আমি যে হাউজিংটায় থাকি, সে হাউজিং এ খুব মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রায় দিনই মসজিদের মাইকে মোয়াজ্জিন সাহেবের কন্ঠস্বর ভেসে আসে সময়ে অসময়ে ।
একটি শোক সংবাদ । একটি শোক সংবাদ ।
অথচ আমি যতবার মাইকে তার কন্ঠে এই কথা গুলো শুনি আমার মনে হয় তিনি বলছেন 'একটি সুখ সংবাদ' । সত্যি সত্যিই আমি প্রথম যেদিন শুনেছিলাম সেদিন আমার সুখ সংবাদই মনে হয়েছিল ।
আগে কালে ভাদ্রে এই শোক সংবাদের শুনানি আসত। কিন্তু কদিন থেকে ঘন ঘন শোনা যাচ্ছে।
আজকে সন্ধ্যার একটু পরে বের হয়েছি। উদ্দেশ্য ছিল সন্ধ্যার নাস্তা শেষ করে একেবারে রাতের খাবার নিয়ে তারপর ফিরব। গলির মাথায় আসতেই মাইকে আওয়াজ ভেসে এল ।
একটি শোক সংবাদ ! একটি শোক সংবাদ!
ঠিক দুইদিন আগে একজন মারা গিয়েছিল । তারও একদিন আগে আরেকজন মারা গিয়েছিল । গত সপ্তাহেও একজনের মারা যাওয়ার কথা মনে আছে।
আমাদের গ্রাম কিংবা গ্রামের আশে পাশে যখন কোন মানুষ মারা যায় তখন গ্রাম ভর্তি মানুষ তার বাসায় গিয়ে হাজির হয় । তাকে শেষ বারের মত দেখতে। আশে পাশের গ্রাম থেকেও মানুষ যায় সেই বাড়িতে।পুরো গ্রাম জুড়ে একটা অন্য রকম পরিবেশ তৈরি হয় ।
আমার ইদানীং মাঝে মাঝেই মৃত্যুর কথা মনে হয় । মনে হয় যে হয়তো আমি একা একাই মারা যাব। এটা নিয়ে অবশ্য আমার খুব একটা দুঃখবোধ নেই। আমি এমনিতেও খুব বেশি মানুষজন পছন্দ করিও না। আর মরে গেলে এর পরে কি হবে সেটা চিন্তা করে আর লাভ কি !
মৃত্যুর কথা এলেই আমি মনে মনে হিসাব করে দেখি জীবনে কী পেলাম আর কী পেলাম না । আমার চাহিদা কোন কালেই খুব বেশি ছিল না । এখনও নেই । সবাই বলে বড় স্বপ্ন দেখো, জীবনে উন্নতি কত সফল হও! আমার সত্যি এসব নিয়ে কোন দিন কোন মাথা ছিল না । আমি কোন দিন কিছু হতে চাই নি । যা কিছু তার বেশির ভাগই আমার পরিবারের কারণে। তারা চেয়ছে বলে করেছিলাম, করতে হয়েছে । তবে কিছু জিনিস পাওয়ার ইচ্ছে ছিল জীবনে। সেসবের ভেতরে একটা জিনিস পাওয়া আর কখনও সম্ভব হবে না । এটা আমি আরও বছর চার আগে থেকেই জানি । সেটার আশা তখন থেকেই বাদ দিয়েছি। আমি সব সময় প্রাক্টিক্যাল। যা পাব না, যা আমার পক্ষে পাওয়া সম্ভব না এমন জিনিস নিয়ে আমি কখনও আফসোস রাখি না। আমার আফসোস কেবল সেই জিনিস গুলো নিয়ে যা আমার পক্ষে সম্ভব। আর বাকি যে একটা ক্ষুদ্র আশা ছিল মানে যে জিনিসটা না পেয়ে মরলে মনের ভেতরে একটা অফসোস থাকত, সেটা সম্প্রতি পূরণ হয়ে গেছে।
এটা নিয়ে একটা গল্প মনে পড়ল । ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি বান্দরবানের এক দুর্গম পাহাড়ে উঠেছিলাম । সেই সময়ে সে পাহাড়ে ওঠাটা সতিই ভয়ংকর ব্যাপার ছিল । ভোর চারটার দিকে উঠে আমাদের ট্রেকিং শুরু হয়েছিল। পাড়াতে ফিরে এসেছিলাম দশটার পরে। এই পাহাড়েই নামতে গিয়ে একটা সময়ে আমার হাত ছুটে গিয়েছিল । কয়েকটা সেকেন্ড আমি একেবারে নিচে পড়ছিলাম । সেই সময়ে আমার সত্যিই মনে হয়েছিল এবার বুঝি গেলাম সত্যি সত্যিই । তবে কপাল ভাল যে একটা বাঁশে আটকে গিয়েছিলাম। তবে সে হাত ছোটা আর বাঁশে আটকে যাওয়ার ভেতরের সময়ে একটা কথা আমার ঠিক মনে হয়েছিল । একটা আফসোস ! মনে হয়েছিল সেই কাজটা তো করা হল না !
সে আফসোস দুর হয়েছে। এখন যদি হুট করে মরে যাই কোন দিন, আমার কেন জানি মনে হয় যে হুট করে একদিন চলে যাব, তখন আমার নিজের কাছে কোন আফসোস থাকবে না। আমি চাই না, আমাকে নিয়ে আসলে কেউ শোক করুক । মৃত্যুর পরের শোক দিয়ে আসলে আমার কী দরকার টা । মৃত্যুর পরে আমাকে কেউ মনে না রাখলেও চলবে। এই পৃথিবীতে সবাইকেই মানুষ ভুলে যায় । কেউ মনে রাখে না।
একবার চিন্তা করে দেখেন, আপনি যত ভাল মানুষ আর যত মহানই হৌউন না কেন আপনাকে কিন্তু এক সময়ে সবাই ভুলে যাবে । আমি কেবল মাত্র আমার দাদার নাম জানি । তার চেহারা কেমন ছিল, কেমন স্বভাবের ছিল সেটা আমার জানা নেই। তার বাবা কে ছিল কোন ধারণাই নেই আমার । যদি স্বাভাবিক বয়সে মারা যাই, তাহলে আমার পরে কেবল মাত্র আমার ভাইয়ের ছেলে বেঁচে থাকবে। বুড়ো হয়ে মরলে তার সন্তান হয়তো আমাকে চিনবে কিন্তু তার সন্তানের সন্তান আমাকে চিনবে না। তার মানে আমার পরের দুই প্রজন্মের পরেই আমার নাম নিশানা এই পৃথিবী থেকে একেবারে মুছে যাবে।
অবশ্য একটু আগে যে বললাম যে মারা গেলে আফসোস থাকবে না, এই কথাটা সম্ভবত সত্যি না। আমার ঘরে আমার না পড়া বইয়ের সংখ্যা প্রায় দেড়শ । এ দেড়শ বই না পড়ে মরে গেলে একটা আফসোস থাকবে বই কি !
ছবি পিক্সেল থেকে সংগ্রহ করা
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:২৮