বিশেষ সাক্ষাৎকারে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ
আমি লেখক, ইতিহাসবিদ নই
দীপন নন্দী
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, 'আমি একজন সাধারণ লেখক মাত্র। কোনো ইতিহাসবিদ নই। সেজন্য ইতিহাসভিত্তিক কোনো উপন্যাসে আমার লেখা তথ্যে ভুল থাকতেই পারে। তবে তা যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব শুধুই পাঠকের। যদি পাঠক মনে করেন আমি সঠিক লিখেছি, তাহলে আমি ঠিক। পাঠক যদি মনে করেন আমি ভুলে লিখেছি, তাহলে আমি ভুল।' প্রকাশিতব্য আলোচিত উপন্যাস 'দেয়াল' প্রসঙ্গে এভাবেই নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করেন তিনি। শুক্রবার গাজীপুর জেলার ভাওয়াল-মির্জাপুর ইউনিয়নের পিরুজালি গ্রামে তার নির্মিত নন্দনকানন 'নূহাশপল্লী'তে যায়যায়দিনের সাথে একান্ত আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। হুমায়ূন আহমেদ বলেন, 'এ বইটি নিয়ে আমি বেশি কিছু বলতে পারব না। আর বললেও তুমি বা তোমার পত্রিকা ছাপাতে পারবে না। কারণ, এতে আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে, বইটি আমি এখনো লেখা শেষ করিনি। আমি প্রচুর বই পড়ছি এ বিষয়ের ওপর। আমি চেষ্টা করব সর্বোচ্চ নির্ভুল তথ্য সংবলিত বই পাঠকের হাতে তুলে দিতে।' হুমায়ূন আহমেদ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করা এই কথাশিল্পী চার দশক ধরে লিখে চলেছেন অবিরাম। তার সরলরেখার মতো লেখার ভাষা পাঠককে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। কৈশোরে 'জোছনার ফুল'- এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ এই শব্দশিল্পীর শরীরে এখন বাসা বেঁধেছে দুরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধি। প্রকৃতি আর জীবনের সৌন্দর্য সন্ধানে নিবেদিত এই লেখক তবুও হার মানেননি রোগের কাছে, মানতেও চান না। তাই তো মাথার ওপর মৃত্যুর পরোয়নাকে সঙ্গী করে তিনি লিখে চলেছেন প্রতিনিয়ত। একই সাথে সুস্থ হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্যান্সার হাসপাতালে নিজের চিকিৎসা করাচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ। সেখান থেকেই গত ১১ মে ভোরে বিশ দিনের জন্য দেশে আসেন। সম্প্রতি, তার 'দেয়াল' উপন্যাসের ওপর নিষেদ্ধাজ্ঞা প্রদান করেছেন হাইকোর্ট। সেই 'দেয়াল' প্রসঙ্গ ছাড়াও শুক্রবার তিনি কথা বলেন নানা বিষয়ে। প্রথমেই আলাপচারিতায় উঠে আসে জীবন ও মৃত্যু নিয়ে তার ভাবনার কথা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'মানুষের জীবন সম্পর্কে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'শবি' উপন্যাসের নায়কের মতো বলতে ইচ্ছে হয়, জীবন এত ছোট কেন? একজন মানুষ এত জ্ঞান-বুদ্ধি নিয়ে পৃথিবীতে আসেন, আর মাত্র ৫০-৬০ বা ৭০-৮০ বছর বয়সে মারা যান। এটা ঠিক না। কচ্ছপের মতো একটি প্রাণী যদি সাড়ে তিনশ' বছর বাঁচাতে পারে, তাহলে মানুষ কি দোষ করলো!' চারপাশে সবুজের সমারোহে অনন্য এক স্থান 'নূহাশপল্লী'। নিজের থাকার কটেজ থেকে শুক্রবার সকালে তিনি বের হন ছেলে নিষাদ হুমায়ূনকে সাথে নিয়ে। বাবার একনিষ্ঠ ভক্ত নিষাদ বাবার হাত ধরে চলে আসেন পল্লীর দীঘির কাছে। দীঘির নাম 'লীলাবতী'। হুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওন দম্পতির প্রথম সন্তানের নাম ছিল লীলাবতী। মৃত কন্যার নামানুসারে তিনি দীঘির নামকরণ করেন। দীঘির নামফলকে লেখা, 'নয়নে তোমারে পায় না দেখিতে/রয়েছে নয়নে নয়নে'। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দৃষ্টিতে দীঘির দিকে তাকিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে চলেন পুকুর পাড়ের দিকে। লিচুগাছের ছায়ায় বসে বলতে শুরু করেন নানা কথা। বললেন, 'অনেকে বলে এই নূহাশপল্লী আমাকে সুস্থ করে দেবে। সত্য নয়, সবই আবেগী কথা। এখানে আসলে আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারি। কিন্তু এখানে কোনো আধ্যাত্মিক শক্তি নেই যে, আমাকে সুস্থ করে তুলবে। আমি অতি আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণ করছি। এই চিকিৎসায় আমাকে সুস্থ করে তুলবে বলে আশা করি। কারণ, বিশ্বের সেরা সেরা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ আমার চিকিৎসা করছেন।' হুমায়ূন আহমেদ বলেন, 'আমার মানসিক শক্তি আছে, হয়তো অনেকের চেয়ে একটু বেশিই। কিন্তু রোগের কাছে কিন্তু আমাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। এই ধরো বিশ্বখ্যাত কম্পিউটার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান অ্যাপেলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের কথা। তার কি মানসিক শক্তি কম ছিল। ছিল না, তারপরও তাকে রোগের কাছে হার মানতে হয়েছে।' এ সময় ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো স্যাভেজের ক্যান্সার থেকে সু্স্থ হওয়ার প্রসঙ্গ তুললে তিনি বলেন, 'আমি রাজনীতিবিদদের কোনো কথা বিশ্বাস করি না। এর আগেও হুগো স্যাভেজ সুস্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তাকে আবারো চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়েছিল। তবে সত্যিই যদি তিনি সুস্থ হয়ে যান, তাহলে এটা অবশ্যই ভালো এবং প্রেরণাদায়ক।' মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেন, 'মৃত্যু ভয়াবহ ব্যাপার। যখন আমেরিকার চিকিৎসকরা আমাকে দুই বছর বাঁচার কথা বলেছিলেন, আমি সহজভাবেই নিয়ে ছিলাম। কিন্তু তারপরও বলি, মৃত্যুর মতন ভয়ঙ্কর বিষয় আর নেই।' প্রসঙ্গ পাল্টে মৃত্যুর পরের জীবন প্রসঙ্গ আনলে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, 'মুত্যুর পরে অনন্ত জীবন রয়েছে_ অনেকের কাছেই এ কথা শুনি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না। হ্যাঁ, ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তা রয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, মৃত্যুর পর আমি মাটির সাথে মিশে যাব। জানি না, আমার বক্তব্য ধর্মপ্রাণ হৃদয়ে আঘাত হানবে কি না।' নূহাশপল্লী নিয়ে তিনি বলেন, 'গাছের প্রতি মমতায় আমি নূহাশপল্লী গড়ে তুলেছি। এখানে বেশিরভাগ গাছ আমি নিজের হাতে লাগিয়েছি, অন্য গাছগুলোর সাথে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানে যে দুই হাজারের মতো গাছ রয়েছে, তারা আমার সন্তানের মতো। আমি থাকব না, কিন্তু আমার গড়া নূহাশপল্লী থাকবে। থাকবে আমার দুই হাজার সন্তান। এর চেয়ে বেশি কী পাওয়ার আছে?' তিনি নূহাশপল্লীর গাছের সাথে কথা বলেন- এ তথ্য জানিয়ে বলেন, 'এখানে থাকা গাছেদের সাথে আমি কথা বলি। জীবনের নানা কথা আমি তাদের শেয়ার করেছি। আমি জানি না, তারা কথা বলে কি না। হয়তো বলে, কিন্তু সে ভাষা আমি বুঝতে পারি না।' তিনি নিজের গল্প-উপন্যাসে বারবার দ্বারস্থ হয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বর্তমানে রবি ঠাকুর আপনাকে কি প্রেরণা জোগাচ্ছেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'কোনো প্রেরণা জোগাচ্ছে না। কারণ, মৃত্যু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দুই ধরনের কথা বলেছেন। একবার তিনি বলেছেন 'মরিতে চাহিনা সুন্দর ভুবনে' আবার বলেছেন 'মরণ রে তুই মম শ্যাম'। এই কারণেই জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমি তার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাচ্ছি না।' জীবন নিয়ে কোনো কষ্ট বা অতৃপ্তি আছে_ কিনা জানতে চাইলে তিনি বললেন, 'জীবন নিয়ে আমার কোনো কষ্ট বা অতৃপ্তি নেই। কারণ, আমি জানি কিভাবে জীবনে সুখী হতে হয়। অনেকেই আছেন যারা বলেন আমি আমার শ্রেষ্ঠ কাজ এখনো করতে পারিনি। কিন্তু, আমি যখনই কোনো উপন্যাস লিখি বা চলচ্চিত্র বানাই তখনই আমার মনে হয় আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজটা করে ফেলেছি।' তিনি পুরস্কার নিয়ে মাথা ঘামান বলেও এ সময় জানিয়ে দেন। প্রত্যেক মানুষকে সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী উল্লেখ করে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, 'প্রতিটি মানুষের মাঝেই সৃজনশীলতা রয়েছে। আমি আমার সৃজনশীলতা লেখালেখির কাজে লাগিয়েছি। অনেকে লাগায়নি বলেই তারা নিজেদের সৃজনশীলতা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারছে না।' লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ছবিও অাঁকেন বেশ। চিকিৎসাধীন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে তিনি জলরঙে অনেকগুলো ছবি অাঁকেন। সেসব ছবি থেকে বাছাইকৃত ৪০টি ছবি নিয়ে ২৯ জুন নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় শুরু হচ্ছে তার প্রথম চিত্রকলা প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর কিউরেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন আলোকচিত্রী ওবায়দুল্লা মামুন আর সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন রুমা সাহা। এ প্রদর্শনী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি সবসময়ই প্রকৃতির প্রতি এক দুর্নিবার আর্কষণ অনুভব করি। সেই অনুভব থেকে প্রকৃতির ওপর কিছু ছবি এঁকেছি। সেগুলোরই প্রদর্শনী হবে। আমি বিমূর্ত ধারার মতো রেখার ওপর ছবি না এঁকে বাস্তবিক ছবি এঁকেছি। বাংলাদেশেও প্রদর্শনী করার ইচ্ছা রয়েছে।' চিত্রকলা থেকে আবার ফিরে যাই তার লেখালেখি নিয়ে। ৪২ বছর ধরে আপনি লিখছেন, আপনার মধ্যে ক্লান্তি এসেছে_ কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, 'লেখালেখি করা কোনো ক্লান্তিকর কাজ নয়। যদি ক্লান্তিকর কাজ হতো তাহলে তো আমি ৪২ বছর ধরে লিখতে পারতাম না। আসলে আমি লেখালেখি করেই আনন্দ পাই। যেমন তুমি হয়তো ছবি তুলে অনন্দ পাও। আসলে কোনো কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলে তাতে ক্লান্তি আসে না।' নিজের উপন্যাসগুলোর নামকরণ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'কখনো-সখনো আমি উপন্যাসের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা অন্যান্য কবির কাছে হাত পাতি। যেমন আমার 'সবাই গেছে বনে' উপন্যাসের নামকরণ করেছি কবিগুরুর 'আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে' গান থেকে। আবার 'যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ'- এর নামকরণের জন্য গেছি জীবনানন্দ দাসের কাছে।' নিজের লেখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমার প্রথমদিককার বিশেষ করে, ৮০ ও ৯০-এর দশকে দিকে আমার লেখায় আবেগের প্রাধান্য ছিল। বর্তমানে আমি যুক্তিকে প্রাধান্য দিই।' হুমায়ূন আহমেদ তার ৪২ বছরের সাহিত্যজীবনে বারবার সমালোচকদের তীক্ষ্ন লেখনির শিকার হয়েছেন। তাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, 'সমালোচকদের বিষয়ে আসলে আমার বলার কিছুই নেই। তারা যা কিছু তা বলতে পারেন। আমার কাজ লেখার, তাদের কাজ সমালোচনা করার। এর চেয়ে বেশি তো কিছু না।' মিসির আলী, হিমু কিংবা শুভ্র_ তার লেখা এমন অনেক চরিত্র পেয়েছে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। এসব চরিত্রের মাঝে কার ওপর হুমায়ূন আহমেদের ছায়া বেশি রয়েছে_ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'প্রত্যেকটি চরিত্রই আমার সৃষ্টি। ফলে প্রত্যেক চরিত্রের মাঝেই কিছুটা হলেও আমার ছায়া রয়েছে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মিসির আলীকে পছন্দ করি। কারণ, যেহেতু আমি একজন যুক্তিবাদী মানুষ, সেহেতু তার যুক্তি আমাকে প্রভাবিত করে।' এ সময় তিনি বলেন, 'আমি জানি না পরবর্তী জন্ম বলে আসলেই কিছু আছে কিনা। যদি থেকে থাকে তাহলে আমি মিসির আলী হিসেবে জন্ম নিতে চাই'। তার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কিনা_ জানতে চাইলে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, 'সব মানুষের মতো আমার কিছু অস্বাভাবিকতা আছে। হঠাৎ হঠাৎ কিছু মানুষের সাথে দেখা করার বাসনা তৈরি হয়। এই বাসনা যাদের জন্য তৈরি হয় তারা সবাই মৃত। যেমন- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ, সতীনাথ ভাদুরি।' প্রায় এক ঘণ্টার সাক্ষাৎকারে তিনি আরেকবার পুনঃব্যক্ত করেন নিজের স্বপ্নের কথা। বলেন, 'ক্যান্সার নিরাময় হাসপাতাল তৈরির ভাবনাটা এখনো আমার ভেতরে আছে। প্রবাসী বাঙালিরা চায় কোনোভাবে দেশের উন্নয়নে অংশীদার হতে। দেশের হতদরিদ্র মানুষদের উপকারে আসতে। ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরিতে তারা এগিয়ে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি।' যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ৩৭ বছরের বন্ধু 'সিগারেট' ছেড়ে দিয়েছেন। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'সিগারেট একটি ভয়াবহ ব্যাধি। এটি আমার শত্রুরূপী বন্ধু ছিল। এর থেকে মানুষকে বাঁচতে হবে। কারণ, সব রোগের সূত্রপাত ঘটে এর থেকে।' সবাইকে এই বদভ্যাস ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'আমি জানি, সিগারেট ছাড়া কতটা কঠিন। তারপরও সবাইকে পরামর্শ দেব সিগারেট ছেড়ে দেয়ার।' জীবনে টাকার অনেক প্রয়োজন উল্লেখ্য করে তিনি বলেন, 'জীবনের পথচলায় টাকার অনেক প্রয়োজন। যাবতীয় সুখ কিনতে টাকার প্রয়োজন। জীবনে ভালোভাবে চলার জন্য টাকার বিকল্প নেই।' অরণ্য, পাহাড় আর সমুদ্র_ প্রকৃতির এই তিন উপহারের কোনটি আপনার বেশি প্রিয়_ জানতে চাইলে এক মুহূর্ত না ভেবে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, 'আমার কাছে সমুদ্র ভালো লাগে। এর মধ্যে যেমন বিশালতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে সৌন্দর্য। সমুদ্রের প্রতি এমন ভালোবাসার কারণে আমি সেন্ট মার্টিন ও টেকনাফে জমি কিনেছি। আশা করি জীবনের শেষ দিনগুলো সেখানেই কাটাব।' 'এছাড়া বৃষ্টি ও জোৎস্না আমার খুব প্রিয়। বৃষ্টি নামলে নূহাশপল্লীতে আমার বৃষ্টিবিলাসে দাঁড়িয়ে কখনো বৃষ্টিতে ভিজি আবার কখনো টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনি। বাংলাদেশে থাকলে প্রতি পূর্ণিমায় আমি নূহাশপল্লীতে ছুটে আসি। দুই পুত্র নিষাদ ও নিনিত ও তাদের মা শাওনকে সাথে নিয়ে উপভোগ করি জোৎস্না। জোৎস্না আমাদের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি করে। তারপরও আমি জোৎস্না দেখি, দেখতে চাই।' আলাপচারিতার একেবারে শেষ পর্যায়ে তিনি পাঠকদের উদ্দেশে বলেন, 'তারা ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আমার মতো দুরারোগ্য রোগের শিকার যেন তারা না হন।' এরপর সম্ভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, 'আর কত কথা বলব? একদিনে অনেক কথা বলে ফেলেছি। এখন যাও পত্রিকায় ছাপিয়ে দাও।' বলে হাসতে হাসতে হাঁটা দিলেন নূহাশপল্লীতে নিজের কটেজের দিকে। যেতে যেতে নিজে থেকেই পরিচয় করিয়ে দিলেন নূহাশপল্লীর বিভিন্ন গাছের সাথে। বললেন কোন গাছের সাথে তার কোন সম্পর্ক। এরই মাঝে কটেজের সামনে এসে উপস্থিত বন্ধুপ্রবররা। তাদের কেউ কেউ আবার তার ধানমন্ডির ফ্ল্যাট 'দখিন হাওয়া'র 'ওল্ড ফুলস ক্লাব'- এর সদস্য, আবার অনেকেই এসেছেন শুধু 'স্যার'কে এক নজর দেখতে। গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর কোলন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় যান হুমায়ূন আহমেদ। দুই পর্বে বারোটি কেমোথেরাপির পর ডাক্তাররা তার বৃহদান্ত্রের অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন। তার আগে মাত্র ২০ দিনের জন্য দেশে আসেন তিনি। জুন মাসের এক তারিখে আবারো আমেরিকা যাচ্ছেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদের সুহৃদ, বন্ধু, পাঠক, ভক্ত সবারই এখন একটাই চাওয়া। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আবার তিনি ফিরে আসবেন প্রিয় মাতৃভূমিতে। তিনি যখন কথা বলছিলেন, তখনো তার কথায় বারবার ফুটে উঠছিল প্রিয় দেশের প্রতি টান। নানা কথায় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতার পঙক্তির মতোই তিনি যেন বলতে চাইছিলেন, 'আবার আসিব ফিরে, এই ধানসিঁড়িটির তীরে'।