স্বপ্ন নয় — শান্তি নয় — ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাছ তুচ্ছ হয়, পন্ড মনে হয়,
সব চিন্তা — প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়!............
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি জীবনানন্দ দাশ। বাংলার রুপ বৈচিত্র্যকে নিঙ্গড়ে বের করে আনা,এমন করে আলো অন্ধকারের রহস্যময়তাকে শব্দের ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তোলা, হাজার হাজার বছরের উপলব্ধির, বোধের, গভীরতার কথা আর কোনো কবি তার কবিতায় তুলে এনেছেন কিনা আমার জানা নেই! আমার কাছে জীবনানন্দের কবিতা মানেই যেন রুপসী বাংলার অকৃত্রিম সৌন্দর্যের এক তৈলচিত্র ,কিংবা সাধারন নর-নারীর সাধারন মানবিক অনুভুতিগুলোকেই কোন এক রহস্যের ঘেরাটোপ জড়িয়ে স্বাপ্নিক কিংবা ঐশ্বরিক উপলব্ধিতে পরিনত করে কুয়াশাচ্ছন্ন সুদূরে মিলিয়ে দেয়া!কবিতা পড়ে ঠিক উঠে যাওয়া নয়,আপাদমস্তক ডুবে যাওয়া!
কবিতার মতই তার জীবন কাহিনীও ছিল বৈচিত্র্যে ভরপুর!অসাধারন খ্যাতিমান এই কবি তার জীবদ্দশায় ছিলেন একেবারেই প্রচার বিমুখ।তাছাড়া তার বেশ কিছু কবিতা সমালোচনায় বিদ্ধ হওয়ার কারনে তিনি নিজ কবিতার অবমূল্যায়নে চিন্তিত হন।তিনি নিজেই নিজের কবিতার কড়া সমালোচকও ছিলেন বটে।আর তাই হয়ত তিনি নিভৃতে ১৪টি উপন্যাস এবং ১০৮ টি ছোটগল্প রচনা করলেও তার একটিও জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি!সাড়ে ৮শ'র বেশি কবিতা লিখলেও মাত্র ২২৬টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও কাব্যসংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। এমনকি রূপসী বাংলার সম্পূর্ণ প্রস্তুত পাণ্ডুলিপি তোরঙ্গে মজুদ থাকলেও তা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি জীবনানন্দ দাস। তবে তিনি এ কাব্যগ্রন্থটির নাম দিয়েছিলেন 'বাংলার ত্রস্ত নীলিমা 'যা তার মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত এবং রূপসী বাংলা প্রচ্ছদনামে প্রকাশিত হয়। আরেকটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয় মৃত্যু পরবর্তীকালে যা 'বেলা অবেলা কালবেলা' নামে প্রকাশিত হয়।কবিতার মতই জীবনানন্দ দাশ নিজেও ছিলেন রহস্যেঘেরা কুয়াশাচ্ছন্ন মরীচিকা,সকলের ধরা ছোঁয়ার একেবারেই বাইরে!হয়ত সেকারনেই তাঁর কবিতার দুর্নাম রটেছিল দুর্বোধ্য বলে!!সকল গভীরতা সকলে ছুঁতে পারে কি?কবি তাই নিজেই বলেছিলেন,"সকলেই কবি নয়,কেউ কেউ কবি!"
জীবনানন্দ দাশের জন্ম ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তের জেলাশহর বরিশালে ।তার পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক।আর মাতা ছিলেন, আমাদের সকলের সুপরিচিত কবিতা -"আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে" -'আদর্শ ছেলে' এর রচয়িতা কুসুমকুমারী দাশ।সম্ভবতঃ মা কুসুমকুমারী দাশের প্রভাবেই ছেলেবেলায় পদ্য লিখতে শুরু করেন তিনি।
তিনি ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে, তার ছোট ভাই অশোকানন্দ এবং বোন সুচরিতা। তিনি শিক্ষালাভ করেন প্রথমে বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলে ও ব্রজমোহন কলেজে, পরে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে ১৯২১ সালে এম. এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৩০ সালে শ্রীমতী লাবন্য দাসকে বিয়ে করেন। তাঁদের দুটি সন্তান, শ্রীমতী মঞ্জুশ্রী এবং শ্রী সমরানন্দ।
অধ্যাপনার কাজে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা ও সমাপ্তি।অধ্যাপনা করেছেন বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ।জীবনের শেষভাগে কিছুদিনের জন্য কলকাতার একটি দৈনিক পত্রিকা স্বরাজ-এর সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনায় নিযুক্ত ছিলেন।তার কর্মজীবন মসৃণ ছিলনা আদেৌ। চাকুরীর অভাব তাকে আমৃত্যু কষ্ট দিয়েছে। একটি চাকুরীর জন্য হন্যে হয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবিকার অভাব কিছুটা পুষিয়েছেন।দুই দফা দীর্ঘ বেকার জীবনে তিনি ইন্সুরেন্স কোম্পানীর এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন এবং প্রধানত গৃহশিক্ষকতা করে সংসার চালিয়েছেন। এছাড়া ব্যবসার চেষ্টাও করেছিলেন বছরখানেক। দারিদ্র্য এবং অনটন ছিল তার কর্মজীবনের ছায়াসঙ্গী।
১৯১৯ সালে তাঁর লেখা 'বর্ষা আবাহন' কবিতাটি ব্রহ্মবাদী পত্রিকার ১৩২৬ সনের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা।তখন তিনি শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত নামে লিখতেন। ১৯২৭ সাল থেকে তিনি জীবনানন্দ দাশ নামে লিখতে শুরু করেন।জীবদ্দশায় তাঁর ৭টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।বুদ্ধদেব বসু ছিলেন জীবনানন্দের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং তার সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকায় জীবনানন্দের বহু সংখ্যক কবিতা ছাপা হয়।১৯৫২ খৃস্টাব্দে তাঁর জনপ্রিয় কবিতার বই 'বনলতা সেন' সিগনেট প্রেস কর্তৃক পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয়। বইটি পাঠকানুকূল্য লাভ করে এবং নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন-কর্তৃক ঘোষিত "রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কার" জয় করে। ১৯৫৪ খৃস্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত হয় 'জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা'।বইটি ১৯৫৫ খৃস্টাব্দে ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করে।
জীবদ্দশায় অসাধারণ কবি হিসেবে পরিচিতি থাকলেও তিনি খ্যাতি অর্জন করে উঠতে পারেননি তার প্রচারবিমুখতার কারনে।তবে মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তিনি বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতার পথিকৃতদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের জীবন এবং কবিতার উপর প্রচুর গ্রন্থ লেখা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, বাংলা ভাষায়। এর বাইরে ইংরেজিতে তার ওপর লিখেছেন ক্লিনটন বি সিলি, আ পোয়েট আর্পাট নামের একটি গ্রন্থে। ইংরেজি ছাড়াও ফরাসিসহ কয়েকটি ইউরোপীয় ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে।
জীবনানন্দের জীবনের মত মৃত্যুও রহস্যপূর্ণ !গত এক শত বৎসরে ট্রাম দুর্ঘটনায় কোলকাতায় মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র একটি। তিনি আর কেউ নন, কবি জীবনানন্দ দাশ!!
১৪ই অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। জলখাবার "জুয়েল হাউজের" সামনে দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করছিলেন জীবনানন্দ দাশ। শুধু অন্যমনস্ক নয়, কী এক গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন কবি। চলন্ত ডাউন বালিগঞ্জ ট্রাম স্পটিং স্টেশন থেকে তখনো প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ হাত দূরে। অবিরাম ঘণ্টা বাজানো ছাড়াও বারংবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করছিল ট্রাম ড্রাইভার। কিন্তু আত্মমগ্ন কবির যেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই,ফলে যা অনিবার্য তাই ঘটলো। গাড়ি থামল যখন, প্রচন্ড এক ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গেই কবির দেহ ক্যাচারের ভিতর ঢুকে গেছে। ক্যাচারের কঠিন কবল থেকে অতি কষ্টে টেনে হিঁচড়ে বার করলেন সবাই কবির রক্তাপ্লুত, অচেতন দেহ। কেটে, ছিঁড়ে থেঁতলে গেছে এখানে সেখানে।।চুরমার হয়ে গেছে বুকের পাঁজরা, ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠা, ঊরু । গুরুতর ভাবে আহত জীবনানন্দের চিৎকার শুনে ছুটে এসে নিকটস্থ চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল এবং অন্যান্যরা তাঁকে উদ্ধার করে। তাঁকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। এ সময় ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ সহ অনেক তরুণ কবি জীবনানন্দের সুচিকিৎসার জন প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাশ এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর অনুরোধেই পশ্চিম বঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কবিকে দেখতে এসেছিলেন এবং আহত কবির সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছিলেন যদিও এতে চিকিৎসা্য তেমন উন্নতি কিছু হয় নি। এ সময় স্ত্রী লাবণ্য দাশকে কদাচিৎ কাছে দেখা যায়। তিনি টালিগঞ্জে সিনেমার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। জীবনানন্দের অবস্থা ক্রমশঃ জটিল হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন কবি। চিকিৎসক ও সেবিকাদের সকল প্রচেষ্টা বিফলে দিয়ে ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে রাত্রি ১১ টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
জীবনানন্দ গবেষক ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ মনে করেন জাগতিক নিঃসহায়তা কবিকে মানসিকভাবে কাবু করেছিল এবং তাঁর জীবনস্পৃহা শূন্য করে দিয়েছিল। মৃত্যুচিন্তা কবির মাথায় দানা বেঁধেছিল। তিনি প্রায়ই ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন।অনেকের মতেই জীবনানন্দ আত্মহত্যা করেন!যদিও প্রত্যক্ষদর্শীর মতে এ সময় দুই হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে ট্রাম লাইন পার হচ্ছিলেন কবি। আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়ে দুই হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে গৃহে ফেরার সড়কে ওঠার জন্য ট্রাম লাইন পারি দেয়া খুব গ্রহণযোগ্য যুক্তি নয়।
অপরদিকে যখন ট্রাম পরবর্তী অবস্থার বর্ণনা সুবোধ রায়ের মুখে শুনতে পাই তখন যথার্থই বিব্রত হয়ে পড়ি । সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারিনা। সুবোধ রায়ের ভাষ্যমতে ,
"শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালে দু নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয় কবিকে। খবর পেয়ে দেখতে আসেন অনেকেই। এসে পড়েন কবির নিকটাত্নীয় স্বনামধন্য চিকিৎসক শ্রী অমল দাশ, এবং আরেকজন খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ ডঃ এ.কে.বসু। ডাক্তার অমল দাশকে দেখে ধড়ে প্রাণ এলো কবির, "কে বুবু ? বুবু এসেছিস ? বাঁচিয়ে দে....।" বেঁচে থাকার জন্য কবির ব্যাকুল আর্তি !
থাক,কিছু রহস্য নাহয় ঘিরেই থাক বাস্তব আর অবাস্তবের লীলাখেলায় মত্ত জীবনানন্দের মৃত্যুকে ঘিরে!বরং কবির মৃত্যু দিনে তাকে স্মরন করি তার কবিতার গভীরতায়-
তবু এ মৃতের গল্প; কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোন খাদ,
সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধু
মধু-আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাবাতের গ্লানি বেদনার শীতে
এ-জীবন কোনদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।
জানি – তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় -
আর এক বিপন্ন বিষ্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে,
ক্লান্ত – ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।
তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি,আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,
চোখ পাল্টায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে ?’

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



