৫)
শেষ জীবনে মা’ যখন পশ্চিম বঙ্গে আমাদের সংসারে আছেন তখন তিনি খুব অবাক হয়ে যেতেন যে তাঁর বৌমারা এক/দুটো সন্তান নিয়ে কেমন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। খুব নির্বিরোধ মানুষ ছিলেন বলে তাঁর সঙ্গে বৌমাদের সম্পর্ক এমনিতে মোটামুটি ভালোই ছিলো। কিন্তু গোলমাল হয়ে যেত যখন কোনো ছেলে বা বৌমা তাদের কোন সন্তানের গা’য়ে হাত তুলতো। নাতি নাতনীদের গা’য়ে হাত তুলে শাসন তার সহ্য হতো না । তার জন্য বৌমাদের বেশ বকাঝকা করতেন। আর ছেলেদের ক্ষেত্রেত রীতিমত তাঁর দুর্বল হাতের দু/চার ঘা পাওনা হতো । সঙ্গে খাঁটি ময়মনসিংএর উচ্চারণে বকাবকি । বাবা হওয়ার পরও মা’য়ের হাতের শাসন এবং তৎসহ বকাবকি নিয়ে বাড়ী শুদ্দু সেই সময়ে বেশ হৈচৈ পড়ে যেত নাতি নাতনীদের মধ্যে।
মাতৃসুত্রের সেই বাৎসল্য বন্ধনের উৎসটি খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া যায় মা’য়ের সেই নিজস্ব সময়টাতে যখন তিনি শুধু মা ।
শহরের সীমিত পরিসরত নয় গ্রামের বাড়ী। বাংলাদেশের গ্রামের বাড়ী বলতে যা বোঝায়। এবং সেখানকার কাজ । এককথায় জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সবকিছুরই দায়িত্বে আমাদের সংসারে একজনই ছিলেন আর তাকে ঘিরে আর সবাই। সাধারণত ঐ সময়কালে মহিলা কেন্দ্রিক কোনো সংসার দেখা যেত না । হয়তো বাবার কারণেই আমাদের সংসারে এটা হয়েছিলো। কিন্তু দায়িত্ব পরিশ্রম—কোনোকিছুতেই ভয় পাওয়ার মত মানুষ ছিলেননা মা। ঐরকম অনুন্নত একটা প্রান্তিক অঞ্চলে টিঁকে থাকার লড়াইটা তাঁকে কোনো বিকল্প ছাড়াই লড়তে হয়েছিলো।
জীবন যাপনের ন্যুনতম আয়োজনেও অনেক ঘাঁটতি । একজন হোমিওপ্যাথ একজন এলোপ্যাথ এই দুই হাতুড়ে ডাক্তারের হাতে আমাদের চারপাঁচ গ্রামের মানুষের বাঁচামরা নির্ভর করতো । ছেলেপিলেদের অসুখবিসুখে শুধু ধৈর্য আর সেবা শুশ্রুষা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা। হয়তো কখনো ঐ দুই ডাক্তারের দেয়া ওষুধ । প্রাকৃতিক পরিবেশ এখনাকার মতো দুষিত না থাকার কারণে হয়তো আমরা বেঁচে গেছি। স্বাভাবিক নিয়মেই আমাদের বিবিধ জ্বর বা পেটের অসুখ একসময় সেরে গেছে। কখনো হয়তো খুব বাড়াবাড়িতে ইষ্টনাম জপ করা ছাড়া উপায় ছিলনা।
আমার মা’কে ঠাম্মা মাঝে মাঝে ‘ডাহাইতের বেডি’ বলে বকতেন । বকতেন মা’র নানা সাহসী কাজের জন্য। ভরা বর্ষায় সন্ধ্যাবেলা মা’ হয়তো সারাদিনের কাজের শেষে একা একা আমাদের গা ছমছম করা পুকুরে আপনমনে স্নান করছেন—-কখনো দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর বাসনকোশন মাঝতে গিয়ে পুকুর থেকে কচু পাতায় করে ধরে আনলেন একটা বেশ বড় সাইজের জোঁক—যা দেখে শুধু আমরা কেন বাড়ীর বড়রা পর্যন্ত ঘাবরে যেত । এককথায় প্রাকৃতিক ভয়ের উপাদানগুলোতে মা’র কোনো অমূলক ভয় ছিলোনা। তা এই ‘ডাহাইতের বেডি’ আমাকে নিয়ে আঁতুড় ঘরে যা করেছিলেন শুনেছি, তার কোনো তুলনা আর পাওয়া যায়নি। সেই কর্মের চিহ্ন এখনও আমি বয়ে বেড়াই। জন্মের পর নাকি দেখা গেল যে আমার এক হাতে ছয় আঙ্গুল। বাঁ হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলের গায়ে লাগানো আরেকটা আঙ্গুল। ঝুলন্ত । হাড় নেই । দেখে মা’র খুব মন খারাপ । ভাবলেন ছেরাডা বড় অইলে এটার জন্য মনে মনে কষ্ট পাবে । আঁতুড়ের তিন চার দিনের মাথায় উনি ঠাম্মাকে দিয়ে একটা নতুন ব্লেড আনালেন। উদ্দেশ্য নখ কাটা। ঠাম্মা ভালো মনে তা এনেও দিলেন। মা’ সেটা গরম জ্বলে ফুটিয়ে সুযোগ বুঝে আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে নিয়ে খচ করে সেই ঝুলন্ত আঙ্গুলটা কেটে দিলেন । আমি বোধহয় কিছুটা অস্বাভাবিক জোরে চীৎকার করে উঠলাম। সেই আওয়াজে ঠাম্মা প্রায় দৌড়ে এসে আঁতুড়ের দরজা ঠেলে ঢুকে বললেন ‘কিতা অইছে গো বউমা—ছেরাডা কান্দে এত —-ভাবলাম তুমি বুঝি ঘুমাইছ—। কিন্তু এসব বলতে বলতেই ঠাম্মারত চোখ ওল্টানোর দশা। মা’ বেশী কথার সুযোগ না দিয়ে শুধু বললেন—দেইনছে ঐ বাডিডা–মলম আছে ঐডায়। একহাতে সাদা একটা ন্যাকড়ায় আমার কাটা জায়গাটা চেপে ধরা । তাতেও সামান্য রক্তের আভাস । তার আগে মা’ তাঁর জানা একমাত্র কবিরাজী মলমটা বানিয়ে রেখেছিলেন যা কাটা ছেঁড়ায় লাগানো হত। ঠাম্মা যতই নার্ভাস হয়ে এটা সেটা বলার চেষ্টা করছেন মা’ তাঁকে ততই রীতিমত ধমকের উপর রাখলেন। বললেন’ মোডেত দুইডা দিনের ব্যাপার’—-।
ঠাম্মা সেদিন সত্যি সত্যি ডাহাইতের বেডির কাছে হেরে গিয়ে দুইদিন মুখ বুঝে রইলেন। শেষে যখন সত্যি সত্যি আমার কাটা জায়গাটা শুকোতে শুরু করলো ঠাম্মা আঁতুড় ঘরে ঢুকে শুধু মাথায় হাত দিয়ে একমনে নাকি আমার দিকে তাকিয়ে তাকতেন ।
এমনিতেই ফোঁড়া কাটাতে মা’র খুব হাত ছিলো। কাটাছেঁড়া দেখে ,রক্ত দেখে মা’র ভয় পাওয়ার প্রশ্ন ছিলোনা। কিন্তু এই সাহস যে তিনি এক নবজাতকের ভবিষ্যৎ ভেবে নিজের সন্তানের উপরই প্রয়োগ করবেন তা কে জানত। বড় হয়ে মা’কে যখন জিগগেস করেছি মা’ শুধু বলতেন ভয় যে আছিলোনা তা না তবে ভয় করলে কি আর চলতো তহ নকার দিনে—-।
শুনেছি একবার আমাদের বাড়ীতে ডাকাত পড়েছিলো। আমাদের বাড়ীটা গ্রামের শেষ বাড়ী এবং তার পরেই জঙ্গল হওয়ার দরুন ডাকাতরা আমাদের বাড়ীতেই প্রথম আসে। হ্য়ত তাদের কোনো ভুল হয়ে থাকবে কারণ তারা নাকি আমাদের সোনাগয়না এবং সামান্য অর্থ যা ছিলো হাতিয়ে নেয়ার পরও চাইছিলো আরো বেশী পরিমান টাকা। তাদের কাছে খবর আছে ।এবং তা কোথায় রাখা আছে জানানোর জন্য বাবাকে রীতিমত শারীরিক অত্যাচার শুরু করে । কাউকে বাবার কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছেনা। অবশেষে অর্থের খোঁজ না পেয়ে বাবাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। সেই মুহুর্তে মাকে আর কেউ আটকে রাখতে পারেনি—বাবাকে আড়াল করে মা শুধু ডাকাতদের বলেছিলেন ‘মারতে অইলে আমারেও মারন লাগব—।’ মাথার উপর তোলা অস্ত্রের কোপ যে কোনো কারণেই হউক তাঁদের উপর নেমে আসতে পারেনি । আর তার পরপরই বাইরে গ্রামের মানুষের পাল্টা প্রতিরোধের চীৎকার শোনা যেতেই আমাদের ঘরের ডাকাতরা পালানোর জন্য বেরিয়ে পড়ে। সেবার ঐ প্রতিরোধের মুখে একজন ডাকাত খুন হয়ে যায় যা নিয়ে পরবর্তীতে নাকি অনেক ফ্যাসাদও পোহাতে হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে অন্তত আমাদের সময়কালটাতে আর ডাকাতির ঘটনা ঘটতে দেখা বা শোনা যায়নি । (পরের অংশটি শেষ অংশ)