সুন্দরবনে সাধারনত তিন ধরনের ট্যুর দেওয়া যায় । প্রথম ধরণটা সর্ট ট্যুর । মোংলা বন্দরে যাবেন । সেখান থেকে ট্রলার ভাড়া করে করমজল গিয়ে হাজির হবে । কিছু সময় বনের ভেতরে ঘুরেটুরে ফেরৎ চলে আসবেন আবার মোংলাতে । সেখান থেকে বাড়ি । দ্বিতীয় ধরনটা হচ্ছে বড় শীপে করে সুন্দরবনের ভেতরে ঘোরাফেরা করা । এটা তিনদিনের একটা ট্যুর । সাধারণত শুরু হয় খুলনা থেকে । মোংলাতেও সম্ভবত রয়েছে । আর তৃতীয় ধরণের ট্যুরটা হচ্ছে সুন্দরবনের কোল ঘেসে বেশ কিছু রিসোর্ট তৈরি হয়েছে এখন । সেই রিসোর্টে গিয়ে হাজির হওয়ার । উপরের দুই ধরণের ট্যুর আমি গিয়েছি আগেই । এইবার ঠিক হল রিসোর্ট ট্যুর হবে ।
আমার যদিও এই আরামের ট্যুর ঠিক পছন্দ না । আমার ঘোরাঘুরির জন্য প্রথম পছন্দ হচ্ছে যেখানে থাকার জন্য আরামের কোন ঘর থাকবে না, যাওয়ার জন্য কোন আরামের বাহন থাকবে না । যেতে হবে পায়ে হেটে পরিশ্রম করে । এমন ট্যুর গুলোই আমার পছন্দ । আরাম করার জন্য আমার নিজের ঘরই তো রয়েছে । টাকা খরচ করে বাইরে যাওয়ার কোন দরকার আছে কি ! আমাদের ঘোরাঘুরির জন্য একটা গ্রুপ রয়েছে। তাদের সাথেই সাধারণ সব স্থানে যাওয়া হয় । তারা ঠিক করলো যে এবার একটা আরামের ট্যুর হোক । সুন্দরবনের ভেতরে বৃষ্টি বিলাশ হোক । একবার মনে হল যে না যাই । কিন্তু পরে রাজি হয়ে গেলাম ।
আমাদের প্রথম গন্তব্য হল মোংলা বন্দর । কয়েক ভাবে ঢাকা থেকে মংলাতে যাওয়া যায় । বেশির ভাগ মানুষই আগে খুলনা কিংবা বাগেরহাট গিয়ে হাজির হয় । তারপর সেখান থেকে মংলা বন্দরে । কারণ ঢাকা থেকে মংলা বন্দর সরাসরি ভাল বাস নেই । তবে আমরা সরাসরি মংলাতেই যাবো এই সিদ্ধান্ত নিলাম । শুক্রবার সকালে সায়দাবাদ জনপদের মোড় থেকে বাসে উঠলাম । বাস ছিল সাড়ে সাতটার । আমাদের গ্রুপের দুইজন আসতে লেট করলো । বাস ছাড়লো আটটার সময়ে । পদ্মাসেতুর উপরে আমি এই প্রথমবার উঠলাম । পদ্মাসেতুর কল্যানে সাড়ে চার ঘন্টায় আমরা গিয়ে হাজির হলাম মংলা বন্দরে । সেখান থেকে আমাদের জন্য রিসোর্টের বোট ঠিক করা ছিল। তবে আমাদের সাথে আরো একটা গ্রুপ যাওয়ার কথা ছিল । তাদের বাস এল আরো আধা ঘন্টা পরে । দুই গ্রুপ নিয়ে বোট ছেড়ে দিল । পশুর নদীর কোল ঘেষে আমরা যাত্রা শুরু করলাম । ঘন্টা দেড়ে লাগলো আমাদের রিসোর্টে পৌছাতে । মোটামুটি উপর থেকে রিসোর্টটা দেখতে এমন লাগে ।
ছবিটা রিসোর্টের ফেসবুক পেইজ থেকে নেওয়া । আমাদের কাছে কোন ড্রোন ছিল না তাই এমন ছবি তোলার উপায় ছিল না ।রিসোর্টের আরো ছবি দেখতে ওদের ফেসবুক পেইজে ঢু মারতে পারেন ।
আমরা এসে হাজির হলাম ইরাবতী ইকো রিসোর্টে । এটা এই বছরের শুরুতেই চালু হয়েছে । গেস্ট বুকে নাম সই করতে গিয়ে দেখি মোটামুটি আমাদের নিয়ে সাড়ে ৬শর বেশি গেস্ট এসেছে এই পর্যন্ত । আমাদের স্বাগত জানালো হল ওয়েলকাম ড্রিংক দিয়ে । তারপর আমাদের ঘর দেখিয়ে দেওয়া হল । রিসোর্টে দুই ধরনের ঘর বিদ্যমান । একটা হচ্ছে চারজনের বড় ঘর । অন্যটা দুইজন থাকার মত কাপল কটেজ । আমরা যেখানে ছিলাম সেটার নাম সুন্দরী । কটেজের নাম আরকি । এটা রিসোর্টের একেবারে সামনের দুইটা ঘরের একটা । মুলত এই ট্যুর আর কিছুই করার নেই । ফ্রেশ হয়ে আমরা খেতে খেলাম রিসোর্টের ক্যান্টিনে । এটা পেছনের দিকে অবস্থিত । খাওয়াটা হল বেশ । প্রথমদিন ছিল হাসের মাংস দিয়ে সাদা ভাত । সাথে নানান পদের তরকারি আর ভর্তা ।
কোন বেলায় কি খাবো ওদেরকে আগে থেকে বলে দিলে সেটা ওরা ম্যানেজ করার চেষ্টা করে । যদিও ওদের রান্নায় লবন হয় কম । খাওয়ার সময় আলাদা ভাবে লবন নিয়ে নিতে হবে
এই ট্যুর পুরো সময়টাতেই আমরা কেবল রিসোর্টের ভেতরেই কাটিয়েছি । আমি সাথে করে বই নিয়ে গিয়েছিলাম । সেই বই পড়ে সময় কেটেছে । বিশেষ করে বৃষ্টি ছিল প্রায় পুরোটা সময় । রিসোর্টের বারান্দায় বালিশ নিয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছি আর বাইরে বৃষ্টি পড়ছে । এমন সময় আর কখনও আসবে বলে মনে হয় না । সময়টা এতো চমৎকার কেটেছে । আমার সাথে লোকজন অবশ্য মোনোপলি খেলে সময় কাটিয়েছি । সাথে তিনটা বই নিয়ে গিয়েছিলাম আমি তার ভেতরে দুইটা পড়ে শেষ করে ফেলেছি ।
পরের দিন অর্থ্যাৎ শনিবার সকালে নাস্তার পরে আমরা গিয়েছিলাম ক্যানাল ক্রুজে । নৌকা নিয়ে আমরা সুন্দরবনের খালের ভেতরে ঢুকে পড়লাম । একেবারে নির্জন সব কিছু । কেবল মাঝে মাঝে বানর দেখা যাচ্ছে । আপনারা রাতারগুল গেলে এমন একটা ফিল পাবেন । তবে এটা বেশি ভাল মনে হবে আপনাদের কাছে । ঐদিন বৃষ্টি হয়েছিলো প্রচুর । রিসোর্টের সামনে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকার ভেতরে আলাদা একটা মজা ছিল । একই দৃশ্য অথচ বারবার মনে হচ্ছিলো সব কিছু ভাবে আসছে ।
পরের দিন রবিবার আমাদের ফিরে আসার পালা । ফিরে আসার সময় আমরা করমজল হয়ে এলাম । যদিও এখানে আমার নামার ইচ্ছে ছিল । আগে বেশ কয়েকবারই করমজলে আমি এসেছি। কিছু ছবি দেখা যাক ট্যুরের।
যাওয়ার পথে বোট থেকে তোলা । আমাদের সাথে অন্য যে গ্রুপটা ছিল তাদের ভেতরে একজন শিল্পি ছিল। ছবিতে তাকেই দেখা যাচ্ছে । পুরো যাত্রা সে বেশ ভাল বিনোদন দিয়েছে ।
নৌকা থেকে ইরাবতী ইকো রিসোর্টের ছবি ।
এই ঘরের একটা আমরা নিয়েছিলাম । মোট দুটা রুমের এক হচ্ছে কোনার দিককার একটা ঘর। অন্য রুমটা সামনের দিকে ।
রিসোর্টের সামনে বসে তোলাম । সামনের সুন্দরবন দেখা যাচ্ছে খালের ওপারে । আমরা খালের এই পাড়ে ।
একই স্থান থেকে সন্ধ্যার ছবি
রিসোর্টের ভেতরে বাঁশের রাস্তা । এক কটেজ থেকে অন্য কটেজে যাওয়ার জন্য এই বাঁশের রাস্তা রয়েছে ।
রিসোর্টের পেছনে আছে গ্রাম ।
গ্রামের ছাগল
গ্রামের হাস
ক্রজ ডিনার চালু ছিল এই নৌকাতে । তবে সেটা এখন সংস্কারের কাজ চলছে । আমরা এটা মিস করেছি । নয়তো এখানে রাতে ডিনার করা যেত ।
ক্যানাল ক্রুজের সময় সুন্দরবনের ভেতরে । জায়গা নির্জন আর সুন্দর ।
ফিরে আসার সময় করমজল গিয়ে হাজির হয়েছিলাম ।
এই যে হরিণ
দুইটা কুমির
ফিরে আসার পথে ।
মোট দুইদিন আমরা ছিলাম রিসোর্টে । বেশির ভাগ মানুষ অবশ্য একদিন থাকে ।
এটা পরিপূর্ণ ভাবে একটা রিল্যাক্স ট্যুর । এখানে প্রায় পুরোটা সময়ই আপনাকে থাকতে হবে রিসোর্টের ভেতরে । পেছনে অবশ্য গ্রাম আছে একটু দুরে । সেখানে বাজার আছে । চাইলে সেখানে ঘুরে আসতে পারেন । বৃষ্টির কারণ পথ ঘাত কাঁদা ময় আর পিচ্ছিল ছিল । তাই আমরা বাইরে বের হয় নি । তবে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম একটা লম্বা সময় । তখন অবশ্য গ্রামের রাস্তায় হেটে বেড়িয়েছি । পাশেই একটা দোকান আছে । সেখান থেকে চা কফি কোক বিস্কিট খাওয়ার ব্যবস্থা আছে । এছাড়া প্রতি সন্ধ্যা বেলা রিসোর্ট থেকেই ঝাল মুড়ি দেওয়া হয় । রাতে চাইলে বার্বিকিউ করা যায় ।
কাপলটা একান্তই নিজেদের ভেতরে সময় কাটাতে চাইলে যেতে পারেন এই ট্যুর । এছাড়া বন্ধুবান্ধবরা আড্ডা দেওয়ার জন্য এই ট্যুর যেতে পারেন । ফ্যামিলি নিয়ে গেলে বাচ্চারা বোর হয়ে যাবে খুব জলদিই কারণ যাওয়ার যায়গা নেই । তবে একদিনের ট্যুরে অবশ্য যাওয়াই যায় পরিবারের সকলের সাথে এক সাথে সময় কাটানোর জন্য ।
যাওয়ার সিস্টেমও বেশ ভাল । এখন পদ্মাসেতু হওয়ার কারণে খুব জলদিই ঢাকা থেকে যাওয়া যায় । সরাসরি মংলা । তারপর সেখান থেকে বোট ভাড়া করে রিসোর্টে ।
খরচও খুব বেশি না । আমরা একটা প্যাকেজে গিয়েছিলাম । এখানে মংলা থেকে বোটে করে যাওয়া, ক্যানাল ক্রুজ ফিরে আসার সময় করমজল হয়ে আবার মংলা, সেই সাথে তিন বেলা খাওয়া, থাকা এই সব ছিল জন প্রতি সাতাশ'স টাকার মত । এটা এক রুমে চারজনের জন্য । আর কাপল যে রুম সেটার জন্য জন প্রতি চার হাজার টাকার কাছাকাছি । তবে প্যাকেজের বাইরে খরচ আরো একটু বেশি । আগস্ট মাস পুরোটা এই প্যাকেজ চলছে ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০২৩ বিকাল ৫:৫০