somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মতুয়া ধর্ম এবং বাংলাদেশের ওড়াকান্দি

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পবন সরকার

বাংলাদেশের গোপলগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানার ওড়াকান্দিতে হরিচাঁদ ঠাকুর মতুয়া ধর্মের প্রচলন করেন। বাংলাদেশে এমন একটি ধর্মের প্রচলন আছে তা আমার জানা ছিল না। দুই শত বছর পূর্বে এই ধর্মের প্রচলন হয়। বর্তমান পর্যন্ত এই ধর্মের অনুসারী চোখে পড়ার মত। লক্ষ লক্ষ ধর্মানুসারির আগমনে প্রতিদিনই ওড়াকান্দি মুখরিত থাকে। ফাল্গুনের বারুনি মেলায় মতুয়া ধর্মের অনুসারী আর ভক্তদের আগমনে পা ফেলার জায়গা থাকে না।

মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদ বা হিন্দু ধর্মের জাতপাত নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণেই নমঃজাতির ঘরে জন্ম নেয়া হরিচাঁদ ঠাকুর প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। ভারতবর্ষে যেমন বৈদিক তথা হিন্দুধর্মের প্রতিবাদী ধর্ম হিসাবে মহাবীর, গৌতম বুদ্ধ, গুরু নানক কর্তৃক জৈন, বৌদ্ধ, শিখ ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে ঠিক তেমনই হরিচাঁদ ঠাকুর বৈদিকধর্মের প্রতিবাদী হিসাবে অবৈদিক মতুয়াধর্মের সৃষ্টি করেন। কিন্তু দুখের বিষয়, জৈন, বৌদ্ধ, এবং শিখধর্মের লোকেরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে নিজস্ব ধর্মীয় আচার-আচরণ পালন করলেও মতুয়াধর্মের লোকেরা তেমন করেন না। তাঁরা অধিকাংশই বৈদিকধর্মের আচার-আচরণ পালন করে থাকেন।

মতুয়া শব্দের অর্থ মেতে থাকা বা মাতোয়ারা হওয়া। হরিনামে যিনি মেতে থাকেন বা মাতোয়ারা হন তিনিই মতুয়া। মতান্তরে ধর্মে যার মত আছে সেই মতুয়া ।

মতুয়া সম্প্রদায় একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী; তারা বৈদিক ক্রিয়া-কর্মে আস্থাশীল নয়। তাদের ভজন-সাধনের মাধ্যম হচ্ছে নাম সংকীর্তন। এই সাধনপদ্ধতির মাধ্যমে ঈশ্বরলাভই তাদের মূল লক্ষ্য। প্রেম ঈশ্বর লাভের অন্যতম উপায়। পবিত্রতা শরীর-মনে প্রেম জাগ্রত করে; ফলে প্রেমময় হরি ভক্তের হৃদয়ে আবির্ভূত হন। মতুয়া ধর্মে হিন্দু ধর্মের মত কোন জাত-পাত নেই, ধনী-দরিদ্র নেই, যে কোন বর্ণ বা ধর্মের লোক ঈশ্বরের সন্তান এই মনোভাব নিয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্যের মধ্যে সকলে মিলিত হয়।

এই ধর্মে নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত এবং বিধবা-বিবাহকে উৎসাহিত ও বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করা হয়েছে। নারী-পুরুষ সবাই এই ধর্মের প্রচার করতে পারে। যারা ধর্ম প্রচার করে তাদেরকে ‘গোঁসাই’ বলা হয়।

মতুয়াদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ "শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত"। মতুয়া ধর্মের কয়েকটি মূল বাণী হলো: ‘হরি ধ্যান হরি জ্ঞান হরি নাম সার। প্রেমেতে মাতোয়ারা মতুয়া নাম যার; জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা। ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা; কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খাই। বেদ-বিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই

মতুয়াদের ‘দ্বাদশ আজ্ঞা’ নামে পরিচিত বারোটি নিয়ম পালন করতে হয়,। সেগুলো হচ্ছে-- ১)সদা সত্য কথা বলা, ২)পরস্ত্রীকে মাতৃজ্ঞান করা, ৩)পিতামাতাকে ভক্তি করা, ৪)জগৎকে প্রেমদান করা অর্থাৎ সকল জীবকে ভালোবাসা, ৫)জাতিভেদ না করা, ৬)কারও ধর্মনিন্দা না করা, ৭)বাইরের সাধুসাজ ত্যাগ করা, ৮)শ্রীহরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করা, ৯)ষড়রিপু থেকে সাবধান থাকা, ১০)হাতে কাম মুখে নাম করা, ১১)দৈনিক প্রার্থনা করা ও ১২)ঈশ্বরে আত্মদান করা।

হরিচাঁদ ঠাকুর
হরিচাঁদ ঠাকুর ১৮১২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৭৮ সালে ইহধাম ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র আর এক মহামানব গুরুচাঁদ ঠাকুরের উপর তাঁর সমস্ত অসম্পূর্ণ কাজ পূর্ণ করার ভার দিয়ে যান। গুরুচাঁদ ঠাকুর পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর পিতার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।

হরিচাঁদ ঠাকুরের পিতার নাম যশোমন্ত ঠাকুর, মাতার নাম অন্নপূর্ণা। হরিচাঁদ ঠাকুরের বাল্যকালের নাম ছিল হরিদাস। হরিচাঁদ কারও দাসত্ব স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না, তাই ‘হরিদাস’-এর পরিবর্তে নিজেকে ‘হরিচাঁদ’ নামে পরিচয় দিতেন।

হরিচাঁদ ঠাকুরের স্ত্রীর নাম ছিল শান্তিবালা। তাঁর পিত্রালয় ছিল ফরিদপুর জেলার ‘জিকাবাড়ি’ গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল ‘লোচন প্রামানিক’।

হরিচাঁদ ঠাকুর প্রথাগত বিদ্যাশিক্ষার কোনো সুযোগ পাননি। তখনকার দিনে হিন্দু চণ্ডাল নমঃজাতিরা অস্পৃশ্য বলে তাঁদের বিদ্যাশিক্ষার কোনো অধিকার ছিল না। তাই তিনি লেখাপড়া শিখতে পারেননি। সুতরাং পুঁথিগত বিদ্যা তাঁর ছিল না। কিন্তু লেখাপড়া না জানলেও তিনি ছিলেন প্রখর বুদ্ধিমত্তা এবং অত্যন্ত মেধাসম্পন্ন জ্ঞানীব্যক্তি। নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তিনি সকলের সব প্রশ্নের মীমাংসা করে দিতেন। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও প্রখর বুদ্ধিমত্তার জোরে বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর বৌদ্ধিকদর্শন উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। কর্মজীবনে তাঁর এই জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা শোষিত বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মুক্তিদূত হিসাবে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের সর্বত্রই মতুয়ারা বাস করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, আন্দামান প্রভৃতি স্থানেও মতুয়ারা রয়েছে। গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে মতুয়াদের প্রধান মন্দির অবস্থিত। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের ত্রয়োদশী তিথিতে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষে সেখানে মেলা বসে।
-- সমাপ্ত --

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:৩৯
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×