somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডেস্টিনি ডিসরাপ্টেড- মুসলিম দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব ইতিহাস (০১০)

২০ শে মে, ২০১৮ দুপুর ১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খিলাফত এর জন্ম (২)
১১-২৪ হিঃ (৬৩২-৬৪৪ খৃস্টাব্দ)

আবু বকর (র) প্রথমেই মসজিদে গেলেন, যেখানে মানুষজন জড়ো হয়েছিল। তিনি তাঁদের উদ্দেশ্যে সদয় এক ভাষণে বললেন যে- আমাকে তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে ভেব না, আমি যদি ভাল করি আমাকে সমর্থন করো আর যদি আমি ভুল করি,আমাকে উপদেশ দিতে বিব্রত বোধ করো না. . . . যদি আমি আল্লাহ ও নবীর আইন অবহেলা করি, তাহলে আমি তোমাদের আনুগত্য পাওয়ার যোগ্য থাকব না। মসজিদে উপস্থিত সবাই তাকে একইভাবে সমর্থন করল যেমনটা পূর্ববর্ণিত সভায়ও করেছিল ।

সমস্যা হলো ‘সবাই’ কিন্তু মসজিদে বা সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন না। উত্তরাধিকারের অন্যতম প্রধান এক দাবীদার আদৌ জানতেনই না যে নেতৃত্বের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বয়স্করা যখন মিটিং করছিলেন, মহানবীর (সঃ) চাচাতো ভাই আলী (র) তখন অন্দরমহলে নবীজির গোসল দিচ্ছিলেন। নেতা নির্বাচনের বিষয়ে কথাবার্তা যতক্ষণে তাঁর কানে আসলো ততক্ষনে সবকিছু ফায়সালা হয়েই গেছে।

এই ব্যাপারটা যে কীভাবে বিতর্কিত হয়ে উঠতে পারে তা বোঝাটা খুব একটা কঠিন না। মহানবীর জীবনের শেষ কয়েক মাসে আলী (র) নিজেকে তাঁর অবিসঃবাদিত উত্তরাধিকারী বলে মনে করতেই পারতেন। কারণ সব দিক থেকেই তিনি ছিলেন নবীজির সবচেয়ে ঘনিষ্ট ব্যাক্তি। নবীজির একাধিক কাজিন ছিলেন, কিন্তু আলী (র) ছিলেন স্পেশাল, কারণ আলীর (র) পিতা আবূ তালেব মোহাম্মদ (সঃ) কে পালক নিয়েছিলেন এবং পুত্রের মতই তাঁকে বড় করেছিলেন। তাঁর মানে আলি (র) একদিক থেকে মহানবীর ভাইয়ের মতোই।

অন্যদিকে আলী বয়সে মোহাম্মদ (সঃ) এর প্রায় ত্রিশ বছরের ছোটো ছিলেন। আরবের গোত্রভিত্তিক সমাজে বয়সে এত সিনিয়র ভাই অনেকটা বাবার মতই সম্মান পেতেন। আলী যখন ছোট বালক তখনই তিনি মোহাম্মদ ও খাদিজা (র) এর সাথে তাঁদের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। তাঁর বেড়ে উঠা প্রায় সম্পূর্ণরূপেই নবীজির ঘরে। দেখা যাচ্ছে আলী শুধু মোহাম্মদ এর ভাই এর মতই ছিলেন না, এক দিক দিয়ে নবীজির পুত্রসম ও ছিলেন। তার উপর খাদিজা (র) এর পরে আলী-ই ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারী দ্বিতীয় মানুষ, অর্থাৎ প্রথম পুরুষ মুসলিম।

মহানবীর হিজরতের আগে মক্কায় আততায়ীরা যখন ঘুমের মাঝে তাঁকে হত্যা করার জন্য আসছিল তখন খুনিদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই আলী-ই নবীজির বিছানায় কম্বল ঢেকে শুয়ে ছিলেন- আততায়ীদের ছুরির শিকার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও। পরবর্তীতে মদিনাতে যখন মুসলমানদের অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে তখন বার বার এই আলী ই নিজেকে মুসলিমদের একিলিস (Achilles, গ্রীক পৌরাণিক নায়ক) হিসাবে প্রমাণ করেছিলেন। তখনকার দিনে অনেক যুদ্ধই শুরু হতো দুই পক্ষ থেকে একজন করে যোদ্ধার সরাসরি চ্যালেঞ্জ এর মধ্য দিয়ে। যতবারই কুরাইশরা মুসলিমদেরকে তাদের সেরা যোদ্ধাকে পাঠাতে বলেছে, মোহাম্মদ (স) আলীকেই পাঠিয়েছেন।

উহুদের যুদ্ধে যখন মুসলিমরা পরাজয়ের মুখে এবং অনেকেই পলায়নপর তখন আহত মহানবী কে আগলে রেখে নিরাপদে ঘরে নিয়ে আসতে আলীর (র) ভূমিকা ছিল বিশাল।

পরে যখন মুসলিম সম্প্রদায় আরও সমৃদ্ধ হলো এবং মোহাম্মদ (সঃ) রাষ্ট্রনেতাতে পরিণত হলেন, আলী তাঁর ডানহাতের মতোই ছিলেন। মোহাম্মদের সকল ঘনিষ্ট সাহাবীদেরই কারিশমা ছিল। তবে একটি নিবেদিতপ্রাণ গোষ্ঠীর চোখে আলীর একটি বিশেষ অবস্থান ছিল, তারা আলীর মধ্যে সেই রকম বিশেষ একটা কিছুর ছায়া দেখতে পেতেন যা তারা নবীজির মধ্যেও পেতেন। এই দলের অনেকেই ছিলেন তুলনামূলকভাবে বয়সে নবীন মুসলিম।

উপরে উল্লেখিত সবগুলো পয়েন্টই অনেকের কাছে আলী (র) কে বিশেষ করে তুলতে পারে, কিন্তু পরবর্তীকালের অনেক মুসলিম আরেকটা যুক্তিকে এসবের চেয়ে বড় করে তুলে ধরেন। নবীজির কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁর কন্যাদের মধ্যে একমাত্র ফাতিমা (র) এর পুত্রসন্তানরা শৈশবের পরও জীবিত ছিলেন। আর ফাতিমার (র) স্বামী ছিলেন আলী (র)। মোহাম্মদ (স) এর নাতিদেরকে তাঁর উত্তরাধিকারী ধরলে আলী (র) এর অবস্থান আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

এতসব বাদ দিলেও আমরা যদি শুধু এটুকু চিন্তা করি যে অন্দরমহলে চরম ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আলী (র) নবীজির শেষ গোসল দিচ্ছেন। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তিনি নবীজিকে ছাড়া তাঁর যে বাকী জীবন সেটার মুখোমুখি হলেন। এই ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব তাঁর উপর কতটা বিশাল ছিল তা আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। বেরিয়ে এসে আলী শুনলেন যে তিনি যখন নবীজির শেষ বিদায়ের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যাস্ত তখন অন্য সাহাবারা নেতা নির্বাচনে তৎপর। শুধু যে তাঁকে নেতা বানানো হয় নি তাই নয়, তাঁর সাথে আলোচনাও করার প্রয়োজন মনে করেনি কেউ। তিনি নিশ্চয়ই এর থেকে বেশী গুরুত্ব পাওয়ার দাবীদার ছিলেন!

অন্যদিক থেকে দেখলে আবার আলী (র)-র বিশেষত্বের পক্ষে যতোগুলো যুক্তি আছে সেগুলোই তাঁর বিপক্ষে কাজ করতে পারে। যেমন- আলী মহানবীর ঘনিষ্ট ছিলেন? মহানবীর পরিবারের অংশ ছিলেন? তো কী হয়েছে? আল্লাহ কী বলেছেন তিনি কোনও বিশেষ পরিবারকে প্রাধান্য দেবেন? পরিবারতন্ত্র তো পুরনো দিনের চল, যেসব বদলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি ইসলাম দিয়েছে।

এছাড়া মহানবী (সঃ) বলেছেন যে তাঁর পর আর কোন নবী আসবেন না। তাই যদি হয় তাহলে আলী (র) –র কোন বিশেষ কারিশমা থাকলেও সেটার কোনও ধর্মীয় গুরুত্ব থাকার কারণ নেই। তাহলে তো মুসলিমদের উচিতই ছিল যে তারা নেতৃত্ব আর মহানবীর বংশধর এই দুইটা জিনিসকে আলাদা করে, যাতে কোন অযাচিত ক্ষমতার প্রভাব ইসলামের সাম্য আর সার্বজনীনতার বাণীকে ডিসটর্ট করতে না পারে? এইভাবে চিন্তা করলে আলীর যেসব বিশেষ কারিশমার কথা বলা হয়, সেগুলোই কি তাঁর প্রতিকূলে কাজ করে না? তাঁর সমর্থকদের মধ্যে অতি উৎসাহীর দল আবার তাঁকে নতুন নবী হিসাবে ঘোষণা দিয়ে দেবে এমন আশংকা হওয়াও হয়তো অমূলক নয়।

শুরুর পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আগের পর্ব এখানে

[তামিম আনসারী’র Destiny Disrupted: A History of the World Through Islamic Eyes বইয়ের অনুবাদ।
https://www.goodreads.com/book/show/6240926-destiny-disrupted
https://www.amazon.com এ প্রিভিউ এবং রিভিউ দেখতে।]
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৪:৫৭
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×