারণ করতে পারে না । ত এর স্থানে ট বলে । সব বিদেশীর বেলাতেই এই ব্যাপারটা হয় । আমি সারার মুখে এই কথা শুনে এবার সত্যিই অবাক হলাম । বলল, তুমি বলেছিলে?
-হ্যা । স্যার ক্রিসকে পাঠাতে চাইছিল আমার কাছে । কিন্তু আমার ক্রিসকে পছন্দ না ।
সারাহ একটু হাসলো । আমি ওর হাসিতে একটু যেন লজ্জা মিশ্রিত আভা দেখতে পেলাম । তবে আমার কাছে ব্যাপারটা নতুন ছিল । আমি কোন কালেই আশা করি নি যে সারাহ এই রকম ভাবে আমাকে আলাদা ভাবে আসতে বলবে সেটা আমি ভাবতে পারি নি । আর বলল যে ক্রিসকে ওর পছন্দ না । তার মানে কি আমাকে পছন্দ ?
ঐ সব দিকে যাওয়া ঠিক হবে না । ভাবাও ঠিক হবে না । আমি খানিকটা অস্বস্থি নিয়েই কফির কাপে চুমুক দিতে শুরু করলাম । তখন সারাহ আবারও বলতে শুরু করলো, আমি যখন হাই স্কুলে পড়ি তখন আমার বাবা আর মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায় !
এই কথাটা অবশ্য আমি জানতাম । আমার তখন মনেই মনে হয়েছিল যে সারার বাবা মা আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণেই বুঝি ওর ছোটবেলাটা ঠিক সুখের হয় নি । এই কারণেই হয়তো ও সবাইকে এড়িয়ে চলে । এতো গম্ভীর থাকে । সারাহ আবার বলা শুরু করলো, প্রথমে আমি আমার মায়ের আথেই থাকা শুরু করি । কিছু দিনের ভেতরেই মা নতুন করে আবার বিয়ে করে । আমি মায়ের সাথে নতুন বাবার বাসায় উঠে পড়ি । নতুন স্কুলে ভর্তি হই । সব কিছু ঠিকই চলছিল কিন্তু তারপরই প্রথ ধাক্কাটা খাই । যদিও প্রথম থেকেই ব্যাপারটা আমার মনের এক কোনে খোঁচা দিচ্ছিলো । তুমি জানো মেয়েরা ঠিক ঠিক বুঝতে পারে কোন পুরুষ তাদের দিকে কোন দৃষ্টিতে তাকায় । এটা মেয়েদের একটা সহজাত ক্ষমতা বলতে পারো । আমি আমার নতুন বাবার আমার দিকে তাকানোর ধরণটা নিয়ে একটু অস্বস্থিতে পড়লেও সেটা আসলে আমলে নিতাম না । কিন্তু একদিন সেই ফল পেলাম । বাসায় একা পেয়ে সে আমাকে চেপে ধরলো ।


আমি ধাক্কার মত খেয়াল কথাটা শুনে । দেখলাম সারাহ চোখে পানির বিন্দু কেমন চিকচিক করছে । সারাহ আবারও বলল, সেদিন কিভাবে কপাল গুণে রক্ষা পেয়েছিলাম । হাতের কাছে একটা পেপার ওয়েট ছিল । বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়ছিলাম । একটা বড় পেপার ওয়েট ছিল বইয়ের উপরে । সেটা দিয়েই মাথায় আঘাত করেছিলাম । তারপর দৌড়ে পালিয়েছিলাম ঘর থেকে । কাছেই আমার এক স্কুল ফ্রেন্ড থাকতো সেখানে গিয়ে হাজির হলাম । পুরো দিনই সেখানে ছিলাম । রাতে মা বাসায় ফিরলে মা আসে আমাকে নিতে । তাকে সব টুকু খুলে বললাম । মুখ বুঝে শুনলো কেবল । কিছু বলল না । পরের দিন আমি আমার বাবার কাছে চলে এলাম । তারপর থেকে সেখানেই বড় হয়েছি ।

সারাহ বেশ কিছু সময় চুপ করে রইলো । আমি সত্যিই ধাক্কার মত খেয়েছি । চুপচাপ থাকা এই মেয়েটার কাছ থেকে সব সময় আমি দুরেই থেকেছি । কাজ ছাড়া কখনই কাছে যাই নি । তবে কোন দিন ভাবতেও পারি নি যে এই মেয়েটার মনে এই জিনিস নিয়ে সে বড় হয়েছে । নিজের সৎ বাবার কাছ থেকে পাওয়া এই আচরণ যে কোন মেয়ের পুরো জীবনটা উলট পালট করে দিতে পারে এক নিমিষেই ।
সারাহ আবার বলল, তারপর থেকে আমি প্রায় পুরুষের চোখে এই দৃষ্টি দেখতে পেতাম । তোমরা তো ভাবি আমি আসলে মানুষের সাথে মিশি না । আমার এই না মেশার মূলে রয়েছে পুরুষের এই দৃষ্টি । আমি খুব ভাল করে চিনি কোন পুরুষ আমার দিকে কোন চোখে তাকায় !

এরপরেই সারাহ আসল বোমা ফাটালো । বলল, কেবল তুমি বাদ দিয়ে !
আমি চোখ তুলে তাকালাম ওর দিকে । সারাহ একেবারে আমার চোখে চোখ দিয়ে গভীর চোখে তাকিয়ে রয়েছে । চোখ না সরিয়েই সারাহ বলল, আমি যতবার তোমার চোখের দিকে তাকিয়েছি ততবার মনে হয়েছে যে অন্য সব পুরুষ থেকে তুমি আলাদা । এখনও তাই মনে হয়। এই কথাটা হয়তো কোন দিন অফিসের ঐ পরিবেশে তোমাকে বলতে পারতাম না ।

আমি সত্যিই একটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়েছি সারাহর দিকে । সারাহর কাছ থেকে এমন কিছু শুনতে পাবো বলে আশা করি নি কোন দিন । আমার এখন কেমন অনুভব করা উচিৎ কিংবা কী বলা উচিৎ আমি সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না । আমি কিছু বলতে যাবো তখন পুরো গেস হাউজ অন্ধকার হয়ে গেল ।

পাওয়ার কাট হয়েছে !

আমরা অন্ধকারের ভেতরেই বসে থাকতাম কিছু সময় । মনে হল যে এখনই বিদ্যুৎ চলে আসবে নয়তো জেনারেটর চালু হবে । তবে দেখলাম দুটির একটাও হল না । অবশ্য খুব যে খারাপ লাগছিলো সেটাও না । বিশেষ করে অন্ধকারের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভাল লাগছে । আমরা দুজন কিছু সময় সেই দিকেই তাকিয়ে রইলাম ।

এক সময় হঠাৎ সারাহ খানিকটা চিৎকার করেই বলে উঠলো, ওটা কি?

চিৎকার শুনে আমি সেদিকে তাকালাম । বারান্দা থেকে নিচে দেওয়ার ঠিক ওপাশেই । অন্ধকারের ভেতরে অনেক সময় থাকার কারণে আমাদের দুজনের চোখেই অন্ধকার সয়ে এসেছে । সেই অন্ধকারের ভেতরেই জিনিসটা সারাহর চোখে পড়েছে । আমিও সেদিকে তাকালাম ।

প্রথমে মনে হবে কেউ দেওয়ালেটার ঠিক ওপাশে বসে প্রাকৃতিক কর্ম সাধন করছে । কালো গায়ের রং । অন্ধকারের ভেতরে সেই কালো শরীরটা ভাল করেই দৃষ্টি গোচর হচ্ছে । আমি আর সারাহ সেই দিকে তাকিয়ে রয়েছি এক ভাবে । একটু পরেই সেই অয়োবয়টা উঠে দাড়ালো । তবে ঠিক মানুষের মত উঠে দাড়ালো না । মনে হল যেন বসে থাকা অবস্থাতেই দাড়িয়ে পড়লো ! তারপর সোজা আমাদের দিকে ফিরে তাকালো । আমরা দুজনেই দেখলাম জ্বলতে থাকা লাল চোখ দুটো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে একভাবে ।

আমি অনুভব করলাম যে সারাহ আমার হাত চেপে ধরেছে শক্ত ভাবে । আমরা দুজনেই তাকিয়ে রয়েছি সেই লাল চোখের দিকে । আমাদের দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে সেটি । কত সময় আমাদের দিকে সেটা তাকিয়ে ছিল সেটা আমরা কেউ বলতে পারি নি । এমন সময়ে আলো জ্বলে উঠলো । চারিদিক আলোকিত হওয়ার সাথে সাথেই আমি দেখলাম যে জিনিসটা দেখে আমরা ভয় পাচ্ছিলাম সেটা আর সেখানে নেই !

একবার মনে হল যে আমি হয়তো ভুল দেখেছি । কিন্তু আমরা দুজনেই কি একই ভুল দেখবো । আমি সারাহের চোখের দিকে তাকিয়েই বলতে পারি যে ও বেশ ভয় পেয়েছে । আমি নিজেও খানিকটা যে ভয় পাই নি সেটা আমি বলবো না । সব থেকে বড় কথা আমরা দেখলাম টা কি !


সারাহ আর কোন কথা না বলেই উঠে গেল নিজের ঘরে । আমিও ফিরে এলাম নিজের ঘরে । নিজের ঘরেই পায়চারি করতে থাকলাম । মাথার ভেতর থেকে কিছুতেই ঐ দৃশ্যটা যাচ্ছে না ।
কিছু সময় পরেই আমার ঘরে টোকা পরলো । দরজা খুলতে দেখি সারাহ দাড়িয়ে আছে ভীত মুখে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার খুব ভয় করছে ! আমি একা ঘুমাতে পারবো না ঘরে !

আমি দরজা ছেড়ে দিলাম । আমার মনেই হচ্ছিলো এমন কিছু হবে ! আমারই এমন একা একা ভয়ে লাগছিলো নিজের ঘরে । সেখানে সারাহর ভয় লাগবে সেটা স্বাভাবিক । রাতটা আমরা সোফাতে বসেই কাটিয়ে দিলাম । বার বার কেবল মনে হচ্ছিলো যে এই বুঝি ঐ জিনিসটা এসে হাজির হবে আমাদের দরজার সামনে । কিংবা জানলা দিয়ে উকি দিবে । তবে আশা করা সেটা দিল না ।


দুই
পরের দিনের কাজ আরও অল্প ছিল । আজই সারাহর লন্ডন ফিরে যাওয়ার কথা । তবে আমার জন্য আরও দুইদিন ছুটি বস দিয়ে রেখেছেন । অফিস থেকে গেস্ট রুমে যাওয়ার পথে আমি কেবল ভালছিলাম কেবল গতরাতের কথা । কিছুতেই অয়োবয়টাকে মন থেকে আমি দুর করতে পারছি না । বারবার মনে হচ্ছে রাতে আমি কী দেখলাম ! রাতের সাহার সাথে আমি এইটা নিয়ে কথা বলেছি । আমি ঠিক যা যা দেখেছি সারাহও ঠিক একই জিনিস দেখেছে । ওর বর্ণনা একেবারে আমার সাথে মিলে যায় । তাহলে দুজনেই যদি চোখের ভুল দেখবো তাহলে একই সাথে একই জিনিস কিভাবে দেখলাম আমরা ?


বিকেলে বেলা সারাহ আমাকে জানালো যে সে যাবে না লন্ডন ফিরে । তার মনে একটা প্রচন্ড কৌতুহল জন্মেছে । যদিও সে ভয় পেয়েছে তবে ব্যাপারটা জানার তার আগ্রহ জন্মেছে । আমার নিজেরও আগ্রহটা বেশ ভাল ভাবেই জন্মেছে ।

সন্ধ্যার পরে আমরা ঠিক একই ভাবে সেখানে বসে রইলাম । এবার আমরা কেবল একা নই । আমার সাথে করে আনা ভিডিও ক্যামেরাটা আমি সেট করে রাখলাম । অর্থ্যাৎ আমরা যা দেখবো সেটা ধরা পরবে ক্যামেরাতে । তবে ঘন্টা দুয়েক বে থাকার পরেও যখন কিছু হল না, আমরা কাউকে দেখতে পেলাম না তখন আমরা দুজনেই হতাশ হলাম । আমি উঠেই যাচ্ছিলাম তখনই সারাহ বলল, আচ্ছা কাল যখন পাওয়ার কাট হয়েছিলো তখনই তো আমরা দেখেছিলাম, তাই না?
আমারও তাই মনে পড়লো । কালকে যত সময় আলো জ্বলছিলো তত সময়ে আসলে কিছুই হয় নি । যখনই পাওয়ার কাট হল তখনই দেখতে পেলাম ।

সাথে সাথে কেয়ারটেকারকে ডাক দিলাম । কাছে আসতেই তাকে বললাম, ফ্লাড লাইটটা অফ কর তো !

আলো বন্ধ করতেই কেয়ারটেকার আমাদের দিকে কেমন চোখে তাকালো । বলল, কেন স্যার ? আলো বন্ধ করবো ?
-এভাবে আলো জ্বালিয়ে রাখার মানে কি ? বন্ধ কর ।
-আসলে এই বাড়িতে আলো জ্বালিয়ে রাখার নিয়ম ।
আমি একবার সারাহর দিকে তাকালাম । তারপর আবারও তাকালাম কেয়ারটেকারের দিকে তাকিয়ে খানিকটা শক্ত কন্ঠে বললাম, যা করতে বলছি কর । যাও !

কেয়ারটেকার আরও কোন জবাব না দিয়ে নিচে চলে গেল । ঠিক মিনিট খানেক পরেই ফ্লাড লাইট বন্ধ হয়ে গেল । আমি আর সারাহ খানিকটা উৎকন্ঠা নিয়েই তাকিয়ে রইলাম । কত সময় তাকিয়ে ছিলাম আমার জানা নেই, হয়তো একটু মনযোগ সরে গিয়েছিল, সারাহ আমার হাত চেয়ে ধরায় আমি আবারও ফিরে তাকালাম । এবং আবারও অন্ধকারের ভেতরে সেই লাল জ্বলতে থাকা চোখ দুটো দেখতে পেলাম । দেওয়ালের ঠিক বাইরে দাড়িয়ে রয়েছে । এবং আমাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে । এইবার কেন জানি আমার গতকালকের মত ভয় লাগলো না । তবে একেবারে যে ভয় লাগলো না সেটাও কিন্তু না । আমি আর সারাহ একভাবেই তাকিয়ে রইলাম সেটার দিকে । কত সময় তাকিয়ে রইলাম সেটা আমাদের মনে হয় হঠাৎ করেই আলো জ্বলে উঠলো এবং দেখলাম সব কিছু গায়েব হয়ে গেছে ।
কেয়ারটেকারকে ডাকার আগেই দেখলাম উঠে এল দোতলায় । ওর চেহারা দেখেই আমার মনে হচ্ছিলো যে বেটা কিছু জানে । তবে আমাদের কিছু বলতে হল না । দেখলাম সে নিজ থেকেই আমাদের বলা শুরু করলো ।

কেয়ারটেকার বলল, আপনারা যেটা দেখলেন একটু আগে ওটার না ওটুলো।
সারাহ বলল, এটা আবার কী ?
-এক ধরনের ডিমন । তবে এটা মানুষদের ঠিক ক্ষতি করে না । বরং মানুষদের সঙ্গ পছন্দ করে দুর থেকে । কেবল দুর থেকে দেখে তাকিয়ে । আলোতে একদম আসে না । আলো দেখলেই গায়েব হয়ে যায় । অন্ধকারে থাকে । মূলত মানুষকে ভয় দেখানোর কাজে একে ডেকে আনা হয় । কাউকে ভয় পাইয়ে কোন স্থান থেকে তাড়াতে চাইলে এই ওটুলোর কোন জুড়ি নেই । শোনা যায় এই গেস্টহাউজে আগে এক বুড়ো দম্পত্তি থাকতো । স্বামীটা মারা যাওয়ার পরে বুড়িকে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে এই ওটুলোকে ডেকে আনা হয় । পুরো এড়িয়া নিয়ে নাকি কিছু করার করার পরিকল্পনা ছিল একটা কোম্পানীর । বুড়িকে জমিটা বিক্রির জন্য বলা হলেও সে বিক্রি করে নি । তাই এই পথ বেছে নেওয়া হয়েছিলো । বুড়ি তো বাড়ি ছেড়ে গেলই না উল্টো ঐ ওটুলোর সাথে ভাব হয়ে গেল !

আমি আর সারাহ দুইজনই এক সাথে বলে উঠলাম, ভাব হয়ে গেল মানে?
কেয়ারকেটার বলল, ভাব হয়ে গেল মানে হচ্ছে স্বামীর মৃত্যুর পরে ভদ্রমহিলা অনেক একা হয়ে গিয়েছিলেন । ঐ ওটুলো যখন আসতো রাতের বেলা তখন এই বারান্দা থেকে মানে আপনারা এখন যেখানে বসে আছেন, সেখান থেকেই ঐটার সাথে কথা বলতো । মানুষের নিঃসঙ্গতা বড় ভয়ানক জিনিস ! নানান খাবার জিনিস ছুড়ে দিতো ওটার দিকে । ওটুলো চুপচাপ বসে থাকতো ওভাবে । ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে থাকতো । সম্ভবত সে নিজেও এমন আচরণ আশা করে নি । এমন আচরণ পেয়ে নিজেও খানিকটা বিস্মিত এবং তারও মনে হয় ব্যাপারটা পছন্দের ছিল । এভাবেই চলল যতদিন মহিলা বেঁচে ছিলেন !

আমি বললাম, এসব তোমরা কিভাবে জানো?
-মহিলা একেবারে অসামাজিক ছিলেন না । সপ্তাহে অন্তত একবার সে বাইরে বের হত সমবয়সী বৃদ্ধদের সাথে দেখা করতে । আমি এখানকার স্থানীয় । আমার কানেও এসেছে এসব । পরে যখন এখানে কাজ নিলাম । আমি প্রথম দিনই দেখতে পেলাম সেটা । সন্ধ্যা বেলা এই উঠোনটা অন্ধকার হলেই সেটাকে দেখা যেত । জানেন এই পেছনের উঠোনের কোন বাতি ছিল না । একদম না । যতগুলো ছিল সব খুলে ফেলা হয়েছিলো । বৃদ্ধ মহিলা ইচ্ছে করেই যে এটা করেছিলেন সেটা বুঝতে কষ্ট হয় নি । পরে আমি অফিসে বলে আবার নতুন করে বাতি লাগিয়েছি । তবে মাঝে মাঝে যখন পাওয়ার কাট হয়ে যায় তখন সে ঠিকই চলে আসে । তাকিয়ে থাকে !


কেয়ারটেকার চলে গেল । আমি আর সারা আরও বেশ কিছু সময় বসে রইলাম বারান্দায় । আজকে কেন জানি আমাদের কারোই আর একদম ভয় করলো না । একা একা বেঁচে থাকাটা সত্যিই বড় বেশি কষ্টের । বিদেশে এসে আমি সেটা টের পেয়েছি হাড়ে হাড়ে ।
আমি সারাহর দিকে তাকালাম । সে তখনও তাকিয়ে রয়েছে সেই ওটুলোর দাড়ানোর জায়গাটার দিকে ।
মানুষের মত করে অশরীরিরাও কোন কিছুর মায়ায় পড়ে? আমরা আমাদের পুরো জীবন কাটিয়ে দেই এই একটু মায়ার কারণে । বারবার সেখানে বা তাদের কাছে ফিরে যাই যেখানে বা যারা আমাদেরকে একটু মায়া দেখিয়েছিল । এই অশরীরিটাও কি সেই মায়ার কারণে আসে এখানে ! সেই পরিচিত মুখটাকে খোজার চেষ্টা করে? একবার মায়ায় পড়ে গেলে সেই মায়া কাটানো বড় মুশকিল !


পরিশিষ্ট

স্কটল্যান্ড থেকে আসার পর থেকে সারাহ খানিকটা মিশুক হয়ে উঠলো সবার সাথে । এবং বলাই বাহুল্য যে সবার থেকে আমার সাথে মেশার পরিমান টা একটু অন্য রকম ছিল । তবে সেটা অন্য কোন গল্প । দুইমাস পরে আমি আর সারাহ আবারও স্কটল্যান্ড গিয়ে হাজির হয়েছিলাম সেই ওটুলোর সাথে দেখা করতে । গেস্ট হাউজটা অন্ধকার করে আমরা তার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম অনেকটা সময় । তবে এইবার কেন জানি সে আর আসে নি । আমাদের অপেক্ষা করাটাই সার হয়েছে । কেয়ারটেকার জানালো যে কদিন থেকে অন্ধকার হলেও সেটাকে আর দেখা যাচ্ছে না । কেন যাচ্ছে না কে জানে !

ভুয়া মফিজের পোস্ট দুইটি
ওয়েলস রাজ্যে গমন, ভ্রমন এবং একটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা
একজন ''বিলাতি সারাহ''র গল্প!!!
গল্পটি আগেই আমার ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হয়েছিল ।


picture source
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১:২৬
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×