ছোট বেলার একটা ঘটনা মনে আছে । আমি তখন কোন ক্লাসে পড়ি সেটা মনে পড়ছে না । আমার বাবা তখনও ব্যবসায় নামেন নি । একজনের আন্ডারে চাকরি করতেন । তখন বাবার খুব বদলি হত । আজকে এখানে ও কাল সেখানে । তখন তার পোস্টিং জয়পুরহাটে । আমরা থাকি চুয়াডাঙ্গাতে । আমার বড় ভাই তখন পড়ালেখার নাম গন্ধ নেই । সারাদিন খেলা ধুলা নিয়ে আছে । বাবা দূরে থাকলে যা হয় । ঠিক হল যে তাকে আব্বার কাছে যেতে হবে ।
সব দিনক্ষণ ঠিক হল । নির্ধারিত সময়ে যখন বাসা থেকে ট্রেন স্টেশনের দিকে রওয়ানা দেওয়া হল আমার মনের ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি এসে জড় হল। আমার কান্না যেন থামে না । অথচ তার সাথে আমার সব মারামারি লেগেই থাকত এটা সেটা নিয়ে । পরিবারে দুই ভাই থাকলে যা হয়। অথচ আমার তখন মনে হচ্ছিল যে আমার যেন কী দূরে চলে যাচ্ছে । আমার কান্না দেখে আমার মা আমাকে নিয়ে আবার চল স্টেশনে । শেষবারের মত আরেকবার ভাইয়ের দেখা হবে । অথচ খুব যে দূরে যাচ্ছে তাও কিন্তু না । ট্রেনে উঠলে এক ট্রেনে সরাসরি আমাদের কাছে চলে আসা যায় ।
এরপরে অবশ্য একটু বড় হওয়ার পরে ছোট বেলার সেই আবেগ অনুভূতি আর ছিল না । মানে ঐ ভাবে আর নিজের অনুভূতি সবার সামনে আমি আর প্রকাশ করি নি । যখন ক্লাস নাইনে পড়ি সে একবার গেল সিঙ্গাপুর গেল । বাসা থেকে সবাই গেল তাকে সি-অফ করতে । আমি গেলাম না । আমাকে কয়েকবার বলার পরেও গেলাম না । আমি বাসাতেই রয়ে গেলাম একা । তবে সেই দিন রাতে সবাই যখন চলে গিয়েছিল আমার মন কি খারাপ হয়েছিল? আমার মনে নেই । হয়েছিল নিশ্চয়ই । ব্যাপারটা অদ্ভুত না? তার থেকেও আগের ঘটনা আমার মনে আছে অথচ সেই ক্লাস নাইনের ঘটনাটা আমার মনে নেই ।
গতকাল আবারও সে দেশের বাইরে গেল । বাপের ব্যবসা তার করার ইচ্ছে নেই । সাথে করে ভাবি এসেছে আর আমি । যখন সে গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল মনের ভেতরে সেই অদ্ভত অনুভূতি এসে জমা হল আবার ! এমন না যে তার তার সাথে আমার প্রতিদিন কথা হয় । বরং উল্টো। আমি যখন বাসায় যাই তখনও তার সাথে কথা হয় না খুব একটা । অবশ্য আমার কারো সাথেই খুব একটা কথা হয় না । আমি গেটের দিকে কেবল তাকিয়ে রইলাম যেন আরও একটু তাকে দেখা যায় । কিন্তু বেশি সময় আর দেখা গেল না । সে ভেতরে চলে গেল ।
ফেরার পথে পুরো পথ মনের ভেতরে একটা গুমট ভাব চেপে রইল। আমার মা আমাকে বলে আমার মনে মায়া দয়া কম । হয়তো কম । অথবা আমি হয়তো দেখাতেই পারি না । ছোট বেলা আমরা যত সহজে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি বড় হয়ে গেল সেসব আর পারি না । কোথায় যেন আটকে থাকে । একবার মনে হয়েছিল যাওয়ার সময় তাকে জড়িয়ে ধরে বলি যে চিন্তা নেই এদিকে আমি সব দেখে রাখব। তোর ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না । তার পড়াশোনার দিকটাও দেখব আমি । এতো মানুষ পড়িয়ে মানুষ করিয়ে ফেললাম আর নিজের ভাইয়ের ছেলেকে পড়াতে পারব না ! বলতে পারলাম না । কেন পারলাম না কে জানে !
এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে ভাবিকে পৌছে দিয়ে ফিরে এলাম । আর কোন কাজ ছিল না । ঘরে ফেরার একটু তাড়া ছিল কারণ একটা অনুবাদের কাজ তখন বাকি । রাতের ভেতরে জমা দিতে হবে । বাসায় না ঢুকে আশে পাশের রাস্তায় ঘাটতে লাগলাম কোন কারণ ছাড়াই । এই সময়ে আমার কেবল খাওয়া দাওয়া করতে ইচ্ছে করে । মনের ভেতরে যখন স্বাভাবিক ভাবে কাজ কর্ম চলে না তখন খাওয়া আমার পছন্দের কাজ । পেট ভরলে আস্তে আস্তে সব কিছু শান্ত হয় ।
সকালে ঘুম থেকে উঠলে হয়তো আবার সব কিছু আগের মত হয়ে যাবে । অনুভূতিটা মনের অন্ধকার কোন গলিতে পড়ে থাকবে । এটা হয়তো আমার পরিবারের কেউ কখনই জানতেও পারবে না । কাল দুপুরে হয়তো মা আবার ফোন করে বলবে তোর মনে কি মায়া দয়া নেই । ভাইডা চলে গেল একটু মনও খারাপ করলি না !
আমিও হয়তো বলব, এসব এসব মনটন খারাপ করে কোন লাভ আছে ! গেছে আবার চলে আসবে !
আমি ঠিক করেছি সে একটু সেটেল হলেই আমিও চলে যাব তার কাছে । আমি যখন এয়ারপোর্টে যাবো তখন কাউকে সাথেই নিব না । কাউকে বলবই না । ওখানে একেবারে পৌছে তারপর সবাইকে জানাব। বাসায় ফোন করে বলব সারপ্রাইড ! দেশ ছেড়ে চলে এসেছি । তখন তারা কান্না কাটির বদলে আমার উপরে রাগ বেশি করবে । কান্নার থেকে শকের ব্যাপারটা বেশি ভাল ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০২৪ সকাল ৯:৫৯