১৫ই আগস্ট ক্যু এর যখন মোশতাক আহমেদ রাষ্টপতি হল তখন এমন রটনা রটে যে অভ্যুত্থানের পেছনে আমেরিকার হাত রয়েছে। বিশেষ করে সেই সময়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রদুত আলেক্সণ্ডার ফোবিনের অনুপ্রেরণায় বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদুত নিকোলাই বয়ডিজেভসহ অন্যান্য কম্যুনিস্ট দেশ গুলো এমন প্রচরণা চালাতে থাকে । তাদের কাছ থেকে একটা প্রশ্নই বারবার আসতে থাকে । মুজিব হত্যাতে আমেরিকা ছাড়া আর কার কার লাভ হয়েছে ?
সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রাশনেয়া ভেজদা পত্রিকার প্রথম পাতায় ২২ আগস্ট একটি নিবন্ধ ছাপা হয় । সেই লেখায় ১৫ আগস্টের ক্যু দেবতাকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাজ বলে আখ্যা দেওয়া হয় । এটি ছিল তাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালের বক্তব্য। তবে সুনিদিষ্ট ভাবে আমেরিকা বা সিআইএয়ের নাম নেওয়া হয় নি । তবে ইঙ্গিতটা সেদিকে ছিল স্পষ্ট।
এই সময়ে ভারতীয় গনমাধ্যমেও আমেরিকার দিকে আঙ্গুল তোলা হয় সরাসরি । ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকাতে বরুন গুপ্ত যে কাহিনী লেখেন তাতে ১৫ই আগস্ট ক্যু এর সাথে আমেরিকার সংশ্লিষ্ট করা হয়। তখন আমেরিকা এই ভাষ্যের প্রতিবাদ করে । ভারতে নিয়োজিত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ইউলিয়াম স্যাক্সবি পশ্চিম বাংলার মূখ্য সজিব অশোক গুপ্তকে ২১ শে আগস্ট বলেন যে আমেরিকা কিংবা আমেরিকার কোন এজেন্সি এই ঘটনার সাথে যুক্ত নয় ।
আমেরিকা বরাবর এই অভিযোগ অস্বীকার করেই আসছে । এমন কি তারা এই বিষয়ে কোন কিছু জানতো না সেটাও প্রচার করে আসছে । তবে আমেরিকা জানতো কিংবা তাদের কাছে এর তথ্য ছিল ভাসা ভাসা হলেও । অন্তত পনের মাস আছেই ঢাকার আমেরিকান দূতাবাস এমন একটি অভ্যুত্থানের কথা শুনেছিলো । ১৯৭৪ সালের ১৩ই মে ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সার ফারুক আগে থেকে না জানিয়েই দূতাবাসের জনসংযোগ অফিসার উইলিয়াম গ্রেসামের বাসায় যান । সেখানে গিয়ে তিনি জানান যে তিনি উর্ধতন সেনা কর্মকর্তাদের নির্দেশে এসেছে আমেরিকানদের মনভাব সম্পর্কে জানতে । ফারুক গ্রেসামের কাছে জানতে চান যে বর্তমান সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা গ্রহন করলে আমেরিকার মনভাব কেমন হবে? এছাড়া আরো জানতে চান যে বিদেশ কোন বহিঃশক্তি যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে এই দিকটা আমেরিকা দেখবে কিনা !
গ্রেসাম তাকে জানায় যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে আমেরিকা নাক গলাবে না ।
ফারুকের এই হঠাৎ সাক্ষাতের ব্যাপারে স্টেট ডিপার্টোমেন্টকে জানালো হলে তারা এটাকে অস্বাভাবিক বলেই মনে করে এবং তারা এটাকে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে নি । কারণ দুই বছরে আরো কয়েকবার দূতাবাসের কানে এই রকম ক্যুয়ের কথা এসেছে ।
তবে তবে ২০১০ সালে স্টের ডিপার্টমেন্টের একটি গোপন দলিল থেকে দেখা যায় ক্যু -এর পরিকল্পনা হয়েছে সেনা বাহিনীর মধ্য থেকে । তবে এতে আর কিছু বিষদ ভাবে লেখা নেই । এর আগেও অনেক রিপোর্টে আমেরিকা পেয়েছিলো । তাদের ধারণা ছিল ক্যু হতে পারে ২১ মার্চ থেকে ১৮ই এপ্রিলের ভেতরে ।
২০ মার্চ স্টেট ডিপার্টমেন্ট ঢাকার দূতাবাসের কাছে জানতে চায় যে স্বল্প মেয়াদে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহনের সম্ভবনা আছে কিনা ! এছাড়া শেখ মুজিবকে হটিয়ে, জেলে নিয়ে, হত্যা করে কিংবা জোর পূর্বক বিদেশ পাঠানো হলে পরববর্তিতে কী অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে? এছাড়া, স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানতে চায় যদি অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয় বা ফাঁস হয়ে যায় তাহলে বাংলাদেশ সরকারের গতি প্রকৃতি কী হবে? এছড়াও আরো নানান বিস্তারিত তথ্য তারা ঢাকার মার্কিন দূতাবাসকে দিতে বলে । এরই প্রেক্ষিতে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস স্টেট ডিপার্টমেন্টকে আট পাতার একটি জবাব দেয় । সেখানে ডেপুটি চিফ অব মিশন আরভিং চেসলো উল্লেখ করেন যে ২১শে মার্চ থেকে ১৮ই এপ্রিলের ভেতরে অভ্যুত্থান ঘটতে পারে । বাকশাল গঠনের আগেই এমনটা ঘটতে পারে বলে চেসলো জানান । আমেরিকান দুতাবাস ধারণা করেছিলো যে যখন শেখ মুজিব একদল গঠন নিয়ে ব্যস্ত থাকবে তখনই হয়তো অভ্যুত্থান ঘটবে।
তবে তারা সন্দেহ করেছিলো যে হয়তো তরুন অফিসাদের দিয়ে এই অভ্যুত্থান সফল নাও হতে পারে । এমন অভিজ্ঞতা অফিসাদের ছিল না বলেই দূতাবাস মনে করেছিলো । তবে সেই সাথে চেসলো একেবারে সম্ভবনা উড়িয়েও দেয় নি । তার মতে যদি সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ হয় তবে এটা সফল হতে পারে ।
চেসলো সর্ব শেষ লিখেছেন কথিত অভ্যুত্থান সফল হোক বা ব্যর্থ হোক তাতে বাংলাদেশের ও উপমহাদেশের স্থিতিশীলতার উন্নয়নে আমেরিকার স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্থ হবে, ভারতের হস্তক্ষেপের কারণ ঘটতে পারে ।
২২ অক্টোবর ফারুক এবং রশিদ আমেরিকান দূতাবাসের পলিটিক্যাল কাউন্সেলের সাথে তার বাসায় দেখা করেন । তারা জানতে চায় যে সেনাবাহিনীকে যন্ত্রপাতি দিয়ে আমেরিকা সাহায্য করবে কিনা । কাউন্সেলর বলেন যে তার বর্তমান অবস্থা থেকে এটা জানানো সম্ভব না । তিনি স্টেট ডিপার্টপার্টমেন্টকে অবহিত করবেন । তারা বলতে পারবে । তখন ফারুক জানতে চায় যে যদি এমন প্রস্তাব দিলে আমেরিকা রাজি হবে কিনা সেই ব্যাপারে তার মত কি ! সেই ব্যাপারেও কাউন্সেলর কিছু বলতে পারেন নি।
ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের খবর যখন ইন্দিরা গান্ধী পান তখন তিনি খুবই হতাশ হন । তবে তখনও তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরিনে সরাসরি হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি । দিল্লিতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের রিপোর্টেও তারা জানান যে তাদের কাছে মনে হয় নি যে এই ক্যু'য়ের পরে ভারত আক্রমন করবে ! ১৬ই আগস্ট কলকাতাস্থ আমেরিকান কনসাল জেনারেলের প্রেরিত রিপোর্টের বর্ণনা অনুযায়ী - বাংলাদেশের ক্যু - এর প্রেক্ষিতে ভারতীয় ইস্টার্ন আর্মি কমাণ্ডের কোনো প্রকার পদক্ষেপ নেওয়ার আলামত আমরা দেখি নি বা শুনি নি । বাংলাদেশের ক্যু এর ঘটনায় সিরিয়ার আর্মি অফিসারদের নিরুদ্বেগ অবস্থায় দেখেছি । তারা এ নিয়ে কোন কথা বলেন নি ।
২৬ শে আগস্ট ভারত এই ব্যাপারে প্রথম মুখ খোলে । ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাস সজিব রনেন সেন আমেরিকার রাষ্ট্রদূত বোস্টারকে বার্তা পাঠান যে - বাংলাদেশে ভারতের একমাত্র স্বার্থ হচ্ছে স্থিতিশীলতা বজায় থাকা । বাংলাদেশ সরকার কী পদ্ধতির হবে অর্থনীতির ধরণ কী হবে তা নিয়ে ভারতের আগ্রহ নেই । তবে হিন্দু জাতি গোষ্ঠী যদি হুমকির মুখে পড়ে তা হলে নয়াদিল্লীর কাছে তা গভীর উদ্বেগের কারণ হবে।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
১৫ আগস্টের পরে পাকিস্তানের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল আনন্দে ভরা । এতে ধারণা করা হয় যে হয়তো এই ক্যু-এর পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে । নতুন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরেই ভুট্টো বাংলাদেশের জন্য ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল এবং ১ কোটি গজ লংক্লথ অনুদান হিসাব পাঠায় । এবং পাকিস্তান বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় । এবং ওআইসি ভুক্ত দেশ সমূহের এই সরকারকে স্বীকৃতি দিতে আহবান জানায় । এবং খন্দকার মোশতাককে এই বলে আশ্বস্ত করে যে যদি ভারত সামরিক অভিজান চালায় তাহলে পাকিস্তান বাংলাদেশের পাশে থাকবে। তবে পাকিস্তানের উচ্ছ্বাসে কিছুটা ভাটা পরে যখন নতুন সরকার বাংলাদেশের নামের সাথে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র যুক্ত করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসে ।
---------০---------
আপনারা হয়তো খেয়াল করে দেখে থাকবেন স্কুল কলেজ গুলোতে আমাদের দেশের ইতিহাস যখন পড়ানো হয় তখন সে সেই পাল সেন আমল থেকে শুরু হয় । তারপর ব্রিটিস পরে পাকিস্তানি আমল । এবং দেশ স্বাধীনের পর হঠাৎ করে আমাদের দেশের ইতিহাস নিয়ে আর কেউ কোন কথা বলে না । অথচ দেশের সব থেকে টুইস্টেড ইতিহাস হচ্ছে স্বাধীনতা পর থেকে পর থেকে এরশাদ ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত সময় । এতো এতো ঘটনা এর ভেতরে ঘটেছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না । আমার এই বিষয় আগ্রহ হয়েছে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বই পড়ার পর থেকে । এই পর্যন্ত ১৪/১৫টার বেশি বই পড়া হয়েছে কেবল এই এই সময়ের ইতিহাস নিয়ে । গত মাসে পড়েছি মুনতাসিনার মামুনের বই ষড়যন্ত্রের রাজনীতিঃ বাংলাদেশের দুই রাষ্ট্রপতি হত্যা বইটি । উপরের যে লেখা টুকু পড়লেন সেটা লেখা হয়েছে বর্তমানে পড়তে থাকা একটা বই থেকে । বইয়ের নাম ''বাংলাদেশে মিলিটারি ক্যু'' । বইয়ের লেখক বিজেড খসরু । বলতেই হচ্ছে যতগুলো বই পড়েছি তার ভেতরে এটাতে তথ্য উপাত্ত সব থেকে বেশি । এটা শেষ হলে আরেকটা বই লিস্টে রয়েছে । ঐ সময়ের ইতিহাস নিয়ে আপনাদের পড়া বইয়ের নাম কমেন্টে জানাতে পারেন । আমি সংগ্রহ করে পড়ার চেষ্টা করবো ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০২৩ দুপুর ১২:৫৯