আসলে মানুষ বড়ই প্রশংসা প্রিয় একটা প্রজাতি। এরা যেমন অন্যের মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে পছন্দ করে, তেমনি নিজের সম্মন্ধে বলতে গেলেও একগাদা প্রশংসাসূচক শব্দমালার অনর্থক উদগিরন করে বেড়ায়। যদিও সবসময় নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে না মনে হলেও নিজের প্রশংসা শুনতে ভালোই লাগে। নিজের এক গাদা প্রশংসা হয়ত জান্তে-অজান্তে আমিও উদগিরন করে দেই।
যাক সে কথা, সত্যি করে বলতে গেলে আমি কোন আহামরি কোন মানুষ না। জীবনে তেমন আহামরি কিছু করতে পারিনি। প্রাইমারি বা হাই স্কুল বা কলেজে কখনই ভালো ছাত্র ছিলাম না, কখনো ভালো হওয়ার চেষ্টাও করা হয়নি।আসলে সবাই নাকি অনেক স্বপ্ন দেখে ছোটবেলা থেকেই। সেই অনুযায়ী ছোটাছুটিও করে। সাথে বাবা মায়েরাও নামে গাঁট বেধে। আমার ক্ষেত্রে এরকম কিছুই হয়নি। আসলে স্বপ্ন দেখতে প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে। একটা আশা কর, তারপর তার পিছনে ঘোড়ার মত ছুট! সফল হবে কি হবেনা তার কোন ঠিক নেই। তাই কখনো স্বপ্ন দেখাই হয় নি। আর বাবা মায়ের গাঁট বেধে নামা বলতে মাঝে মাঝে দোয়া দুরুদ পরে মাথায় গায়ে ফুঁ দিয়ে দিত, এই পর্যন্তই! তারপরও এক অদ্ভুত কারণে কিভাবে কিভাবে যেন প্রত্যেকটা ধাপ পেরিয়ে গেছি। একটা মোটামুটি মানের সরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে চান্সও পেয়ে গেছি। মাঝে মাঝে ভাবতে বসলে সব কিছুই কেমন যেন মিরাকেল মনে হয়, বিশ্বাস করতে অনেক কষ্ট হয়। তারপরও কেন জানি মনে হয় এই ধাপটাও টেনেটুনে পার হয়ে যাব।
আসল ব্যাপারটা হল জীবন সম্মন্ধে একটা ধারনা নিয়ে ফেলেছি। জীবনে বাধা আসবেই। কিছু বাধা এমনি এমনি পার হয়ে যাব, আর কিছু বাধা হাতড়ে হাতড়ে অনেক কষ্টে পার হব। কিন্তু বাধা পার হবই। যদিও সেটা খুব সম্ভবত নিজের চেষ্টায় না। অনেকটা হয়ত কপালের জোরে। আর যে বাধাটা পার হতে পারব না সেখানে জীবনের পাতার শেষ ফুল স্টপটা দেয়া হবে। এর বেশি কিছু ভাবতে পারিনি, আসলে ভাবার যোগ্যতাও আমার নেই।
যদিও প্রায়ই বলি আমার কপালটা অনেক ভালোই। কিন্তু এই ব্যাপারে নিজের ভিতর থেকে সাড়া পাই নাহ! কারণ হিসেবে একটা ছোট ঘটনা বলি, দেখা গেল বাসে উঠলাম। নেহাত কপাল গুনে একটা সিট খালি পেয়ে বসেও গেলাম।একটু পরেই শুরু হলও মুষলধারে বৃষ্টি। এরপরে স্বভাবতই বাসের ভিতরে ছাদ থেকে পানি পড়বে। হবেও তাই। কিন্তু দেখা গেল বাসে প্রায় ৪০ টা সিট থাকলেও ঠিক আমি যেখানে বসেছি সেখানটাই পানি পরতে শুরু করেছে ভয়াবহ ভাবে। বাকি সিটগুলো দিব্যি ভালো আছে। এই হলও আমার ভাগ্যের নমুনা! এ ব্যাপারে অবশ্য একটা ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছি যে, ভাগ্য যদি কাউকে ভালবেসে কিছু দেয়ও তবে সে অন্যও কোনভাবে এর সমতা সাধন করবে।জানি এর চেয়ে হাস্যকর ব্যাখ্যা হয়ত খুব কমই আছে। কিন্তু সবকিছু সহজ করে চিন্তা করার জন্যই এমন সব উদ্ভট ধারনার জন্ম দিতে হয়। ব্যাপারটা অনেকটা সেই খরগোশের গল্পের মত যেখানে শিকারির তাড়া খেয়ে খরগোশ দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় আর না পেরে নিজের চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে পরে। সে ভাবে তাকে আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না। আসলে যখন পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায় তখন সবাই সব কিছুকে সহজ করে ভাবতে চায়। তা সে যত হাস্যকর ভাবনাই হোক না কেন!
প্রচণ্ড হতাশাবাদী বলতে যা বুঝায়, আমি আসলে তাই। আশেপাশে যা দেখি তাই মনে হয় অনর্থক! যখন কোন ছেলেকে এক মেয়ের হাত ধরে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে থাকতে দেখি তখন চড় মেরে দুইজনেরই দাঁত ফেলে দিয়ে ডেন্টিস্টের একটা বিশাল উপকার করার ইচ্ছা জাগে। যখন বাসের মধ্যে ২ টাকার জন্য বাসের কন্ডাক্টর আর জনৈক যাত্রী তুমুল বাক বিতণ্ডা শুরু করে, তখন প্রচণ্ড ইচ্ছা জাগে ২ জনকেই লাথি মেরে বাস থেকে ফেলে দেই। যখন আশেপাশের মেয়েগুলো হাউকাউ করে এক অনর্থক শব্দজট বাধায়,তখন সবগুলোকে একসাথে বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দেয়ার দুর্দমনীয় ইচ্ছাটাকে অনেক কষ্টে দমন করতে হয়। যখন বাচ্চাদের হাত ধরে বাপ মাকে অদম্য গতিতে স্কুল কোচিং এ দৌড়াদৌড়ি করে নিজেদের সাথে সাথে ওই বাচ্চাগুলোর জীবনটাকে অতিষ্ঠ করে ফেলতে দেখি,তখন সেই সব বাপ মাকে সাহারা মরুভূমির কোন এক দুর্গম অঞ্চলে নির্বাসন দেয়ার একটা হাহাকার মনে জাগলেও সেই হাহাকারকে অনেক কষ্টে পাথরচাপা দিতে হয়!সত্যি বলতে জীবন থেকে শুরু করে জীবনের আনুসাঙ্গিক খুঁটিনাটি সব কিছুই কেমন যেন চরম অনর্থক বলে মনে হয়!
এই হতাশাটা আমার নিজের ক্ষেত্রে আরও ভয়াবহ। সেটা বললে নিদেনপক্ষে কয়েক পৃষ্ঠার মহাকাব্য লেখা যাবে। তাই সে কথা বাদ দেই!তবে এ ব্যাপারেও একটা ব্যাখ্যা খুঁজেছিলাম। কিন্তু তেমন আন্তর্জাতিক মানের কোন ব্যাখ্যা পাইনি। তবে শুনেছি সৃষ্টিশীল মানুষরা নাকি হতাশাবাদী হন। আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ হলেন এর বাস্তব উদাহরণ। তারও নাকি জীবনের প্রতি ছিল চরম অনীহা। আর "গালিভারস ট্রাভেলস"এর লেখক জোনাথন সুইফট তো নিজের জন্মদিনে কালো পোশাক পরে অন্ধকার ঘরে বসে উপোষ করতেন বলে শুনেছি! কিন্তু সমস্যা হল আমি তো কোন সৃষ্টিশীল মানুষও না, তাহলে আমার নিরাশাবাদী হওয়ার কি কারণ? হয়ত কোন এক কারণে ওই জিনিসটা বাদ দেয়া হয়েছে অথবা বাদ পরে গেছে! হয়ত আমার দুর্বল হার্ডওয়্যারে অত দামী সফটওয়্যার কাজ করবে না বলেই ওটা দেয়া হয়নি। কি জানি! নিশ্চয়ই হবে কিছু একটা! এত ভাবতে ভালো লাগে না। নিজের অক্ষমতা না লুকিয়ে বললে এত ভাবতে পারি না! হয়ত যত সময় যাবে তত ধাঁধার জট খুলবে। তখন হয়ত ভাবতে পারব, কারণটা হয়ত খুঁজে বের করতে পারব। অথবা হয়ত কখনোই এর উত্তর পাওয়া যাবে না। সব প্রশ্নের যে উত্তর থাকবে এমন তো আর কোন কথা নেই!!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১২:১১