somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ অমলিন চিরদিন

২০ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১০:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক.
বাড়ীতে ঢুকতে সাহস পাচ্ছেনা শওকত। বাড়ীতে ঢুকার সাথে সাথেই মা একেবারে “ফেড়ে” ফেলবেন। মাগরিবের আযানের পর বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে গেছে। অন্ধকার হয়ে এসেছে প্রায় চারিদিক। ফুটবলটা হাতে নিয়ে দরজার গোড়ায় দাড়িয়ে আছে সে। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। এতক্ষণে ওর কলপাড়ে হাত মুখ ধোয়ার কথা। কিংবা পড়তে বসে যাওয়ার কথা। বড় ভাই পড়া দিয়েছে রচনা। এখনো মুখস্থ হয় নাই। সেটা নিয়েও ভয়ের শেষ নাই। ভয়টা বড় ভাইয়ের না। মায়ের। যদি কোন ভাবে বুঝতে পারে যে পড়া তৈরী হয় নাই, তাহলে আর দেখতে হবেনা। পাড়া প্রতিবেশী এক হয়েও মাকে ঠেকানো যাবেনা। একেবারে আস্ত মেরে ফেলবে।

মা কেন এমন করে তা নিয়ে অনেক ভেবে দেখেছে সে। তার ক্লাস সেভেনে পড়া ছোট্ট মাথাটায় সব কথা ঢোকেনা। ঢুকলেও বোঝেনা। কানাঘুষা শোনে মার নাকি কি একটা অদ্ভুত অসুখ আছে। সবাইকে নিজের মত চালাতে চায়। না চললেই বিপদ। তখন তাকে শত্রু মনে করে। নিজের ছেলেরে কেউ শত্রু মনে করে? শওকত ভেবে পায়না। ওর ছোট্ট মাথাটায় গন্ডগোল লেগে যায়।

ইচ্ছে করে কি আর দেরী করেছে সে আজ? ফুটবল খেলছিল স্কুলের মাঠে। ঠিক আযান দেওয়ার আগে আগে মিতুলের লাথিতে বল পাশের পুকুরে গিয়ে পড়লো। সবাই কিছুক্ষণ গুতাগুতি করল বলটা তোলার জন্য। তারপর ভেগে যেতে লাগল এটা ওটা বলে। মিতুল পর্যন্ত কেটে পড়ল। একা একা এখন বল তুলবে কিভাবে ও? বলের পেছনে ইট মারতে লাগল। একটা ইট পেছনে পড়ে তো পরেরটা সামনে। আর জায়গাটাও কেমন ফাকা। পুকুরের এদিকটাতে লোকজন তেমন আসেনা। পরে অনেক কষ্টে লাঠি দিয়ে টেনে, ইট মেরে বলটা তুলেছে সে। অনেক শখের বল তার। বৃত্তির টাকায় কেনা। কিন্তু ঝামেলা হচ্ছে আযান তো দিয়ে দিয়েছে। আর আযানের পর একমিনিটও বাইরে থাকা শওকতের জন্য হারাম।

যা আছে কপালে মনে করে দরজার দিকে পা বাড়ায় শওকত। এমন সময় ঠিক যেন ফেরেশতার মতন “শওকত না? এখানে কি করছিস খোকা?” বলে উদয় হলেন সিরাজুল মিঞা। শওকতে মেঝ মামা। কাচাপাকা দাড়ির পান খেয়ে দাঁত লাল হয়ে যাওয়া মানুষটিকে দেখেই শওকতের মনে আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। মেঝ মামা বাড়ীতে আসা মানেই মোটামুটি ঈদ আর কি শওকতের কাছে। সেদি কেউ বকা ঝকা করেনা, পড়াশুনার নাম গন্ধ থাকেনা, যাওয়ার সময় আবার বিশ পঞ্চাশ টাকাও দিয়ে যান মাঝে মাঝে। তবে আজ খুশির কারণ হল মায়ের বকার হাত থেকে রক্ষা।

খুশিতে বত্রিশ টা দাত বের হয়ে যায় শওকতের।
-কি রে এখানে কি করছিস খোকা? চল বাড়ি চল।
মামার সাথে বাড়িতে ঢোকে শওকত। মোটামুটী হইচই পড়ে যায় বাড়ীতে। রাহেলা বেগম ও ব্যাস্ত হয়ে পড়েন। কেন জানি ভাইজানকে দেখলেই তার ব্যাবহারেও পরিবর্তন আসে মাঝে মাঝে। শওকতের বড় বোন আসমা পা ধোয়ার পানি আগায় দেয়। বড় ভাই নিজের ঘর থেকে বের হয়ে আসে। মা পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকেন তার ভাইকে। শওকতের কথা যেন তার মনেই নেই। ভাগ্যিস মামা আসছিল। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শওকত। তারপর খেয়াল হয় এখনো হাত পা ধোয়া হয়নি তার। হাসিমুখে কলঘরের দিকে এগোয়। জানে আজ ওকে কেউ কিছু বলবেনা। আনন্দে একটু শিস ও দিয়ে ফেলে।

দুই.
ওদের কাচাপাকা বাড়ীটাতে আজ বেশ একটা খুশীর রেশ। হাতমুখ ধুয়ে মামার পাশে এসে বসে শওকত। মামা গ্রাম থেকে আম এনেছেন। সেই আম কাটা হয়েছে। পাটীতে বারান্দায় জাকিয়ে বসেছেন মামা। পাশে শওকতরা তিন ভাই বোন। কারেন্ট চলে গেছে। পাটির একপাশে হারিকেন জ্বলছে। বড় ভাল লাগে শওকতের।
-ইয়াকুব কই রে রাহেলা?
রান্নাঘরের দিকে হাক দেন মামা। শওকতের বাবা ইয়াকুব।
-বাজারের দিকে গেছে মনে হয় মিঞা ভাই। শওকতরে পাঠান, ডাইকা আনুক।
-যা তো খোকা, এক দৌড়ে যাবি আর আবি। আমার কতা কইস।

শওকতের বড় ভাল লাগে। রাতে বাজারে যেতে বেশ লাগে তার। বাবাকে ডেকে আনতে রওনা হয় সে। রূপনগর প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক ইয়াকুব সাহেব। স্কুলে শিক্ষক আছেই দুইজন। হেডমাস্টার দিলীপবাবু আর ইয়াকুব সাহেব।

কোণার দিকের চার দোকানটাতে বসে চা খাচ্ছিলেন দিলীপবাবু। পাশে ইয়াকুব সাহেব বসা। দূর থেকে বাবার হাতের সিগারেটটা দেখে শওকত। বাবা মাঝে মাঝে সিগারেট খান সেটা সে জানে। অবশ্য সে সামনে গেলেই বাবা কায়দা করে সিগারেটটা ফেলে দেবেন। বাবার জন্য মায়াই লাগে তার। আহা এত আরাম করে সিগারেটটা খাচ্ছে। খাক না। শেষ হলে তারপর যাবে সে। তাড়াহুড়ার কিছু নাই। একটা দোকানের আড়ালে গিয়ে দাড়ায় সে।

শওকতের মামা এসেছে শুনে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন ইয়াকুব। “মেজে ভাই” কে বেশ মান্য করেন।
-চল তো শওকত। মুরগি নিয়ে যায় একটা। বাড়িতে আছে কিছু? তোর মা কিছু কইছে নিয়ে যেতে?
- মা খালি মুরগি নিয়ে যাইতে কইছে। আর গরম মসলা। সেমাই রান্না করবে।

মুরগী রান্না করা হয়েছে। সাথে গরম ভাত আর ভর্তা। আহ! কতদিন পর মজা করে খাওয়া সবাই মিলে। পাটিতে মামার চারদিকে বসেছে তিন ভাই বোন। বাবা শওকতের পাশে। খাবার তুলে দিচ্ছেন রাহেলা সবার প্লেটে। শওকত এর খুশি আর ধরেনা আজ।

মা যদি সুস্থ থাকত,তবে তাদের মত সুখী সংসার কি আর একটাও আছে?


তিন.
শওকতের প্লেটে মাংস তুলে দিতে গিয়ে কি যেন হল রাহেলা বেগমের।
-শওকত।
-জ্বি মা!
-এদিকে আয় তো! উঠে আয়।
শওকত ভয়ে ভয়ে উঠে দাড়াল।
-আজ দেরী করে বাসায় এসেছিলি কেন হারামজাদা? হঠাৎ পাগলের মত চিৎকার করে ওঠেন রাহেলা। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাতের তরকারীর চামচ দিয়ে বাড়ি দিয়ে বসেন শওকতের কপালে। দরদর করে বেরিয়ে আসে রক্ত। হিস্টিরিয়া রোগীর মত করতে থাকেন রাহেলা। মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে। তাকে সামলাতেই তখন ব্যস্ত সবাই। শওকতের দিকে কারো খেয়াল নেই।

মায়ের এসব ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। আহা,মায়ের কি বিচিত্র এক অসুখ!

ঝোলমাখা হাতে বারান্দায় বেরিয়ে আসে শওকত। জ্যোৎস্না রাত। স্নিগ্ধ নরম আলো চারিদিকে। চাদের দিকে তাকিয়ে অজানা কারো প্রতি তীব্র এক অভিমান দানা বেধে ওঠে। তবে কেন জানি আজ দু চোখ ভিজে ওঠে ওর। ব্যাথায় না, অভিমানে।

মায়েদের অসুখ না দিলে কি এমন ক্ষতি হত আল্লাহর?
মায়েরা থাকবে রোগমুক্ত-অমলিন চিরদিন।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১১:১৪
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখনো নদীপারে ঝড় বয়ে যায় || নতুন গান

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২০

এ গানের লিরিক আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ২০২৪-এ সুর ও গানের প্রথম কয়েক লাইন তৈরি হয়ে যায়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য একটা গান নিয়ে। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×