কথায় বলে একবার না পারলে দেখ শতবার। কিন্তু প্রবাদটি আমার ক্ষেত্রে একেবারেই অচল। কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একজন নারীকে নিজের মতো করে কাছে পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছি। কিন্তু যতবারই চেষ্টা করি না কেন, সব ক্ষেত্রেই পরাজয়ের গ্লানি আমাকে সহ্য করতে হয়েছে। রীতিমতো ধন্দ্বে পড়ে যাই, কোন গুণ থাকলে প্রেম হয় তা নিয়ে।পরের দিকে জীবনের এই হাহাকার আমাকে রীতিমতো মানসিক রোগীতে পরিণত করে। প্রেম না পাওয়ার যন্ত্রনা থেকে আমি আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকি। অথচ অন্তত একজনের হৃদয়েও দাগ কাটতে পারলে জীবনের এই মরুভূমির দশা যে কেটে যেতো সে কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। তাই বলে যে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম তা নয়। মনে তেমন কাউকে ভালো লাগলে, নতুন নতুন উদ্যোমে তাদের কাউকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছি। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই সে প্রেম আমার কাছে ধরা দেয় নি। এদিকে আমার প্রেমপ্রবণ মানসিকতার কথা বন্ধুমহলে জানাজানি হয়ে যায়। তারা আমায় নিয়ে হাসাহাসি করে। আমি যে বুঝিনে তা নয় কিন্তু ওদের এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা ও আচরণে আমি বিন্দুমাত্র বিচলিত হবার পাত্র নই। উল্টে এতোবড় পৃথিবীতে একজন নারী হৃদয়ে ঝড় তুলতে পারিনি-এই ব্যর্থতাই আমাকে ভাবিয়ে তোলে। চাকরি পাওয়ার পর অবশেষে নিরাশ হয়ে পাত্রী নির্বাচনের দায়িত্ব বাবা মায়ের উপর ছেড়ে দেই। আমার মনের তখন এমন একটা পরিবর্তন এসেছিল যে, যে কোন পাত্রী বাবা-মায়ের পছন্দ হলেই চলবে। আলাদা করে তাকে দেখতে যাবার আগ্রহ আমি তখন হারিয়ে ফেলি। বাবা মায়ের পছন্দ মানেই বাড়িতে ঘটক মশায়ের আসা যাওয়ার পর্ব শুরু হয়। কিছুদিন খোঁজাখুঁজি করতেই পছন্দসই পাত্রীর সন্ধান মেলে। বাধ্য সন্তানের মত যে পাত্রীকে বিয়ে করে আমি ঘরে তুলি। বিয়ে আমি করি ঠিকই কিন্তু বাবা-মায়ের শরণাপন্ন হতে হওয়া, মনে মনে একটা পরাজয়ের গ্লানি আমার প্রেমপ্রবণ হৃদয়কে তাড়া করতে থাকে।
সম্বন্ধ করে বিয়ে মানে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে। বাসরঘরে বসে অপরিচিত এই বউয়ের সঙ্গে কিভাবে আলোচনা শুরু করব তা নিয়ে আগে থেকেই চিন্তায় ছিলাম। তাই বার দুয়েক চোখাচোখি হলেও তা ঠিক কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না। ভাবতে থাকি কি নিয়ে কথা শুরু করব তা নিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অবশেষে আমিই প্রথম মুখ খুলি। হানিমুন নিয়ে গল্প করতে বসি। দুজনের কার কেমন জায়গা পছন্দ তা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। ওর পছন্দ পাহাড় আর আমার পছন্দ সমুদ্র। আমি ওকে পাহাড়ের বৈচিত্র নেই বলে বোঝাতে গেলে আমাকে অনেকটা ধমকের সুরে থামিয়ে দিয়ে জানায়, সমুদ্রের মধ্যে বরং কোনো বৈচিত্র নেই। লক্ষ ভোল্টেজের গম ভাঙ্গানো মেশিনের অহরহ শব্দ আর ফেনিল জলরাশির উত্তুঙ্গ রূপ ছাড়া আর কিই বা দেখার আছে সমুদ্রের। যা একদিনের জন্য যথেষ্ট হলেও কোনমতেই তা হানিমুনের পক্ষে উপযোগী নয়। সঙ্গে আরো জানায়, সে দিক থেকে পাহাড়ে যাওয়া অধিকতর শ্রেয় সেখানে নাকি হাজারো বৈচিত্র আছে।
মনে মনে বলি,যা বাবা! বিয়ের রাতেই এত মনোমালিন্য!
অবশ্য আমিও দমে যাওয়ার পাত্র নই। বন্ধু পিন্টুর কাছ থেকে ইতিমধ্যে ট্রেনিং নিয়েছি। বন্ধু আমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে ভালো করেই যে বিড়াল মারতে হবে প্রথম রাতেই। এখন বিড়াল মারা তো দূরের কথা, উল্টে নিজেই বেড়াল হওয়ার আশঙ্কায় মাথার মধ্যে আসন্ন পরাজয়ের গ্লানি ভো ভো করে ঘুরপাক খেতে থাকে। উল্লেখ্য বিয়ের একদিন আগেও পর্যন্ত বন্ধু পিন্টুর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছি কি করে বউকে বাগে রাখা যাবে তা নিয়ে। কাজেই শুরুতেই আশাহত হতেই বুঝে যাই, কাজটা মোটেই সহজ হবে না। কিন্তু তাই বলে আমিও দমে যাওয়ার পাত্র নই। একটা হেশতোনাস্ত করতেই হবে তাই যদি বাসররাত মাথায় ওঠে উঠুক। কোন অবস্থাতেই সামান্যতম জায়গা ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
দুজনের পছন্দ যেহেতু দুদিকের। কাজেই দুজনের পক্ষে তো আর দুই মেরুতে হানিমুন করতে যাওয়া সম্ভব নয়। যেকোনো একদিকেই যেতে হবে। এক্ষেত্রে কার মত প্রাধান্য পাবে তা নিয়ে অহেতুক তর্কাতর্কি না করে বরং টস করে তা নির্ধারণ করা উচিত। আমার কথা শুনে বৌ আকাশ থেকে পড়ে। হানিমুন করতে যেতে হবে টস করে, এ কথা শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে।ওসব টসফস বুঝিনা। সমুদ্রে যেতে হলে একাকি যেতে হবে। সঙ্গে আরও জানায়,এই বিয়েতে নাকি তার মত ছিল না। পরিবারের চাপে সে এই বিয়েতে মত দিয়েছে। কাজেই এখন যদি মতের মিল না হয় তাহলে শুরুতেই আমাদের আলাদা থাকা বা বিকল্প ভাবনা বোধহয় ঠিক হবে। বৌয়ের কথা শুনে আমি চিন্তায় পড়ি।নিজে তো একটা প্রেম করতে পারলাম না। বাবা-মা ঠিক করে দিয়েছেন। এখন সেই প্রেমও হাতছাড়া হতে পারে ভেবে গলা শুকিয়ে যায়।মুখ নিচু করে চুপচাপ বসে থাকি। খানিক বাদে হঠাৎ বৌয়ের গলার স্বর বদলে যায়।গলা নামিয়ে বলে,
- ঠিক আছে টস হয় হোক। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করি,
- কি? কি শর্ত?
-আমি যদি টসে হেরে যাই তাহলে সমুদ্র হলেও কোথাকার সমুদ্র সেটা ঠিক করার দায়িত্ব আমাকে দিতে হবে।
হারতে হারতে জেতার সুযোগ সামনে আসায় আমি অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। পরম আনন্দে বলি,
-ঠিক আছে তাই হবে। তুমি হারলে কোথাকার সী বিচে যাব সেটা না হয় তুমিই স্থির করবে।
যাইহোক টসে রাজি করাতে পেরে মনে মনে যুদ্ধ জয়ের স্বাদ পাই। এক্ষেত্রে না হয় বৌকে একটু সহানুভূতি দেখালাম।
আমার সম্মতি পেয়ে বউ খুশি হয়। মুহূর্তে ১৮০° পাল্টি খেয়ে মুখে হাসি নিয়ে আসে। আমি ড্রেসারে রাখা গুটিকয়েক খুচরা পয়সার মধ্যে থেকে একটা এক টাকার কয়েন তুলে নিয়ে তালুতে লুকিয়ে রেখে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে টোকা মারতেই কয়েনটি ঘরের সিলিং পর্যন্ত উপরে উঠে যায়। জোরে জোরে কল করে,
-টেল।
ফ্রাকশন অফ সেকেন্ডের মধ্যে কয়েনটা ঘরের মেঝেতে ঝনঝনিয়ে শব্দ করে কয়েকবার পাল্টি খেয়ে উল্টে পড়ে।মুখ নিচু করতেই চোখে পড়ে 'টেল'।
এতোক্ষণে মুদ্রার পিঠ দেখতে বউ খাট থেকে নিচে নেমে আসে। নিজের চোখে টেল দেখে লাফিয়ে ওঠে।
টসে জিতে যুদ্ধ জয়ের হাসি নিয়ে বৌ জানালো,
-হানিমুন করতে যাওয়ার জন্য পাহাড় ওর পছন্দের হলেও সব পাহাড় জাতের নয়। একটা বিশেষ শৈল শহর কয়েকটি বিশেষ কারণে ওর পছন্দের।আজ সেই স্বপ্ন সার্থক হতে চলেছে। হাসতে হাসতে আমাকে পাঁচটা শহরের নাম করতেও বললো, যার মধ্যে ওর স্বপ্নের শহরের সঙ্গে মেলে কিনা যাচাই করার জন্য।
চলবে....
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
১-পাঠকদের উদ্দেশ্যেও পাঁচটি শহরের নাম উল্লেখ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে। আসন্ন হানিমুনের শহরটি কতজনের সঙ্গে মেলে তা পরীক্ষা করার জন্য।
২-এই ছোট গল্পটি শেষ হলে আবার তমোময়ী সিরিজের পরবর্তী অংশ শুরু হবে।