বন্ধুদিবসের এক রোদেলা দিনে জীবনের প্রথম ট্রেনভ্রমণের কথা মনে হলেই স্বপ্নালু চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। জলজ চোখে নিকষ অন্ধকার তখন ধূসর লাগে। বাগেরহাট সার্কিট হাউজের নির্ঘুম রাত, শাওনের কারসাজিতে রাত বারোটায় তমালের ভূতের ভয় কিংবা ক্রীম ভেবে চুলের জেল মুখে মাখিয়ে বেকুব হওয়ার স্মৃতি এখনও ওদের মনে পড়ে কি না, আমার জানা নেই। কে জানে, রুপালী আলোয় নৌ-ভ্রমণের স্মৃতি মনে হলে আমার মতো ওরাও হয়তো জীবনের খেই হারিয়ে ফেলে!
এক জীবনে কত কিছুই তো হারালাম- প্রিয়তম নদীর কোলাহল, খালিশপুরের চিরচেনা শ্রমিক সাইরেন, ভিনগাঁয়ের অচেনা বুড়ি মা’র জীবন দর্শন অথবা পাটের নৌকায় রাতভর গল্পের সোনামাখা দিন। তবু তমালের অকৃত্তিম স্নেহ আর শাওনের একাগ্রতা আমার জীবন থেকে ‘নিখোঁজ’ হয়নি কখনো। উচ্চশিক্ষার জন্যে প্রিয় শহর ছেড়ে আসার সময় তমালের মলিন মুখ আর শাওনের আদ্র কণ্ঠের ‘ভুলে যাস না’ আমাকে বারবার টেনে নিয়ে যায় খুলনা। যেখানেই থাকি, যত দূরেই- ওদের জন্যে আমার মন কেমন করে!
শম্পা আপুর বিয়েতে আমাদের হৈ হুল্লোড়, বরের গাড়ীতে ব্যাঙ ছেড়ে দেওয়ার দু:সাহসিক অভিযান, ভয়ানক গরমের মধ্যেও এক বিছানায় চারজনের নিদ্রাহীন সারারাতের কথা মনে হলেই শীতের পাতার মত টুপ-টাপ ঝরে পড়ে দীর্ঘশ্বাস।
এখনও বড় কোন ছুটি পেলে ছুটে যাই খুলনা। দূর পাল্লার নাইট কোচে পদ্মার উত্তাল ঢেউ পেরোলেই আমার হার্টবিট বেড়ে যায়। যশোর অতিক্রম করার পর আর তর সয় না। যৌক্তিক করনেই বাস কোথাও ব্রেক কষলে আমি অস্থির হয়ে পড়ি। মনে হয়, কখন পৌঁছাবো!
২.
খুলনা গেলেই আড্ডা বসে আমাদের। পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে এখনো আমরা জাতিসংঘ পার্কে জড়ো হই। দেরী করে পৌঁছানোর স্বভাব ছাড়তে পারি না বলে শাওনের বকা খাই এখনো। তবে কোথায় যেন সুতো ছিঁড়ে গেছে। সময় আমাদের বড্ড অসহায় করে দিয়েছে। সীমাহীন প্রত্যাশা নিয়ে খুলনা গেলে শাওন-তমালের ব্যস্ততা আমাকে কষ্ট দেয়। চেনা দিনগুলো ভীষণ অচেনা মনে হয়। নতুন বন্ধুদের নিয়ে তমালের গোছানো জীবন দেখে কেমন কষ্টই লাগে। এই বিরাণ শহরে নিজেকে বড্ড বেমানান করে তুললেও তমাল সে কষ্ট মাড়ায়নি দেখে ভালই লাগে এক অর্থে। শাওনের বাসায় আমাদের অনন্ত কথামালা এখন আর কাউকেই আগের মত দোলা দেয় না। তবু হুটহাট সেই সব দিনের কথা ভেবে গোপনে ভিজে ওঠে চোখের জমিন। একান্তে আমার এই নীরব বেদনা হয়তো ওদের কাছে পৌঁছাবে না, হয়তো ওরা জানতেই পারবে না- কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে!
ভোরের আলোয় চোখ বুজবার ঠিক পূর্বে, বন্ধু দিবসের সকালে তমাল-শাওনের জন্যে আঁজলাভরা ভালোবাসা পাঠিয়ে দিলাম। অধর ছুঁয়ে বললাম, ‘আমি তোদের জন্যে কিছুই করতে পারিনি রে, শুধু নিয়েছি দুহাত ভরে, মা করিস। যেখানেই থাকিস, ভাল থাকিস, মনে রাখিস!!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১০ বিকাল ৫:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




