somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাতি ও জাতীয় সাহিত্যের পুথি পাঠ : আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ গৌতম ভদ্র

১৮ ই মে, ২০০৯ সকাল ৮:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(সমাজ-রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্র আয়োজিত 'আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্মারক বক্তৃতা'র সংক্ষেপিত ভাষ্য৷ বক্তৃতার তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৩ )




কত শত যোজন নক্ষত্র দূরে বাস করেন মুনশি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ? সাইবার স্পেস, ই-মেল, সাইবার বুক ইত্যাদিতে অভ্যস্ত আমরা কি পুথি দেখি, পুথি পড়ি ও তার অবয়বটি কখনো তাঁর মতো স্পর্শ করি? আজহারউদ্দিন খান, এনামুল হক, আবদুল করিম, আহমদ শরীফ, ভূঁইয়া ইকবাল প্রমুখ বিদ্বত্জিনের গবেষণা, স্মৃতিচারণ ও রচনা সংকলন সম্পাদনার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের সুচক্রদণ্ডী গ্রামের এন্ট্রান্স পাস-করা সংস্কৃত পড়ুয়া মুসলমান আবদুল করিমের জীবনপঞ্জি সুপরিজ্ঞাত, এমন কি তাঁর জন্মের সালটুকু নিয়েও বিতর্কটির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে বলে শুনতে পাই৷ কৈশোরের শেষে পুথি পড়ার মজলিশে আলাওলের পুথি শুনতেন, সেই আনন্দে মশগুল হয়ে প্রাচীন পুথির সন্ধান ও আবিষ্কার তাঁর কাছে 'ধ্যানের বস্তু' হয়ে ওঠে৷ শেষ জীবনে প্রায়ই তিনি নিজেকে 'ধ্যান-নিমগ্ন যোগী' বলতেন৷ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ৷ কী অর্থে কীটদষ্ট পুথির সাধনা যোগসাধনায় রূপান্তরিত হয়, কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে পুথিসংস্কৃতির বস্তুগ্রাহ্য রূপকে ছাড়িয়ে সহসা আমাদের সংস্কৃতি অন্য অভ্যন্তরের ইঙ্গিত দিতে পারে, তারই দুয়েকটি কথা পেশ করব৷

ব্যক্তি বিষয়ীর নিষ্ঠার কথা স্বীকার করেও এবং পুথি সন্ধান ও সম্পাদনার কৃত্কৌকশলের দক্ষতার কথা মেনে নিয়েও মনে হয় যে, সংস্কৃতিমনস্কতার এক বিশেষ পর্যায়ে ও সময়ে এই পুথি সংগ্রহরীতির চর্চা গড়ে ওঠে৷ এই চর্চা অবশ্যই দেশ-কাল-নিরপেক্ষ নয়৷ এরই সঙ্গে দানা বাঁধে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম, অনুদান ও সম্পাদনার রীতি৷ দেখব যে আমাদের সমাজের আধুনিকতা/অনাধুনিকতার বিচিত্র প্রতিচ্ছেদন টানাপোড়েন থেকে মুনশী আবদুল করিমের মতো ধ্যাননিমগ্ন যোগীরাও নিস্তার পান না৷

উনিশ শতকের ৭০-এর দশক থেকেই প্রাচ্যবিদ্যা প্রকল্পে একটা প্রতিসরণ নজরে পড়ে৷ বার্নাড কোহনের গবেষণা থেকে পরিষ্কার যে অষ্টাদশ তথা উনিশ শতক ধরে সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংস্কৃতির প্রত্নরূপ হিসাবে নানা পুথি সংগ্রহ চলছিল; সভ্যতার সার্বিক স্কেলে ভারতের নানা জাত-পাতের ও ধর্মগোত্র, চিন্তাভাবনার স্থান কোথায়, শাসন-সভ্যতা-সংস্কৃতির কোন পর্যায়ে ও কোন অভ্যাসে নানা গোত্র ও সংস্কৃতির ভারতীয়রা থাকে, তারই যেন এক প্রত্নস্বাক্ষর এই ভাষা ও পুথিগুলি৷ তবে এইসব ক্ষেত্রে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি পুথিগুলিরই দাম ছিল, বৌদ্ধ রচনাগুলিও পেছনে পড়ে নেই৷ স্মৃতিশাস্ত্র ও ব্যবহারবিধির তাগিদে নানা সাহিত্য সংকলনও শুরু হয়৷ কিন্তু মহাবিদ্রোহের অভিজ্ঞতা, পেনাল কোড ও আদমসুমারির দাপটে আঞ্চলিক ভাষাগুলির প্রাত্যহিক গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ এই প্রসঙ্গে জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসনের ভারতজোড়া প্রকল্পটি একটি জলবিভাজিকা (১৮৮৬-১৯০২)৷ সারা ভারতে চালু ভাষা, তার ব্যাকরণ ও তার রচনার তিনি একটি ছক তৈরি করেন, ঐ ভাষা সংক্রান্ত পুথি, কথ্য নমুনার সংগ্রহে হাজারো লোক নিয়োগ করেন৷ রঙ্গপুরের গোপীচাঁদ থেকে কাশ্মীরের লাল দেবের লালবাক কিছুই তাঁর চোখ এড়ায় না৷ রাষ্ট্রের বিপুল আনুকূল্যে আধুনিক ভারতীয় ভাষার কুলপঞ্জী ও পারম্পরিক নিরূপণের প্রস্তুতিপর্বটাই সাহিত্যবিশারদের সাহিত্যচর্চার প্রথম পর্বের সঙ্গে যুক্ত৷ (আনোয়ারা স্কুল ১৮৯৯-১৯০৫)

আধুনিক ভারতীয় ভাষাচর্চা ও কুলজী নির্ণয় তথা পুথিবিচারের পাশাপাশি আরেকটি ধারাও বিদ্যমান৷ এই ধারাটি জাতীয় ইতিহাস রচনার প্রকল্প৷ এই প্রকল্পের এক বিশেষ পর্যায়ে বঙ্গদর্শন, বঙ্কিমচন্দ্র ও সাহিত্য পরিষদের চেষ্টা স্মর্তব্য; হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, দীনেশচন্দ্র সেন ও নগেন্দ্রনাথ বসু কাজে নেমেছেন৷ কিছুটা প্রাদেশিক সরকারের আনুকূল্যে, দেশজ ভূমধ্যকারীদের বদান্যতায় 'নির্বিচারে' পুথি ও কুলজি সংগ্রহ চলছিল, শাস্ত্রী মহাশয় মাঝে মাঝে প্রতিবেদনও লিখছিলেন৷ অবশ্যই উনিশ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত চর্যাচর্য বিনিশ্চয় বার হয়নি, বড়ু চণ্ডীদাসের পুথির কথাই বা কে জানে? কিন্তু একটি ধারণা শাস্ত্রী, নগেন্দ্রনাথ বসুর চিন্তায় দানা বাঁধছে, তরুণ উত্সাদহী রবীন্দ্রনাথও বাদ সাধছেন না৷ পাশ্চাত্যের মত আমাদের সভ্যতা কেন্দ্রাভিমুখী নয়, রাষ্ট্রনির্ভর নয়; গোষ্ঠী, কুল, গোত্র পরিবার ও অন্যান্য অসংখ্য ধরনের সামাজিক আদানপ্রাদানে আমাদের সংস্কৃতির পরিচয় আছে৷ এই ভারতীয় তথা বঙ্গসমাজের কোন ঐতিহাসিক সংজ্ঞার্থ মধ্যযুগে পাওয়া সম্ভব নয়, বরং আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার বিপরীতে এইরকম সমাজনির্ভর ও আদান-প্রদান পুষ্ট সমূহের ধারণা করা সম্ভব৷ অবশ্যই এর অন্যতম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পল্লীগ্রাম ও লোক৷ এই পল্লী লোকের সময়চিন্তা অন্যবিধ, নীতিবোধ স্বতন্ত্র৷ এই অন্য সময় ও নীতির চিন্তার মধ্যেই কৌম ও সামূহিক সংস্কৃতি জীবন্ত আছে৷ যেহেতু এই সংস্কৃতি জীবিত, এই সংস্কৃতিই শিকড়, ইতিহাসের মূল এই সংস্কৃতিতে_এই ধারণায় জাতীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাস একাকার হয়ে যায়, জাতীয় সাহিত্য রচনাই হয়ে ওঠে জাতীয় ইতিহাস রচনার প্রধান ধাপ৷ ইতিহাসের উপকরণ পাওয়া যাবে সাহিত্যে, তার 'স্বাভাবিক' প্রকাশ যাতে ঘটবে সেটাই তো মাতৃভাষা; আর মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে জাতীয় ভাবপুষ্ট হলেই সে সর্বতগ্রাহ্য হবে, আর সেই ভাষাই তো জাতীয় ভাষা৷ এই অক্ষে সাহিত্য, ভাষা ও ইতিহাস পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যায়, একটার পরিবর্তে আর একটা ব্যবহৃত হতেই পারে৷
জাতীয় ভাষা, জাতীয় সাহিত্য ও জাতীয় ইতিহাসের আরেকটি স্তরে অঞ্চল-এর ধারণা জাঁকিয়ে বসে৷ ১৮৭০ দশকের ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারের পাশাপাশি নানা অঞ্চলে সাময়িক পত্র-পত্রিকা বার হয়, সাহিত্যগোষ্ঠী তৈরী হয়, অঞ্চলের প্রত্নতত্ত্ব, নানা সুলুক সন্ধান চলতে থাকে৷ ৯০-এর শেষে এই ধরনের টুকরো লেখা পত্র-পত্রিকায় বার হয়৷ এই পত্র-পত্রিকা সমস্তই যে 'অ্যাকাডেমিক' অর্থে বিদ্বত্মনণ্ডলীর দ্বারা, গবেষণাকর্ম দ্বারা প্রণোদিত তা নয়, এর সমস্তই বরং অনেক বেশি সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনস্ক পত্রিকা৷ এবং পুথিমুনশী আবদুল করিমের প্রথম আবির্ভাব এই গোত্রের পত্রিকায়৷ দুর্গাদাস লাহিড়ীর অনুসন্ধান পত্রিকায় নানা প্রবন্ধ তাঁকে উত্সাসহিত করে, অক্ষয় সরকারের পূর্ণিমা পত্রিকায় 'চণ্ডীদাসের পদাবলী' তাঁর রচনার হাতেখড়ি৷ আলাওলের রচনায় তিনি ছেলেবেলা থেকেই যুক্ত৷ বটতলার ছাপা আলাওল তো মাত্র দেড় শত বছরের, অথচ আনোয়ারা গ্রামে হঠাত্‍ পুরনো পদ্মাবতী আবিষ্কার তাঁকে সারাজীবনের সাধনার পথে ঠেলে দেয়৷ ১৩০৭ সালে আলো পত্রিকায় আলাওলকে নিয়ে তাঁর রচনার সূত্রপাত হয় ও তা সারাজীবন ধরে চলে৷ অন্যপক্ষে ১৩০৩ সালের মধ্যেই তিনি সাহিত্য পত্রিকার নিয়মিত লেখক হয়ে ওঠেন৷ অর্থাত্‍ তৃতীয় স্তরে সাহিত্যবিশারদের আবির্ভাব পুথিসাহিত্যের রসিক হিসাবে, চট্টগ্রামের আনোয়ারা অঞ্চলের পল্লীতে সঞ্চিত পুথির পরিচয়-দাতারূপে৷ এদিক থেকে তিনি স্বশিক্ষিত, বাড়ির পুথির মজলিস, সংগৃহীত পুথি, পত্রপত্রিকার বিচার ইত্যাদির উপর নির্ভর করেই তাঁর পুথিপাঠ গড়ে ওঠে৷ প্রাচ্যবিদ্যার প্রশস্ত অঙ্গনের নানা বিতর্ক তাঁর সমসাময়িক হলেও সেগুলি তাঁর প্রেরণার প্রত্যক্ষ অংশ ছিল না৷ তাঁর নিজের অবস্থান প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্যটি হলো, "আমি পূর্ববাংলার একজন গ্রাম্যলোক, গেয়োমানুষ, গাঁইয়া৷... আমি একজন পুথিসাহিত্যরসের পথিক, তার ভাণ্ডারি, তার প্রেমিক৷ আজীবন তিল তিল করিয়া আমি এই রস আহরণ করিয়াছি, সঞ্চয় করিয়াছি, এবং সেই রসপাত্র পুথিসংগ্রহ আমার ব্রত করিয়াছি৷"

এই রসদৃষ্টিতেই আবদুল করিম যোগী, তিনি আদৌ জন্ম-মীমাংসক নন, নির্মোহতা তাঁর কাম্য নয়; আধুনিক শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে তাঁর আবেদন পুথিপাঠক ও পুথিপ্রেমিকরূপে, প্রাচ্যবিদ্যার জ্ঞানতপস্বীরূপে নয়৷ ফলে তাঁর পুথি বিবরণী ও সম্পাদনা গোড়া থেকেই অন্য মোড় নেয়, বৈজ্ঞানিক পুথিপাঠের মধ্যে ঝলসে ওঠে অন্য এক দৃষ্টি৷

পুথি বিবরণ ও তালিকা

১৩০৭-১৩২০৷ বাদানুবাদ, পরিষদীয় গোলমাল, বিশৃঙ্খলা, তারই মধ্যে আবদুল করিম হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে পুথির বিবরণাত্মক লেখা পরিষদ পত্রিকায় ছাপছেন, শেষে সাহিত্য পরিষদগ্রন্থাবলী সিরিজে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হল মোট ৬০০ পুথি৷ সার্বিক ভূমিকা লিখছেন ব্যোমবেশ মুস্তফী, ১৯১৩ খ্রী.৷ ভূমিকাটিতে বাংলা সংস্কৃতিতে পুথির গুরুত্ব কী তার বর্ণনা, কীভাবে Sanskrit mss.-এর আদর্শে শাস্ত্রী, নগেন্দ্রনাথ বসুর পথ ধরে মুনশী আবদুল করিম এগিয়ে এসেছেন তার প্রশস্তি৷ পুথি ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, সমাজ, রাজনীতি সবেরই যেন আকর, মুস্তফীর এই ধারণা৷

"বঙ্গসাহিত্যই বলিয়া দেয়, বাঙ্গালার পাঠান-নৃপতিরা যেমন হিন্দুর দেবমন্দিরাদি ধ্বংস করিতেন, তেমনি আবার হিন্দু দেবদেবীরই মঙ্গলগীত লেখাইতেন, বাঙ্গালী কবিকে প্রতিপালন করিতেন, শিরোপা দিতেন৷ মুসলমান কবিরা বাঙ্গালা ছন্দে হিন্দু দেবতার লীলা, হিন্দু-সতীর মহিমা, হিন্দু নায়ক-নায়িকা লইয়া কাব্য রচনা করিতেন এবং হিন্দু শাস্ত্রের 'হাদিস' লইয়া সাধকের ভাবে সাধন গীত লিখিলেন৷" আপত্তির কিছু নেই, পুথিতে সবই আছে, পুথির পৃষ্ঠাতেই তৈরি হচ্ছে হিন্দু-মুসলমান যৌথ সংস্কৃতির টানাপোড়েন৷ ব্যোমকেশের চোখে মুন্সী আবদুল করিম 'মাতৃভাষার অকৃত্রিম সাধক', সব প্রতিকূলতার মধ্যে পুথি সংগ্রহ করছেন, বিবরণ ছাপাচ্ছেন৷

ব্যোমকেশ বলছেন না যে বিবরণীতে আবদুল করিমের বিশেষত্ব কোথায়, কেরদানিটাই বা কী৷ গ্রীয়ারসন দূর অস্ত, হরপ্রসাদ এমন কি বসন্তরঞ্জনও তাঁর আদর্শ নয়৷ পুথির গোত্র বিচারে তাঁর আগ্রহ কম, কালপঞ্জির খুঁটিনাটিও পেছনে পড়ে থাকে৷ প্রত্যেকটি পুথিই তাঁর কাছে অনন্য, বিশেষে ভরপুর৷ পরিচিতির ভাষা ও বিন্যাস তাঁর একান্ত৷ খুঁটিয়ে উদাহরণ দেওয়া যাক৷

৫০৬ নং পুথি জয়নাবের চৌতিশা৷ ৬৮ পদ সংখ্যা, তারিখ ও ভণিতা কিছু নেই৷ 'চৌতিশা' কি, তাই নিয়েও আবদুল করিম গোত্র বিচার করেননি, তুলনা আনেননি৷ হঠাত্‍ পরিচিতিতে একটা মুখবন্ধ জুড়ে দেন, বিবি জয়নব হজরত ইমাম হাসানের স্ত্রী৷ তাঁহাকে লইয়া পাপমতি এজিদের নিষ্ঠুর অন্তঃকরণে যে বিদ্বেষবহ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়, সে আগুণে হজরত ইমাম হাসন ভস্মীভূত হয়েন_সমস্ত নবী বংশ ছারখার হইয়া যায়৷ সেই মর্মান্তিক দুঃখকাহিনী লিখিতে লেখনী সরে না৷ সুতরাং আমরা পুথিখানি লইয়াই দুটি কথা বলিব৷
গ্রীয়ারসন বা হরপ্রসাদ পড়লে হয়তো অবাক হতেন৷ সুতরাং কেন? পুথির বিবরণীতে তো পুথি আলোচনাই হবে, বড় জোর মূল আখ্যান প্রসঙ্গক্রমে থাকবে৷ পুথিটি তো ৬ পৃষ্ঠা, 'কাগজ একেবারে তাম্রকূটপত্র৷' অথচ কাহিনীটি যে মহাকাব্য, মহররম গাথা বা বিষাদসিন্ধুর অনুরণনের৷ তাই সমস্ত নবীবংশকে ঘিরে আখ্যানকাব্যের ট্রাজেডির রসে সামান্য চৌতিশাও যে বঞ্চিত নয়, খণ্ডের মধ্যে অখণ্ড আছে, সেই রসে মনভরপুর থাকলেই তবে পুথিটির তাত্প র্য বোঝা যাবে, সেটা বোঝাতেই যেন পুথিপ্রেমিকের এত আক্ষেপ৷ পুথির নিহিত মূল্য নয়, পুথির ভাবপরিমণ্ডল ও পুথিপাঠকের রসবোধই যেন জয়নবের 'চৌতিশা'কে বিশিষ্ট করে তুলল৷

মুনশী আবদুল করিমের প্রিয় কাব্য, দৌলত উজির বাহরাম খাঁ বিরচিত, লায়লী মজনু৷ এই পুথি সম্পাদনা করেই তো সুযোগ্য উত্তরাধিকারী আহমদ শরীফ পিতৃব্যের ধারাকে বহন করার অঙ্গীকার করেন৷ তালিকার সময় আবদুল করিমের সংগ্রহে কুল্যে একটা পুথি, তাও 'বর্ণজ্ঞানহীন মুসলমান লিপিকরের' হাতে পড়ে একেবারে অবোধ্য হয়ে গেছে৷ অথচ বোঝা যায় যে, 'ভাষা কোমল ললিত সরস'৷ গোটা বিবরণীতে পুথিটির পাতা কত, কী লিপিতে বিন্যস্ত ইত্যাদি কিছু নেই, কাগজের বিবৃতিও নেই৷ আছে একটি বিশেষ পাঠের বর্ণনা৷
ইহার ভাষা বৈষ্ণবকোবিদকুলকুহরিত দূরাগত নৈশানিল সমাগত সঙ্গীত ধ্বনিবত্‍ সুমিষ্ট সেই ব্রজবুলি,_প্রেমপ্রবণ বাঙ্গালী হৃদয়ের সেই প্রেমের ভাষা৷ ... সকলেই জানেন, লায়লী-মজনু বিয়োগান্ত কাব্য৷ মজনু ও লায়লীর জন্য বড় দুঃখ হয়৷ বাস্তবিক বাঙ্গালীর কোমল হৃদয়ে বিয়োগের মর্মভেদী তীব্র যন্ত্রণা অসহ্য৷ তাই এই গ্রন্থের
লায়লী লায়লী বলি হইল নৈরাশ৷
মজনু ঘরেতে রইল ছাড়িয়া নিঃশ্বাস৷
এই শেষ ছত্র পড়িয়া আমাদের কোমল হৃদয় নৈরাশ্যের গুরুভারে আপনিই দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে৷

অবশ্যই মুনশী আবদুল করিমের নাড়িজ্ঞান প্রখর, দৌলত উজির বাহরাম খানের তত্স ম শব্দ প্রয়োগ ও লৌকিক বাক্যবন্ধ গাথাকাব্যের নজির৷ কিন্তু তাকে ছাপিয়েও আবদুল করিম সাহিত্যপাঠের রীতি তালিকায় বসিয়ে দিলেন ব্রজবুলি, সেই শব্দের হাত ধরে এল বৈষ্ণবীয় প্রেমগাথা, বিরহকাব্য ও বাঙ্গালী কোমল হৃদয়ের নির্মিতি৷ লিপিকর যতই প্রমাদ করুন না কেন, কাহিনী যেখান থেকেই আসুক না কেন, পাঠের রস বাঙ্গালীর কাছে তৈরী আছে, পুথিটি যে তাদের, আবদুল করিম তাদেরই একজন৷ তাই মজনু ও লায়লীর জন্য তাঁর দুঃখ হয়৷ বাঙালীসিদ্ধ সংস্কৃতি, হৃদ্য স্বভাব ও পুথির বিচার_এইসবের যোগ যে স্বাভাবিক, এতে আবদুল করিমের কোন দ্বিধা নেই৷

পুথিবিচার শুধু পড়া নয়, সালতামামির হিসেব নয়, বরং তা সর্বতোভাবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, নানা পারফমেন্সে পূর্ণ, আবদুল করিমের বিচারে সেখানেই পুথির মাহাত্ম্য৷ প্রাচীন পুথির তালিকার শেষে ৬০০ নং পুথির বিচারে আবদুল করিম ফাঁপরে পড়েছেন৷ 'জীর্ণশীর্ণ' পুথি, আদ্যন্ত খণ্ডিত, নাম নেই৷ শুরুই করছেন, 'ইহা যে কি পুথি, কিছুই বুঝিতে পারিলাম না৷' হাল ছাড়ার পাত্র নন মুনশী আবদুল করিম৷ পরে এটাকে কতকগুলি ঘোষা বা ধূয়ার সংগ্রহ বলছেন, গানের পংক্তি মাত্র৷ সিদ্ধান্তে আসছেন, 'ইহা যে কিরকম পুথি, লেখনী যোগে তাহা বুঝান অসম্ভব৷ বোধহয়, তাল-লয়-সহকারে জাগরণ পাঠ ও গান করিবার সময় ব্যবহার করিবার উদ্দেশ্যেই এই সকল ঘোষা সংগ্রহ করা হইত৷' বলে ধুয়াগুলি তিনি উদ্ধৃত করছেন আর বলছেন, 'কিন্তু আরো কয়েকটি ধুয়া উদ্ধৃত না করিলে মনের খেদ মিটিতেছে না৷ ইচ্ছা হয় সমস্ত ধুয়াগুলিই উদ্ধৃত করিয়া দেখাই৷' ইচ্ছামত নামও দিচ্ছেন, "ইহাতে কেবল ঘোষা সংগৃহীত হইয়াছে বলিয়া আলোচনার সুবিধার্থ ইহাকে জাগরণের ঘোষা নামে অভিহিত করিলাম৷"

পুথির বিচার হচ্ছে পারফরমেন্সে, রসের আস্বাদনে৷ ধুয়া তুলছেন, লিখে পুথি বর্ণনা করা সম্ভব নয়, গান শুনতে হবে, সুরে মজতে হবে৷ পুথির কাজ শুধু ইতিহাস পরিক্রমা নয়, রসে মজে যাওয়া_এই বোধে আবদুল করিম প্রত্যয়ী৷ কার্য্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়েও আবদুল করিমের কাছে সহজ বর্তমানের অভিজ্ঞতাই ধূসর অতীতকে ব্যাখ্যা করতে পারে৷ উদাহরণ দেওয়া যাক৷ মৃগলুব্ধ সংবাদ বলে সম্পাদিত পুথিটির ভূমিকা লিখছেন আবদুল করিম৷ তাঁর সাব্যস্ত অনুযায়ী, কবি রামরাজ বড়ুয়া মগ, তিনিই শিবচতুর্দ্দশী ব্রতের মাহাত্ম্যগাথা লিখছেন৷ রচনার কার্যকারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুনশী মোক্ষম মন্তব্য করেন, "সাত সমুদ্র তের নদী পার হইয়া জমর্্মণ বংশীয় ম্যাকসমূলার যদি হিন্দুর বেদ বেদান্ত বিষয়ে গ্রন্থাদি লিখিতে পারেন, আর এই গ্রন্থের অকিঞ্চন সম্পাদক যদি স্বীয় জীবনের সুদীর্ঘ পঞ্চবিংশতি বর্ষকাল হিন্দু সাহিত্যালোচনায় কালক্ষেপণ করিতে পারেন, তবে কবি রামরাজ একখানি মাত্র হিন্দুগ্রন্থ লিখিয়া এমন কি অপরাধ করিয়াছেন বুঝিতে পারি না৷... মানুষের রুচি কখন কোনদিকে ধাবিত হয়, কে বলিবে?"

সাংস্কৃতিক অভ্যাস নির্ণয়ে অসামপ্রদায়িক মনোভাব অহরহই ঘটছে, প্রত্যক্ষ দৈনন্দিন জীবনচর্চাই যেন প্রমাণ৷ পরে আবদুল করিম নিজেই স্পষ্ট বলছেন, কবি রামরাজা হয়ত মগ ছিলেন, ইহা আমার একটা অনুমান মাত্র৷ সুধী সমাজে আমার এই মত গ্রহণযোগ্য হইবে কিনা জানি না৷ নিজের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে সরলমনে যাহা বুঝিয়াছি, তাহাই অকপটভাবে সাধারণের নিকট প্রকাশ করিয়াছি৷

বিনয় ও সারল্যের ভঙ্গিটুকু ছাপিয়ে ফুটে উঠছে আরেকটি বিচারের প্রকৃতি৷ পুথির তৌল বিচারে ভাষা বা তুলনামূলক রীতি, কোষ্ঠী বিচারের অপেক্ষা জোর দেওয়া হচ্ছে সাংস্কৃতিক অভ্যাসের উপর৷ এই অভ্যাসটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর, আবদুল করিম তারই অঙ্গ৷ রুচি-বিচারে তাঁর বর্তমান অভিজ্ঞতাই অতীত অনুমানের ভিত্তি৷ আর পুথি পড়া বা লেখা তো সার্বিক জনরুচির ফসল, পুথিরসিক আবদুল করিম তাই মনে করতেন৷ ঐতিহাসিক সালতামামির হিসেব সবসময় নাও পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু পুথি পাঠ ও বিচারের প্রেক্ষাপট হিসেবে জনরুচি আজও আছে, তিনি তার প্রতিনিধি৷ এই অন্তলর্ীন বিচারক্ষমতা পুথির বহিরঙ্গের বিচার থেকে আলাদা৷ গোত্র ও কুলজি নির্ণয়ে কুললক্ষণ অপরিহার্য, তার কেতাবি কানুননামা থাকা দরকার৷ গোত্রে বসানো যায়৷ অন্তলর্ীন বিচারে পুথি বিশেষ অভিজ্ঞতা সিঞ্চিত, গোষ্ঠীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সংলগ্ন৷ আবদুল করিম সেই নাড়িটুকু জানেন, ফলে প্রতি পুথিই যেন বিশেষ৷ গ্রীয়ারসনের বহিরঙ্গিক নির্বিশেষ বিচার থেকে আবদুল করিম এখানে বিশেষ স্বক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন৷

আলাওলের খোঁজে

এইরকম কথা বলা আমার আদৌ উদ্দেশ্য নয় যে, প্রামাণিকতার দায় সাহিত্যবিশারদ স্বীকার করতেন না৷ আলাওলের পদ্মাবতীর প্রামাণিক সংস্করণ বার করাটাই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য৷ জীবদ্দশায় তাঁর স্বপ্ন সার্থক হয়নি, পরেও মাত্র একতৃতীয়াংশ ছাপানো সম্ভব হয়৷ পুথি-পরিচিতিতে সাহিত্যবিশারদ নানা পুথির কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু কোনটিকেই আদর্শ পুথি বলেননি৷ পুথির সমন্বয়ী পাঠে তিনি বিশ্বাসী৷

পুথি বিচার ও পুথি পাঠ

নিজেই স্বীকার করছেন, "বড় দুঃখ যে অসংখ্য হস্তলিপি সংগ্রহ করিলাম, তথাপি পদ্মাবতীর অনেক জায়গায় সুবোধ্য পাঠোদ্ধার করিতে পারিলাম না৷" কিন্তু তিনি যাত্রা শুরু করেছেন অন্যভাবে, মজলিসে৷ আলাওলের পদ্মাবতী সবচেয়ে জনপ্রিয়, তার নানা টীকা ব্যাখ্যান আছে৷ 'বাঙ্গালা প্রাচীন পুথির বিবরণে' সাংস্কৃতিক অভ্যাসটির বর্ণনা এইভাবে আবদুল করিম দিয়েছেন, "এই রূপবর্ণনা সাধারণের বোধগম্য নয়৷ তথাপি ইহা তাহাদের বড় আদরের জিনিস৷" কীভাবে বোধ্য হয়? "দুই একজন গায়ক বিবিধ রাগ-রাগিনীর ঝঙ্কারের সহিত বিবিধ ধূয়া ধরিয়া সমস্বরে পুথি পাঠ করিতে থাকে আর পণ্ডিত নামধারী ব্যক্তি পঠিত অংশের ব্যাখ্যা করিয়া শ্রোতৃবর্গেকে শুনাইয়া থাকেন৷"
আবদুল করিমের মমত্ববোধ এই অভ্যাসের পক্ষে৷ যেমন,
একসময় চট্টগ্রামে এই 'পুথি পড়ার' বিশেষ আদর ছিল৷ অধুনা জীবনসংগ্রামের কঠোরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই নির্দ্দোষ আমোদপ্রবণতা লোকসমাজে হ্রাসপ্রাপ্ত হইয়াছে৷ অদূর ভবিষ্যতে ইহা স্বপ্নের কাহিনীতে পরিণত হইতে পারে৷
কিন্তু নস্টালজিয়া / লোকঅভ্যাস তো আর প্রামাণিকতার বিকল্প হতে পারে না৷ আবদুল করিম উদাহরণ দেন৷

পদ্মাবতীর রূপবর্ণনা হইতে নমুনা দিতেছি৷
জন্মান্তর বাঞ্ছা সিদ্ধি হৈতে সহসাত৷
ত্রিভিনি উপরে জেন ধরিছে করাত৷

ব্যাখ্যা : জনর্্ম হেইয়া পৈর্জ্যন্ত যাশা সিদ্ধি হওয়ার কারণ অবিলম্বে এক জাগার নাম তাহাতে এক খরগ সৈন্যে (শূন্যে আছে) সেই খরগের নিচে হিন্দুরা বেত্য করে৷ জেমত সেই খরগ এইখানে ধরিয়াছে৷' ...পণ্ডিতগণের মুখে এই ভাবের ব্যাখ্যা শুনিয়া শ্রোতৃবর্গের মধ্যে বাহবার উচ্চরোল পড়িয়া যায়৷ পাণ্ডিত্যের দৌড় দেখিয়া অনেকে আবার বিস্ময়ে হা করিয়া থাকিত৷
এই লোকায়ত আলাওলকে শোধিত করে একটি শুদ্ধ সংস্করণ আবশ্যক, এই বিষয়ে তাঁর সাধনার শেষ নেই৷ অন্যপক্ষে পাণ্ডিত্য জবাবীর মধ্যেও আলাওল নেই৷ গফুর সিদ্দিকী ও ভট্টাচার্যের সঙ্গে সাহিত্যবিশারদের বিতর্ক তীক্ষ্ন, সামপ্রতিক রচনাবলীতে তা মুদ্রিতও হয়েছে৷ যেখানে বারবার সাহিত্যবিশারদ বলছেন যে, আলাওলের আত্মপরিচিতি গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে, ফরিদপুর আলাওলের আদিনিবাস নয়, আর পুথিতে শব্দটি হল আলুলেশ, তাকেই সিদ্দিকী 'আঙ্গলেশ' পড়ছেন৷ আবদুল করিম স্পষ্টই ঘোষণা করছেন, "ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি ঐকান্তিকী নিষ্ঠা থাকা চাই ও তাহার প্রত্যেক উক্তির পেছনে যুক্তি ও প্রমাণ থাকা আবশ্যক৷" লোককল্পনা ও পণ্ডিতিকল্পনা পাঠবিচারে শেষ নির্দেশ হতে পারে না৷
অথচ ইতিহাসবিচারে সঙ্কোচন ও প্রসারণ দুটোরই দায়ে যেন আবদুল করিম৷ দ্রোণাচার্য আবদুল করিম এনামুল হকের সঙ্গে আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য লিখছেন, দীনেশচন্দ্র ভূমিকা লিখছেন, বৃহত্‍ বঙ্গের প্রকাশ আসন্ন৷ রোসাঙ্গে কীভাবে এক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই ভাষা গেড়ে বসছে, সেটাই হয়ে উঠছে পরিচিতির বাহন৷ চট্টগ্রামের আলাওল, করিমের চোখে,
মহাকবি আলাওল বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ৷... মধ্যযুগীয় বঙ্গসাহিত্যে তিনি মধ্যাহ্ন ভাস্করবত্‍ দেদীপ্যমান৷ তাঁহার প্রতিভার ভাস্কর জ্যোতিতে সমগ্র বঙ্গসাহিত্য আলোকিত হইয়া রহিয়াছে৷ তিনি একদিকে মুসলমান জাতির মধ্যে স্বর্ণসিংহাসনে সমাসীন, অপরদিকে সমসাময়িক হিন্দু কবিকুলেও তাঁহার আসন অতি উচ্চে৷ ...একদিকে হিন্দুশাস্ত্র ও সাহিত্যে এবং অপরদিকে মুসলীম শাস্ত্র ও ফারসী সাহিত্যে তাঁহার যেরূপ গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় তেমনটি আর কোন মুসলমান কবির মধ্যে পাওয়া যায় না৷... তাঁহার আবির্ভাবে চট্টগ্রাম ধন্য৷
শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী কবি, মুসলমানজাতির মহাকবি, আবার চট্টলবাসী_তিন পরিচিতিতই তো আলাওল৷ জোবরা গ্রামই আলাওলের জন্মস্থান_এই চিন্তায় আবদুল করিম অনড়৷ নানা আত্মপরিচিতি থেকে আলাওলের পরিচয় হচ্ছে অমাত্য, মগরাজার ওমরাহ মাগন ঠাকুরের প্রিয়পাত্র৷ তাঁরই নির্দেশে পদ্মাবতী লেখা৷ পরে শাহ সুজার আগমনে আলাওল-এর সাময়িক ভাগ্য বিপর্যয় হয়৷ আলাওলের কাব্যে যেন লোকসমাজ প্রাণ পেয়েছে, পূবর্্ববঙ্গীয় মুসলমান সমাজের চিত্র হচ্ছে এই দর্পণ৷ সাহিত্য হলো সমাজের গোষ্ঠীচেতনার বাহন, এই হচ্ছে আরাকান রাজসভার বাঙ্গালা সাহিত্যের সিদ্ধান্ত এবং তার প্রভাব আজও পূর্ববাঙ্গলায় বিদ্যমান৷

অঞ্চল ও ভাষা

আলাওল পড়া হচ্ছে, নৃতত্ত্বের ছক অনুযায়ী সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলমান সমাজ দেখানো হচ্ছে৷ সভ্যতার সংস্কৃতির ছকও জেঁকে বসছে৷ যেমন, "সপ্তদশ শতাব্দীতে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা কোন উল্লেখযোগ্য বাঙ্গলা সাহিত্যের সৃষ্টি করেন নাই বলিয়াই আমাদের ধারণা; কেননা এযাবত্‍ বাঙ্গলার ঐদিক হইতে মুসলমানদের এমন কোন প্রাচীন সাহিত্য আবিষ্কৃত হয় নাই৷ পূর্ববঙ্গের সাধারণ মুসলমান সমাজ, পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মুসলমান সমাজ হইতে ইসলামী আচার ব্যবহার, ধর্ম ও সভ্যতা প্রভৃতি অনেক বিষয়ে উন্নত;... এখনও পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মুসলমান সমাজের পার্থক্য বিস্তর; মুসলমান ধর্ম ও সভ্যতার অনেক বিষয় এখনও পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মুসলমানের নিকট সম্পূর্ণ অপরিজ্ঞাত বস্তু৷"
এই অনুন্নতির মূল কোথায়, বীজ কোথায়? কেন? ভাষায়৷ তাঁদের মতে, পূর্ববঙ্গের 'বাঙ্গাল' মুসলমানেরা 'বাঙ্গালা ভাষাকে মাতৃভাষারূপে গ্রহণ করিয়া বিরাট জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টি করছেন', তখন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান নিদ্রিত, উত্তরবঙ্গ নড়েচড়ে বসছে৷ ভৌগোলিক ভাগ ও জাতীয় সাহিত্য লক্ষ্য করার মতো৷ প্রমাণ কী? কেন পুথি? সপ্তদশ শতকে বাঙ্গাল কবি মোহাম্মদ খান আর ঘটি কবি মোহাম্মদ ইয়াকুব কারবালা নিয়ে জঙ্গনামা লিখছেন৷ শাহাদতের শ্লোকে মোহাম্মদ খান নয়টি ফারসী শব্দ এনেছেন, তাও নাম৷ আর এয়াকুব আনছেন একত্রিশটি শব্দ, ভাষাটাই যেন 'দোভাষী৷' একেই বলা হচ্ছে খিচুড়ী বাংলা, 'উদর্ুর মামদো ভূত চাপাবার' চেষ্টা৷ ভাষা মেরুদণ্ডহীন, তবে সমাজের গতিই বা কী হবে?
পুথিবিচারের এই পদ্ধতি একদিনে তৈরি হয়নি; ইসলামী সংস্কৃতির ব্যাপ্তি ও আঞ্চলিক স্থানীয় ভাষা থেকে সংস্কৃতির গোত্র-লক্ষণ তৈরি৷ তার প্রথম রচিত তালিকাতে আবদুল করিম টানাপোড়েনটি লক্ষ্য করছেন, পুথির অনন্য সমস্যা ভাবছেন৷ যেমন নূরফরামিস নামার সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে ১৯১৩ সালে তিনি বলছেন, নূর নবির মজলিসে পুথি পড়া হচ্ছে

একদিন সভামধ্যে নির্জনে বসিয়া৷
পুণ্য পরস্তাব কথা সুনাইল পড়িয়া৷
তা সুনিয়া সবে মিলি হরসিত হইয়া৷
কহিলা কিতাব বাণী নিশ্চএ জানিল৷
কিতাব অব্যাস নাহি পড়িতে না পারি৷
নিসি দিসি পড়ি শুনি মনে শ্রধা করি৷৷
বুদ্ধি ক্রেমে তোহ্মা কৃপা জদি থাকে মনে৷
বাঙ্গালা ভাসে রচি দেয় পড়ি সর্বজনে৷
দয়াময় রসুল্লা, তাই তিনি ফুকরে ওঠেন,
তা সুনিয়া নবীর কহিলেকে পুনি৷
হাসিবেক সবর্্বজনে পড়ি শুনি জানি৷৷
সবে মিলি সম্ভূ দিয়া লাগীলা কহিতে৷
জে হৌক সে হৌক জনে পুণ্যভাব চিত্তে৷
তা সব বচন শুনি নবী মহাসএ৷
আবদুল করিম স্থানে হুকুম কর এ৷
ফারসি ভাসেত শুনি না বুঝে কারণ৷
বাঙ্গালা ভাসাতে তোহ্মি করহ রচন৷
আবদুল করিমে সুনি মনেত ভাবিয়া৷
বাঙ্গালা ভাসেত রচে প্রভু প্রণামিয়া৷

সাহিত্যবিশারদ আব্দুল করিম ১৯১০-এ পুরো উদ্ধৃতিই দিচ্ছেন, পুথি পড়ছেন, পরে থমকে মন্তব্যটি করছেন,
সে কালের গ্রন্থরচয়িতারা স্বীয় গ্রন্থের মাহাত্ম্য বর্দ্ধনের জন্য কতরূপ মিথ্যা বুজরুকির ভান করিতেন, প্রাগুদ্ধৃত অংশটি তাহার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷ কোথায় ইসলাম ধর্ম প্রবর্তক হজরত মোহাম্মদ, আর কোথায় বাঙ্গালা ভাষা, এবং বঙ্গ ভাষাভাষী এই লোক৷ দেশকালের ব্যবধান পরিজ্ঞাত থাকিলে এই সরলচিত্ত লেখক কখনই এরূপ অনৃতবাদে আপন লেখনী কলঙ্কিত করিতেন না৷
ভাষার বিন্যাসে স্বর ধরা পড়ে৷ ইসলামি শাস্ত্র প্রচার আবার বাঙ্গলা ভাষা, পুথিতে খাঁটি ইতিহাস গুলিয়ে যায়, লেখক সরলচিত্ত, আবার গ্রন্থের গৌরবর্দ্ধনে গল্প চালাচ্ছেন৷ উদ্দেশ্য ও রীতির এক বিশেষ বিচার৷
ত্রিশের দশকে ঐ একই গোত্রগ্রন্থ আবদুল হাকিমের নূরনামাকে বিচার করছেন সাহিত্যবিশারদ৷ সেখানে আবদুল হাকিম আদৌ সরলচিত্ত লেখক নন, বরং বিজ্ঞ ভাষা প্রেমিক,
জে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী৷
সে সব কাহার জন্ম নির্ণএ ন জানি৷
দেসি বিদ্যা জার মনে না জুয়া এ৷
নিজ দেশ তেআগী কেন বিদেসে ন জাএ৷
মাতাপিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি৷
দেশি ভাসা উপদেস মন হিত অতি৷

তাই শাস্ত্র ও ভাবধারাকে ছাপিয়ে ভাষাকে পুথি অাঁকড়ে ধরছে, তারই রীতি ও আদান-প্রদানের মধ্যে গড়ে উঠছে, "ভাষাকে ঘিরেই যেন দেশকে অধিক শক্ত করে অাঁকড়ানো হচ্ছে", হিন্দুরাও 'কিতাবিয়া' হয়ে পড়ছেন৷ তাঁর অসামান্য গবেষণা গ্রন্থে মমতাজুর রহমান তরফদার দেখাচ্ছেন যে, বঙ্গের মুসলমান সমাজ আদৌ বিচ্ছিন্ন নন, আওয়্যাধী-হিন্দীকাব্যের ঐতিহ্য উত্তর ভারতের নানা প্রেমোপাখ্যানের সঙ্গে মধ্যযুগের বাংলার গাথাসাহিত্যের যোগ নিবিড়৷ কিন্তু ভাষ্য তো দেশী, শ্রোতাও তাই৷ তাই রূপটিও অনেক পরিবর্তিত ও সংহত৷ নবরাজ মজলিসের আমলে নিজাম গজনভীর সিকন্দরনামা অনুবাদ করতে গিয়ে আলাওল এই সমস্যায় পড়ছেন,

ভাঙ্গিয়া বএত ছন্দ রচিতে পয়ার৷
সমুদ্রে সাতার সম গ্রন্থের গ্রন্থন৷
বিশেষ পারস্য ভাষা বএত ভাঙ্গন৷
মোহন্ত নেজামী বাক্য ইঙ্গিত আকার৷৷
বিশেষত পঞ্চভাস কিতাব মাঝার৷
আরবী ফারসী আদ্য নছানী এহুদী৷
পাহলবি সঙ্গে পঞ্চভাষের অবধি৷
আমি ক্ষুদ্র বুদ্ধি তারে রচিতে অশক্য৷
কোল শ্রীমন্ত মজলিস ভাগ্য অলক্ষ্য৷

নিজের মতো করে আলাওল তার লেখার পরিসরের কৈফিয়ত দেন৷ কোরআনের মাহাবেগ দোহাই পেড়ে তিনি কথার গৌরব, কাব্যের প্রশস্তি গান৷ আবদুল করিমের আলোচনা ও সম্পাদনায় সেই রচনাই দেশী ভাষার গৌরবগাথা হয়ে ওঠে, বাংলা ভাষার ঐতিহ্যে পরিণত হয়, পূর্ববাংলার সত্তার নির্দিষ্ট কুললক্ষণ তিনি দেখতে পান৷ পুথি সাহিত্যের সম্পাদনায় সময়ের আত্মসাতে দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে আবদুল করিমও অগ্রগামী৷ বটতলায় পুথি প্রকাশকরা দাবি জানায় যে তারা আলাওলের নাতির কাছ থেকে বই ছাপাবার স্বত্ব কিনেছে, সেটাই তাদের প্রমাণিকতার দাবি৷ আবদুল করিম সেই দাবিকে নাকচ করেছেন, আলাওলকে মধ্যযুগে খুঁজে বার করেন৷ রাজসভায় সেই আলাওল নিজেকে প্রকাশ করেছেন, এক রাজসভায়, কবিকৃতির গৌরবটুকু তাঁর প্রাপ্য৷ পরে দুইশত বছর ধরে পুথি সাহিত্য ও পঠনের চর্চাতে গোষ্ঠী ও সমাজের সঙ্গে আলাওল জড়িত৷
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×