somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

২৬শে অক্টোবর ২০০৮ - শেষ পর্ব

২৬ শে অক্টোবর, ২০১১ সকাল ১১:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(প্রথম পর্বের লিঙ্ক )

২৬শে অক্টোবর। সকাল সাড়ে নয়টা তখন। অসময়ে হলেও হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ থমথমে, রাস্তায় ভালই ট্রাফিক জ্যাম। কালো প্যান্ট, বাদামী টি-সার্ট পরিহিত, কাঁধে ল্যাপটপের এক ব্যাগ নিয়ে ছেলেটি বসুন্ধরা সিটি মলের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামলো। এখানেই আজ মেয়েটির সাথে দেখা করার কথা তার, সকাল দশটায়। আধা ঘন্টা আগেই চলে এসেছে ছেলেটি।

গত ২২ তারিখে ছেলেটি দেশে এসে পৌছায়। দু'দিন পর মেয়েটির সাথে ফোনে কথা হয় তার। ঠিক হয় যে আজ তারা দেখা করবে। কোথায় দেখা করবে সেটা মেয়েটিই ঠিক করে দেয়। মেয়েটির ধারণা ছিলো "বিদেশ ফেরত ছেলে, দেশের কোথায় কি আছে না আছে কিছুই তো জানে না। আমাকেই সব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঠিকমতো দেখাতে হবে।" অতএব এধরণের নাদান ও অবুঝ (!) ছেলেকে ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য বসুন্ধরা সিটি মলকেই তার আদর্শ জায়গা বলে মনে হয়েছে।

গতকাল রাতেও ফোনে মেয়েটির সাথে কথা হয়েছে। আজকের দেখা করা নিয়ে দু'জনই বেশ উদ্দিপীত। দেখা করা নিয়ে মেয়েটি আগেই ভাল মতো হেদায়েত করে দিলো ছেলেটিকে।

- দেখুন, প্রথম দেখা বলে কথা। ফার্স্ট ইমপ্রেশন!! এটা যদি খারাপ হয় তাহলে সবই শেষ। তাই একেবারে ঠিক টাইমে এসে হাজির হবেন কিন্তু! একটুও যেন লেট না হয়!!

হেদায়েতের ধাক্কায় ছেলেটি তাই আধা ঘন্টা আগেই চলে এসেছে বসুন্ধরায়। দেশে ফেরার পর এখনও তার জেট ল্যাগিং ঠিকমতো কাটেনি। এমনিতেই প্রতিদিন ভোর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তার উপর আজ একটা বিশেষ দিন। অতএব দেড় ঘন্টার জার্নি হলেও সাড়ে নয়টায় জায়গামতো এসে পৌছাতে তার কোন অসুবিধা হয়নি।

বসুন্ধরা সিটি মলের আশেপাশেই ছেলেটি একসময় চাকরী করতো। তবে এটা তখনও তৈরীই হয়নি। কয়েক ধাপ সিড়ি এবং সিকিউরিটি পার হয়ে ভিতরে ঢুকে তাই সে বেশ অবাকই হলো। ঢুকার পরেই সামনে বেশ বড় একটা হলের মতো। মাঝখানে চকচকে নতুন একটা গাড়ি রেখে দেয়া হয়েছে, কোন লটারীতে পুরস্কার দেয়া হবে সম্ভবতঃ। তার ওপাশ দিয়ে চলন্ত সিড়ি উঠে গেছে উপরতলায়। ডানে বামে দুইপাশে দুই ক্যাপসুল লিফট দেখা যাচ্ছে। কাঁচের টিউবের ভিতর দিয়ে এই ক্যাপসুল লিফটের উঠানামা দেখে মনেই হচ্ছে না যে বাংলাদেশের কোন মলের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। হল বরাবর উপরের প্রতিটা ফ্লোর রেলিং দিয়ে ঘেরা। সবার উপরে নকশা করা কাঁচের ছাঁদ, সেখান দিয়ে দিনের আলো এসে পড়ছে ভিতরে।

হাতে সময় আছে, তাই ছেলেটি এই ফ্লোর ঐ ফ্লোর ঘুরে দেখতে লাগলো। অতঃপর প্রায় দশটার দিকে তিন তলায় এসে থিতু হলো। হল বরাবর রেলিংয়ের গায়ে ভর দিয়ে নিচের হলে লোকজনদের আসাযাওয়া পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। এখান দিয়েই মেয়েটির আসার কথা যেকোন সময়। দেখে চিনতে পারার জন্য মেয়েটি আগেই বলে রেখেছে যে গোলাপী রংয়ের সালোয়ার কামিজ পড়ে আসবে। ছেলেটির মনে অদ্ভুত এক উত্তেজনা! ঐ তো, গোলাপী কাপড় পরা এক মেয়ে মাত্র সিড়িতে উঠলো! এই কি সেই মেয়ে? উত্তেজনা তখন কয়েক ধাপ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু নাহ!! এ তো ইয়া মূটকী!! এটা মোটেই সেই মেয়ে হতে পারে না! আবারও পর্যবেক্ষণ। দেখতে দেখতে অনেক মেয়েই বসুন্ধরায় ঢুকে, অনেকেই বেরিয়ে যায়। কেউ একা, কেউ বা জোড়া বেঁধে, আবার অনেকে দল বেঁধেও মলে ঢুকলো। কিন্তু তাদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত মেয়েটির কোন পাত্তাই নেই। অপেক্ষা করতে ছেলেটির অবশ্য বেশ ভালই লাগছে। গল্পের বইয়ে সব সময় পড়ে এসেছে এধরণের অপেক্ষার সময় নাকি অনেক অস্থিরতায় কাটে। কিন্তু তার মনে প্রথম দেখা করার উত্তেজনা থাকলেও অস্থিরতা নেই মোটেই। লাইফে এধরণের সময় বারবার আসবে না জানে সে। তাই পুরো সময়টাই তারিয়ে উপভোগ করে নিচ্ছে। বাইরে তখন তুমুল বর্ষন। কাঁচের জানালায় সেই বৃষ্টি দেখা, আর ভিতরে এসির ঠান্ডা এক আবহ। এতোশত লোকের মাঝে একা দাঁড়িয়ে, অপরিচিত কিন্তু পছন্দের কোন একজনের সাথে দেখার করার অপেক্ষা। ঘড়ির কাঁটার টিক টিক, তার সাথে চারপাশের কর্মব্যস্ততাও যেন টিক টিক করে ঘুরে চলেছে। প্রতিটি সেকেন্ড আলাদাভাবে পড়া যায়। দেখতে দেখতে সাড়ে দশটা বাজে। তারপরে এগারো। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার মেয়েটার সাথে ফোনে কথা হয়েছে। বাইরে বৃষ্টি, রাস্তায় প্রচন্ড ট্রাফিক জ্যাম। মেয়েটির গাড়িও সেই জ্যামে আটকে আছে। তবে কাছে প্রায় এসে পড়েছে। এই এসে পৌছালো বলে! অতএব চলতে থাকে অপেক্ষা। সাথে স্বপ্নীল এক ভাল লাগা!

তিনতলার উপর থেকে নিচের হলের মানুষগুলোকে দেখতে অনেকটা কার্টুনের মতো মনে হয়। বড়সড় মাথা, তার নিচে টিঙটিঙে হাত-পা। কার্টুনগুলো হেটে হেটে হলে ঢুকে, আবার কার্টুনের মতোই হেটে হেটে এদিক সেদিক চলে যায়। এই মাত্র আবারও এক গোলাপী রঙের কার্টুন প্রবেশ করেছে হল রুমে। ছেলেটির মনযোগ বৃদ্ধি পায়। কার্টুনটি হেটে হেটে হলের মাঝখানের গাড়িটির সামনে এসে থামে। ডানে বামে তাকিয়ে ফোন তুলে নেয় কানে। ছেলেটির মোবাইলে রিং বেজে উঠে।

- হ্যাল্লো, আমি এখন বসুন্ধরায়।
- হ্যাঁ, তোমাকে দেখতে পাচ্ছি।
- আপনি কোথায়?
- উপরে তাকিয়ে দেখো।

মেয়েটি উপর দিকে তাকায়, সামনে, ডানে, বামে।

- কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না তো!
- তোমার পিছন দিকে তাকাও।

মেয়েটি এবার পিছনে ঘুরে উপর দিকে তাকায়। উপর থেকে ছেলেটি হাত নাড়ে। মেয়েটিও দেখতে পায় এবার।

- আপনি কতো তলায়? তিন তলা? ঠিক আছে, ওখানেই অপেক্ষা করুন। আমি চলে আসছি।

মেয়েটি এবার দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে যায়। অবশেষে তাহলে দেখা হচ্ছে দু'জনার! মেয়েটা এক ঘন্টারও উপরে লেট। ফার্স্ট ইম্প্রেশন হিসাবে খারাপ না!! ছেলেটির মনে অদ্ভুত এক উত্তেজনা। মেয়েটির সিড়ি বেয়ে উপরে উঠার অপেক্ষা করছে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেলো, তাও কোন পাত্তা নেই! একবার হেটে সিড়ির ওখানে গিয়ে দেখেও এলো ছেলেটি। কিন্তু মেয়ের কোন পাত্তা নেই। তাই আবার ফোন দিলো মেয়েটিকে।

- কোথায় তুমি?
- আমি লিফট থেকে বের হলাম। আপনি থাকুন, জায়গা থেকে নড়বেন না কিন্তু! আমি আসছি।

মোবাইলে কথা বলতে বলতেই মেয়েটি ছেলেটির মুখোমুখি হয়। ফোন রেখে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়। মেয়েটি দেড়ির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। ছেলেটা হাসে। দু'জনই একটু চুপ, চিন্তা করে এখন কি করবে। মেয়েটি এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে, "ওকে, ফলো মি!" মেয়েটির চোখমুখের ভাব হলো, "আমি সব জানি! অতএব হে অবুঝ বালক সন্তান, আমাকে অনুসরণ করো।" মেয়েটির চোখে-মুখে একটা চঞ্চল টাইপের ভাব আছে, যা ছেলেটার প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায়। মেয়েটি আগে আগে হাটতে থাকে, আর নাদান ছেলেটিও সুবোধ বালকের মতো তাকে ফলো করতে থাকে। মেয়েটির আবার এস্কেলেটর ফোবিয়া আছে। চলন্ত সিড়িতে সে উঠবে না। তাই লিফটে করে একেবারে উপরের তলায় হাজির। এখানে চারপাশে ক্যাফেটেরিয়া আর ফাস্ট ফুড শপ। এদিক সেদিক দুই চক্কর মেরে মেয়েটি এক ফাস্ট ফুডের দোকানের সামনে এসে থামে। করিডোরের রেলিংয়ের পাশে দুই সিটের এক টেবিল দেখে দু'জন বসে পড়ে। আশেপাশে আদম সন্তানে ভরপুর। অনেকেই এরকম জোড়া বেঁধে এদিক সেদিক বসে মনের সুখে খোশগল্প করছে। দোকানের একজন এসে মেনু দিয়ে গেলো। মেনুর চেয়ে ছেলেটার মনযোগ তখন মেয়েটার দিকেই কেন্দ্রীভূত বেশি।

মেয়েটা কিন্তু গোলাপী কাপড় পড়েনি। বেশ সুন্দর রোজ কালারের থ্রি-পিস। স্নিগ্ধ রঙ, তার উপর সোনালী রঙের হালকা কারুকাজ। কাপড়ের রঙের জন্য মেয়েটির ফরসা ত্বকে কমলা রঙের ছোপ পড়েছে। চুল থেকে কড়া লালচে আভা বের হচ্ছে। দেশের তথাকথিত ফ্যাশন সচেতন মেয়েগুলোর মতো এই মেয়ের ভুরু প্লাক করা না, চেহারায়ও প্রসাধনীর কোন বাহুল্য নেই। চোখে কাঁজল দিয়েছে কি দেয়নি চোখে পড়ে না। একেবারেই ছিমছাম, পরিপাটি এক সৌন্দর্য্য ফুটে উঠেছে সার্বিক অবয়বে। কাপড়চোপড়ে সুক্ষ্ণ রুচির প্রকাশ স্পষ্ট হলেও কোথাও কোন বাড়াবাড়ি নেই। প্রথম দেখাতেই ভাল লাগা তীব্র হলো ছেলেটার। পাশাপাশি হাটার সময় ছেলেটা দেখেছে যে দু'জনের উচ্চতাও বেশ ম্যাচ করে। অবশ্য এই যুগের সব মেয়েরাই যেই হারে হাই হিল পড়ে! উচ্চতার কথা মনে পড়তেই ছেলের নজর এবার গেলো মেয়ের জুতার দিকে। খুবই অবাক হয়ে দেখলো একেবারে ফ্ল্যাট পাতলা একজোড়া স্যান্ডেল পড়ে এসেছে মেয়েটি। জুতা দেখতে গিয়ে ছেলেটি মেয়ের পা দেখে বরং আরও মুগ্ধ হয়ে গেলো। অতএব প্রথম প্রশংসাসূচক বাক্যটি বের হলো মেয়েটির পা নিয়েই।

- বাহ! তোমার পা তো দেখতে বেশ সুন্দর!!

মেয়েটি লজ্জায় একটু রাঙ্গা হলেও খুশী হলো প্রশংসা শুনে। একটু অবাকও নিশ্চয় হয়েছে সব রেখে ছেলেকে পায়ের প্রশংসা করতে শুনে।

- তোমার চুলে রঙ করেছো, তাই না?
- না তো! আমার চুল এমনিতেই লাল টাইপের।

ছেলেটা এবার ভালমতো দেখে। হ্যাঁ, এটাই মেয়েটার চুলের ন্যাচারাল রঙ! একেবারে সিল্কের মতো মসৃন হয়ে নেমে গেছে নিচে। ছেলেটার মুগ্ধতা আরও বাড়ে।

বার্গার আর সফট ড্রিংকের অর্ডার দিয়ে দু'জনে এসে আবার টেবিলে বসে। মেয়েটি বিভিন্ন বিষয়ে একটানা কথা বলে যেতে থাকে। তার স্কুল-কলেজের বন্ধু-বান্ধব, ইউনিভার্সিটির টিচার-ক্লাসমেট, বন্ধুবান্ধবেরা কি কি নিয়ে ফাজলামী করে ইত্যাদি। ছেলেটি মনযোগী শ্রোতা হয়ে কথা শুনতে থাকে, সাথে মুচকি হাসি, আর মাঝে মধ্যে এক-আধটা মন্তব্য। মেয়েটা বলে যেতে থাকে, আগেরবার যখন বান্ধবীদের সাথে এখানে এসেছিলো তখন কোথায় বসেছিলো, নিচের করিডোরে হেটে যাওয়া লোকগুলো কে কতো নাম্বার স্টেপে কোন মার্ক পর্যন্ত পৌছাবে এসব নিয়ে বান্ধবীদের সাথে বাজি ধরা... ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এসব শুনতে শুনতে মুগ্ধ চোখে ছেলেটা মেয়ের চেহারার দিকেই তাকিয়ে থাকে। কথা বলার সময় মেয়েটির চেহারায় চঞ্চল যেসব অভিব্যাক্তি ফুটে উঠে সেগুলো গেঁথে নিতে থাকে স্মৃতির পাতায়। মেয়েটির চঞ্চলতায় খুঁজে পায় কবিতার চপল ধারা, "ঝর্না ধারায় নেচে বেড়াই, থমকে থাকি পাখির নীড়ে। জোয়ার এলেই দু'কূল ভাসাই, আবার ডুবে যাই গভীরে... হাওয়ায় ভেসে বেড়াই ঘুরে, আবার গুটাই মনের পাখা। দু'চোখ ভরে শ্রাবণ এলেও দৃষ্টি থাকে স্বপ্নে ঢাকা..."। এরকম কোন চঞ্চল মেয়ের কথা কল্পনা করেই তো কবি লিখেছিলো কবিতাটি! মাঝখানে মেয়েটা একটু সচেতন হয়, বুঝতে পারে সে নিজের মতোই কথা বলে চলেছে।

- প্রথমে ভেবেছিলাম অপরিচিত এক ছেলের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি, কিভাবে কি কথা বলবো। কিন্তু আপনাকে দেখে কেন জানি সেরকম মনে হচ্ছে না। তাই এভাবে বকবক করে যাচ্ছি। আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না তো?
- না তো! আমার তো ভালই লাগছে। তুমি বলতে থাকো।

মেয়েটি আবারও চঞ্চল ভঙ্গিতে কথা বলা শুরু করে। মাঝখানে হঠাৎ একটু থামে। লজ্জায় হালকা একটু রাঙ্গা হয়ে জিজ্ঞেস করে,

- মেয়ে কেমন দেখলেন?
- তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। বিয়ে করবে আমাকে?
- বিয়ে! এটা তো অনেক বড় ব্যাপার!! আমি কোন ভুল করতে চাই না এক্ষেত্রে। চলুন আমরা দু'বছর প্রেম করি আগে!!

এবার ছেলে একটু ভাব নেয়।

- উহুঁ! আগে বিয়ে, পরে প্রেম। রাজি থাকলে বলো। নইলে কিন্তু অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলবো!!

মেয়েটা এবার একটু চিন্তিত হয়।

- সত্যিই আর কাউকে বিয়ে করে ফেলবেন?
- হ্যাঁ।
- কি জানি! এমূহুর্তে বিয়ের কথা ভাবতে চাচ্ছি না। কিন্তু আপনি অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলবেন এটা ভাবতেও খুব খারাপ লাগছে। বিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এখানে আমি কোন ভুল করতে চাই না। আপনি বলেন, আপনাকে বিয়ে করলে আমি কোন ভুল করবো না তো?
- ভুল করছো কিনা এটা তোমাকেই খুঁজে বের করতে হবে। তোমার হিসাব আমি করে দিলেও পরে মিলবে না।

মেয়েটা আবারও চিন্তিত হয়। কিন্তু একটু পরেই আবার চঞ্চল হয়ে অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা শুরু করে। কথার মাঝে হঠাৎ করেই আবার বলে উঠে,

- আপনি তখন থেকে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। তাই আপনার দিকে আমি ঠিকমতো তাকাতে পারছি না। আপনি এবার একটু অন্য দিকে তাকান প্লিজ। আমি আপনাকে একটু ভালমতো দেখতে চাই।

ছেলেটা বেশ মজা পেয়ে অন্য দিকে তাকায়। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়েই আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে মেয়েটা কিভাবে তাকে দেখছে। তাই দেখে লজ্জা পেয়ে মেয়ে আবার চোখ নামিয়ে নেয়। মেয়েটার আর ঠিকমতো পাত্র দেখা হয়ে উঠে না।

কথাবার্তা চলতে থাকে। এক পর্যায়ে ছেলেটা তার ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে।

- এটা তোমার জন্য এনেছি। আমার লেখা কবিতার বই।
- তাই নাকি?!
- হ্যাঁ। এবারের বই মেলাতেই বের হয়েছে।
- আচ্ছা! কবি মানুষ!! তা কিছু লিখে দিবেন না বইয়ে? দেখি কবি মানুষেরা কি লিখে!

ছেলেটা একটু চিন্তা করলো। তারপরে বই খুলে প্রথম পাতায় লেখা শুরু করলো,

"আমি তোমার চোখের তারায় দেখি
সর্বনাশা পাগল নেশা...
আর কি লিখবো? আমি বাকহারা!"

মেয়েটা বই নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকে। ছেলেটা বলে, "একেবারে শেষের কবিতাটি দেখো। চপল ধারা। তোমার সাথে কথা বলে এই কবিতাটির সাথে খুব মিল খুঁজে পাচ্ছি।" মেয়েটি মনযোগ দিয়ে কবিতাটি পড়ে। চেহারায় খুশি খুশি ভাব। পড়া শেষে বাকি কবিতাগুলো পরে পড়বে বলে বইটি হাতব্যাগের পাশে রেখে দেয়।

এক পর্যায়ে ছেলে-মেয়ে দু'জনই আবার হাটা শুরু করে। মেয়েটা বলে, "চলুন আপনাকে বসুন্ধরা ঘুরিয়ে দেখাই।" দু'জন গন্তব্যহীনভাবে এই ফ্লোর থেকে ওই ফ্লোরে হাটাহাটি করতে থাকে। হাটতে হাটতেই মেয়েটি এক কাঁচের দেয়ালের সামনে এসে দাঁড়ায়। ছেলেটিকে তার পাশে এসে দাঁড়াতে বলে। কাঁচে দু'জনের আকৃতি দেখা যাচ্ছে ঝাপসাভাবে। দেখে মেয়েটি বলে উঠে, "পাশাপাশি আমাদের হাইট তো ঠিকই আছে, তাই না?" আবার শুরু হয় হাটাহাটি। দেয়ালে বা কাঁচে কোথাও নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখা গেলেই দু'জন একটু থামে, তারপর আবারও হাটা শুরু হয়। এক সময় আবারও বিয়ে নিয়ে কথা উঠে। মেয়েটির সেই একই কথা,

- আমি কোন ভুল করতে চাই না। আপনি বলেন, বিয়ে করলে সেটা ভুল হবে না তো?
- আমি তো আগেই বলেছি। তোমার সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে।
- আপনি আমার জায়গায় থাকলে কি করতেন?
- আমি তোমাকে বিয়ে করতাম। আমার কাছে ভুল মনে হতো না। ইন ফ্যাক্ট আমি ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছি, আমাদের বিয়ে হচ্ছে। আমাদের সংসার দেখতে পাচ্ছি।
- হাহ্! বললেই হলো!!

মেয়েটা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকায়। ঘুরতে ঘুরতে আবারও এক টেবিলে গিয়ে বসে দু'জন। ছেলেটি এবার বিয়ে নিয়ে সিরিয়াস আলাপ আলোচনা শুরু করে।

- দেখো আমার কিন্তু কোন গ্রীন কার্ড নেই। আমি এইচ ওয়ান বি-তে আছি। চাকরীর পজিশন বড় শুনালেও বেতন কিন্তু খুব বেশি না। তবে...

মেয়েটি কথার মাঝে বাধা দেয়।

- এসব কথা আমার ফ্যামিলিকে শুনাবেন। আমার জানার কোন দরকার নেই।

ছেলের চাকরী, বেতন বা গ্রীন কার্ডে মেয়েটির এহেন অনাগ্রহে মেয়ের প্রতি ছেলেটার আকর্ষন যেন আরও বৃদ্ধি পায়। ছেলেটি এবার তার ফ্যামিলি নিয়ে কথা শুরু করে। মেয়েটির তাতেও কোন আগ্রহ দেখা যায় না। তবে বিয়ের পরের সংসার নিয়ে কথা শুরু হতেই মেয়ের উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়।

- দেখুন। আমি কিন্তু রান্নাবান্না পারি না। বিয়ের পরে আমি এসব করতে পারবো না আগেই বলে রাখলাম।

ছেলেটা হাসে। বলে,

- আমি বলবো না আমাকে রান্না করে খাওয়াতে হবে। তবে তুমিও আমাকে বলতে পারবে না রান্না করে খাওয়াতে।

মেয়েটা আরও মজা পায়।

- দেখুন, সংসারের সব কাজ শেয়ার করে করতে হবে।
- হ্যাঁ, তা তো বটেই।
- যেমন ধরুণ, আপনি রান্না করবেন আমি খাবো, আমি থালা বাসন এঁটো করবো আপনি তা সাফ করবেন, আমি কাপড়চোপড় ময়লা করবো আপনি ধুয়ে দিবেন ইত্যাদি...

ছেলেটাও মজা পায় এই মেয়ের কথা শুনে। টুকটাক আরও কথা চলতে থাকে। এভাবেই দুপুর গড়ায়। এক পর্যায়ে ইচ্ছে না থাকলেও দু'জনকে বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে হয়। ছেলেটা বলে, "আমার কিছু কাজ আছে এখানে এক অফিসে। তাই যেতে হবে।" মেয়েটিও বলে, "অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাসায় ফিরতে হবে।" দু'জনে হেটে হেটে নিচে নেমে আসে। ইতিমধ্যেই মেয়েটি তার ড্রাইভারকে ফোন করে দিয়েছে। বাইরে গিয়ে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে হাজির। মেয়েটিকে বিদায় দেয়ার কিছুক্ষণ পরে ছেলেটিও এক সি এন জি নিয়ে তার গন্তব্য অভিমুখে রওয়ানা হয়।

দিনটি ছিলো ২৬শে অক্টোবর, ২০০৮। গল্পের কাহিনী এখানে শেষ হলেও ছেলে এবং মেয়েটির কাহিনীর কেবল শুরু এখান থেকে। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে এখনও তা বয়ে চলেছে। সাথে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন আরও অনেক কাহিনী। তবে সেটা এই গল্পের প্রতিপাদ্য নয়।





অতঃপর

মেয়েটি তার খাটের উপর আধশোয়া হয়ে প্রায় সারা রাত পার করে দেয় ছেলেটির কবিতার বই পড়তে পড়তে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি কবিতা পড়ে, তারপর আবার পড়ে। মনে অন্য রকম অনুভূতি। এসবের মাঝে সে টেরই পায়নি যে তার এই হঠাৎ পরিবর্তন অন্য কেউ মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছে।


(লেখাটি গত বছর এই দিনে বকলমে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো।)
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×