আজকে মোট চারদিন ইন্টারনেট ডাউন । ব্যাপারটা খানিকটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে । সরকার নিজের উদোম ঢাকতে আজকে গুনে গুণে চারদিন নেট বন্ধ করে রেখেছে ! আবার এদিকে পলক সাহেব মেসেজ দিয়ে জানাল যে সন্ত্রাসীরা নাকি নেটে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে এই জন্য নেট নাই । এরা নিজেরা যা সবাইকে কি তাই মনে করে? যদি সন্ত্রাসীদের আগুন লাগানোর জন্যই নেট চলে যাবে তাহলে একেক এলাকাতে একেক সময়ে নেট কিভাবে চলে যায় ? আমার বাসায় দুইটা লাইন, একটা বন্ধ হওয়ার আরো আধাঘন্ট পরে অন্যটা বন্ধ হয়েছে ! যাত্রা বাড়ির দিকে নেট বিকেল থেকে বন্ধ। এরা যে মিথ্যা বলে, একটু বুদ্ধিদ্বীপ্ত মিথ্যা তো বলতে পারে !
নেট ছাড়া থাকাটা অনেকের কাছেই অসম্ভব একটা ব্যাপার আমি জানি। এই যুগে এসে পুরো চারদিন শহরের নেট নেই, ব্যাপারটা সত্যিই অবিশ্বাসই । আমার অবশ্য এই ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে । যখন পাহাড়ে বেড়াতে যাই তখন দিনের পর দিন এই রকম নেট থাকে না । এখন তো তাও ফোন কিংবা ম্যাসেজ দিয়ে যোগাযোগ করা যাচ্ছে, পাহাড়ে এসবও বন্ধ। সেই হিসাবে দিন খারাপ যায় নি আমার ।
আমার মনে আছে যখন প্রথম মোবাইল ফোন হাতে এল সেই সময়ে আমি আমার বন্ধুবান্ধবের সাথে মেসেজ আদান প্রদান করতাম । ফোনে গল্প করা আমার কোন কালেই পছন্দের কোন কাজ ছিল না । আর তাছাড়া সেই সময়ে মিনিট ছিল সাত/আট টাকা । এতো টাকা খরচ করে আজুড়ে গল্প করার শখও আমার ছিল না । আমি তখন প্রচুর মেসেজ পাঠাতাম । সেই সময়ে মেসেজের বান্ডেল কিনে সবাইকে মেসেজ পাঠিয়ে খোজ খবর নিতাম । এই নেটওয়ার্ক বন্ধের ভেতরে সেই একই ভাবে সবার কাছে মেসেজ আদান প্রদান করছিলাম ।
প্রথম দিন কারফিউয়ের খবর আমি পাই নি। রাতেরবেলা সেদিন একটু আগেভাগেই নিচে নেমেছিলাম । সেইদিন বাসস্টান্ডে তুমুল গোলোযোগ হয়েছে শোনা যাচ্ছে । সেই হিসাবে এলাকার পরিবেশ বেশ থমথমে। আমি দ্রুত নিচে নেমে গেলাম খাবার হোটেলে । গিয়ে দেখি সে হোটেলের অর্ধেক সাটার নামানো। সবার মাঝে একটা চিন্তার ছাপ । একটু আগে নাকি এখানেও ঝামেলা হয়েছে । চারিদিকের প্রায় সব দোকান বন্ধ । আমি খাবার নিতে গিয়ে দেখি সেখানে প্রায় কিছুই নেই । আমি দ্রুত হোটেল থেকে বের হয়ে হাউজিংয়ের ভেতরের দিকে আরেকটা হোটেলে গিয়ে হাজির হলাম । দেখলাম সেখান গরম গরম পরোটা ভাজছে । তবে এছাড়া আর কিছুই নাকি নেই । আমি দ্রুত খাবার নিয়ে বাড়ির দিকে হাটা দিলাম ।
রাস্তার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কফি কিনব ভাবছিলাম কিন্তু অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে প্রতিটি দোকানেই প্রচুর ভীড় । সবাই কেনাকাটা করছে । আমি তখনও জানি না যে কারফিউ দিবে। তবে লোকজন সম্ভবত জেনে গেছে। আমি চেষ্টা করেও কোন দোকান থেকে কোণ জিনিস পত্রই কিনতে পারলাম না।
রাতে বাসায় ফিরে এসে পিসি চালু করলাম । খেতে খেতে নেট সার্চ করছি, প্রথমে আমার ডট ইন্টারনেট ডাউন হয়ে গেল । বাসায় মাজেদার লাইনও আছে । সেটা তখনও চলছে । তবে সেটাও বেশি সময় ধরে চলল না। কিছু সময় পরে দেখলাম সেটাও ডাউন । মোবাইল নেট তো আরও আগেই বন্ধ হয়েছে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আরও কোন কাজ খুজে পেলাম না । যদিও রাতে আমি দ্রতই ঘুমিয়ে পড়ি । আজকে আরও একটু জলদি ঘুমিয়ে পড়লাম ।
সকালে ঘুম ভাঙ্গল বেশ সকালে । প্রতিদিনের নিত্য রুটিন মোতাবেক ফ্রেশ হয়ে কফি তৈরি করলাম । তারপর সকালের নাস্তা সেরে পিসি অন করলাম। জানি তখনও ইন্টারনেট আসে নি । আজকে নেট ছাড়াই কাজ করতে হবে ।
তখনই পরিচিত একজনের কাছ থেকে মেসেজ পেলাম । আমার ফোনের হোয়াটসএপ আর সিমের মেসেজ টোন একই রকম । আমার মনে হয়তো নেট ফিরে এসেছে । কারণ জানি রাতে নেট অফ রাখলেও সকালে ঠিক নেট চালু হয়ে যায় । দেখলাম মেসেজ এসেছে । সেখান থেকেই জানতে পারলাম না কারফিউ দিয়েছে। আর তখনই আমার মনে হল শনিবার পর্যন্ত নেট আসবে না ।
সাড়ে বারোটার দিকে বাইরে বের হলাম । মনে একটা ভয় ছিল যে খাবার হোটেল বুঝি বন্ধ থাকবে । তবে সেরকম কিছুই হল না। দেখলাম গতরাতের হোটেলটা খোলা আছে । আর মানুষও নেই । দেরি না করে দুপুরের খাবার কিনে বাসায় চলে এলাম । এখন কেন জানি আর পিসি অন করতে মন চাইল না । চারদিকে কী হচ্ছে কিছু জানার কোন উপায় নেই । আজিমপুরে একজন বন্ধু থাকে । তাকে মেসেজ দিয়ে জানালাম যে ওদের রাতে অবস্থা ভাল ছিল না । তবে এখন শান্ত । এভাবে যাকেই জিজ্ঞেস করি সেখানে রাতের অবস্থা জানায় । বসিলা ব্রিজের কাছে এক বন্ধু থাকে সেখানেও নাকি একই অবস্থা ।
রাতের বেলা একটু ভয়ে ভয়েই বের হলাম খাবার কিনতে। দুপুরে কারফিউ শিথিল ছিল কিন্তু এখন তো আবার চলছে। কারফিউয়ের ভেতরে বাইরে বের হওয়ার ঝুকির ব্যাপার। তবে হাউজিংয়ের ভেতরে দেখতে পেলাম মানুষজন ঘোরাঘুরি করছে । আমি দ্রুত হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম । হোটেলটা একেবারে হাউজের গেটের বাইরে । একটু ভেতরের দিকে । তাই এদিকে লোকজন আসে না । গতদিনের মত দ্রুত খাবার কিনে ফিরে এলাম ।
সকাল বেলা হঠাৎ কুমিল্লা থাকা একজন বন্ধুর ফোন । তার ফ্লাইট রাতের বেলা । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তার এনওসি টিকিট কিছুই প্রিন্ট করা হয় নি । সব দোকানপত্র বন্ধ । আমার বাসায় প্রিন্টার আছে সে জানে । তাকে বাসায় নিয়ে এলাম । আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম সে কুমিল্লা থেকে ঢাকা এলো কিভাবে? সে জানালো গতকাল যে দুইঘন্টার ব্রেক দিয়েছিল সেই সুময়েই রওনা দিয়েছে। আমার বাসার গলির পাশেই ওর এক ছোট ভাই থাকে । রাতে সেখানেই ছিল । আমার কাছ থেকে সব কাগজপত্র প্রিন্ট করে নিয়ে সে দৌড়াল শ্যাওড়া পাড়াতে । সেখান থেকেই এয়ারপোর্টে যাবে রাতে।
আরেকটা মজার ব্যাপার হল এই কদিনে । অনেকদিন পরে নিয়মিত ভাবে রেডিও শোনা শুরু করলাম । বাইরের খবর পাওয়ার একমাত্র উপায় এই রেডিও । প্রতি ঘন্টা ঘন্টার খবর হচ্ছে সেটা শুনছি । স্কুলে থাকতে আমি রেডিও শুনতাম খুব । আমার কালো রংয়ের ছোট একটা এমএমএফএম ব্রান্ডের রেডিও ছিল। সেটা আমার অনেক পছন্দের ছিল । আজকে অনেক দিন পরে আবার নিয়মিত ভাবে বাংলাদেশ বেতারের গান আর সংবাদ শুনছি !
বাইরে বের হয়ে সব থেকে বেশি ভীড় দেখলাম মোবাইল রিচার্জের দোকানে । বিকাশ নগদের সার্ভার পুরোপুরি ভাবে বন্ধ । এমন কি ম্যানুয়্যাল ভাবেও কাজ করছে না। আর ইউটিলিটি বিল প্রদানে দেখলাম বিশাল লম্বা লাইন । ভাগ্য ভাল যে আমার মোবাইলে যথেষ্ঠ পরিমান টাকা ছিল । আমি সব সময় মাসের শুরুতেই মাস চলার মত কিছু টাকা একাউন্ট থেকে তুলে নিজের কাছে রাখি। মোটামুটি একটা হিসাব থাকে যে মাসে কতটাকা খরচ হবে। যদি কোন দরকার পড়ে তখন আবার একাউন্ট থেকেই টাকা তুলে সেই সমাধান করি । খরচের টাকা থেকে খরচ করি না। এই কারণে এই যাত্রার কোন সমস্যা হয় নি। কিন্তু এমন অনেকেই আছে যারা তাদের সব টাকা কেবল ব্যাংক/বিকাশ একাউন্টেই রাখে। যখন দরকার হয় তখন তুলে খরচ করে। তারা এইবার সবাই বিপদে পড়েছে খুব।
এরপর এভাবে দিন পার হচ্ছে । প্রতদিন দুইবেলা করে বাইরে বের হই । খাবার কিনে আবার দ্রুত বাসায় ফিরে আসি। সারাদিন বই পড়ি আর গান শুনি । এরই ভেতরে দুইটা বই পড়ে শেষ করে ফেলেছি। একটা বই হচ্ছে একজন মুক্তিযোদ্ধা আর্মি জেনারেলের লেখা। স্বাধীণতার প্রথম দশটা বছর কেমন ছিল সেটার বর্ণনা। অন্য বই হচ্ছে স্বাধীনতা পরে ৭৫ এর আগ পর্যন্ত সেই সময়ে বাংলাদেশের অবস্থা কেমন ছিল । প্রায় প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার একটা বই। এই বইটা একটু বেশি বিস্তারিত ভাবে লেখা। এই বই নিয়ে একটা আলাদা রিভিউ লিখতে হবে । বইটা পড়তে পড়তে কেবল একটা কথাই আমার মনে হল যে পরিস্থিতি খুব একটা বদলায় নি।
আজকে (সোমবার) দুপুরে কেবল হোটেলে বসেই খাবার খেলাম । দেখলাম লোকজন এখন অনেকটাই নির্ভয়েই চলাচল করছে।
লেখাটা গুগল ডকে তিনদিন আগে, অর্থ্যাৎ সোমবার লিখেছিলাম। তারপরের দিনগুলো আর স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মানুষজন সব বাইরে বের হচ্ছে । ২৪ তারিখ আমিও বের হলাম । একবার শান্তিনগরে ঢু মেরে আসলাম। সাইকেল ছিল সাথে তাই যাতায়াতে কোন সমস্যা হয় নি। তবে এখনও ফেসবুক এবং ইনস্টগ্রাম ডাউন দেশে। এছাড়া আমি এখনও পর্যন্ত হোয়াটসএপে কোন ছবি বা ডকিউমেন্ট পাঠাতে পারি নি । কালকে রাতে ইউটিউব চলছিল বাফারিং হয়ে তবে আজকে সকাল থেকে কোন ভিডিও চলছে না এখনো পর্যন্ত !
একটা কথা শেষ করি । বিটিভির মত একটা অযোগ্য অদরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবন ভাংচুর নিয়ে সরকারকে উৎকন্ঠিত দেখলাম, ১৮৭টা মৃত্যু নিয়ে তাদের ততখানি চিন্তিত হতে দেখলাম না । মৃত্যুর সংখ্যাটা কেবল পত্রিকাতে এসেছে । এর থেকে সংখ্যাটা যে আরও কত বেশি সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের এই দেশে সব কিছুর সব কিছুর দাম আছে, কেবল মানুষের জীবনের দাম ছাড়া ! পত্রিকাতে দেখলাম ২১ জনকে দাফন করা হয়েছে যাদের পরিচয়ই জানা যায় নি ! তাদের কাছের মানুষগুলো কোন দিন কি জানতে পারবে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল?
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১১:৪৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



