১)
মেয়েটার মূলতঃ একটা ছবিই দেখেছিলো ছেলেটা। আর এই একটা ছবিই চিন্তাভাবনার সব গতিপথ ঘুরিয়ে দিলো। মনের মাঝে পছন্দের মানসীর যে ছবিটি কল্পনার রঙে এঁকে রেখেছে এতোদিন ধরে, তাই যেন পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে ফুঁটে উঠেছে মেয়েটির ছবিটিতে। প্রথম দেখাতেই তীব্র ভাললাগা। কবিতার অক্ষরগুলো যেন বাস্তব রূপ লাভ করলো হঠাৎ করেই। অতএব ফাজিল ছেলেটা তার ফাজলামী বাদ দিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলা শুরু করলো এবার।
- আমাকে বিয়ে করবে? আগামী মাসে আমি দেশে আসবো। তখন তোমার সাথে দেখা করতে চাই। যদি সামনাসামনি কথা বলে আমাদের দু'জনার দু'জনকে পছন্দ হয়, তাহলে আমার ফ্যামিলি তোমার ফ্যামিলির সাথে কথা বলবে। ঠিক আছে?
বলে কি ছেলেটা!?! প্রথম পরিচয়েই একেবারে বিয়ের প্রস্তাব! মেয়েটা অবাক হলেও বেশ মজা পেলো। ইন্টারনেটের জগতে বলতে গেলে একেবারেই নতুন সে। মাসখানেক হলো ব্যবহারের জন্য নিজের রুমে একটা পিসি পেয়েছে। সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষাও শেষ। এই প্রথম তাই ইন্টারনেটে এতোটা সময় নিজের মতো করে কাটানো। আর এখানেই ঘটনাক্রমে এই ফাজিল টাইপের ছেলের সাথে দেখা। ছেলেটার খোঁচামার্কা কথায় বেশ মজাই পাচ্ছিলো সে। কথায় কথায় ছেলেটি তার ছবি দেখালো, মেয়েটিকেও দেখাতে বললো।
- আমার কোন ছবি পিসিতে খুঁজে পাচ্ছি না।
- খিক খিক খিক! সবাই এই কথাই বলে।
- মানে?!
- দেখতে শুনতে ভাল না হলে কোন মেয়েই তার আসল ছবি দেখাতে চায় না।
- এখন পর্যন্ত আমাকে দেখে কেউ বলেনি যে আমি অসুন্দরী!
- তাই নাকি? তাহলে ছবি দেখাও। না দেখে কিভাবে বুঝবো?
এত্তো বড় কথা!! "দাঁড়ান, খুঁজে দেখছি" বলে মেয়েটি আবারও ছবি খোঁজায় ব্যাস্ত হয়ে যায়। খুঁজে পেতে তার খুবই সাদামাটা এক ছবি পেয়ে সেটাই ছেলেটাকে পাঠিয়ে দেয়।
-
- ছবি পেয়েছেন?
- হ্যাঁ
- কেমন দেখলেন?
- আমাকে বিয়ে করবে? আগামী মাসে আমি দেশে আসবো। তখন তোমার সাথে দেখা করতে চাই। যদি সামনাসামনি কথা বলে আমাদের দু'জনার দু'জনকে পছন্দ হয়, তাহলে আমার ফ্যামিলি তোমার ফ্যামিলির সাথে কথা বলবে। ঠিক আছে?
"হাহ্! বলে কি ছেলেটা!?! বিয়ে?! আমি করবো? তাও আবার এই ছেলেকে?!? হা হা হা হা..." মেয়েটা বেশ মজা পেলো। তবে পাশার দান উলটে গেছে। ছেলেটা এতোক্ষণ অতিমাত্রায় ভাব দেখাচ্ছিলো। এবার তার দেখানোর পালা।
- বিয়ে? কি জানি! করতেও পারি। আগে তো দেশে আসেন। তখন দেখা যাবে!
এবার পাত্র হিসাবে ছেলের ছবিটা আরেক নজর দেখতে গিয়ে লজ্জায় রাঙা হয় মেয়েটি। সাথে সাথেই ছবির উইন্ডো বন্ধ। এদিকে ছেলেটিও এক দৃষ্টে মেয়েটির ছবিই দেখতে থাকে। ছবিতে মেয়ের পিছনের লেক এবং ঢাকা নগরীর কাঠামো ঝাপসা হয়ে শুধু মেয়ের মায়াবী চেহারাটাই স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় চোখে। চোখের নিশ্চুপ ভাষা, চুলে রৌদ্রের লালচে আভা, সব মিলিয়ে অদ্ভুত সুন্দর এক স্নিগ্ধতা ফুঁটে উঠে সেই চেহারায়।
২)
দু'সপ্তাহ পরের কথা। ছেলেটি তখন কোন এক এয়ারপোর্টে। কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করেছে। কি করবে তাই চিন্তা করতে করতে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে এয়ারপোর্টের এদিক সেদিক। পরবর্তী ফ্লাইট সেই ভোর সকালে। পুরো রাত পড়ে আছে সামনে। একবার ভাবলো কোন এক হোটেলে গিয়ে রাতটা পার করে দিবে। আবার কি মনে হতে সেই প্ল্যান বাদ দিলো। ৮-১০ ঘন্টারই তো ব্যাপার। এয়ারপোর্টে বসে বসেই রাতটা কাটিয়ে দিতে পারবে।
একা একা আগেও অনেক বার জার্নি করেছে ছেলেটি। এর আলাদা একটা স্বাদ আছে, যা সে উপভোগই করে বলতে হবে। চারপাশের শত শত লোকের ভীড়ে পুরোপুরি একা একজন। সবার মধ্যে থেকেও যেন কতো আলাদা, কতো দূরে আর সবার কাছ থেকে! তখন নিজের এক জগতের ভিতরে বসে থেকে বাইরের দুনিয়াটা দেখতে দেখতে চারপাশের সবকিছু সে তার নিজের মতো করেই অনুভূতিতে গেঁথে নেয়। তবে এবারে তার অনুভূতিগুলো আরও অনেক বেশি উদ্বেলিত। না, ফ্লাইট মিস করার জন্য না। এধরণের কোন সমস্যাই এখন আর মনে খুব গভীরভাবে দাগ কাটতে পারছে না। মন ছেয়ে আছে পুরো অন্যরকম এক ভাল লাগা টাইপের আবেশে। মনের মাঝে বারবার ঘুরেফিরে আসছে একটাই ছবি। এক চেহারা! এই মূহুর্তে বাংলাদেশের কোথাও আছে সে, পছন্দের এক মেয়ে। "সে জানে আমি দেখা করতে আসছি। অপেক্ষায় আছে?" ছেলেটা নিজেও অপেক্ষায় আছে। আর টের পাচ্ছে প্রতি মূহুর্তেই অপেক্ষার সময় একটু করে কমে আসছে। দেশে যাওয়ার পর কিভাবে দেখা করবে মেয়েটির সাথে? ছবি দেখে আর কথা বলে মেয়েটিকে যেমন মনে হয়েছে, সামনাসামনি সে কি ঠিক তেমনই হবে? যদি না হয়? মেয়েটা তাকে পছন্দ করবে তো? এরকম নানারকম চিন্তা মাথার ভিতর। এবং সব কিছু ছাপিয়ে অদ্ভুত রকমের এক উত্তেজনা, আর ভাল লাগা।
কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে ছেলেটা এসে এক ক্যাফেটেরিয়ার খালি এক টেবিলে গিয়ে বসলো। কাধের ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বের করে রাখলো টেবিলের উপরে। পাশে ক্যাফে থেকে কেনা কেক আর সোডা। আজকাল প্রায় সব এয়ারপোর্টেই বলা যায় ওয়াই-ফাই ইন্টারনেটের হটস্পট থাকে। অতএব কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেটা ইন্টারনেটে মশগুল হয়ে গেলো। ভাগ্যিস ল্যাপটপটা সাথে ছিলো! মেয়েটাকে একটা এস এম এস পাঠালো ছেলেটা। ভাবেনি যে সাথে সাথেই সে নেটে আসতে পারবে। কিন্তু কপাল ভাল বলতে হবে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেবীর দর্শন মিলে গেলো।
- হাই
- আমি এখন এয়ারপোর্টে
- তাই নাকি?
- হ্যাঁ। ফ্লাইট মিস করেছি।
- বলেন কি?!? হায় হায়! আপনার কি খুব খারাপ লাগছে? কান্না পাচ্ছে আপনার?
শুনে ছেলেটা কি বলবে ভেবে পেলো না। মেয়েটা কি তাকে বাচ্চা ভাবে নাকি, যে ফ্লাইট মিস করে এখন কান্নাকাটি করবে? হা হা হা...
এভাবেই কথা বলতে বলতে কিভাবে যেন প্রায় পুরো রাত পার হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম, অতঃপর আবার যাত্রার শুরু। সামনে আরও অনেক পথ বাকি আছে। মাঝখানে আরেক দেশে কাজও আছে বেশ কিছু। কিন্তু ছেলেটা জানে, অপেক্ষার সময়গুলো পার হয়ে যাবে। সময় কখনোই থেমে থাকে না...
৩)
ক'দিন হলো মেয়েটার মনেও বেশ রঙ লেগেছে। মনে রোমান্টিক রোমান্টিক ভাব। পছন্দের হিন্দি গানগুলো আরও মধুর মনে হয় যেন আজকাল। কিছু গান যেন আরও বেশি করে মনে গাঁথে! প্রায়ই সেই একই গান শুনতে শুনতে অনেকটা স্বপ্নীল হয়ে যায় সে আনমনে। "তেরি ওর তেরি ওর... হায় রাব্বা..." বেজে চলে কানের পাশে।
সে যে প্রেমে পড়ে গেছে, তা কিন্তু না। খুব সিরিয়াসও না এসব নিয়ে এখন। বিয়ের চিন্তা তো আরও দূরে। তবে কেন যেন ছেলেটাকে তার অনেকটা ভাল লেগে গেছে। বেশ মজা করে কথা বলে ছেলেটা। চ্যাটিংয়ে লেখার পাশে অনেক অনেক আইকন দেয়। ওগুলো দেখতে আরও বেশি মজা লাগে। আর প্রতিটা কথার উত্তর যেন আগে থেকেই রেডি থাকে। সে নিজেও বন্ধু মহলে বেশ চঞ্চল হিসাবেই পরিচিত। সে যখন তাদের কাছে মাতাব্বরি করে কিছু বলতো, খুব কম বন্ধুই ছিলো যারা কিনা প্রতিউত্তরে তাকে আবার কিছু বলতো এভাবে।
ছেলেটা তাকে সরাসরি বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে! ধুর, বিয়ে কে করে!! তবে দেশে আসলে ছেলেটার সাথে সে অবশ্যই দেখা করবে। অন্তত একবার তো বটেই। ছেলেটা তার ছবি পাঠালেও এখন পর্যন্ত ঠিকমতো দেখতেই পারেনি সেগুলো। দেখতে গেলেই কেমন যেন লজ্জা লাগে। সেদিন তো ওয়েব ক্যামেরাতেও এসেছিলো। কিন্তু মনিটর থেকে একটা ছেলের চেহারা ড্যাবড্যাব করে তার দিয়ে তাকিয়ে আছে দেখতে কেমন যেন লাগছিলো! তাই সাথে সাথেই মিনিমাইজ করে ফেলে ভিডিওর উইন্ডোটা। আর ছেলেটাও এমন ফাজিল, ভিডিওতে সরাসরি নিজের চেহারা না দিয়ে শুরুতে আর্টিফিসিয়াল এফেক্ট ব্যবহার করে ভূতের মতো একটা চেহারা বানিয়ে সেটা দেখাচ্ছিলো!
ছেলেটার সাথে কথা বলার প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে যায়। কথাবার্তার এক পর্যায়ে ফোন নাম্বারও আদান-প্রদান হয় দু'জনার মধ্যে। কিছুক্ষণ পরেই ছেলের এস এম এস আসে, "আমার এই মেসেজ পেলে ইন্টারনেটে আমাকে জানাবে"। কথা দেখো ছেলের! সেও সাথে সাথে উত্তর পাঠালো, "ইন্টারনেট কেন? আমি এস এম এস লিখতেও পারি, পাঠাতেও পারি।"
পরদিন আবার ছেলের এস এম এস আসে। "তোমার গলার স্বর শুনতে খুব ইচ্ছে করছে। আমি কি তোমাকে ফোন করতে পারি?" সেও উত্তর দেয়, "আমি তো খুব ব্যস্ত মানুষ। আগে আমার পি এস কে ফোন করে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিবেন। তারপরে কখনও আমি যদি ফ্রি হই তখন হয়তো কথা বলতে পারি।" যথা সময়ে ছেলের ফোন আসে।
- হ্যালো!
- হ্যালো। আপনি কি আপনার পি এস বলছেন? আমি আপনার সাথে কথা বলার জন্য এপয়েন্টমেন্ট নিতে চাই। শিঘ্রই অনুমতি দিয়ে বাধিত করুন। (মিটি মিটি হাসির ফাজিল টাইপের এক কন্ঠ)
এরপর আরও এক আধবার ছেলেটার সাথে ফোনে সরাসরি কথা হয়েছে। তবে ইন্টারনেট আর এস এম এস-এই বরং বেশি কথা হয়। ছেলেটা এখন যাত্রাপথে। মাঝখানে এক দেশে সপ্তাহখানেকের উপর ছিলো ছেলেটি। তখনও যোগাযোগ হয়েছে তার সাথে। একই সময়ে দু'জন অনলাইনে না থাকলেও দেখা যেতো ছেলেটি সুযোগ পেলেই তাকে অফলাইন মেসেজ দিয়ে রাখতো। তাকেও বলে রেখেছে যেন ইন্টারনেটে আসলেই সেও অফলাইন মেসেজ দিয়ে রাখে ছেলেটিকে অনলাইনে না পেলে। এরই মধ্যে একবার তো হঠাৎ করেই ছেলের কথায় তার বোনের সাথেও দেখা করে এসেছে উত্তরায় গিয়ে! কেন করেছে তা অবশ্য নিজেও বলতে পারবে না! আবার কি মনে করে একবার ছেলেটিকে এস এম এস পাঠালোঃ "যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভুলে না মোরে"।
আজ ২২শে অক্টোবর। ছেলেটির দেশে পৌছানোর কথা আজ!
(দ্বিতীয় পর্ব এখানে )
(লেখাটি গত বছরের এই দিন উপলক্ষ্যে বকলমে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো।)