somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মোল্লাকুটির অথবা আমাদের গল্পঘরে

১০ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নদীর মতো, কিন্তু নদী নয়, অথচ অনেক অনেক নৌকার মত গাড়ি ও কার্বন নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে আকাশমুখী শুয়ে থাকা সড়কের গ্রীবা থেকে লম্বালম্বি প্রবৃদ্ধ চিপাগলির ভেতর আরো চিপাগলির গভীরে দাঁড়িয়ে থাকা দালানের সবচেয়ে উপরে, যেখানে পাখিরা সাধারণত অস্থায়ী নিবাস বানায় আর জানালায় তাকালেই নানাবিধ বিলবোর্ড ও বিলবোর্ড সুন্দরীগণ, সেখানে আমাদের অস্থায়ী এলোমেলো নিবাসের নাম হাসতে হাসতে মোল্লাকুটির হয়ে যায়, অথচ এখানে মোল্লাগিরি চলে না এবঙ মোল্লা নামেও কেউ নেই এবঙ এই শব্দটি কোনোভাবেই আমাদের কাওকে বিশেষায়িত করে না, তবু এর নাম মোল্লা কুটির হয়ে যায়। এখানে আমরা কোনো এক সকালে অথবা দুপুরে অথবা মধ্যরাতে অনায়াসে আসতে ও যেতে পারি, প্রবেশ কিংবা বহির্গমন, কোনো কিছুতেই জিজ্ঞাসা নেই।
মোল্লাকুটিরের গল্পের আগে এই শহর, নদীর মতো অথচ নদী নয় সড়ক, দূরনিবাসে আমাদের সম্মিলিত দিনলিপি এবঙ আমাদের সূত্রে আরো কিছু শহর ও আরো কিছু মানুষ প্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। এই গল্পের আগে আরো কিছু গল্প আছে। দীর্ঘ গল্প। সবুজ গাছ, জলের পুকুর বাক্সবন্দি জীবনের গল্প। ঐসব গল্পের ভেতর কখন কীভাবে আমাদের অনেকগুলো পা একই তালে পড়া শুরু করেছিলো, আমরাই কখনো বুঝিনি, কেবল টের পেলাম এভাবেই ভালো লাগে, এভাবেই ভালো থাকি, এভাবেই অনেককিছু কিংবা অনেক মানুষকে ভুলে থাকি। এই গল্পের শুরুতে আমাদের কর্মহীন দিনযাপনের ধূসর কথামালা, টিশার্ট ফেলে মাড় দেয়া শার্ট আর চকচকে কালো জুতোর ভেতর ঘাপটি মেরে অপেক্ষা, দৈনিক পত্রিকা কিংবা আন্তর্জালিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ধারা উপধারা বিশ্লেষণ, কারো ফেরিওয়ালা হবার গল্প। সকালের নাস্তা না করে একজনের দুপুরের খাবারের সংস্থান কিংবা সকালের নাস্তার যোগাড় করে খাদ্যহীন পেট নিয়ে চিলেকোঠায় ফেরার গল্প। মাদকজলে ডুবে যাবার গল্প। এবঙ উঠে আসার গল্প।
মোল্লা কুটিরের গল্পে আমরা সারাসকাল ঘুমিয়ে থাকি, সমাজ চায় নিষ্কর্ম আমরা ঘুমিয়েই থাকি, দুপুরে উঠে নিকোটিনে আহার সারি, বিকেলের রোদে পত্রিকার বিস্তারিত পাঠ করি। কেবল রাতে আমরা স্বাভাবিক হয়ে উঠি, গল্প করি, তাস পেটাই, দাবার সাদাকালো ছকে রাজা মন্ত্রী সৈন্য সামন্তের নিয়তি নির্ধারণ করে ঘুমিয়ে পড়ি শেষরাতে, পরের দুপুরে জেগে উঠে আগের নিয়মে ঘুরপাক খাওয়ার জন্যে।

মোল্লাকুটিরের গল্পে আমাদের সাথে জমে উঠে তেল মবিল, ইট কাঠের হিসাব, বিদ্যুৎ সঞ্চালক তারের দৈর্ঘ্য ও দামের ক্যাটালগ, বেনিয়া ব্যবসায়ীর সম্প্রসারণবাদ।
মোল্লাকুটিরের গল্পে ব্যবচ্ছেদ হয় স্থানীয় ও আন্রর্জাতিক রাজনীতি, ধর্ম, বিজ্ঞাপন, গান কবিতা সিনেমা। বিশ্লেষিত হয় শাহবাগ, হেফাজত,লাদেন, আমেরিকা, রাশিয়া, ভারত। আমরা একমত হই এবঙ হই না। তর্কের খাতিরে আলোচনার রসবৃদ্ধিতে আমাদের কেউ বলে হয়তো মোল্লারাই ভালো, যদিও সে মোল্লা হতে দূরেই থাকে, আর আমর রসগ্রহণ করে বলি তবে তুই মোল্লা, আর এভাবেই হয়ে যায় মোল্লাকুটির। অথবা আমাদের সৌখিন সাম্প্রদায়িকতা চ্চর্চার জন্য যাদের বলি মালু সম্প্রদায়, আবার বিভাজন করি নদীয়ার মালু ও কলকাতার মালু, অথচ বেশী করে মসলা পেয়াজ দিয়ে রান্না করা খাসির মাথা কিংবা বাচ্চুর দোকানের চা সিগারেট ভাগ করে খাওয়ার সময় মনেই থাকে না, কে মালু আর কে নয়, তবুও সৌখিন সাম্প্রদায়িকতা চর্চার স্বার্থরক্ষায় বলি, না তোরা মালুই, তখন ভারসাম্য নীতিতে মোল্লা উপাধি আরো পোক্ত হয়, আর আমাদের নিবাস আরো অধিকতর মোল্লা কুটির হয়ে যায়।
মোল্লাকুটিরের অনেক গল্প। এইসব গল্পের ভেতর ভেসে আসে সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশালের কন্যা। এবঙ প্রাসঙ্গিক হয়ে বাতাসে ভাসে নারায়নগঞ্জ কিংবা এই শহরেই হারিয়ে থাকা কেউ। আমরা অন্যান্য বিভাগের সাথে সম্পর্ক দৃঢকরণ নিয়ে আলোচনা করি হারিয়ে যাওয়া মুখগুলো ভুলে থাকার উপায় খুঁজি।
আমরা আবেগতাড়িত হই, হঠাৎ বিকেলের আড্ডা ছেড়ে উঠে পড়ি চট্রগ্রামের বাসে, সিলেটের পথে, কিংবা বরিশালের লঞ্চে। কিংবা অলস পথ হাটার মাঝে চমকে উঠি, এই শহরেই কী তুমি, এই শহরের কোনো ফুটপাত ধরে চলে যেতে পারো কিংবা শহর পেরিয়ে নারায়নগঞ্জের বাতাসে এখনো ফেলে রাখো প্রশ্বাস। কখনো কখনো মোল্লাকুটিরে কেউ কেউ এসে ছায়া ফেলে যায়। কেউ এসে কেবল বেখেয়ালে টিপ রেখে যায়, আর কেউ এসে সবচেয়ে শক্ত চেয়ারটাই ভেঙে যায়। কেউ আবার সারারাত বসে থাকি নিশ্চল উদাস, অচেনা কন্ঠের সাথে জমে বেওয়ারিশ কথোপকথন, আবার কেউ কার্ণিশ ধরে যেতে যেতে হঠাৎ শূন্যে পা বাড়িয়ে দেবার ঠিক আগেই চমকে উঠে।

এইসব তেল জল মবিল নিকোটিনের গল্প পেরিয়ে আমাদের মোল্লাকুটিরে ছায়া ফেলে বৃক্ষ। আমরা বৃক্ষের ছায়ায় চমকে উঠি, এরকম বৃক্ষও আছে বলে আমরা জানতামই না!
ছায়ার উৎসাহে মোল্লাকুটিরে জমে উঠে সম্মিলিত পাঠ, যা আমরা দীর্ঘকাল করিনি, আমরা আমাদের অন্তর্গত শক্তির পালে হাওয়া অনুভব করি, অথচ আমরা ভেবেছিলাম ফুরিয়ে গেছি। আমাদের বাতাসে নিকোটিন কমে আসে, ইনহেলারে দম অনিয়মিত হয়, চোখ লালের বদলে সাদাই থাকে। ছায়ার উৎসাহে আমরা সাফল্যের দেখা পাই। সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তার কিছু কিছু দায়িত্ব নেবার যোগ্যদের তালিকায় আমাদের নাম ঘোষণা শুরু করে।
আমাদের কর্ম সম্মানসূচক বিশেষণে বিশেষায়িত হয়। কিন্তু মোল্লাকুটিরের বাতাসে আমাদের অনুপস্থিতি বাড়ে। যার মন চলে যায় অহরহ চট্টগ্রাম, তার শরীর ঘুরে বেড়ায় রংপুর-কুড়িগ্রাম; সিলেটের চাপাতার সজীব ঘ্রাণে যে মুগ্ধ, তাকে চলে যেতে হয় খুলনার ওখানে ওখানে, শহরের সড়কে চমকে উঠা চোখে জমে উঠে টিলাবাড়ি চা বাগানের ছবি। কেবল বরিশালের লঞ্চ দিয়ে গেছে সব। এই শহরের অন্যকোণে কেউ চুপচাপ সুখী সংসার যাপনের চিত্রলিপি সাজে।

মোল্লাকুটিরের গল্পঘর ভেঙে যায় কিন্তু গল্প ভাঙে না। এভাবেই আমাদের তুমুল কর্মহীনতায় ব্যস্ত মোল্লা কুটির আমাদের নিজস্ব ব্যস্ততায় নি:সঙ্গ হয়ে যায়। কেউ জানে না, এই শহরে একদিন 'মোল্লাকুটির' ছিলো, কিছু বেপরোয়া যুবকের দিনলিপি এখানেই রচিত হয়েছিলো। কেবল আমরা জানি, চোখের ভেতর নয়, বুকের গহীনে আমরা ঝুলিয়ে রাখি বিলবোর্ড, যেখানে মোল্লাকুটিরের বিজ্ঞাপন কখনো সরে যাবে না।
৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×