আসামে ৪০ লাখ মানুষকে বাংলাদেশী সন্দেহে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের (এনআরসি) তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। আজ ৩০ জুলাই ২০১৮ বহুল প্রত্যাশিত এনআরসি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এনআরসিতে নাম নাই এর অর্থ হচ্ছে এই চল্লিশ লাখ মানুষ আর আসামের বা ভারতের নাগরীক নন, তারা বিদেশী। আর সহজ কথায় বললে তারা বাংলাদেশ থেকে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। ১৯৭১-এর ২৪ মার্চকে এনআরসি তৈরির প্রক্রিয়ায় আসামে নাগরিকত্বের মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ যারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পরে আসামে প্রবেশ করেছেন তাদেরকে বিদেশী (বাংলাদেশী) হিসাবে চিহ্নিত করতেই এই এনআরসি। এখানে বিজেপির কথা উল্লেখ না করলেই নয়। আসামে বাংলাদেশী খেদাও আন্দোলন দীর্ঘদিনের হলেও এ নিয়ে সরকারী-বেসরকারী জোরদার তৎপরতা শুরু হয় মূলত ২০১৬ সালে। আসমের বিধানসভার নির্বাচনী প্রচরনায় বিজেপির রাজনৈতিক অঙ্গিকার ছিলো, ক্ষমতায় গেলে তারা আসাম থেকে বাংলাদেশিদের বের করে দেবে। নরেন্দ্র মোদি যখন নির্বাচনী প্রচারে আসামে আসেন তখনও জনসভাগুলোতে জোর গলায় আসাম থেকে বাংলাদেশী খেদানোর অঙ্গীকার করেন তিনি। বিজেপি বিপুল ভোটে নির্বাচনে জিতে আসামে সরকার গঠন করলে এনআরসি তৈরীর প্রক্রিয়া বেগবান হয়। শুধু একটু পার্থক্য হচ্ছে, বিজেপির আন্দোলনের মূল দাবী ছিলো মুসলমান বাংলাদেশীদের খেদানো। কিন্তু এনআরসি-তে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাদ দেয়া হয়েছে যারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর আসামে গিয়েছিলেন। কেনো এই ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ?? কারণটা বেশ সোজা! ২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে এবং এর সাথে সাথে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের কারণে যারা আসামে গিয়েছিলো এবং স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে ফেরত আসে নি তাদেরকেই আসামের সরকার এখন বিদেশী তকমা দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর পাঁয়তারা করছে। অন্যদিকে মজার ব্যাপার হচ্ছে পাশের রাজ্য ত্রিপুরাতে এখন একই বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এবং সেখানের মূখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশী বাপ-মায়ের সন্তান বিপ্লব দেব। এই বিপ্লব দেবের বাবা-মা ৭১-এ বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বিপ্লব দেব তখন তার মায়ের পেটে। বিপ্লব দেবের কি সৌভাগ্য... আসামে জন্ম নিলে তিনি এখন বিদেশী (বাংলাদেশী) হিসাবেই পরিগণিত হতেন!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের এতে কি সমস্যা, কি আশঙ্কা!! কেউ কেউ বলবেন ভারত তো আর মায়ানমার না! হ্যা, এটা সত্য, ভারত আর মায়ানমায়ের মধ্যে রাজনৈতিক পার্থক্য অনেক! কিন্তু ‘পুসব্যাক’ শব্দটা জনপ্রিয় হয়েছিলো সেটা তো খুব বেশিদিনের কথা না। ভারতই তো শত শত বাংলাদেশিদের ধরে কাটাতারের বেড়া গলিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়ে পুসব্যাক শব্দটাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলো।
মিডিয়ায় খবর এসেছে, ইতিমধ্যে আসামে ৩০০ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল খোলা হয়েছে ‘বিদেশিদের বিষয়ে। এসব ট্রাইব্যুনাল প্রায় ২০ হাজার ব্যক্তিকে বিদেশি (বাংলাদেশী) চিহ্নিত করার কাজ শেষ করেছে। আরও লাখ লাখ মোকদ্দমা সেখানে মীমাংসার জন্য ঝুলছে। ছয়টি কারাগারে বিদেশিদের আটক রাখার জন্য যে ডিটেনশন সেন্টার রয়েছে, সেগুলো ইতিমধ্যে উপচে পড়ছে। কেন্দ্রীয় সরকার নতুন ডিটেনশন সেন্টার খোলার জন্য বড় আকারের বরাদ্দ দিয়েছে।
আসামে বাংলাদেশী বিরোধী হাওয়া বেশ জোরালো। লক্ষ লক্ষ অসমীয়া বাংলাদেশীদের খেদাতে চায়। যদি বাংলাদেশী বিরোধী অসমীয়ারা লুটপাট শুরু করে, নির্যাতন শুরু করে, এনআরসিতে যাদের নাম নাই তাদের চিহ্নিত করে হয়রানী শুরু করে?? প্রাণের ভয়ে, নির্যাতন-হয়রানী-ডিটেনশনের ভয়ে যদি হাজার হাজার মানুষ আবারও কক্সবাজার সীমান্তে রোহীঙ্গাদের মতো আসাম-বাংলাদেশ সীমান্তে এসে জড়ো হয়?? বাংলাদেশ কি তাদের আশ্রয় দিবে না?? রোহিঙ্গাদের তো কোন ব্যাখায়ই বাংলাদেশী বলা যায় না। কিন্তু আসামের এই বিদেশীরা তো বাংলাদেশের বা বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত! ১০ লাখ রোহিঙ্গাদের থাকার জায়গা দেয়া যাচ্ছে না, ৪০ লাখ অসমীয়া বাংলাদেশীর কি হবে???
আমার মনে হয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ এব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে বিষয়টা নিয়ে গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা এবং সম্ভব হলে এব্যাপারে যৌথ কোন এগ্রিমেন্টে আসা। আসামের বাংলাদেশী বিরোধী সমস্যাটা বহুদিনের। তাই এর স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন এবং এর সাথে বাংলাদেশের স্বার্থও জড়িত। একমাত্র ভারত-বাংলাদেশ সরকারের যৌথ আন্তরিক প্রচেষ্টাই পারে এই সমস্যার সঠিক সমাধান করতে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১৮ ভোর ৪:৩৫