somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুভি রিভিউ-সহজ পাঠের গপ্পো

১৭ ই মার্চ, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এখানে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মাথা ঘোরানো থিউরি নেই, H2O পানির রাসায়নিক সংকেত, না ধানমন্ডির রেস্টুরেন্ট, সেই দ্বন্দ নেই। শরীর তত্বিয় বায়লোজি নেই, নেই ব্যাকরণের দুর্ব্ধতাও। তবে কি আছে? আছে জীবনের সরল অংক।

সত্যজিত রায়কে একবার একজন বলেছিল, আপনার চিত্রনাট্য ভালো লাগেনি কিন্তু সংলাপ ভালো লেগেছে। সত্যজিত রায় তাকে বলেছিলেন, সংলাপ চিত্রনাট্যের অংশ। যেটা বোঝনা সেটা নিয়ে কথা বলো না।

কলকাতার একটি ব্যান্ড চন্দ্রবিন্ধু। চন্দ্রবিন্দুর একজন ভোকাল ও লিরিসিস্ট চন্দ্রিল। ভদ্রলোকের ফিল্ম ও সাহিত্য সম্পর্কে অগাত জ্ঞান, তবে আমি যে কারণে তাকে হিংসা করি তা'হল তার সাবলীল উপস্থাপনা। মহাশয় ফিল্ম বিষয়ে এক ডিবেটে বলেছে, চলচিত্র একটি আশ্চর্য মিডিয়া। যেখানে অনেকগুলো মিডিয়া এক সাথে কাজ করে, যেমন: লাইট, ক্যামেরা, আর্টিস্ট, চিত্রনাট্য। যার একটিতেও সমস্যা থাকলে ফিল্ম বাজে। সেটা চিত্রনাট্য বাজে আর সংলাপ ভালো হলেও ফিল্ম বাজে। এমনকি চিত্রনাট্য, সংলাপ, ক্যামেরা, অভিনয় সব ভালো শুধু ব্যাকগ্রাউন্ডে লাইট দুইবার কেঁপে গেছে, তাহুলেও ফিল্ম বাজে। আমি খারাপের মাঝে ভালো খুঁজবো না, ভালোর মাঝে বেস্ট খুঁজবো।
যদি দিনেমাটোগ্রাফি ভালো হলেই সিনেমা ভালো হয় তাহলে কয়েকটা স্টিল ছবি তুলে পাশাপাশি বসিয়ে দিলেই ভালো ফিল্ম হয়ে গেল। যদি শুধু অভিনয় ভালো হলেই মুভি ভালো হয় তাহেল অভিনেতাদের কে ছেড়ে দিলেই হবে, তারা অভিনয় করবে। ডিরেক্টরের দরকার কি?

ফিল্ম কোন তরকারী নয় যে, পেঁয়াজের দাম বেশি আজ পেঁয়াজ ছাড়াই তরকারি খেলম নাহয় স্বাদ একটু কম হল। এভাবে ফিল্ম বিচার করা যায় না। একটা ফিল্ম কে ফিল্ম হয়ে উঠতে গেলে সবদিক স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে হবে। একটা দিকও বাজে হলে মুভি বাজে। সুতরাং যারা বলে, কমার্শিয়াল হিসাবে ঠিক আছে, বাংলাদেশী হিসাবে ভালো কিংবা হলিউড এবং বলিউডের সাথে তুলনা করবেন না বা অভিনয় ঠিক আছে, গল্প ভালো, সংলাপ কেমন যেন, ক্যামেরা কিছু জায়গায় খারাপ, মিউজিক ভালো লাগেনি কিন্তু ওভার অল ফিল্মটা ভালো তাদের সাথে আমার চরম বিরোধ। আগেই বলেছি একটা ফিল্ম কে ফিল্ম হয়ে উঠতে গেলে তার সব দিক স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে হবে।
এতকথা কেন বললাম ? কারণ আছে।

SPOILER ALERT

বিভূতিভূষণের তালনবমী গল্প অবলম্বনে নির্মিত এই মুভিতে শুরুতেই আমরা দেখতে পাই, দুজন ছোট বাচ্চা বাড়ির পাশে ছিপ ফেলে মাছ ধরছে। ছোটু বলে" দাদা, বাবা কি মারা যাবে? বাবা মারা গেলে আমরা খাব কি? আমি শুনেছি, মা বলেছে বাবা আর বাঁচবে না, আমাদের আর একটাও টাকা নেই।" শুরুতেই বুকের ভেতর একটা হাহাকার ঢুকে যায়। বড় তখন বলে যে, এলাকার এক কাকী তাকে ডেকেছে কুয়া পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য, সেখানে কুয়া পরিষ্কার করার পর যদি কিছু খেতে দেয় তাহলে তোকেও দেব, ঠিক আছে। সাথে সাথে ছোটুর কান্না ভেজা চোখে টলটলে খুশির ঝলক ঝিলকে ওঠে। একটা বড় মাছ বঁড়শিতে আটকে গেলে ছিপ ভেঙে যায়। ছোট মজাতে লাফাতে থাকে, বড় কে রাগানোর জন্য। সুখ দুঃখ এখানে এমনি, পাশাপাশি জড়িয়ে থাকে, নব বিবাহিত দম্পতির মত। অবশ্য ছোটু টা একটু বেশিই সহজ-সরল, আর সহজ সরল মানেই তো বোকা। ছোটু টা একটা বোকার হদ্দ।

একটু পরে বড় ছোট কে নিয়ে জঙ্গলের দিকে যায়। ছোট ভেতরে ঢুকতে ভয় পায় বলে ছোট কে বাইরে রেখে বড় একা ভেতরে যায়। পাখির বাসা থেকে ডিম্ চুরি করে আনে। সামান্য ডিম দেখে ছোটোর যে আনন্দ- উল্লাস, সাত রাজার ধন পেলেও হয়তো কেউ এমন লাফাতো না। ফিরতি পথে ছোট বলে "দাদা, পাখির ডিম চুরি করলেও কি পাপ হয়? মা বলেছে চুরি করলে ভগবান পাপ দেয়।" বড় তখন বলে "জানিনা, কই যখন খেতে পাই না, তখন তো ভগবান খেতে দেয় না।" না বুঝে দুজন ছোট বাচ্চা কী গভীর কথা বলে ফেলে।
একটা অণুগল্প পড়েছিলাম, সেখানে লেখক বোঝাতে চেয়েছে যে, পেটে খাবার না থাকলে ভগবানও পাগল হয়ে যায় আর সামনে খারাব থাকলে পাগলও নিজেকে ভগবান ভাবে।

গল্পটা যেখানে বাক নেয় তা হল, বড় একদিন স্বপ্ন দেখে যে, তাদের বাবা মারা গেছে আর মা ট্রেনের নিচে আত্মহত্যা করছে। এই একটি স্বপ্ন বড় কে অনেক বড় করে দেয়। সে দায়িত্ব নিতে শিখে। অভাব অনটন বুঝতে পারে। একদিন তারা জানতে পারে গ্রামের এক ধনী পরিবার জন্মষ্টমীর পূঁজা করবে। সারা গ্রাম দাওয়াত করবে। খবরটা শুনে ওদের চোখ চকচক করে ওঠে। বড়োর মাথায় খেলে ব্যবসা। পূঁজা মানে তালের বড়া, পিঠা। তার মানে তাল লাগবে। গিয়ে কথা বললে হয়তো তালের অর্ডার পাবে। আর ছোটোর চোখে ভাসে নানান পদের খাবার। বলেছিলাম না ছোটটা একটু বেশিই বোকা। তালের অর্ডার তারা পায়। কিন্তু বাঁধসাধে ছোট। ছোট বলে তাল দিয়ে টাকা নিস না, টাকা নিলে ওরা আর আমাদের দাওয়াত করবে না। কিন্তু বড় নাছোড়বান্দা, সে টাকা নিবেই। নাছোড়বান্দা ছোটও, পরদিন সকালে সে বড়োর আগে ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টির মধ্যে একা তাল কুড়াতে যায়। পথে একজন বলে, খোকা একা ওদিকে যেয়োনা সাপ আছে। কিন্তু ছোটোর নাকে তখন পোলার গন্ধ, চোখে হরেক পদের খাবারের স্বপ্ন। গন্ধ আর স্বপ্নের কাছে ভয় কাবু হয়ে যায়। সে তাল কুড়িয়ে টাকা না নিয়েই দিয়ে আসে। বড় জানতে পেরে চড়াও হয় ছোটোর উপর। সে বলে, দাওয়াত এমনিতেও করবে না, করলে প্রথম দিনই করতো। কিন্তু ছোটোর দৃঢ় বিশ্বাস দাওয়াত তাকে করবেই, না করে পরেই না।

পূজার দিন ছোটুর মা ছোটুকে সাদা ভাতের সাথে শাক সিদ্ধ খেতে দেয়। ছোটু বিরস মুখে চিবাতে চিবাতে দেখে, দুজন ছেলে সেজে গুঁজে কোথায় যেন যাচ্ছে। সে দৌড়ে এসে জিঙ্গেস করে, কোথায় যাচ্ছিসরে তোরা? তারা বলা দাওয়াত খেতে, কেন তোদের বলেনি? ছোটুর বুকের ভেতর তখন ঝড় ওঠে, ঝড়ের দমকা হাওয়ার মত ভেতর থেকে তীব্র রাগ, আক্রোশ, আক্ষেপ বেরিয়ে আসে। ছোটু তীব্র ক্ষোভে চেঁচিয়ে বলে, কে বলেছে আমাদের বলেনি! আমাদেরও বলেছে, দাদা হাটে থেকে ফিরলে আমরাও যাব। তখন ছোটুর যে এক্সপ্রেশন, অসাধারণ।

পুরো মুভিতেই ছোটুর এক্সপ্রেশন চমৎকার। গল্পের গাঁথুনিও সুন্দর। সংলাপ, সাউন্ড মিলে মুভিটি অনবদ্য। পথের প্যাঁচালীতে আপনি ভাই বোনের দুষ্ট-মিষ্টি খুঁনসুটি পাবেন আর এখানে পাবেন পিঠাপিঠি দুই ভাইয়ের।

কিন্তু এত কিছু থাকার পরও মুভিটি বাজে, যদি আমি চদ্রিল এর কথা ধরি, যেটা আমি ধরব। আমরা জানি শুটিং এর জন্য এক্সট্রা লাইটের দরকার হয়, সেটা যদি রাতের দৃশ্য হয় তাহলে কথাই নেই। হারিকেন বা কুপির আলোয় ইমেজ ক্লিয়ার আসবে না কিন্তু সেই লাইট যদি যততত্র ব্যবহার করা হয় আর সেটা ক্যামেরায় ধরা পরে তাহলে চোখে লাগে। যেটা গোটা মুভিতে করা হয়েছে। বড় এবং তাদের মায়ের অভিনয় দু এক জায়গায় দুর্বল লেগেছে। আমি জানি না, গল্পটা সত্যজিত রায়ের চোখ এড়িয়ে গেছে কিনা, না পথের প্যাঁচালীর পর তিনি আর এধরণের মুভি করতে চাননি, কিন্তু- উনি যদি করতেন তাহলে আমরা পথের প্যাঁচালীর মত আর একটা মাস্টারপিস পেতাম। যেহেতু পেতাম বলছি, সেহুতু প্রেজেন্টেশনের দিক থেকেও দুর্বল লেগেছে। সুতরাং আমার কাছে এটা একটা বাজে মুভি।

একটা বাজে মুভি হওয়া স্বত্বেও মুভিটি আমি আপনাদের দেখতে বলব। দেখুন- তাজমহল যারা গড়তে দেখেছে নিঃসন্দেহে তারা ভাগ্যবান, এখন যারা তাজমহল দেখছে তারাও ভাগ্যবান কিন্তু তাজমহল যদি কোনদিন ভাংগা পড়ে, সেই ভাঙ্গনের স্বাক্ষী হয়ে থাকাও কম সৌভাগ্যের নয়।

সুতরাং হাতে সময় থাকলে দেখতে পারেন, হতে হতেও না হয়ে উঠতে পারা অসাধারণ এই মুভিটি।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:০৭
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×