somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর হামলা ও 'ধর্মানুভূতির উপকথা'

২০ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ (২০ জানুয়ারি) দৈনিক সমকালে প্রকাশিত

ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর হামলা ও 'ধর্মানুভূতির উপকথা'

রোবায়েত ফেরদৌস, বাকি বিল্লাহ, ড. দীপেন ভট্টাচার্য, শরৎ চৌধুরী, বদরুন নাহার সুচন্দা চৌধুরী, অভিনু কিবরিয়া ইসলাম, অদিতি ফাল্গুনী


নিত্যদিনের রুটিন অপরাধ সংবাদ হিসেবেও এই হত্যাচেষ্টার খবর আমাদের মুদ্রণ ও তড়িৎ গণমাধ্যমে বিশেষ একটা আসেনি। গত ১৪ অক্টোবর রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে উত্তরা ১১নং সেক্টরের সামনে একটি আইটি ফার্মে রাতের শিফটে কাজে ঢোকার সময় হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন আঠাশ বছর বয়সী তরুণ ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন। সাম্প্রতিক সময়ে মূলধারার সংবাদপত্রের পাশাপাশি বল্গগ ও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং মিডিয়া বা ফেসবুকে লিখে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের ঝড় তুলতে সক্ষম হচ্ছিলেন এই তরুণ।
আসিফের ওপর এই হামলা কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে করা হয়নি। করা হয়েছে আদর্শিক ভিন্নতার কারণে। আসিফ কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী নন। আসিফ মুক্তচিন্তার কথা বলেন, প্রগতির কথা বলেন। আসিফ বিভিন্ন বিষয়ে ধারালো যুক্তি দিয়ে লেখালেখি করেন। সরকারের মন্দ কাজের তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমালোচনা করেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭/৪ ধারাবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে লেখালেখি করায় তাকে ডিবি পুলিশের কার্যালয়ে আটক করে রাখা হয় এবং তাকে আর না লেখালেখি করার জন্য মুচলেকা দিতে বাধ্য করা হয়। আসিফ ধর্মান্ধতার মূলে কুঠারাঘাত করেন। বিভিন্ন বিষয়ে তার বক্তব্য হয়তো নানা বিতর্কেরও তৈরি করে।
আসিফের কোনো বক্তব্য হিন্দুধর্মের বিরোধী বলে মনে হলে একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু অপছন্দ করতে পারেন বা তার বক্তব্য ইসলাম ধর্মের ভাবনার সঙ্গে না মিললে একজন বিশ্বাসী মুসলিম তা অবশ্যই অপছন্দ করতে পারেন। কিন্তু তাই বলে রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে রিকশা থেকে অফিসে নামার সময় আসিফের মুখে কাপড় চাপা দিয়ে তার ঘাড়ে, গলায়, পিঠে ও বুকের পাঁজরে অসংখ্য ছুরির আঘাত করে কাপুরুষের মতো পালিয়ে যেতে হবে, এ শিক্ষা পৃথিবীর কোন্ ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থ কাকে দিয়েছে? আসিফের এই দুর্দশা দেখে আশপাশের 'ভদ্রলোকে'রা যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন এক রিকশাঅলা তাকে রিকশায় তুলে নিয়ে আসিফের অফিসের নিকটবর্তী এক ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করেন। সাহসী রিকশাঅলা এরপর আসিফকে আর একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান। ক্লান্ত ও মুমূর্ষু আসিফ তখনও জ্ঞান হারাননি। অটুট মনোবলে সেলফোনে তিনি তার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু বাকি বিল্লাহ ও ভগি্নপতিকে ফোন করলে তারা তার কাছে ছুটে যান। সেখানে আসিফকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তার রক্তপাত বন্ধ করে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় রাত ১টা ৪৫ মিনিটের সময়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্তব্যরত সার্জন ড. প্রতাপ সাহা তখুনি এক্স-রে করে রাত ২টা ৩০ থেকে ৫টা ৩০ মিনিট অবধি শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে আসিফের প্রাণ রক্ষা করেন। আসিফের আয়ুর জোরই বলতে হবে যে ছুরির আঘাত তার শিরদাঁড়ার খুব কাছে গিয়েও শিরদাঁড়ায় আঘাত করেনি। সবচেয়ে যেটা মর্মান্তিক ব্যাপার হলো যে, আসিফ যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই লড়ছেন, তখন সেই হামলার খবরে কিছু 'ধর্মান্ধ' আনন্দ প্রকাশ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন!
প্রয়াত লেখক ও ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদ 'ধর্মানুভূতির উপকথা' নামে একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। আমাদের দেশে এখন সবচেয়ে সহজে যা আহত হয় তা হলো 'ধর্মানুভূতি'। খোদ ধর্মেই যে অনুভূতি সবচেয়ে দৃঢ় কঠিন, হাজার আঘাতেও অনাহত থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, তাই যেন সবচেয়ে নাজুক আর স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রবীন্দ্রনাথের 'গোরা' উপন্যাসে গোঁড়া হিন্দু পিতার পরিবারে প্রতিপালিত আইরিশ শ্বেতাঙ্গ যুবক গোরা যখন 'ব্রাহ্ম' তরুণীর হাতে চা খাবার অপরাধে বন্ধু বিনয়কে তীব্র কটাক্ষ করে, বিনয় তখন বলে যে 'ধর্ম' এত অল্পে 'হারায়', তা 'হারানো'ই ভালো। আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলোর প্রতি আমাদের আস্থা কি এতই কম যে, একজন আসিফের মন্তব্যে তা মুছে যাবে? তাই তাকে হত্যা করার চেষ্টা করতে হবে?
বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯-এ বলা হচ্ছে : '(১) প্রজাতন্ত্রে নাগরিকদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকবে। প্রজাতন্ত্রে সকল নাগরিকের চিন্তা ও বক্তব্যের অধিকার রয়েছে, তবে শর্ত এই যে এই স্বাধীনতা (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব, জনশৃঙ্খলা, রুচি বা নৈতিকতার পরিপন্থী অথবা আদালতের প্রতি নিন্দাবাদ, অবমাননা বা কোনো অপরাধের জন্য প্ররোচনার কারণ হবে না।' ফেসবুকে আসিফের লেখাগুলো আমরা পড়েছি। সেগুলো কোনোমতেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব নষ্ট, অশল্গীলতা বা আদালত অবমাননার দোষে দুষ্ট নয়। তারপরও ধরা যাক আসিফের স্ট্যাটাসে সত্যিই যে কোনো ধর্ম সম্প্রদায়ের যে কোনো ব্যক্তি যদি আহতবোধ করেন, সেক্ষেত্রেও সেই ব্যক্তি দেশের প্রচলিত আইনে অর্থাৎ 'বাংলাদেশ ফৌজদারি দণ্ডবিধি'র ২৯৫ ক-এর আওতায় আসিফের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা দায়ের করে তাকে কারারুদ্ধ করার আবেদন জানাতে পারতেন। কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে 'হত্যাচেষ্টা' কি এই রাষ্ট্রের ক্রমাগত 'তালেবানিকরণে'র আলামত নয়? ১৯৭১ সালে লাখ লাখ প্রাণত্যাগ ও অগণিত নারীর সম্ভ্রমহানির বদলে আমাদের যে 'প্রজাতন্ত্র' গঠিত হয়েছিল তা আধুনিক 'গণতন্ত্র' ও 'মানবাধিকারে'র বাণীতে বিশ্বাসী। আমাদের আইন-আদালত ব্যবস্থাও 'ধর্মনিরপেক্ষ।' ১৯৯৩ সালে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী দণ্ডবিধি ২৯৫ (ক)-এর সঙ্গে (খ) ও (গ) যুক্ত করে 'কোরআন' ও 'ইসলামের নবী'র বিরুদ্ধে বলার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি যথাক্রমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ড করার বিল এনেছিলেন। পাকিস্তানি বল্গাসফেমি আইনের এই কার্বনকপি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ অবশ্য গ্রহণ করেনি। কাজেই আসিফের লেখায় এমন কিছু নেই, যা তাকে বাংলাদেশে প্রচলিত আইনের পরিপ্রেক্ষিতে মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠিন বিধান দান করতে পারে।
আর যেহেতু আমাদের সংবিধান নাগরিকদের চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের অধিকার স্বীকার করে, কাজেই রাষ্ট্র তার সেই অধিকার রক্ষায় বাধ্য এবং অধিকার রক্ষায় যারাই বাধা দেবে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়াটাও রাষ্ট্রের জরুরি কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। ভলতেয়ারের সেই বাণী নতুন করে বলাটা নিরর্থক, 'আমি তোমার মতবাদে বিশ্বাস না করতে পারি। কিন্তু তোমার বিশ্বাস রক্ষায় আমি প্রাণ দেব।'
আসিফকে হত্যাচেষ্টাকারীদের অবিলম্বে খুঁজে বের করে, দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় এনে তাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।

লেখকবৃন্দ : দেশে-বিদেশে অধ্যাপনা, লেখা ও মুদ্রণ প্রকাশনা ফটোগ্রাফি, ব্যাংকিংসহ নানাবিধ পেশায় জড়িত
২০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×