
আমার ছোটবেলার একটা বড় অংশ কেটেছে জাফরপুরে। আমাদের বাসার বাড়িটা একেবারে আমার নানার বাড়ির পাশেই। বাড়ির দরজা থেকেই আগে নানা দেখা যেত। সেই হিসাবে জীবনের একটা বড় অংশ মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে কেটেছে আমার। ঢাকায় আসার আগ পর্যন্তও তাদের সঙ্গে আমার প্রতিদিন দেখা হতো।
আমার বড় মামার দুই ছেলেমেয়ে। আমার এই বোনটা আমার থেকে দেড় বছরের বড় আর ছোটটা আমার থেকে দুই-তিন বছরের ছোট হবে। ঢাকায় আসার কয়েকদিন পরেই বোনের বিয়ে হয়ে যায়। বরের সঙ্গে সেও ঢাকায় এসে ওঠে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি যেখানে টিউশনি করতাম, বোনের শ্বশুরবাড়ি ছিল সেই এলাকাতেই। সে আমাকে ফোন করে কতবার যেতে বলেছে, তবে কোনোদিন আমি তার বাড়ি যাইনি। তারপরও তার সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ ঠিকই হতো, ফোনে কথা হতো। ছোট মামাতো ভাই ইন্টারের পরে কিছুকাল এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে, তারপর মালয়েশিয়া চলে যায়। তারপর থেকে তার সঙ্গে আর আমার দেখা বা কথা হয়নি। দশ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে, তার সঙ্গে কোনোদিন কথা হয়নি।
আজকে বাসায় এসে মামাতো বোন আমাকে ফোন করে বলল, বাবু, মানে আমার সেই ছোট মামাতো ভাইয়ের একটা কাজ করে দিতে হবে। আমি পারব কি না। আমি যোগাযোগ করতে বললাম ফোনে। একটু আগে তার কাজটা করে দিলাম।
এতদিন পরে বাবুর ছবিটা আমি দেখতে পেলাম। শেষবার যখন বাবুকে দেখেছিলাম, তখন তার চেহারা অনেক চমৎকার ছিল, এখন একেবারে চেনা যায় না। আগের সেই মোলায়েম ভাবটা আর নেই। এরই মধ্যে বয়সের ছাপ পড়ে গেছে।
ছোটবেলায় বাবুর মাছের লেজ খাওয়ার খুব জেদ ছিল। বাসায় যখন মাছ রান্না হতো, তাকে মাছের লেজ দিতেই হতো। নয়তো সে কোনোভাবেই ভাত খেত না। এই লেজভক্তি দেখে একবার আমার নানা বলেছিলেন যে ওকে অনেকগুলো পুটি মাছের লেজ রান্না করে দেওয়া হবে, তখন যত ইচ্ছে লেজ খেয়ে শেষ করুক। বাবুর আরেকটা অদ্ভুত অভ্যাস ছিল। ও ইলিশ মাছ আর গরুর দুধ দিয়ে ভাত খেত। এটা তার পছন্দের একটা খাবার ছিল। আমি নিজের চোখে তাকে এই খাবার খেতে দেখেছি।
স্কুলের সময়টা বাদ দিলে বাবু প্রায় পুরো সময়ই আমার পেছনপেছন ঘুরে বেড়াত। আমি যখন বাড়ির আশপাশের বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম, তখন বাবু সব সময় আমার সঙ্গেই থাকত। ক্রিকেট, ফুটবল, কানামাছি কিংবা চিঁড়ে খেলা—সব কিছুতেই সে আমাদের সঙ্গেই থাকত।
সন্ধ্যাবেলা যখন বিদ্যুৎ চলে যেত, তখন হয় আমি ওদের বাসায় যেতাম, নয়তো ওরা ভাইবোন আমাদের বাসায় এসে হাজির হতো। এমন অনেক দিন গেছে, বইখাতা নিয়ে আমরা তিনজন একসঙ্গে পড়তে বসেছি, যদিও সেখানে পড়াশোনার থেকে গল্প বেশি হয়েছে।
এসএসসি পাসের পরে বাবু একটু কুসঙ্গে পড়ে যায়। তখন সে অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। আমিও তখন কলেজে পড়ি। দিনের বেশিরভাগ সময় কলেজ, প্রাইভেট নিয়েই ব্যস্ত। বাবুর থেকে আলাদা হয়ে যাই। তখন তার অনেক নতুন বন্ধু-বান্ধব হয়ে যায়, তখন থেকেই মূলত বাবুর সঙ্গে সম্পর্কে ছেদ পড়ে। কালেভদ্রে আমাদের তখন দেখা হতো। আমি ঢাকায় চলে আসার পরে আর বাবুর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। ইন্টারের পরে তার বাবা-মা তাকে তার নানার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়, কারণ গ্রামে থাকলে খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তার কিছু সময় পরে সে মালয়েশিয়ায় চলে যায়। তারপর থেকে সেখানেই আছে। প্রথম প্রথম কারও সঙ্গে যোগাযোগ করত না। পরে এখন অবশ্য সবার সঙ্গেই যোগাযোগ করে। আজকে আমার সঙ্গে কথা হলো!
পুরানো দিনের এই কথাগুলো ভাবলে মনে হয় যেন এই তো সেদিনের কথা। সেদিন আমি আর আমার কাজিনরা মিলে আড্ডা দিচ্ছি, আম ঝালাই করে খাচ্ছি। অথচ মাঝ দিয়ে কতগুলো বছর পার হয়ে গেছে! আমরা কত বড় হয়ে গেছি!
Pic source
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


