সেদিন এক দোকানে কেনাকাটা করছি। এমন সময় এক ভদ্রমহিলা একটা সয়াবিনের ক্যান হাতে তুলে সেলস ম্যানকে অধীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন,” এটা কি কোলেস্টেরল ফ্রি?” সেলস ম্যান অভ্যস্ত ভাবে উত্তর দিল- হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি পাশে থেকে বললাম,” আপা, সয়াবিনে কোলেস্টেরল থাকেনা” , আমার এই আশ্বাসবাণীতে ভদ্রমহিলা কান দিলেন বলে মনে হলনা। কান দেবার অবশ্য কোন কারন নেই, সর্বক্ষণ কানের কাছে ভোজ্য তেলের বিজ্ঞাপনে যেভাবে কোলেস্টেরল না থাকার মহিমা কীর্তন করা হয় তাতে সাধারণ মানুষের বিহ্বল হয়ে থাকারই কথা। বিজ্ঞাপনের দৌলতে কোলেস্টেরল হয়ে উঠেছে এক মিথ, এক দুর্বিনীত স্বাস্থ্য ভিলেন। তবে ভোজ্য তেলের কোম্পানিগুলো কী মিথ্যা বলে? না ঠিক মিথ্যা নয়, তবে এটাকে চালাকি বলা যায় অবশ্যই। বাঙ্গালীর কোলেস্টেরল ভীতিকে কাজে লাগিয়ে আরও একটু বেশী মুনাফা আদায়ের ফন্দি। আসুন, বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখা যাক।
কোলেস্টেরল একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যাবশ্যকীয় অরগানিক প্রাণীজ কেমিক্যাল যা প্রাণী কোষের কাঠিন্য তৈরি করে। এছাড়াও কোলেস্টেরল থেকে সেক্স হরমোন এবং ভিটামিন ডি তৈরি হয়। কোলেস্টেরল যেহেতু প্রাণী শরীরের একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান তাই এটা শরীরের মধ্যেই তৈরি হয়। শরীরের সব কোষই কম বেশী কোলেস্টেরল তৈরি করতে পারে, তবে সবচেয়ে বেশী কোলেস্টেরল তৈরি হয় যকৃতে। খাদ্যের মাধ্যমেও শরিরে কোলেস্টেরল আসতে পারে। তবে খাদ্যের কোলেস্টেরল এস্টারিফাইড অবস্থায় থাকে; এই অবস্থায় থাকলে শরীরে কোলেস্টেরল শোষিত হতে পারেনা। তবে খাদ্য থেকে কোলেস্টেরল দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণে শোষিত হলে শরীরের আভ্যন্তরীণ কোলেস্টেরল সংশ্লেষণ বন্ধ বা স্তিমিত হয়ে যায়। তার মানে খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমান বাড়ানো খুব কঠিন।
শরীরে তিন ধরনের কোলেস্টেরল থাকে, সল্প ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল, উচ্চ ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল এবং আদার লিপিডস যার মধ্যে থাকে ট্রাইগ্লিসারাইড। এই তিন ধরনের কোলেস্টেরলের মিলিত পরিমাণকে বলা হয় টোটাল কোলেস্টেরল। এই তিন ধরনের কোলেস্টেরলের মধ্যে উচ্চ ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল যত বেশী থাকে তত ভালো কারন এটার উচ্চ মাত্রা হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। সল্প ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল যত কম থাকে তত ভালো এর উচ্চ মাত্রা হৃদপিণ্ডের এবং মস্তিস্কের রক্তনালীতে চর্বি জমে রক্তনালী বন্ধ করে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক এর মতো প্রাণঘাতী রোগ তৈরি করে। ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা হৃদ রোগের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়।
এবার আসুন দেখি খাদ্যের কোলেস্টেরল কোথায় থেকে আসে? কোলেস্টেরল একমাত্র থাকে প্রাণী শরীরে। উদ্ভিদের শরীরে কোলেস্টেরল থাকেনা। তাই উদ্ভিদজাত তেলে কোলেস্টেরল থাকার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। উদ্ভিদে ফাইটোস্টেরল বলে কোলেস্টেরল এর মতো গঠনের এক কেমিক্যাল থাকে যা আদতে মানব শরীরে কোলেস্টেরলের শোষণকে বাধা দেয়। তাই সয়াবিন তেলকে কোলেস্টেরল মুক্ত দাবী করা আর মিনারাল ওয়াটারকে এলকোহল মুক্ত বলা একই কথা। তবে, সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্ভিতজাত তেলে খুব অল্প পরিমাণে কোলেস্টেরল থাকতে পারে। এর পরিমান প্রতি কে জি তেলে সর্বোচ্চ ৫৫ মি গ্রা পর্যন্ত, যদি কেউ দিনে এক কে জি তেল খায় তারপরেও তা মানুষের দৈনিক চাহিদার বিশ ভাগের এক ভাগ।
এই কর্পোরেট দুর্বৃত্তরা অনাবশ্যক তথ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ কে বিভ্রান্ত করছে আর বিজ্ঞাপনের তোড়ে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য তথ্যকে টুইস্ট করে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখছে।
তবে শরীরে কোলেস্টেরলের প্রবেশ যদি এত কড়াকড়ি ভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয় আর খাদ্যের কোলেস্টেরলের যদি তেমন কোন ভুমিকাই না থাকে তবে আমরা কোলেস্টেরল নিয়ে এত চিন্তিত কেন? কারণ কোন এক পর্যায়ে শরীরের ভিতরে কোলেস্টেরল তৈরির কারখানা যকৃতে অনাবশ্যক এবং অতিরিক্ত কোলেস্টেরল তৈরি হতে থাকে এবং ভালো কোলেস্টেরল উচ্চ ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিনের পরিমান কমে যায়; ফলে হৃদপিণ্ড আর মস্তিস্কের রক্তনালীতে চর্বি জমতে থাকে। এই চর্বি জমা বন্ধ করার জন্য কোলেস্টেরল কমানোর চিকিৎসা দিতে হয়।
কেউ যদি উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরলের চিকিৎসা না করে সেই তথাকথিত “কোলেস্টেরল ফ্রি” তেল খেয়ে নিরাপদে আছে মনে করে তাহলে মহা বিপদ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


