somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পর্ব-১ - হাদীস সংকলনের ইতিহাসঃ শরীয়া আইন এর অনুপযোগিতা

১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইসলাম একটি শাশ্বত ধর্ম। তবু এই ধর্মের এত সমালোচনা করা সম্ভব হয় কিভাবে? এর কারণ হচ্ছে বর্তমানে যারা ইসলাম পালন করে তারা ইসলামের মূল ধারা থেকে বহু দূরে বেঁকে গিয়ে ধর্ম পালন করে। যেকোন ইসলামিক আলেমকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় ইসলামের ভিত্তি কি, তাহলে তার উত্তর হবে নিম্নরুপঃ

শরীয়তের মূল ভিত্তি হচ্ছে পবিত্র কোরআন গ্রন্থ, যা কিনা আল্লাহ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর উপর অবতীর্ণ করেছেন। তবে কোরআন এর অনেক আয়াতই বুঝা কষ্টসাধ্য বিধায় কোরআনের পরেই শরীয়তের ভিত্তি হচ্ছে সহিহ হাদীস যা কোরআনকে ব্যাখ্যা করে। হাদীসের বহু গ্রন্থের মাঝে ছয়টি গ্রন্থ সবচেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য, এই ছয়টি গ্রন্থকে একত্রে সিহাহ সিত্তা বলা হয়। সিহাহ সিত্তার মাঝে প্রথম দুটি গ্রন্থ সহিহ বুখারী এবং সহিহ মুসলিম শরীফের হাদীসে কোনই সন্দেহ নাই, তবে বাকি চারটি গ্রন্থের হাদীসে বর্ণনাকারীর ধারাতে (ইসনাদ) ত্রুটি থাকলে বা কোরআনের সাথে সাংঘর্ষিক হলে অভিযুক্ত হাদীসটি বাতিল বলে গণ্য হবে। মোট কথা ইসলামের মূল ভিত্তি হচ্ছে ১. পবিত্র কোরআন, ২. বুখারী শরীফ, ৩. মুসলিম শরীফ। এই তিন গ্রন্থে কোন সন্দেহ নাই।


আলেমরা উপরোক্ত ধারণাটি এত ব্যাপক প্রচার করেন যে একজন সাধারণ মুসলিমও এই ধারণায় শতভাগ বিশ্বাসী হয়ে যান। কিন্তু আসলে কি আলেমদের কথা প্রকৃত সত্যের সাথে মিলে? এর উত্তর জানার জন্য আমাদের কিছু বিষয় জানা প্রয়োজন, সেটাই আমি ধারাবাহিক পর্বে সাধারণ পাঠকদের জানানোর চেষ্টা করব।

শরীয়া আইন নিয়ে আলোচনা করলে মূলত হাদীস শাস্ত্র নিয়েই আলোচনা করতে হয় কারণ শরীয়া আইনে কোরআনের চাইতে হাদীসের প্রাধাণ্য অনেক অনেক বেশী। কোরআন এর সাথে শরীয়া আইনের সম্পর্ক খুবই কম। বরং কোরআন আইনের প্রধান উতস হিসেবে কিভাবে ব্যবহৃত হবে সেটাই হাদীস শাস্ত্র নির্ধারণ করে দেয়। বর্তমানের বেশীরভাগ মুসলিম শরীয়া আইন সম্পর্কে প্রায় তেমন কিছুই জানেনা, শুধুমাত্র বাপ দাদার আমলের বিশ্বাস হিসেবে অন্ধ ভক্তি করে। কিন্তু হাদীসগুলো বিস্তারিতভাবে না পড়লে শরীয়া আইন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব না। আধুনিক মুসলিম সমাজ বেশ কিছু ক্ষেত্রে অনেক উদার মনোভাব প্রকাশ করে। এমন মনোভাবের সাথে মিলে যাওয়া বাছাইকৃত হাদীস নিয়ে বই লিখা হয় যা পড়ে শরীয়া আইনের উপর আধুনিক মুসলিমের অন্ধ বিশ্বাস আরও প্রগাড় হয়। সমস্যা হয় তখনই যখন দাসপ্রথা, পাথর ছুড়ে হত্যার বিধান, অসাম্প্রদায়িকতা, নারীর অধিকার, বিজ্ঞান ইত্যাদি অনেক বিষয়ের হাদীস যেগুলো আধুনিকতার সাথে মিলে না সেগুলো চোখের সামনে পড়ে। তখন সবাই নানাভাবে এগুলো অতীতের বিষয় বলে এড়িয়ে চলে সেই পূর্বের অন্ধ বিশ্বাসকেই সংরক্ষণ করে। অথচ বাঙ্গালী মুসলমানের জীবনে শরীয়া আইনের কোন প্রভাব বা গুরুত্ব কোনটাই নেই। এটা শুধু ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাতিয়ার হিসেবেই এদেশে ব্যবহার হয়ে আসছে। সামান্য একটু পড়াশুনা করলেই হাদীস শাস্ত্রের দূর্বলতা সকলেরই চোখে পড়বে। স্ববিরোধী হাদীস, কোরআন বিরোধী হাদীস, অবৈজ্ঞানিক হাদীস, অশ্লীল ও লজ্জাজনক হাদীস, বর্বর হাদীস, আজগুবি হাদীস, মিথ্যা হাদীস, সমসাময়িক বাস্তবতায় অনুপযোগী হাদীস ইত্যাদি বিভিন্ন ত্রুটিপূর্ণ হাদীসের কোন অভাব নেই হাদীসের বইগুলোতে।

শরীয়া আইন ও হাদীস সংকলনের ইতিহাসঃ

মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে আছে যে মুহাম্মদ (সা) নিজেই হাদীস সংকলণ করতে নিষেধ করে গিয়েছিলেন। এই কথার সমর্থনে আরও কিছু হাদীস আছে। তবে এর বিপরীত কথাও হাদীসের গ্রন্থে পাওয়া যায় যেখানে হাদীস লিখার অনুমতি নবী দিয়েছিলেন। অনুমতি দেয়ার হাদীসগুলো দেখিয়ে অনেকে প্রমাণ ছাড়াই দাবী করেন যে কোরআন এর সাথে সংমিশ্রণের ভয়ে প্রথমে হাদীস লিখতে নিষেধ করলেও পরে নবী হাদীস লিখার অনুমতি দিয়ে যান। কিন্তু এই দাবীর বিপক্ষেও জোড়ালো যুক্তি দেখানো যায়। যেমন কেউ এমন দাবীও করতে পারেন যে নবী প্রথমে হাদীস লিখার অনুমতি দিলেও পরে হাদীস লিখতে নিষেধ করে গিয়েছেন। হাদীস সংকলনের কোন তারিখ না থাকায় এই দাবীটি কেউ মিথ্যা প্রমাণ করতে পারবেনা। বরং এই দাবীর স্বপক্ষেই প্রমাণ আছে। উদাহরণ স্বরুপঃ নবীর পরবর্তী প্রধান চার খলিফাও হাদীস সংকলনের বিপক্ষে ছিলেন, তাদের আমলে কোন হাদীস গ্রন্থ সংকলিত হয়নি, বরং সারা দেশের সমগ্র হাদীস যোগাড় করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। এমনি করেই প্রায় দেড়শ বছর নিষেধাজ্ঞার কারণে হাদীসের কোন গ্রন্থ লিখিত হয়নি। তবে হযরত আলীর মৃত্যুর পর এই নিষেধাজ্ঞার কথা একসময় মানুষ ভুলে যায়।

হাদীসের সবচেয়ে পুরানো যে গ্রন্থের কথা জানা যায় সেটাও লিখিত হয়েছিল মুহাম্মদ (সা) এর মৃত্যুর প্রায় দেড়শ বছর পর। সেই গ্রন্থের কোন অস্তিত্বও এখন খুজে পাওয়া যায়না। তবে বহুল পরিচিত বুখারী ও মুসলিম শরীফ সহ সুন্নি মুসলিমদের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সিহাহ সিত্তার ছয়টি হাদীস গ্রন্থই লিখিত হয়েছিল নবীর মৃত্যুর আড়াইশ/তিনশ বছর পর। এই গ্রন্থগুলোয় আসলেই সত্যি কথা লিখা আছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা তাই সম্ভব নয়। যুগে যুগে নতুন নতুন হাদীস নিয়ে নতুন গ্রন্থ লিখিত হয়েছিল। বর্তমান শরীয়া আইনের সাথে তাই আগের শরীয়া আইনেরও ছিল প্রচুর গড়মিল। ঈমাম আবু হানিফা তার হানাফি মাযহাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সিহাহ সিত্তা ও অন্যান্ন অনেক হাদীস গ্রন্থ লিখিত হবার বহু আগে, তাই এই মাযহাবে হাদীসের প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম ছিল, ইজমা কিয়াসের সুযোগ ছিল। ঈমাম আহমদ ইবনে হাম্বল তার হাম্বলী মাযহাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সিহাহ সিত্তা গ্রন্থ সংকলণের পর, তাই এই মাযহাবে ইজমা কিয়াসের সুযোগ নেই, সবকিছুই হাদীস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

একটা কথা জানা দরকার যে বুখারী/মুসলিম হাদীস গ্রন্থ লিখিত হবার পূর্বেই লক্ষ লক্ষ হাদীসের অস্তিত্ব ছিল যার বেশীরভাগই ছিল জাল বা নকল হাদীস। ইহুদিরা জাল হাদীস তৈরি করেছে এমন ধারণা প্রচলিত ছিল বলেই ঈমামগণ হাদীস সংকলণের ব্যাপারে উদ্যোগী হন। লক্ষ লক্ষ জাল হাদীস তৈরী হবার কিছু কারণ উল্লেখ করা দরকার। ইসলামের শত্রুরা কোরআনের কোন ক্ষতি করতে সমর্থ ছিলনা বলে লক্ষ লক্ষ জাল হাদীস রচনা করে ইসলামের ক্ষতি করতে চেয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মৃত্যুদন্ড প্রপ্ত আব্দুল করিম স্বীকার করে গিয়েছিলেন যে তিনি একাই চার হাজার জাল হাদীস প্রচার করে গিয়েছিলেন যেখানে তিনি হারাম কে হালাল আর হালালা কে হারাম বানিয়ে দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক ভেদাভেদের কারণে লক্ষ লক্ষ হাদীস জাল করা হয়েছিল। খলিফা উসমানের মৃত্যুর পর হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়া কে নিয়ে মুসলিম সমাজ শিয়া, খারেজি ইত্যাদি বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তখন হযরত আলীর সম্মান বাড়ানোর জন্য শিয়া গোত্র অনেক জাল হাদীস রচনা করেছিল, আবার বিরুদ্ধ পক্ষ হযরত আলীর জন্য অসম্মানজনক কথা প্রচার করেও অনেক জাল হাদীস রচনা করেছিল। এমনি করে হযরত আবু বকর ও অন্যান্ন নেতার পক্ষে বিপক্ষে অনেক জাল হাদীস রচিত হয়েছিল। আবার কিছু কিছু সুযোগ সন্ধানী লোক তাদের নেতাদের সুনাম করে হাদীস জাল করত নিজেদের সুবিধা আদায়ের লক্ষে। অনেকে আবার কাল্পনিক সব গল্প বলে হাদীসের নামে চালিয়ে নিজের সম্মান বৃদ্ধি করত। হাদীস জাল করার এমন আরও বহু কারণের মাঝে অনিচ্ছাকৃত মানুষ্য ভুলও জাল হাদীস রচিত হবার পেছনের বড় একটি নিয়ামক ছিল।

নবীর মৃত্যুর তিনশত বছর পর এত লক্ষ লক্ষ জাল হাদীসের ভীড়ে সত্য হাদীস বের করাটা প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। তবে ঈমাম বুখারী সত্য হাদীস নির্ণয় করার একটা উপায় বের করলেন। তিনি শুধু সত্যবাদী লোকদের কাছ থেকেই হাদীস সংগ্রহ করা শুরু করলেন যারা কিনা আবার পূর্ব বা বর্তমান প্রজন্মের অন্য কোন সত্যবাদী লোকের কাছ থেকেই হাদীসটি শুনেছিলেন। এমনি করে ঈমাম বুখারী প্রায় ছয় লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করেছিলেন যেগুলো যাচাই বাছাই করে এক লক্ষ সহিহ হাদীসে নামিয়ে এনেছিলেন আর মুখস্থ করেছিলেন। এই এক লক্ষ সত্য হাদীসের মাঝে মাত্র ছয় হাজার হাদীস তিনি তার বুখারী হাদীস গ্রন্থে লিখেছিলেন। বাকিগুলো তিনি সময় স্বল্পতা বা অন্য কোন কারণে লিখে যেতে পারেননি। এই সেই বুখারী হাদীস গ্রন্থ যা প্রায় শতভাগ সহিহ বলে বর্তমান আলেম সমাজ প্রচারণা করে। বর্তমানের আলেমদের এই দাবী কতটা সঠিক তা পরের পর্বে আলোচনা করা হবে।

চলবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:২৮
২২টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×