somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডক্টর জিভাগো (১৯৬৫): মুভি রিভিউ

১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমরা প্রায় সবাই ডক্টর জিভাগো নামটা শুনেছি — কেউ সাহিত্যের পাঠে, কেউ সিনেমার পোস্টারে, কিংবা কোনো শিক্ষকের মুখে। কিন্তু আমি কখনও উপন্যাসটি পড়িনি, সরাসরি সিনেমা দেখলাম। বরিস পাস্তেরনাক-এর এই উপন্যাসটি ১৯৫৭ সালে রাশিয়ার বাইরে প্রথম প্রকাশিত হয়, যখন সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ এটিকে দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর এক বছর পর, ১৯৫৮ সালে, পাস্তেরনাক নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন এবং বিজয়ীও হন। কিন্তু সোভিয়েত সরকারের চাপ ও হুমকির মুখে তিনি শেষমেশ পুরস্কারটি গ্রহণ করেননি। বইটি তখন ইউরোপে গোপনে ছাপানো হয়েছিল, কারণ সোভিয়েত রাশিয়া তখন এর বিপ্লব-বিরোধি দৃষ্টিভঙ্গি পছন্দ করেনি।

এর প্রায় আট বছর পর, ১৯৬৫ সালে, উপন্যাসটি অবলম্বনে তৈরি হয় কিংবদন্তি ব্রিটিশ পরিচালক ডেভিড লিন-এর পরিচালনায় সিনেমা — ডক্টর জিভাগো। এটি এমন এক সময়ে তৈরি হয়েছে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক ছিল তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ — অর্থাৎ ‘cold- war’-এর সময়। ফলে সিনেমার চিত্রায়ন রাশিয়াতে করা সম্ভব হয়নি। পরিবর্তে স্পেন, ফিনল্যান্ড এবং কানাডার প্রাকৃতিক দৃশ্য ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয় এক অবিশ্বাস্যভাবে বিশ্বাসযোগ্য রাশিয়া। রাশিয়ান চরিত্রগুলো করেছেন মূলত ব্রিটিশ, আমেরিকান এবং একজন ইজিপশিয়ান অভিনেতা। হ্যাঁ, নায়ক ডক্টর জিভাগোর চরিত্রে অভিনয় করেন বিখ্যাত মিশরীয় অভিনেতা ওমর শরীফ, যিনি নিজের গভীর চোখ ও শান্ত অথচ সংবেদনশীল অভিব্যক্তির মাধ্যমে চরিত্রটিকে অমর করে তুলেছেন।

মূল চরিত্র ডক্টর ইউরি জিভাগো — একজন চিকিৎসক এবং একজন কবি, যার মনে প্রেম, নৈতিকতা ও দায়বোধের এক জটিল মিশ্রণ। তার জীবনে আছে স্ত্রী টোনিয়া, আছে প্রেমিকা লারা — যিনি একাধারে প্রেমিকা, মা, বিপ্লবের ভিকটিম এবং এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি। তাঁর জীবন বিভিন্ন পুরুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও তাঁর নিজের সত্তাটিও অসামান্য।

লারার ভূমিকায় জুলি ক্রিস্টি যেন একদম নিখুঁত। লারা জীবনের শুরুতেই এক কূটচালাক ব্যক্তি, কমারোভস্কির শিকার হন। তবে লারা কখনও দুর্বল নন — তাঁর চরিত্র জটিল, আত্মমর্যাদাশীল এবং গভীরভাবে মানবিক। এই জটিলতাই তাঁকে জীবন্ত করে তোলে।

কমারোভস্কি চরিত্রটি একজন ‘রক্ষাকর্তা’ ধাঁচের মানুষ, যিনি লারাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান — কখনও ভালবাসার মোড়কে, কখনও সমাজ-রাজনীতির বাস্তবতায়। তাঁর চরিত্রটি নিন্দনীয় হলেও বাস্তব — হয়তো অনেকটাই বিপ্লব-পরবর্তী রাশিয়ার আত্মকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর প্রতীক। কমারোভস্কির হাত ধরেই লারা ইউরির জীবন থেকে হারিয়ে যান। কিন্তু তা-ও যেন পূর্বনির্ধারিত — এই সিনেমায় ভালোবাসার চেয়ে সময় বড়, বাস্তবতা জোরালো।

এছাড়াও আছে চরিত্র ইয়েভগ্রাফ — ইউরির সৎ ভাই, একজন সোভিয়েত অফিসার, যিনি সিনেমার শুরুতে এবং শেষে উপস্থিত থেকে পুরো গল্পটিকে একটি আত্মজৈবনিক কাঠামোয় বেঁধে দেন। তাঁর উপস্থিতি যেন ইতিহাস ও ব্যক্তিগত গল্পের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন।

এই সিনেমার অন্যতম শক্তি হল চরিত্রগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক। ইউরি ও লারার ভালোবাসা যেন ধরা দেয় না, আবার ফাঁকেও পড়ে না — সমাজ, সময়, পরিবার, যুদ্ধ, সবকিছু মিলিয়ে তাঁদের প্রেম একটি দীর্ঘ অস্ফুট দীর্ঘশ্বাস। তাঁদের দেখা হয়, আলাদা হয়ে যায়, আবার দেখা হয় — কিন্তু কখনও পূর্ণতা পায় না।

চলচ্চিত্রটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট। বিশেষ করে প্রথম আধঘণ্টা কিছুটা ধীর গতির, চরিত্র পরিচিতি ও ইতিহাস নির্মাণে ব্যস্ত। কিন্তু একবার যদি ডুবে যেতে পারেন — তাহলে আপনি উঠে আসবেন এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা নিয়ে। এই অভিজ্ঞতা শুধুই ইতিহাস জানার নয়, বরং অনুভব করার — কীভাবে ভালোবাসা, দেশপ্রেম, শিল্প এবং জীবন একসঙ্গে মিশে যায় সময়ের এক ভয়াবহ মোড়ে। রুশ সাহিত্যিকদের যে বৈশিষ্ট্য — এক বিশাল ক্যানভাসে মানুষের ক্ষুদ্র কিন্তু গভীর যাত্রা — তার চমৎকার প্রতিফলন এই সিনেমায়। সমসাময়িক সাহিত্য বা সিনেমায় এমন বিশাল ক্যানভাস, এমন উচ্চমাত্রার নাটকীয়তা এবং মানবিক ট্র্যাজেডির এই স্বর দেখা যায় না। রুশ বিপ্লব, হিমশীতল তুষার, দিগন্তবিস্তৃত তুন্দ্রা — সব কিছু মিলিয়ে এক অনন্য ইতিহাস ও বাস্তবতা।

বরিস পাস্তেরনাক এই উপন্যাসের শেষে অন্তর্ভুক্ত করেন প্রায় ২৫টি কবিতা, যেগুলো মূলত পাস্তেরনাক নিজেই রচনা করেছিলেন, কিন্তু উপন্যাসে দেখানো হয়েছে সেগুলো ইউরি জিভাগোর লেখা। Winter Night বা Hamlet নামক কবিতাগুলো আজও রুশ সাহিত্যের এক ধ্রুপদি সম্পদ। এই কবিতাগুলিই পাস্তেরনাকের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অন্যতম কারণ বলে গবেষকরা মনে করেন।

সব মিলিয়ে, ডক্টর জিভাগো এমন একটি সিনেমা যা কেবল ‘দেখা’র নয়, বরং ‘অনুভব’ করার জন্য।

এই সিনেমাটি শুধু সমালোচকদের প্রশংসাই পায়নি, বরং বিশ্বজুড়ে রোমান্টিক দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিল। ডক্টর জিভাগো (১৯৬৫) পাঁচটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড (অস্কার) জিতে নেয়, যার মধ্যে রয়েছে সেরা চিত্রনাট্য, সিনেমাটোগ্রাফি এবং অরিজিনাল স্কোর—মরিস জারে'র বিখ্যাত Lara’s Theme আজও অবিস্মরণীয়। যদিও এই গল্পের মূল উৎস বরিস পাস্তেরনাকের উপন্যাস, তবুও এই চলচ্চিত্রটি নিঃসন্দেহে পরিচালক ডেভিড লিনের কৃতিত্বের প্রতিচ্ছবি। এমন বিশাল এক রাজনৈতিক ও আবেগঘন কাহিনীকে তিনি যেভাবে পর্দায় রূপ দিয়েছেন—তাতে প্রতিটি চরিত্রের আত্মা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে এই গল্প নিয়ে একাধিক রিমেক তৈরি হয়েছে, তবে ১৯৬৫ সালের এই সংস্করণই সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রভাবশালী। এমনকি মুদ্রাস্ফীতির হার অনুযায়ী হিসাব করলে এটি এখনও পর্যন্ত ইতিহাসের অষ্টম সর্বাধিক আয় করা চলচ্চিত্র।

(লেখাটি ChatGPT-র সাহায্য নিয়ে সাজানো হয়েছে)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৮:১০
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×