ডঃ ইউনুস সাহেব কে নিয়ে একটু পড়াশুনা করলাম । ইউনুস সাহেবের সাথে আমার পরিচয় ক্লাস নাইন থেকে । আরে না না, ব্যক্তিগত ভাবে নয় । বইয়ের পাতায় থেকে । তার প্রতিষ্ঠিতি গ্রামীণ ব্যাংক এর লেখা প্যারাগ্রাফ আমারে অনেক প্যারা দিসে । আমার ইংরেজি শিক্ষক আমারে গুলাইয়া খাওয়াইছে ।
যাইহোক সে প্রসঙ্গ বাদ দেই । যদিও কেন জানি ইউনুস সাহেব কে আমার তখন থেকেই ভাল লাগত না । একটা চাপা ক্ষোভ ছিল । কিন্তু সত্যি বলতে নোবেলজয়ী হওয়ার পর পাগলু ড্যান্স ড্যান্স দিছিলাম । কিন্তু তার নোবেলজয়ী বক্তব্য এত মর্মাহত করবে ভাবিনি । পুরো আনন্দ মাটির সাথে মিশে গেছে ।
গ্রামীণ ব্যাংক এর কথায় আসি । ইউনুস সাহেব ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প শুরু করেন দারিদ্র বীমোচন এর জন্য । ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক থাকা কালে ড. ইউনূস জোবরা গ্রামে তার ক্ষুদ্র ঋণ আইডিয়াটি চালু করেন জনতা ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে। কিন্তু যে পরিবার ঋণ নিয়েছিল তাতে তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। পরে তিনি তার এই চিন্তা-ভাবনা নিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে দেখা করেন।
জিয়া সাহেব ড. ইউনূসকে উত্সাহিত করার জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ড. ইউনূসের আইডিয়াকে একটি প্রকল্প হিসাবে গ্রহণ করে তাকেই প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। আমি যত দূর জানি, এটাই ছিল গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের যাত্রা শুরু। তখন ড. ইউনূস কিছুদিন বাংলাদেশ ব্যাংকেও অফিস করেছেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের অফিসিয়াল ওয়েব সাইটে গেলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফরমেশনগুলো পাওয়া যায় না। শুধু বলা হয়েছে ১৯৭৬ সালে ড. ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পটি চালু করেন। ১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে পূর্ণাঙ্গ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি আইন পাশ করে। এটা মূলত একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান। শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। সাইফুর রহমান সাহেবের আমলে ৩০০ কোটি টাকা ঋণও দেয়া হয়েছিল। এক সময় এই ব্যাংকের সরকারি মালিকানা ছিল ৬০ শতাংশ। পরে আস্তে আস্তে সরকারের মালিকানা ২৫ শতাংশে নেমে আসে। এই ব্যাপারে সরকারের গাফেলতিও কম নয়।
যেকোন দরিদ্রকে ক্ষুদ্রঋণ বিতরনের বহুল-প্রচারিত কথাটা আসলে পুরাই চাপাবাজি। ঋণ পাওয়ার জন্য ধনীদের যেমন ব্যাংকের কাছে নিজেদের ‘ঋণ পাবার যোগ্যতা” প্রমাণ করতে হয়, ক্ষুদ্রঋণের বেলাতেও সেটা আছে। সেটা কি রকম?- গ্রামীনের ওয়েব সাইটেই আছে, ক্রেডিটের তিন ‘সি’। এগুলো হলোঃ
এক, ক্যারেক্টার- এর মানে হল, ঋণ প্রত্যাশীর আর্থিক লেনদেনের পূর্ব-ইতিহাস, যা থেকে নির্ধারন করা হয় ঋণ-পরিশোধে প্রার্থির সততা+নির্ভরযোগ্যতা,
দুই, সামর্থ- এর মানে হল, তার আয়ের ধারা+আইনগত বাধ্যবাধকতা (যা কি না ঋণ আদায়ে ইন্টারফেয়ার করতে পারে) অনুযায়ী কি পরিমাণ ঋণ পেতে পারে,
তিন, পুঁজি- এর মানে হল, ঋণ-প্রত্যাশীর বর্তমান সম্পদ, যেমন, বাড়িঘর, মজুত বা বিনিয়োগকৃত অর্থ যা ঋণ-পরিশোধে ব্যর্থ হলে “ব্যবহার” করা যাবে।
(টার্মগুলোর এইসব বিশেষ ডেফিনিশনগুলোও গ্রামীনেরই দেওয়া, আমি শুধু অনুবাদ করেছি)।
এখন দেখা যাক, কারা কারা গ্রামীনের নির্ধারিত এইসব যোগ্যতার মাপকাঠিতে উৎরে যায়। –
প্রথমত, ঋণ লেনদেনের পূর্ব-ইতিহাস কার থাকতে পারে বলে মনে হয়? যার কখনোই কিছু ছিলোনা? নাকি যে আগে থেকেই কিছু কিছু ঋণ নেওয়া-ফেরত দেওয়া করেছে? অতএব, যারা এই মাপকাঠিতে উৎরে যাবে, তারা নিশ্চয়ই নিঃস্ব নয়। তার সেই পূর্ব-ইতিহাস কেমন হতে হবে? নিশ্চয়ই ভালো, অর্থ্যাত সফলভাবে ঋণ পরিশোধ করেছে। সফল+ব্যর্থ দুই দলই উৎরে গেলে ত এই শর্তই থাকার কথা না।
দ্বিতীয়ত, একজন সামর্থবান ঋণ-প্রার্থী সে’ই যার একটা নির্দিষ্ট আয়ের উৎস বিদ্যমান+এমন কোন আইনী বন্ধন/সুবিধা নেই ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে যা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। লক্ষ্যণীয় যে, আয়ের একটা উৎস থাকা লাগবে ।
তৃতীয়ত, পুঁজি থাকতে হবে । তবে সেটা নগদ অর্থ না হয়ে বসত-বাড়ি, মজুত বা বিনিয়োগকৃত অর্থ হলেও চলবে।
১৯৯৩ সালের বার্ষিক রিপোর্টে গ্রামীন ব্যাংক উল্লেখ করেছিলো যে, পূর্ববর্তী বছরে তাদের সদস্যদের মধ্যে ড্রপট-আউটের হার ছিলো ১৫%। কিন্তু ঋণ পরিশোধের হার কিন্তু ঠিকই ৯৫%। এর মানে হচ্ছে, ঋণ খেলাফিরা ড্রপট-আউট হলেও তাদের কাছ থেকে ঋণ ঠিকই আদায় হয়েচ্ছিল। সেটা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল?
এটা কল্পনা করা লাগবে না, হাতের কাছেই টাটকা নজীর আছে। ২০০৭ এর নভেম্বরে বাংলাদেশের উপর দিয়ে ঘটে যাওয়া প্রলংকরী ঘূর্ণীঝড় ‘সিডর’ শুধু মানুষের ঘরবাড়ি, ফসল, গাছপালাই উড়িয়ে নিয়ে যায় নি, সেই সাথে ক্ষুদ্রঋণের মহামানবদের “গরীবের বন্ধুনামক” মুখোশটাও উড়িয়ে নিযে উলংগ করে দেখিয়েছে তাদের আসল চেহারা। (দেখুন ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়, ১১ ডিসেম্বর, ২০০৭)।
১৯৯০ এ পরিশোধিত মূলধন ৭.২ কোটি টাকায় পৌঁছে যাওয়ায় ১৯৯১ সালে অর্থ মন্ত্রনালয়ের একটি পত্রে পরিশোধিত মূলধনের ঊর্ধসীমা ১৫ কোটি টাকায় স্থির করা হয়। এটিও অর্জিত হয় ১৯৯৩ সালে। ১৯৯৪ সালে অর্থ মন্ত্রনালয়ের আরেকটি পত্রে পরিশোধিত মূলধনের ঊর্ধসীমা স্থির করা হয় ৪০ কোটি টাকা। এবং ২০০৮ সালে এটি আবারো বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টাকা করা হয়। গ্রামীণের পরিশোধিত মূলধন ২০০৯ সালেই ৪০ কোটি টাকা অতিক্রম করে এবং ২০১২ সালের শেষ পর্যন্ত গ্রামীণের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ প্রায় ৬০ কোটি টাকা যার মধ্যে সরকারের অংশ এখনো ১.৮ কোটি টাকা, বাকিটা ঋণগ্রহীতা সদস্যদের। অর্থাৎ ১৯৮৩ এর পর থেকে সরকার গ্রামীণ ব্যাংকে কোন মূলধন জমা করেনি, কিন্তু ঋণগ্রহীতাদের শেয়ার বেড়েছে, যেটা এখন প্রায় ৯৭%।
কয়েকটি পর্যবেক্ষণঃ
১। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রারম্ভিক মূলধন যোগান দিয়েছিল সরকার।
২। সদস্যদের কাছ থেকে মূলধন সংগ্রহের অনুমোদন ছিল ১৯৮৩ র অধ্যাদেশে এবং প্রয়োজনমত পরিশোধিত মূলধন পরিবর্তনের ও সুযোগ ছিল।
৩। পরবর্তীতে সদস্যদের কাছ থেকে মূলধন সংগ্রহের হার আশাব্যঞ্জক হওয়ায় সরকারকে আর মূলধন যোগান দিতে হয়নি এবং অব্যাহতভাবে সদস্যদের কাছ থেকেই শেয়ারের বিনিময়ে মূলধন সংগ্রহ করা হয়েছে।
৪। যখনই পরিশোধিত মূলধন নির্দিষ্ট সীমা স্পর্শ করেছে তখনই সেই সীমা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সরকার নির্বিশেষে।
৫। অর্থাৎ গ্রামীণ ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনে ঋণগ্রহীতাদের শেয়ার বেড়ে যাওয়াতে কোন সরকারেরই আপত্তি ছিল না এতদিন।
৬। গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের কাছ থেকে মূলধন সংগ্রহ নতুন কিছু নয়, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এটা হয়ে আসছে। অব্যাহতভাবে মূলধন বৃদ্ধি এবং এটা সরকারের অনুমোদনের একটা মানে হতে পারে, এই প্রক্রিয়াটা প্রত্যাশিত ছিল সব পক্ষের কাছে। সাধারণ বিবেচনায়ও এখানে আপত্তি করার মত খুব কিছু দেখা যায়না, গ্রামীণ ব্যাংক যদি বিদেশী দাতা, সরকার কিংবা বেসরকারী খাত থেকে পুঁজি সংগ্রহ না করেই শুধুমাত্র সদস্যদের পুঁজির উপর ভিত্তি করে বিকাশ লাভ করতে পারে এবং একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হতে পারে, সেখানে অখুশী হওয়ার মত কিছু আমার চোখে পড়ে না। বরং ক্ষুদ্র পুঁজি সঞ্চয় করে এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা গ্রামীণের সদস্যদের একটি বড় কৃতিত্ব। এবং গ্রামীণ লাভজনক হওয়ার ফলে এই কৃতিত্বের পুরষ্কার ও তারা পাচ্ছেন।
৭। সর্বোপরি গ্রামীণের পরিশোধিত মূলধনের বৃদ্ধি সবসময়ই সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ছিল। কিন্তু গ্রামীন ব্যাংক অর্ডিন্যান্স এর ১৯৮৬ এর সংশোধনী যদি বিবেচনা করা হয়, যেখানে সরকারের ২৫% শেয়ারের কথা বলা হয়েছে, তাহলে গ্রামীণ পরিশোধিত মূলধনের এই ভাগ ১৯৯০ সালেই অতিক্রম করে যায়। তাহলে সরকারের ২৫% শেয়ার ধরে রাখার জন্য হয় আরো টাকা বিনিয়োগ করা দরকার ছিল অথবা গ্রামীণের সদস্যদের কাছে শেয়ার বিক্রি বন্ধ করে দেয়া উচিত ছিল। দ্বিতীয় বিকল্পের খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা থাকার কথা না কোন বিচারেই। তাহলে বাকি থাকল প্রথম বিকল্প। গ্রামীণ যদি তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত মূলধন যোগাড় করতে পারে, তাহলে সরকারের কি স্বার্থ থাকতে পারে শেয়ার বৃদ্ধি করার বা ধরে রাখার? লাভের অংশ পাওয়া? লাভের অংশ যদি সরকারের বদলে দরিদ্র্য ঋণগ্রহীতাদের কাছে যায় তাহলে সরকারের আপাত উদ্দেশ্যের (দারিদ্র্য দূরীকরণ, গরীব মানুষকে আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান) সাথে সেটা খুব অসামঞ্জস্যপূর্ন নয়। আর গ্রামীণ ব্যাংকের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখাই যদি শেয়ার রাখার উদ্দেশ্য হয় তাহলে সেটা খুব সহজেই আইন সংশোধন করে বা গ্রামীণের যেকোন নীতিনির্ধারণী প্রস্তাব অনুমোদন করা না করার মাধ্যমে সেটা করা যায়। আমার কাছে মনে হয়, হয়তো এরকম একটা চিন্তা থেকেই সরকার গ্রামীণে শেয়ার বাড়ানো বা ২৫% ধরে রাখার চেষ্টা করেনি এবং ঋণগ্রহীতাদের অব্যাহত শেয়ার বৃদ্ধিকে অনুমোদন দিয়ে গেছে।
৮। ১৯৮৬ র সংশোধণী অনুযায়ী সরকারের ২৫% শেয়ার রাখা যদি আবশ্যকীয় হয়, তাহলে পরবর্তীতে (১৯৯১, ১৯৯৪, ২০০৮) সরকারী শেয়ার সমন্বয় না করে পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধি করার অনুমতি দেয়া মূল অধ্যাদেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
কোন এক সাংবাদিক বলেছিলেন, যেদিন দেখেছি যে ইউনুস সাহেবের সামনে গ্রামীন ব্যাংক এর লোকজন গরিবের বাড়ির টিন খুলে নিয়ে আসছে । তখন ই বলেছি, গ্রামীন ব্যাংকের সফলতা কেউ ঠেকাতে পারবেনা । সেই সাংবাদিক কে ছিলেন মনে নেই । এখন । তবে তার ধারনা যে ঠিক ছিল সেটা অবাস্তব নয় ।
নোবেল শান্তি পুরস্কার একটি রাজনৈতিক পুরস্কারে পরিণত হয়ে পড়েছে। সরকার বা রাষ্ট্রের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে এর আগেও ইরানের শিরিন এবাদি এবং মায়ানমারের অং সাং সুচিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছে। যুদ্ধরত ফিলিস্তিন ও ইজরায়েলের নেতা আরাফাত ও শ্যারনকে শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার সম্পর্কে লোকে নানা ধরনের তামাশা করে। বলে, আপনি আপনার মায়ের বিরুদ্ধে বদনাম করুন আপনাকে পশ্চিমারা নোবেল দিয়ে দিতে পারে। সবচেয়ে মূল্যবান ইস্যু হলো এখন ইসলাম। আপনি ইসলামের বিরুদ্ধে বলুন আপনাকে নোবেল দিয়ে দিবে।
তবে এখন যে খুব ভাল অবস্থানে আছে তা নয় । কারণ হিসেবে সেটা নাই বা বলি । তবে সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দুর্নীতি হলেও সেটা বোঝার উপায় নেই । আপনি আমি তা বলতে পারব না ।
(বিঃদ্রঃ এই লেখাটা আমার বিবিএ পড়ার সময় একটা প্রজেক্টের অংশবিশেষ । পুরোটা তুলে ধরলাম না । তবে এটা ইউনুস সাহেব কে ছোট করা বা তার বিরুদ্ধে নয় । গ্রামীন ব্যাংক নিয়ে আমার একটা ছোট রিসার্চ মাত্র)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:৫৪